গত ৩০ বছরে মানুষের সবচেয়ে বড় সমস্যা হল ভুঁড়ি। বেড়ে-চলা-ভুঁড়ি এবং কোন অব্যর্থ প্রতিষেধক ব্যবহারে তাকে ছেঁটে ফেলে, স্লিম-ট্রিম-ঝলমলে হওয়া যাবে, এই নিয়ে গত কয়েক দশকে প্রিন্ট মিডিয়ায় যত পাতা এবং ডিজিটাল মাধ্যমে যত বাইট খরচ হয়েছে– তাতেই সম্ভবত আমাজন অরণ্যের অর্ধেক গাছ নষ্ট এবং আমাজন কোম্পানির অর্ধেক ক্লাউড-গুদাম জবরদখল হয়ে গেছে। এদিকে পৃথিবীর অর্ধেক লোক হাড়-জিরজিরে অপুষ্টিতে ভুগছে, কালাহান্ডি কিংবা আমলাশোল দিগ্বিদিকে জাজ্বল্যমান, কিন্তু তাতে কী!
যে কোনও লাইফস্টাইল ম্যাগাজিন খুললেই টের পাওয়া যায়, গত ৩০ বছরে মানুষের সবচেয়ে বড় সমস্যা হল ভুঁড়ি। বাকি সব তুচ্ছ! বেড়ে-চলা-ভুঁড়ি এবং কোন অব্যর্থ প্রতিষেধক ব্যবহারে তাকে ছেঁটে ফেলে, স্লিম-ট্রিম-ঝলমলে হওয়া যাবে, এই নিয়ে গত কয়েক দশকে প্রিন্ট মিডিয়ায় যত পাতা এবং ডিজিটাল মাধ্যমে যত বাইট খরচ হয়েছে– তাতেই সম্ভবত আমাজন অরণ্যের অর্ধেক গাছ নষ্ট এবং আমাজন কোম্পানির অর্ধেক ক্লাউড-গুদাম জবরদখল হয়ে গেছে। এদিকে পৃথিবীর অর্ধেক লোক হাড়-জিরজিরে অপুষ্টিতে ভুগছে, কালাহান্ডি কিংবা আমলাশোল দিগ্বিদিকে জাজ্বল্যমান, কিন্তু তাতে কী! আসল সমস্যা হল লোকে খাচ্ছে আর মোটা হয়ে যাচ্ছে। ইন্টারনেট খুললেই দেখবেন ওজন কমানোর ৩৩৩টি উপায়। কেউ বলছে ফ্যাট খেও না বাড়বে ভুঁড়ি, কেউ বলছে কার্ব নয় ফ্যাট খান। কেউ বলছে তেড়ে দৌড়ও, কেউ বলছে ধুস দৌড়ে কী হবে, আসল কথা হল নিয়ন্ত্রিত শরীরচর্চা। কেউ বলছেন ক্র্যাশ ডায়েট, কেউ বলছেন পরিমিত আহার ও যোগাভ্যাস। একই সঙ্গে সমাজমাধ্যমের জমায়েতেও চলছে ক্রমাগত ক্রন্দন। ‘এ মাসেও ওজনটা কমল না রে’ বলে কান্নাকাটি করছেন ফিগারসচেতন সোনা মাসিমা, নির্জলা ডায়েটের মধ্যে একটা মাত্র রসগোল্লা খেয়ে ফেলে বিষণ্ণ হয়ে পড়ছেন আজকের সুবর্ণলতা। বছরে একদিন জিমে গিয়ে ফলাও করে চাউর করা, আর গ্রুপ ছবি তোলার জন্য টাক ঢেকে এবং কোমর বেঁধে দাঁড়ানো পরিণত হয়েছে রেওয়াজে। পত্রপত্রিকার ঢক্কানিনাদেও কান পাতা দায়। কোথাও কিছু নেই, থেকে-থেকেই কোনও এক নায়িকার খোলামেলা ছবি, সঙ্গে ব্রেকিং নিউজ, মাত্র তিনমাসে ২০ কেজি ঝরালেন অমুকচন্দ্র ওমুক, তাঁর পেট এখন সরলরেখার মতো সোজা। ছেলেদের অবশ্য স্রেফ সরলরেখা হলেই হবে না, তাতে কয়েকখানা ভাঁজও চাই, যাকে বলে ‘সিক্স প্যাক’। মানুষ পেট দিয়ে কোদালও কোপায় না, লাঙলও টানে না, ওইখানে চাট্টি অতিরিক্ত পেশির কী উপযোগিতা, ঈশ্বরই জানেন। কিন্তু ওটা চাই-ই চাই। নইলে জীবন অনর্থক!
এর পুরোটাই হুজুগ, যার সঙ্গে স্বাস্থ্যের সম্পর্ক প্রায় নেই বললেই হয়। হ্যাঁ, সেই মহাভারতের আমল থেকেই চিকিৎসকরা বেশি মোটা হতে বারণ করেন, নিয়মিত স্বাস্থ্যচর্চাও করতে বলেন, সরু লিকপিকে হাত-পা কোথাওই চমৎকার চেহারা বলে বন্দিত হয়নি কখনও, কিন্তু পেটের উপর হালকা ছোট্ট একটা স্নেহের নেয়াপাতি আস্তরণ, কোনও কালেই স্বাস্থ্যবানদের এসবে কোনও নিষেধাজ্ঞা ছিল না। মুগুরভাঁজা পেটেও দিব্যি থাকত ফ্যাটের আস্তরণ, কোনও মহাভারত অশুদ্ধ হয়নি কখনও। পেটটি-নাদা-গণেশ-দাদার কথা বাদই থাক, ওটা না হয় মুজতবা আলীর মতো পেটুকদের এলাকা, যিনি নাকি পাচকের ভালো-মন্দ বিচার করতেন তার ভুঁড়ি দিয়ে। কিন্তু বাঙালির কার্তিক ঠাকুরকেই দেখুন, তিনি তো দেবসেনাপতি, রীতিমতো যুদ্ধ-টুদ্ধ করতে হয়, তাতেও সিক্স প্যাক নেই। ওইসব খাঁজকাটা জিজাইনার কোমর বরাদ্দ কেবল পৈশাচিক শক্তির প্রতীক মহিষাসুরের জন্য– মণ্ডপে মণ্ডপে তিনিই যেন শাহরুখ খান। অথবা অজন্তার পুরনো গুহাচিত্র দেখুন। সেখানে নারীচিত্রে ধনুকের মতো বাঁকা ভুরুর কোনও অভাব নেই, শরীরের মূর্ছনাও আঁকাবাঁকা, কিন্তু ল্যাম্পপোস্টের মতো সোজা পেট? কদাচ না। বরং শরীরের যে বিভঙ্গ, সর্পিল আঁকাবাঁকা গলির যে হাতছানি, তার অপরিহার্য অংশ হল কোমরের মেদ। সেটা না হয়ে কাঠির মতো শরীর হলে কেমন লাগত, ভাবলেই ভয় করে। ভাবুন, পেনসিল-শরীর অপ্সরারা নৃত্য করছেন, সিক্স-প্যাক অবলোকিতেশ্বর পদ্মপানি ভাবে বিভোর, ‘এই রে একটা পিৎজা খেয়ে ফেললাম’ ভেবে সুজাতার চোখে জল, এইসব ভাবভঙ্গিমা আনতে হলে আস্ত ভারতীয় চিত্রকলাটাই লাটে তুলে দিতে হত। শুধু চিত্র কেন, গোটা নাট্যশাস্ত্রটাই আরেকবার লিখে ফেলতে হত।
বস্তুত অত পুরনো যুগেও যাওয়ার দরকার নেই, স্রেফ গত সাত এমনকী, আটের দশকের সিনেমার নায়িকাদের দেখুন, কারওরই পাটকাঠির মতো সোজা কোমর না। বেশিরভাগই পৃথুলা এবং কেউ-কেউ তো রীতিমতো মোটাই। কোমরে একটু মেদ না জমলে এবং তাতে ভাঁজ না পড়লে সে আমলে উদ্দীপক যৌনপ্রতিমা হিসেবে আদৌ কল্কে পাওয়া যেত না। পুরুষদেরও তাই। নানারকম পুরুষ ছিলেন। অনেকের গায়েই গুচ্ছের লোম থাকত, এমনকী, বনমানুষের মতোও লাগত, কেউ-কেউ মোটাসোটাও হতেন, কারও-কারও হত পেটানো চেহারা। লম্বা-চওড়া, ফর্সা-কালো, চোয়াড়ে-মিষ্টিমতো সব রকম নায়কের চাহিদা ছিল, কিন্তু সিক্সপ্যাক এবং নির্লোম ডলফিনের মতো শরীর সম্ভবত একটাও দেখতে পাওয়া যাবে না। সে আমলে পেনসিলের নামও হত নটরাজ, সঙ্গে ত্রিভঙ্গমুরারীর একটা ছবি থাকত। পেনসিলের মতো সোজা শরীর তো অকল্পনীয় ছিল। গিটারের ফ্রেটবোর্ডের মতো কিংবা লাউহীন তানপুরার মতো চেহারা যে আদৌ হতে পারে, সেটাই লোকে জানল নেহাতই হাল আমলে। কায়দাটা শুরু হল নয়ের দশকে, এমটিভি এবং ফ্যাশন-শোর হাত ধরে। ফ্যাশন শো আদিতে ছিল মূলত জামা-কাপড় সাজসজ্জা এবং অলংকারের প্রদর্শনী। শরীর সেখানে আসে স্রেফ ম্যানিকুইনের মতো একটা দেখানোর জায়গা হিসেবে। হ্যাঙারে ঝুলিয়ে রাখলে নিষ্প্রাণ মনে হবে, তাই বিকল্প হিসেবে মানুষের শরীর। ফলে ফ্যাশন শো-তে মানুষ ক্রমশ হয়ে উঠল হ্যাঙারের বিকল্প, তার শরীর হয়ে উঠল দুই-ঠ্যাঙা আলনার পরিপূরক। মডেলরা হয়ে উঠলেন তালপাতার সেপাইয়ের মতো। এতই রোগা, যে, সামনে দেখলে উড়ে যাবে কি না মনে হয়। তাঁদের হাঁটার নাম দেওয়া হল মার্জারচলন, আর পুরো বস্তুটাকেই গ্ল্যামারের ঠোঙায় পুরে চালান করে দেওয়া হল টেলিভিশনে। কেবল টিভি ভারতে এসে পৌঁছল নয়ের দশকে। সে খুবই ঘ্যাম ব্যাপার। আমরা হাঁ করে শ্রদ্ধাবনত চিত্তে দেখতে শুরু করলাম, আর পোশাকের কাটিং, লিপস্টিকের শেডের সঙ্গে, অনুকরণপ্রিয় শিম্পাঞ্জির মতো, সেই হ্যাঙার-ফিগারকেও নকল করতে শুরু করলাম শ্রদ্ধাবনত চিত্তে। আমাদের বিশ্বসুন্দরীরা জাদুমন্ত্রে দারুণ অভিনেত্রী হয়ে গেলেন হঠাৎ! ভাঙা চোয়াল আর জিরো-ফিগার নামক এক বকচ্ছপ বস্তু ফ্যাশন হিসেবে এসে গেল ভূ-ভারতে। অনুকরণে উদগ্রীব আমরা, তৃতীয় বিশ্বের বালক-বালিকারা, বিশ্বনাগরিক হয়ে গেলাম পাঁচ বছরে।
তার আগে আমরা, গরমের দেশের লোকেরা ঢিলেঢালা পোশাক পরতাম। ধুতি-লুঙ্গি-ফতুয়া তো আর এমনি জন্মায়নি। আমাদের বিলাস ছিল দিবানিদ্রা, সুখ-দুঃখের সাথী ছিল পেটের ওপর ছোট্ট একটু স্নেহের আস্তরণ। সেসব এখন আর হওয়ার উপায় নেই। এখন ইউনিফর্ম হল শরীর-আঁকড়ানো টিশার্ট কিংবা স্প্যাগেটি-টপ। শরীরের প্রতিটি ভাঁজ যেখানে স্পষ্ট। পেটের একটু কুঞ্চনও সার্চলাইটের তলায়। দুনিয়া এখন আপনাকে জরিপ করছে। পেটের ওপর একটুও ভুঁড়ি আছে কি না, মেপে নিচ্ছে সিসিটিভি। নিতে তো হবেই। কারণ, গত ৩০ বছরে, সিগারেট এবং বিশ্ব উষ্ণায়নের পরেই, মানুষের সবচেয়ে বড় সমস্যা হল ভুঁড়ি। ভুঁড়িই মানবপ্রজাতির আসল শত্রু। যে কোনও লাইফস্টাইল ম্যাগাজিন দেখলেই সেটা টের পাবেন।