সব শেষ করে শেষে তিনি চলে গেলেন। অভিমানী রাজপুত্রের মতো, সিংহাসন এড়িয়ে, অবসন্ন প্রতিভা নিয়ে। পারতেন তিনি নতুন বাদশা হতে। পারতেন পায়ের পিয়ানোয় পৃথিবীকে আরও একটু পাগল করে দিতে। পারতেন ইউরোপীয় ক্লাব ফুটবলের শৌর্যসৌধে লাতিন লাবণ্যের অগ্রদূত হতে। পারতেন এক-আধটা ব্যালন ডি’অর জিততে। পারতেন, কিন্তু করলেন না। কিংবা পারলেন না।
আসলে জাভির মন গলল না। বার্সেলোনা টাকা জোগাড় করতে পারল না। বোহলি তেমন গুরুত্ব দিলেন না। এনরিকে দরজা দেখিয়ে দিলেন। ইউরোপ তাঁকে নিয়ে অতশত ভাবল না। ইউরোপ নিয়ে তিনিও আর ভাবলেন না। সাত সমুদ্র পেরিয়ে তিনি চললেন আরব-বেদুইনের দেশে। যেমন ওদিকে এখন যাচ্ছে অনেকে। সৌদি শেখের পাশে বসে তিনি বলে উঠলেন, ‘আজ থেকে আমি হিলালি’, লোকে শুনল। শুনে তাক লেগে গেল! বিশ্বমত বিভাজিত হয়ে পড়ল মুহূর্তে। একদল বলল– অর্থপিশাচ। একত্রিশেও ‘নাদান লড়কা’। নিজের ভাল বোঝে না। মেসি নেই। সিআর নেই। তুই তো পারতি এবার গ্রহের সেরা ফুটবলার হতে। তা নয়, অযাচিত ফুটবল-গ্রহণ ডেকে আনলি! আর একদল আবার রোনাল্ডোর গুণকীর্তন করতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। বলল, ক্রিশ্চিয়ানো আর ফুটবলার নন, শাহেনশা বটে, ফুটবলের নতুন আরব্য রজনী লিখছেন যিনি। তাঁর আকর্ষণ উপেক্ষা করে, সাধ্যি কার? বেঞ্জেমা এসেছেন, মানে এসেছেন, তিনি এলেন। আসবে আরও, দলে দলে। পালে পালে। শুধু তাঁর মনের খোঁজ কেউ নিল না। শেখের পাশে বসে তাঁর হাসিমুখ দেখল মাত্র, হাসির ছায়ায় বিষণ্ণতা দেখেও দেখল না।
‘নেই’ আর ইউরোপে নেই। কিন্তু নেমার ইউরোপ ছাড়তে চেয়েছিলেন কি?
পিএসজি ছেড়ে আল-হিলাল যাওয়ার দিন ব্রাজিলের এক বিখ্যাত স্পোর্টস ওয়েবসাইট দেখলাম শিরোনাম করেছে, ‘অ্যান ইটার্নাল স্টেইন অন হিজ কেরিয়ার’। তরজমা সহজবোধ্য। এ এক এমন কলঙ্ক-দাগ, যা অবিনশ্বর। শত ধুয়ে-মুছেও যাবে না। আবার দেখলাম, ব্রাজিলের এক নামজাদা সাংবাদিক আন্দ্রাদে বলেছেন, নেমারের মতো এক জিনিয়াসের জীবন-শর্তই হল, দেশ-বিদেশের ট্রফি জেতা। ট্রফি-ট্রফিতে তাক ভরিয়ে ফেলা। ইউরোপীয় ফুটবলের সর্বোচ্চ পুরস্কার একাধিকবার জেতা। তবে না তিনি জিনিয়াস– ফুটবলারদের ফুটবলার! কিন্তু নেমার যা করলেন, একত্রিশে আরব যাত্রার যে কু-সিদ্ধান্ত নিলেন, তাতে আর এ সমস্ত তাঁর ইহজীবনে ঘটবে কি না সন্দেহ! হয়তো ঘটবে। হয়তো ঘটবে না। হয়তো আন্দ্রাদে ঠিক। হয়তো আন্দ্রাদে ভুল। কিন্তু উপেক্ষা ছাড়া কি অবহেলা আসে? অর্ধচন্দ্র না দিলে কি তারা কখনও কক্ষচ্যুত হয়?
দোষ নেমারের আছে। অবশ্যই আছে। ২০১৭ সালে রাগের মাথায় তাঁর বার্সেলোনা ছাড়া উচিত হয়নি। পিএসজি যাওয়া ঠিক হয়নি। লিওনেল মেসির এত বন্ধু তিনি। মিত্রর থেকে তিনি এটুকু শিখলেন না যে, জীবন জিনিয়াসকেও সহজে কিছু দেয় না। দেব-প্রতিভাকেও অক্লান্ত সাধনা করে যেতে হয়, ইষ্টদেবতার কাছে ভিক্ষুকের মতো প্রার্থনা করতে হয় মোক্ষলাভের। যে মেসি বিশ্বজয়ের পর আর্জেন্টিনার ‘হৃদয়’, সেই মেসিকেই এককালে শুনতে হয়েছিল, ‘তুমি দেশদ্রোহী। দেশে জার্সিতে তুমি সেরাটা দাও না, দাও ক্লাবে।’ বলেছিল, আর্জেন্টিনাই। তাহলে? এর পাশে মেসির মতো এক রাজ-প্রতিভার পার্শ্বনায়ক হয়ে থাকা কতটুকু অসম্মানের? কতটা মাথায় বাজ পড়ার মতো? বদলে প্যারিসের বন গাঁয়ে ‘শেয়াল রাজা’ হয়ে লাভ কী হল? ছ’টা বছর চলে গেল, ধূসর হল ফুটবল-যৌবন, দোসর হল চোট। ১৭৩ ম্যাচে ১১৮ গোল করতে তো যাননি তিনি, যাননি লিগ ওয়ান নামের এক ‘বালখিল্য’ লিগ জিততে, ফুটবল সমর্থকরা যাকে দুয়ো দেয় ‘ফার্মার্স লিগ’ বলে। গিয়েছিলেন একচ্ছত্র মহানায়ক হতে, একক দক্ষতায় চ্যাম্পিয়ন্স লিগ জিততে। কিন্তু সেসব নিষ্ফলা প্রচেষ্টায় উল্টে তিনি আরও একা হয়ে গেলেন। বিশ্ব ফুটবল বিমুখ, বিশ্ব মিডিয়া বিমুখ। বার্সেলোনায় থেকে গেলে আরও চ্যাম্পিয়ন্স লিগ জিততেন কি না, মেসিকে ছাড়িয়ে মহানায়ক হতেন কি না– জানা নেই। তবে এত চোট লাগত না। প্রতিপক্ষ মেসির পায়েই বেশি মন দিত, আর তিনি নেমার, অতিরিক্ত বল হোল্ড করার দুর্বলতা নিয়েও বেঁচে যেতেন, গোল বেশি করতে পারতেন। পিএসজিতে যা হয়নি। নেমার যখন পিএসজি যান, এমবাপে ভোরের ফুল সবে এবং ব্রাজিলীয়ই একমাত্র মহানায়ক। আর কে না জানে, মহানায়ক হওয়ার জ্বালা অনেক। ফুটবলে তার গ্ল্যামারের ঋণ প্লেয়ারের পা’কে চুকোতে হয়!
তবু, সব দোষ নেমারের নয়। ফুটবলও যথেষ্ট অবিচার করেছে তাঁর সঙ্গে, নির্মম হয়েছে। ফুটবল বিশ্বকাপ বরাবর তাঁর ‘জুনিগা’-র মতো আচরণ করেছে, সুযোগ পেলেই গুঁড়িয়ে দিয়েছে তাঁর প্রত্যাশার কোমর! ২০১৮ বিশ্বকাপের আগে চোট লাগল। নেমার পারলেন না। ২০২২ কাতারে শুরুতে ফের লাগল, কোনও রকমে ফিরলেন, ক্রোয়েশিয়ার সঙ্গে দুর্ধর্ষ একটা গোল করলেন, তবু শেষে ব্রাজিলকে বাঁচাতে পারলেন না। আর ২০১৪ তো বাদই দিলাম। যে চোট পেয়েছিলেন, নেমারের ফুটবল কেরিয়ারই তারপর শেষ হয়ে যেতে পারত। এর সঙ্গে দ্রুত জুড়ে নিন ব্রাজিল নামক ফুটবলের এক মায়া-সভ্যতার সুগভীর নিম্নচাপ। যার সোনার ইতিহাসের উত্তরাধিকার বহন করতে হয়েছে নেমারকে, অহর্নিশি তুলনা সহ্য করতে হয়েছে রোনাল্ডো-রোনাল্ডিনহো-কাকার সঙ্গে, যেখানে সাফল্যের এক এবং একমাত্র মানদণ্ড বিশ্বকাপ। পারলে তুমি নিখাদ ব্রাজিলিয়ান, নইলে ফালতু ভুঁইফোঁড়। সহজ ছিল না, নেমারের কাজ সহজ ছিল না। ঠিক যতটা অসহনীয় ছিল, বার্সেলোনার ইতিহাসে সম্ভবত চিরশ্রেষ্ঠ প্রত্যাবর্তনের (বার্সা বনাম পিএসজি, চ্যাম্পিয়ন্স লিগ, ২০১৭) কারিগর হয়েও তাঁরই লাতিন বন্ধুর প্রচারের সবটুকু শুষে নিয়ে চলে যেতে দেখাটা। তাই বার্সা ছেড়ে তাঁর অভিমানে চলে যাওয়া। সেই অনন্ত অভিমানেই এখন ইউরোপ ছেড়ে দেওয়া। যেখানে অনুঘটকের কাজ করেছে তিন নাম। নতুন পিএসজি কোচ লুই এনরিকে। নেমারের পুরনো কোচ নতুন টিমে চাননি পুরনো ছাত্রকে। চেলসি মালিক টড বোহলি প্রথম প্রথম আগ্রহ দেখালেও পরে কোনও অজানা কারণে আর দেখাননি (কে জানে সেখানেও নেমারের আর এক পুরনো কোচ পোচেত্তিনোর ভূমিকা কতটা)। আর বার্সা? শত চেষ্টাতেও তারা অর্থ জোটাতে পারেনি। পিএসজি চায়নি নামমাত্র মূল্যে তাদের চ্যাম্পিয়ন্স লিগ প্রতিপক্ষের হাতে নেমার তুলে দিতে। সঙ্গে যথেষ্ট ব্যাগড়া দিয়েছেন বার্সা কোচ জাভি (ইনি আবার নেমারের পুরনো সতীর্থ)। পরিষ্কার বলেছেন, তাঁর ড্রেসিংরুমের ‘সোনার’ আবহ নষ্ট করে দেবেন নেমার! দেখতে গেলে, নেমারের ‘পুরনো’রাই নেমারকে ‘পুরনো’ করে দিয়েছেন, বাতিলের দলে ফেলে।
আর কত অপমান নেবে এরপর শরীর-মন? সব ছেড়েছুড়ে সে পা বাড়াবে না সৌদি লিগ নামের এক নতুন ‘এল ডোরাডো’-র দিকে? যারা জামাই আদর করে মাথায় তুলে রাখতে চায়? দুটো রাস্তা এখন নেমারের সামনে। পরের বিশ্বকাপে মেসির মতো প্রতিভার শেষ শিখায় দাবানল বাঁধিয়ে দেওয়া, নিভে যাওয়ার আগে প্রদীপ শেষ বার দপ করে জ্বলে ওঠে যেমন। দ্বিতীয় পথ, রোনাল্ডোর পথ। বিশ্বকাপ না জিতেও এমন কিছু করা, যা বিশ্ব-দরবারে অমরত্ব পায়। যে লিগে গিয়েছেন নেমার, তার পূর্ণ বিকাশের প্রতিভূ হতে পারেন পরবর্তীতে, রোনাল্ডো-উত্তর সময়ে, সৌদি লিগের আরও উত্তরণ ঘটিয়ে। যাতে আজ থেকে শত বছর পরেও তাঁর নাম শুনলে অপার শ্রদ্ধায় লোকের মাথা ঝুঁকে পড়ে।
কিছু করার নেই নেমার, কিছু করার নেই। ক্ষণজন্মা আপনি। আর তাই বিদায়টাও যে ক্ষণজন্মার মতোই নিতে হবে!