রেস্তোরাঁয় বসে বিশ-পঁচিশ হাজার টাকার বিল মিটিয়ে ছবি তোলার আরামে নাগরিক সমাজের চোখ বুজে এসেছিল কোভিড পরিস্থিতিতে। সে সময় দিল্লিতে এক রিকশাওলার তিন সন্তান খিদের জ্বালায় ঘাস খেয়ে মারা গেল– এই ঘটনার উল্লেখ আমার না হোক ১০-১২টি লেখায় আছে। একটাই কারণ, কোন দেশে খাবারের ছবি পোস্ট করি, সেটা মাথায় থাকা দরকার। কোথায়, কাদের মাঝে, রাজস্থানি রাজা-উজিরদের ‘থালি’ নামক কুৎসিত স্প্রেড নিয়ে এত মাতামাতি হয় না জানলে সিন্ধিয়া ইত্যাদি নরপশুরা কীভাবে ইংরেজদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে ভুখা মানুষদের পরিকল্পিত হত্যা থেকে জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে ইংরেজদের পা চেটেছিল, বা এখনও বিভাজনের রাজনীতিকে তোল্লাই দিয়ে চলেছে, তা সম্যক বোঝা যাবে না।
১.
চারপাশে না-খেতে পাওয়া মানুষের সংখ্যা বাড়ছে লাফিয়ে এবং একইসঙ্গে খাবার নিয়ে আদেখলাপনা বৃদ্ধি পাচ্ছে পাল্লা দিয়ে। রেস্তোরাঁ, পার্ক, রেলস্টেশন, বিয়েবাড়ি, শ্রাদ্ধ, জামাইষষ্ঠী, চলন্ত বাস– কোথাও বাদ নেই! মানুষ কেবল গেলার ছবি এবং ভিডিও তুলতে ব্যস্ত, তাই নয়, সেসব তদ্দণ্ড সোশ্যাল মিডিয়ায় আপলোড করতে এমনি হুড়োহুড়ি যে খাবার ঠান্ডা হয়ে বেলা গড়িয়ে একাকার কাণ্ড। পাশাপাশি কে কতবড় রাঁধুনি, তা প্রমাণের প্রতিযোগিতায় নেমে পড়েছে সবাই। আগে যেমন পুরুষদের রাঁধতে না-জানার খোকাপনা রং চড়িয়ে প্রচার হত, ইদানীং কেতা হচ্ছে সকলেই মা-ঠাকুমার পাশে বসে ফোড়ন দিতে শিখেছিল– বলে বেড়ানো। ‘অথেন্টিক বরিশাল’ অথবা ‘অরিজিনাল নোয়াখালি’ প্রভৃতি রান্নার ঠেলায় যে কারণে প্রাণান্তকর অবস্থা। একমাত্র নয়ের দশকের পরে জন্মানো স্লাইটলি অশিক্ষিত বাঙালির পক্ষেই রান্নার ‘অজ্জিনালিটি’ নিয়ে বুক ফোলানো সাজে– এবং সেটা কিছু ‘হঠাৎ বড়লোকের’ রেস্তোরাঁবাজি মারফত অর্জিত।
বাঙালির রান্নার সবচেয়ে বড় গুণ ছিল বিভিন্ন দেশের স্বাদ, গন্ধ, মশলা, রন্ধনপদ্ধতিকে মিলিয়ে মিশিয়ে নেওয়ার ক্ষমতা। কারণ, বাঙালি ঘর ছেড়ে বেরিয়েছে, মিশেছে পৃথিবীর সমস্ত জাতির সঙ্গে প্রাণ খুলে এবং যেটুকু অর্জন, তার সবটাকেই জীবনে ঠাঁই দিয়েছে ছুঁতমার্গ বর্জন বাবদ– এবং তাও প্রতি ৫০-১০০ কিলোমিটার পেরলে আঞ্চলিক ভাষার মতোই বদলে যেত অন্য একটি অপূর্ব পদে। বাঙালদের রান্না নিয়ে এই যে এত মাতামাতি, তার কারণ শেয়ালদা স্টেশন, উদ্বাস্তু কলোনি, লাইনপারের বস্তিতে প্লাস্টিক, ত্রিপলের আচ্ছাদনের তলায় হাতের নাগালে যা পেলাম তাই দিয়ে বহু মানুষকে অন্তত একবেলা খাওয়ানোর ইন্তেজামটি তিনদিন অভুক্ত থাকার পর অমৃত মনে হয়েছিল– বিভিন্ন জেলার মানুষ এক জায়গায় গুঁতোগুঁতির সময় ফের একবার রেসিপি শেয়ার করেছিল খানিকটা নিরুপায় হয়েই। অতঃপর, প্রায় তেল ছাড়া চুনো মৌরলা লাউপাতায় মুড়ে ভাজাপোড়া নিভু উনুনের আঁচে বসিয়ে চচ্চড়ি রান্নার তরিকাটির সঙ্গে পঞ্চাশ তেল কেনার সামর্থ, টালির চালে লাউডগা লতিয়ে ওঠা এবং আঁচের শেষটুকুতে ‘যেটুকু যা হয়’ জড়িত, অন্য কোনও ‘ঐতিহ্য’ নয়।
গেঁড়ি-গুগলি বর্ধমানের সম্পন্ন গেরস্ত বাড়িতে যেভাবে খায়, বনগাঁ লাইন ধরে দু’পাশের বস্তির মানুষ সেভাবে খায় না, তার কারণ তেল-মশলা কেনার পয়সা যবে হয়েছে, তদ্দিনে রেলের পুকুরে তালপাতা ফেলে গেঁড়ি ধরার অভ্যেস ঘুচেছে। অতএব, ‘এগ্জটিক খাবার’ বলতে একালের বাবু-বিবিরা যেমন আনন্দাশ্রু বিসর্জন করেন, তেমনটা চালিয়ে যেতেই পারেন– শুধু খেয়াল রাখবেন, ওপার থেকে ভিটেমাটি ছেড়ে ‘প্রাণটুকু সম্বল’ করে এপারে আসা আপনাদের আগের জেনারেশনের কেউ যেন সেসব নাটক দেখে না ফেলে, নয়তো কপালে দুঃখ আছে।
আর্থিক অবস্থা বদলানোর পর বিশ-তিরিশ বছর আগেকার এক দ্বিপ্রাহরিক ‘ভোজের’ স্মৃতি স্বাদের বোধ এবং অভুক্ত থাকার কষ্ট নিয়ে কেমন ছিনিমিনি খেলে, তা প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা ছাড়া বোঝা যায় না। একেবারে নিরুপায় অবস্থায় ফেঁসে হেঁশেলে দানা খুঁজে ফেরা মহিলারা যতটুকু পারতেন খানিকটা অদলবদল সহকারে ফেলে দেওয়া, বাতিল মাল বহু মানুষের জন্য প্যালেটেবল করে বেড়ে দিতেন– বড় কম কথা নয় সেটা। কোনও বাড়িতে কচুর লতি এসেছে, মাছের মাথা কেনার সামর্থ নেই– অতএব লাগাও আধমালা নারকেল আর খানিকটা ওবেলার ছোলাসেদ্ধ। বা তাও না থাকলে রাঁধুনি ফোড়ন দিয়ে অপূর্ব চচ্চড়ি। প্রতি সন্ধ্যায় যে রান্নাগুলো বদলে যাচ্ছে, তা কোনও রাজার হেঁশেল বা নবাবি খানসামার ঐতিহ্য সংবলিত গল্পের লেজুড় না হলেও ‘অরিজিনালিটি’ নেই বলা যাবে না– তবে সেটি ক্ষণস্থায়ী, এবং পরদিন রাতে বাড়ি ফেরা বাবুটির সেদিনকার রোজগার এবং স্টেশন সংলগ্ন সান্ধ্য-বাজারের উদ্বৃত্ত, বা বিয়ে, অন্নপ্রাশন, নিয়মভঙ্গ ইত্যাদি অনুষ্ঠান বাড়ির জন্য কাটা মাছের তেল, ডিম, মাথা সস্তায় পাওয়া না-পাওয়ার ওপর নির্ভরশীল।
জমি দখল করা বাড়ির ছেলে জমি থেকে উচ্ছেদ করতে শিখে এখন বড় চিংড়ি বা ইলিশের মাথা ছাড়া কচুর লতি খায় না। সাতের দশক অবধি, বা তার পরেও যারা পড়াশোনা চালিয়ে নিজেদের পায়ে দাঁড়ানোর চেষ্টা করেছে, তাদের বাড়ির সাধারণ খাদ্যাভ্যাস, যা ক্রমে বাঙালদের ঐতিহ্য হয়ে উঠেছিল, গুটখা খেয়ে দেওয়ালে পিক ফেলা, আঙুলে দশ-বারোটা গ্রহরত্ন ধারণ, বিকেলে মাঠে খেলতে যাওয়ার বদলে রাস্তার পাশে গুলতানি মারায় অভ্যস্ত হয়ে ওঠার সঙ্গে হাওয়ায় মিলিয়েছে। আড্ডা বাঙালরা মারে না তা নয়, তবে ‘রকে’ বসে বাখোয়াজি সেরে বেলা তিনটেয় বাড়ি ফিরলে ‘বড় বউদি’ টাইপের কেউ ভাত বেড়ে বসে থাকবে, সেরকম মহিলা আর অন্নের জোগান উদ্বাস্তু পরিবারগুলো গোড়ার দিকে বেশ কিছুকাল গুছিয়ে উঠতে পারেনি। দুটো আলাদা জগতের জীবনযাপনের, সকাল থেকে রাত অবধি একে-অপরের টুঁটি টিপে ধরার লড়াইয়ে হার-জিতের খুঁটিনাটি খাদ্যাভ্যাসের সমীকরণগুলিকে সাজিয়ে নিচ্ছিল বেশ সহজেই। পাশাপাশি এটাও মাথায় রাখা দরকার যে বেশিরভাগ মানুষের বাড়িতে, যাদের হাঁড়ি ছিল বা আছে– এবং যাদের হাঁড়িতে রান্নার অভ্যাস এবং হাঁড়ি থেকে খাবার বেড়ে দেওয়ার আদত বহুকালের– তাদের বাসায় রোজ হাঁড়ি চড়ত না, যেমন এখনও চড়ে না এবং তাদের ‘ঐতিহ্য’ শাক সেদ্ধ।
মাঝেমধ্যে বিল ছেঁচে, আবর্জনা ঘেঁটে, অথবা জাকাতের খয়রাতি বাবদ বছরে এক আধবার যা পেল, তা দিয়ে যেমুছেমু রান্না হয়, কারণ সবসময় একই তেল, মশলা, বা কেরোসিন, কয়লা, গুল, ঘুঁটে জোটানো ছিল অসম্ভব ব্যাপার– জ্বালানি এখনও ক্রমশই বেশি দাম দিয়ে কিনতে হচ্ছে রোজ। অতএব ঐতিহ্যর উল্লেখ যদি একান্তই করতে হয়, তবে তা হাতের কাছে যা পেলাম তাই দিয়ে রেঁধে ফেলার মানসিকতাটিকে সকাল-বিকেল সমস্ত প্রতিবন্ধকতা সত্ত্বেও চাঙ্গা রাখার ঐতিহ্য– ছেড়ে দেব না, কিছুতেই মরব না শেষ না দেখে ইত্যাদি লড়াইবাজদের ঐতিহ্য। জমিদার বাড়ির রান্না, উত্তর থেকে দক্ষিণ মোটামুটি এক– খাস কলকাতায় খানিকটা আলাদা রকম জলখাবার, মদের আসরে বেড়ে দেওয়া টুকিটাকির ব্যবস্থা তিনের দশক থেকে বদলাতে থাকে, তবে সেটা অন্য গল্প। উল্টোদিকে, না-খেতে দেওয়ার ইতিহাসটিও নিরবচ্ছিন্ন, একটানা চলছে– এক্ষেত্রে যাদের হাঁড়ি-কুড়ির ঝুটঝামেলা নেই, যারা পুড়িয়ে, সেঁকে, মাটির পাত্রে আধসেদ্ধ, আধকাঁচা পেলেই সন্তুষ্ট, তাদের কথাও মাথায় রাখতে হবে। তারা বরাবর এই শহরে ছিল এবং থাকবে খুব বড় ধরনের রাজনৈতিক পালাবদল না হলে।
রেস্তোরাঁয় বসে বিশ-পঁচিশ হাজার টাকার বিল মিটিয়ে ছবি তোলার আরামে নাগরিক সমাজের চোখ বুজে এসেছিল কোভিড পরিস্থিতিতে। সে সময় দিল্লিতে এক রিকশাওলার তিন সন্তান খিদের জ্বালায় ঘাস খেয়ে মারা গেল– এই ঘটনার উল্লেখ আমার না হোক ১০-১২টি লেখায় আছে। একটাই কারণ, কোন দেশে খাবারের ছবি পোস্ট করি, সেটা মাথায় থাকা দরকার। কোথায়, কাদের মাঝে, রাজস্থানি রাজা-উজিরদের ‘থালি’ নামক কুৎসিত স্প্রেড নিয়ে এত মাতামাতি হয় না-জানলে সিন্ধিয়া ইত্যাদি নরপশুরা কীভাবে ইংরেজদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে ভুখা মানুষদের পরিকল্পিত হত্যা থেকে জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে ইংরেজদের পা চেটেছিল, বা এখনও বিভাজনের রাজনীতিকে তোল্লাই দিয়ে চলেছে, তা সম্যক বোঝা যাবে না। সমগ্র মধ্যভারত, পশ্চিমে রাজস্থান, গুজরাতে আর এদিকে বিহার, ওড়িশা এবং বাংলায় পরিকল্পিত উপায়ে মানুষকে না-খেতে দিয়ে মারা হয়েছে– মানুষকে সবসময়ই ভেবেচিন্তে না-খেতে দিয়ে মারা হয়, সবসময় এবং যখন মারা হচ্ছে, তখন ওইসব ‘থালি’ বয়ে আনা হত দরবারে উপবিষ্ট মান্যগণ্যদের উদরপূর্তির জন্য। ছপ্পনভোগ ইত্যাদির উচ্ছিষ্ট চেটে যেকালে পুরুত, সেবায়েতদের গা বেয়ে ঘি গড়িয়ে পড়ছে, মন্দিরের বাইরে সাধারণ মানুষ খিদের জ্বালায় মরছে পোকামাকড়ের মতো– ঠিক এই মুহূর্তে যেটা দেশের অবস্থা, সেটাই গত ৩০০ বছরের ইতিহাস!
ইংরেজরা আসার আগে দেশে মন্বন্তরের কোনও ইতিহাস নেই, সায়েবরা এই লোকগুলোর হাতে ক্ষমতা দিয়ে যাওয়ার পর ৮০ কোটি ভারতীয়র দু’বেলা পেট ভরে খেতে পাওয়ারও কোনও সম্ভাবনা নেই। তবে হ্যাঁ, আরব সাগরে দুধ ফেলে দেওয়া হয়, ডিম, মুরগি বুলডোজার চালিয়ে ‘নষ্ট’ করে ফেলা হয়, যাতে বাজারদর পড়ে না যায়। মুনাফা তৈরির খেলায় উদ্বৃত্ত মানুষ– না-খাইয়ে মেরে ফেলাটা কোল্যাটেরাল ড্যামেজ। সন্ত্রাসবাদীরা ২৬ জনকে মারে, এদেশের সরকার রোজ ৪০০০ শিশুকে অপুষ্টিজনিত কারণে গোর দেয়। পাকিস্তানিদের হাতে মরতে হল না– এটুকুই যা এদেশের গরিবের শান্তি, থুরি, সেই বামুনদের শান্তি– যারা হিন্দুরাষ্ট্র চাইছে।
সম্প্রতি একটি ছোট ইন্টারভিউতে দেখলাম প্রশ্নকর্তা এক মৌলানাকে জিজ্ঞেস করছেন ‘আপনার কাছে কোনটি বড়– দেশ না ধর্ম।’ এটি জামাই ঠকানো প্রশ্নের আধুনিকতম নমুনা, যা দিয়ে গোটা দেশকে টুপি পরানো হচ্ছে। যাই উত্তর দাও, মার তুমি খাবেই। তবে উত্তরটা হওয়া উচিত ‘হিন্দু সন্ত্রাসবাদীদের মিডিয়াই বড়, দেশ বা ধর্ম নয়।’ তারা একবারের তরেও জিগায় না দেশ-ধর্ম বড়, না খাদ্য-শিক্ষা-স্বাস্থ্য বড়। উত্তরপ্রদেশে যে লোকগুলোকে শিশু, বৃদ্ধ, আত্মীয়দের নিয়ে পথে বসতে হল, বুলডোজার চালিয়ে গত কয়েক মাসে প্রায় সাড়ে তিন লক্ষ মানুষের ঘর ভেঙে দিল, তাদের কেউ জিজ্ঞেস করে না– মাথার ওপর ছাদ চাই না ঈশ্বর? দুটো রুটি চাই, না মন্দির?
এদেশে খাদ্যের অধিকারের সঙ্গে এই সমস্তটাই জড়িত, এবং তা স্বাধীনতার পর নতুন রাষ্ট্র গঠনের সময় থেকেই একটি বড় আখ্যানের অংশ। উদ্বাস্তু বাঙাল আর এলাহাবাদের রাস্তায় সম্প্রতি যে পরিবারটি সদ্য উদ্বাস্তুদের খাতায় নাম লেখাল, তাদের গল্পটা একই রয়ে গেছে। না-খেতে পাওয়ার দিনলিপিও। সবাই নতুন বাঙাল।
বিশ্ব ক্রীড়াক্ষেত্র যে বাঁকে দাঁড়িয়ে, তাতে ভবিষ্যতের সাক্ষী মালিক, মনিকা বাত্রা, লক্ষ্য সেনদের বিকল্প পথের কথা ভাবতে শুরু করতে হবে। কমনওয়েলথ গেমসকে ভুলে অলিম্পিক, এশিয়াডের প্রস্তুতি হিসেবে পাখির চোখ করতে হবে নিজ খেলার আঞ্চলিক, মহাদেশীয় ও বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপগুলোকে।