একটা অসম্পূর্ণ পরিকল্পনা দিয়ে দামোদরকে শাসন করা হচ্ছে। তার থেকেই বড় কথা– দামোদর অববাহিকা আর টেনেসি নদী অববাহিকার মধ্যে চরিত্রের আকাশ-পাতাল পার্থক্য। এমন একটা নদী পরিকল্পনা দামোদরের জন্য ‘সুইটেবল’ ছিল না, প্রথম থেকেই। রাজ্য সেচ দফতরের সরকারি রিপোর্টই বলছে দামোদরের উপরে বাঁধ নির্মাণের পর বন্যার প্রকোপ বেড়েছে অনেক। ২০০০ সালে প্রকাশিত ‘ওয়ার্ল্ড কমিশন অন ড্যামস’-এর রিপোর্ট বলছে বড় বাঁধের আয়ু মেরে কেটে কম বেশি ৪০ বছর।
প্রচ্ছদ শিল্পী: সোমোশ্রী দাস
‘দাম’ উদরে রয়েছে তার। তাই তিনি দামোদর। কিংবা বলা হয়, মুন্ডা জনজাতির জলের ধারা এই নদী। দামোদর নদ সেই জন্য তার নাম। জনজীবন ও ভূগোলের সঙ্গে মিশে থাকা নদীর ধারা আজ রাজনীতির অংশ। কেন্দ্র আর রাজ্যে তা নিয়ে দড়ি টানাটানি।
দামোদরের সঙ্গে জুড়ে দেওয়া হয়েছে একটা শব্দ। কারা জুড়লেন? ঔপনিবেশিক ভাবধারার মানুষরা। কী বললেন তারা? দামোদর ‘বাংলার দুঃখের নদী’। আমরা কি আদৌ কোনও দিন ভেবে দেখেছি, দামোদর সত্যি দুঃখের নদী কি না?
দামোদরে বন্যা আসবে প্রতি বছর, একথা দামোদরের অববাহিকার মানুষ যেমন জানত, তেমনই জানত দামোদর নদ নিজেও। নদী পাড়ে ঘুরে বেড়াই নদীর উপকথা। রূপকথা ছেলে ভোলানো গল্প হলেও, উপকথা আসলে আমাদের কাহিনি। যেখানে কিংবদন্তির সঙ্গে মিশে থাকে ইতিহাস। প্রেমিক দামোদর তার প্রেমিকা কংসাবতীকে পাওয়ার জন্য নিজেকে ‘জলের ধারা’ বা নদীতে পরিণত করল। কম জলের নদী হলে তো কংসাবতীকে পাওয়া যাবে না! তাহলে উপায়? আকাশের মেঘের কাছে দামোদর চাইল শ্রাবণের ধারা। শ্রাবণের ধারা পেয়ে পুষ্ট হল দামোদর নদ। তারপর প্রবল বেগে গিয়ে দামোদর আলিঙ্গন করল কংসাবতীকে। এই উপকথার ইন্টারপ্রিটেশনে যা ধরা পড়ে তা হল, বর্ষায় বৃষ্টির ধারাতে দামোদর উত্তাল হবে। এই কথা যুগ যুগ ধরে মানুষ জানত।
আমাদের পিতৃপুরুষরা বন্যার জলকে ধরে রেখে সেচের কাজে ব্যবহার করার পদ্ধতি জানতেন। যাকে সেচবিজ্ঞানী উইলিয়াম উইলকক্স বলেছিলেন, ‘প্লাবন সেচ’ বা ‘ওভার ফ্লো ইরিগেশন’। শুধু তাই নয়, বন্যা আসার আগে আগাম প্রস্তুতি নিত গ্রামের মানুষেরা। নদীকে তাঁরা পুজো করে আমন্ত্রণ জানাত বন্যাকে।
নদী শাসনের পরম্পরাকে আমরা যেদিন থেকে নিজের করে নিলাম, সেই দিন থেকে শুরু হল নদীর বন্যাকে দুঃখ হিসেবে দেখা। ছোট ছোট বন্যা নদীর জীবনে খুব প্রয়োজনীয় একটা বিষয়। চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের সময় থেকে নির্মাণ করা রায়তী বাঁধ, নদীর মৃত্যুকে সবার আগে ডেকে আনল।
বিনা অর্থ ব্যয় করে বন্যার থেকে শক্তিশালী প্রাকৃতিকভাবে ড্রেজিং করার উপায় আর কিছু নেই। ছোট ছোট বন্যা আসলে নদীর জীবনে বড় বন্যাকে নিয়ন্ত্রণ করত। চারের দশকে দাঁড়িয়ে বাঙালি প্রকৌশলী সতীশচন্দ্র মজুমদার সে কথা বুঝেছিলেন। দুঃখের বিষয় হল স্বাধীনতার পরে দেশনায়কেরা তাঁর কথায় পাত্তা দেননি।
এদিকে প্রথম বিশ্বের সমৃদ্ধির ব্যবসায়ীরা একটা পথ খুঁজছিল। তাঁরা দেখলেন বহুমুখী নদী পরিকল্পনার মতো একটা রাসভারী বিষয় জুড়ে দিতে পারলে, সারা পৃথিবী জুড়ে জলসম্পদ নিয়ে একটা ভালো ব্যবসার পরিমণ্ডল গড়ে উঠবে। যেখান থেকে চক্রবৃদ্ধি হারে মুনাফা আসবে দীর্ঘ সময় ধরে। আমেরিকার টেনেসি ভ্যালিকে সামনে রেখে বড় বাঁধের রমরমিয়ে প্রচার শুরু হল। তুলনায় নমনীয় টার্গেট ছিল ভারতের মতো তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলো। একদিকে জল আটকে বড় বাঁধ, টারবাইনকে জলের ভেতরে ঘুরিয়ে জলবিদ্যুৎ, জলকে খালের মধ্যে বয়ে নিয়ে গিয়ে সেচ সেবিত অঞ্চল করা, বন্যাকে নিয়ন্ত্রণ করার মতো ক্ষমতা, ওদিক থেকে উঁকি মারা সবুজ বিপ্লবের হাতছানি সব মিলিয়ে মিশিয়ে দু’চোখ ভরা রঙিন স্বপ্ন।
অল্প কিছুদিনের মধ্যেই সেই স্বপ্ন ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে গেল। যে রাষ্ট্রনায়ক ভেবেছিলেন বড় বাঁধ দিয়ে আধুনিক ভারত গড়বেন, তিনি শেষ জীবনে তাঁর ভুল বুঝতে পারলেন। ১৯৫৮ সালের কেন্দ্রীয় সেচ ও শক্তি দফতরের বার্ষিকসভায় দাঁড়িয়ে তিনি বলেছিলেন ‘ছোট সেচ প্রকল্প’ দিয়ে পৌঁছে যেতে হবে মানুষের কাছে। সেকথা তিনি বুঝেছিলেন। তবে উত্তরসূরিরা তাঁর দেখানো পথকে সম্পূর্ণ এড়িয়ে গেছে।
দামোদরের বন্যা নিয়ন্ত্রণ যে কলকাতা বন্দরের নাব্যতাকে একেবারে তলানিতে নিয়ে যাবে, সেকথা দৃঢ়ভাবে বলেছিলেন প্রাজ্ঞ প্রকৌশলী কপিল ভট্টাচার্য। তাঁকেও নানাভাবে অপদস্ত হতে হয়েছে ক্ষমতা নামক এক অদৃশ্য শক্তির কাছে। তাঁকে একসময় আইএসআই-এর চর বলেও দাগিয়ে দেওয়া হয়েছে। প্রাজ্ঞ ইংরেজ সাহেব বুঝেছিলেন, নদী-শাসনের অজুহাতে আমরা যা করছি, তা প্রকারান্তরে প্রকৃতির বিরুদ্ধে যাবার চেষ্টা। যা কোনও দিন ভালো কিছু এনে দিতে পারে না আমাদের জীবনে।
আসলে টেনেসি ভ্যালি পরিকল্পনাকে নিয়ে তৈরি করা হল বহুমুখী দামোদর নদী পরিকল্পনা। যে পরিকল্পনা তৈরি করা হয়েছিল, আর যা বাস্তবায়িত হল, তা আকাশ-পাতাল পার্থক্য। এখনও পর্যন্ত পুরো দামোদর নদী পরিকল্পনা বাস্তবায়িত করা যায়নি। একটা অসম্পূর্ণ পরিকল্পনা দিয়ে দামোদরকে শাসন করা হচ্ছে। তার থেকেই বড় কথা– দামোদর অববাহিকা আর টেনেসি নদী অববাহিকার মধ্যে চরিত্রের আকাশ-পাতাল পার্থক্য। এমন একটা নদী পরিকল্পনা দামোদরের জন্য ‘সুইটেবল’ ছিল না, প্রথম থেকেই।
রাজ্য সেচ দফতরের সরকারি রিপোর্ট বলছে, দামোদরের উপরে বাঁধ নির্মাণের পর বন্যার প্রকোপ অনেক বেড়ে গিয়েছে। ২০০০ সালে প্রকাশিত ‘ওয়ার্ল্ড কমিশন অন ড্যামস’-এর রিপোর্ট বলছে বড় বাঁধের আয়ু মেরে কেটে ৪০ বছর। তাহলে নদীর বুকে দাঁড়িতে থাকা মরা বাঁধগুলোকে নিয়ে বন্যা নিয়ন্ত্রণের কথা ভাবা হচ্ছে। বিষয়টাই হাস্যকর। অনেকটা মরা মানুষকে বাঁচানোর মতো।
………………………………………………
আরও পড়ুন তন্ময় ভট্টাচার্য-র লেখা: সরস্বতী নদী ও আদিগঙ্গা: প্রচলিত মৃত্যু-তত্ত্বের বিপরীতে
………………………………………………
টেনেসি নদীর উপর সমস্ত বাঁধকে ইউরোপে ভাঙা হয়েছে নদীকে অবিরল ও নির্মলভাবে বইতে দেওয়ার জন্য। ওখানকার মানুষেরা বুঝেছে বড় বাঁধ নদীর কোনও ভালো করে না। আমরা আজকের দিনে দাঁড়িয়ে হাড়ে হাড়ে বুঝতে পাচ্ছি বড় বাঁধ বন্যাকেও নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না-একটা নির্দিষ্ট সময়ের পর। যত দিন বাঁধ আছে, ততদিন বন্যা আছে। যদি বন্যা থেকে বাঁচার ইচ্ছে থাকে বিকল্প পথ খোঁজা ছাড়া কোন উপায় নেই।
……………………………………..
ফলো করুন আমাদের ফেসবুক পেজ: রোববার ডিজিটাল
……………………………………..
আমবাগানে গজল-সম্রাজ্ঞীকে গোর দেওয়া হয়ে যাওয়ার পর, রাত জেগে শাহিদ লেখেন ‘In Memory of Begum Akhtar’ নামে একটি কবিতা, যে কবিতাটা পরে উৎসর্গ করেছিলেন সেলিমকে। এর বেশ কয়েক বছর পর শাহিদের একটা কবিতার বই বের হয় ‘In Memory of Begum Akhtar’ নামে।