দ্বীপের শেষতম গ্রামে এই ইঁট বাঁধানো একটিই উঁচু রাস্তা। গ্রামের লাইফ লাইন বলা চলে, ফলে এর জাবর কাটা গরু, ওর চঞ্চল পাঁঠা ছাগল, রোদে শুকোতে দেওয়া কাঁথা, হামাগুড়ি দেওয়া শিশু, ছড়ানো ধান সহ বলা যেতে পারে গোটা গেরস্থালি টপকে টপকে ধান কাটা মাঠের গোড়ার খোঁচা বাঁচিয়ে দোতলা স্কুল বাড়ির সামনে এসে দাঁড়াতে হবে। তার একটি মাত্র ঘরে দরজা জানানো সম্পূর্ণ হয়েছে বলে সেটি স্টাফ রুম এবং হেডমাস্টারের ঘর। মোবাইল নেটওয়ার্ক নেই, বিদ্যুৎ নেই, কাঠের বিবর্ণ বেঞ্চে দুই-একটি হাত পাখা পড়ে আছে।
২০০৫-’০৬ সাল হবে। সায়েন্স সিটির উল্টোদিকে খাল বরাবর যে রাস্তাটা নিচের দিকে অনন্ত ভেড়ি আর মেছো গন্ধের দিকে নেমে গেছে, সেদিকেই ছুটে চলেছে সরকারি বাস। ধর্মতলা থেকে এই বাহনটি ছাড়া আধঘণ্টা অন্তর যেখানে আর সরাসরি যোগাযোগ ব্যবস্থা নেই, সেখানে সে নিজেই একটি আস্ত হাটবাজার হয়ে উঠবে, তাতে আর সন্দেহ কি! স্কুল সার্ভিসের দাক্ষিণ্যে সেই বাস ধরে এক দিদিমণি চলেছে বিদ্যাদানে। পাঁচটায় দমদম থেকে রওনা দিয়ে, বনগাঁ লোকালে শিয়ালদায় নেমে, সাড়ে ছ’টায় প্রাচী সিনেমা হলের কাছ থেকে বাস ধরে ভাঙর সরবেড়িয়া হয়ে ধামাখালিতে শেষ হয় সড়ক যোগাযোগ। বাসের গতি যদিও পক্ষীরাজের মতো, কিন্তু বাসিন্দাদের আবদারে থামতে হয় প্রতিটি গঞ্জ-গাঁয়ে। যেখানেই থামছে, সেখানেই লেবু-লজেন্স, ছোলাভাজার সঙ্গে সঙ্গে ছাগল, মুরগি, হাঁস মালিকের হাত বা কোল বাঁধা হয়ে উঠে পড়ছে। দিদিমণি খোলা জানালা দিয়ে বাইরে মুখও বাড়াতে পারে না কারণ, আগের আগের সিটে বসা কোনও বদহজমের ভাত-ডাল উগরে এসে মুখে ঝাপটা দিয়ে চলে যেতে পারে যেকোনও সময়! আবার বাঁদিকে পাশে বসা সহযাত্রীর দিকেও বেশি ঘেঁষা যাবে না, তাদের অত্যুৎসাহী মুরগি বা বিরক্ত হাঁস ক্যাঁক করে ঠুকরে দিতে পারে। ওড়নাও টেনেটুনে বসতে হয়, কারণ ক’দিন আগে এক নির্বিকার ছাগ-শিশু সেটিকে চিবিয়ে গলায় এমন টান মেরেছিল যে, ফাঁস পরার উপক্রম হয়েছিল! ভাঙরের পর থেকে বাঁদিকে খাল এসে নদীতে মিশতে থাকে, সেই ক্রমশ প্রস্থে বাড়া নদীতে মাছধরার নৌকোয় কুয়াশার মতো পাল দোলে, ডানদিকে বাড়িঘর খেতখামার ছাড়িয়ে ক্রমশ ভেড়ি শুরু হয়– যার টং-ঘরে তখনও লাল গামছা ওড়ে।
…………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
দিদিমণি নিজেই কুমির আর বাঘের সঙ্গে মোকাবিলায় জেরবার, ফলে শুনে যাওয়া ছাড়া তার আর গত্যন্তর নেই। এবারে নদীঘাট অবধি হণ্টন। নদী মানে এপার ওপার দেখা যায় না এমন সম্বৎসর দুধ ওথলানো জল। বড়া কলাগাছি ছোটা কলাগাছি হাতানিয়া দোয়ানিয়া কত সব নদী মিলেমিশে একাকার যে বারদরিয়ার উপমা মনে পড়ে যায়। ওপারের সন্দেশখালি দ্বীপে যেতে হলে ভটভটি ভরসা।
…………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
সাড়ে ছ’টার যাত্রা পথ শেষ হয় সাড়ে ন’টায়। মাঝপথে সরবেড়িয়ায় এসে রাস্তাটা নদীর সমান্তরালে চলার জন্য বাঁক নেয়। সরবেড়িয়াই শেষ বড়সড় গঞ্জ। দিদিমণি অবাক হয়ে দেখে সবটাই যেন হাকুঞ্জিদের! হাকুঞ্জি সুপার মার্কেট, হেকিমি দাওয়াই, মৎস্য সমবায় সমিতি, মায় গুপ্ত রোগ সারাইয়ের ক্লোন হেন লামা সাহেবের চেম্বার অবধি! কিছুদিন আগে কাগজে এদের নিয়ে কী একটা কেচ্ছা পড়েছে, মনে পড়তে পড়তেও পড়ে না।
গাড়ি এসে অন্তিম শ্বাস টানার মতো করে ধামাখালি বাজারে এসে থামে। বাজার নামেই! কাঁটা গাছ ভরা ঢালুতে একটা সুলভ শৌচাগারে যেতে হলে টিউবওয়েলে প্রাণান্তকর ডাইভ মেরে ভাঙা টিনের কৌটোয় জল ভরে ঢুকতে হবে। আর নারী-পুরুষের পার্টিশনের মধ্যিখানের পার্টিশানে এক পা-ওয়ালা এক খালি-গা সবুজ-নীল চেক লুঙ্গি বসে থাকে। দিদিমণিকে পিঁপড়ে জ্ঞানে সে তার ছোট্ট ফোনে মেয়ে পাচারের দরদাম করতে থাকে। দিদিমণি নিজেই কুমির আর বাঘের সঙ্গে মোকাবিলায় জেরবার, ফলে শুনে যাওয়া ছাড়া তার আর গত্যন্তর নেই। এবারে নদীঘাট অবধি হণ্টন। নদী মানে এপার ওপার দেখা যায় না এমন সম্বৎসর দুধ-ওথলানো জল। বড়া কলাগাছি ছোটা কলাগাছি হাতানিয়া দোয়ানিয়া কত সব নদী মিলেমিশে একাকার যে বারদরিয়ার উপমা মনে পড়ে যায়। ওপারের সন্দেশখালি দ্বীপে যেতে হলে ভটভটি ভরসা। নদী পাড়ে অজস্র নৌকোর সারি। ইয়া সাইজের রামছাগল একরাশ পানিফলের খোসা চিবুচ্ছে। দু’-চারটে কাঁচা ছাউনির জোড়া তালি দোকান। ছেঁড়া পরোটা, কাঁচাগোল্লা, আঁশটে গন্ধ ওঠা চিংড়ি আলুর ঝোল আর মোটা ভাত আসছে, যাচ্ছে। দুলতে থাকা এক নৌকার খোলে উঠে আরেক নৌকার কোল গলে নিজের ভটভটির নাগাল পেতে হয়। গন্তব্য, চতুর্দিকে সমুদ্র সমান জলে ভেসে থাকা সন্দেশখালি দ্বীপের লেজে থাকা একটি স্কুল। ৫৫ মিনিটের যাত্রায় ভুলেও নদীতে পা ডুবিয়ে মনটি পর্যটনের ভাবালুতায় নিয়ে যাওয়া যাবে না, কারণ দিদিমণি ইতোমধ্যেই শুনে ফেলেছে যে নোনা নদীর জলে কামট বিরল নয় মোটেই!
নৌকায় তার সঙ্গে সওয়ার হবে পায়ে জুতো মোজাহীন কিন্তু সর্বাঙ্গে চকচকে শীত জামা পরা খোকা সহ কিশোরী মা, সার সার গুড়ের টিন, কষে বেঁধে রাখা বাছুর। নৌকো বাঁধ বরাবর চলবে আর বাঁধের গায়ে ঘাটে ঘাটে থামবে। উঠবে নামবে– মুরগি, ছাগল, তেলের টিন, স্টিলের আলমারি, নব দম্পতি, ব্রিফকেস হাতে সরকারি বাবু, ঘরে ফেরা ছেলেমেয়ে আর মীন ধরার ইয়া ইয়া হাঁড়ি। বাঁধের ওপর আস্ত একটা হুমহুমিয়ে চলা পালকি দেখে টাইম ট্রাভেলের সাধ মিটে যাবে দিদিমণির। নিচে অনন্ত জল, মুখে চড়া রোদ, জোয়ারে ডুবে যাওয়া সারি সারি সুন্দরী হেতাল গাছের শুধু ডগাটুকু জেগে আছে। দিদিমণির ধারণা ছিল সুন্দরবনের এলাকা মানেই বাঘের ভয়, মধু সংগ্রহ এবং তজ্জনিত বিপদ, সুন্দর রায়, বনবিবির প্রতি ভক্তি আর প্রাচীন সভ্যতার নোনা ধরা ইট। পর্যটনে এলে এরকমই একটা ছবি পাওয়া যায় বটে। কিন্তু সে ঘাটের ধারে ধারে অগভীর জলে হাঁটু অবধি কাপড় তুলে নিবিষ্ট মনে অজস্র মহিলাদের জল থেকে মীন সংগ্রহ করতে দেখে। শোনে, এই সব মাছের বাচ্চা মানে গলদা চিংড়ির বাচ্চা ভেড়িতে চলে যাবে। হ্যাচারির বদলে তখন ওই পদ্ধতিই চলত বেশি। আরও কিছু শিক্ষকের সঙ্গে পথ চলতি আলাপ হয়। অবশ্য কেউ তার মতো এত দুর্গম পথের যাত্রী নয়। তারা ঠারে ঠোরে বলে, এই এতটা পথ মোটেই একা একা যাতায়াত ঠিক নয়। এখন বাঘ আর প্রধান উপদ্রব নয়, বাদা বনের ধারের জমিতে বছর বছর বাঁধ ভেঙে নুন ঢুকে চাষ নষ্ট হচ্ছে। ফলে ভেড়ির সংখ্যা বাড়ছে। শুকিয়ে যাওয়া ভেড়ির তলার ফেটে যাওয়া মাটি দেখে বোঝা দুষ্কর ক’দিন পর এখানেই কেমন জলে হাওয়ায় ঢেউ খেলে যাবে। দিদিমণির স্কুলে বাথরুম আছে, কিন্তু আর কোনও মহিলা কর্মী না থাকায় তার দরজা নেই। যেতে গেলে ছাত্রদের চোখের সামনে দিয়ে বালতি হাতে ছোট মতো এক ডোবা থেকে জল নিতে হবে। প্রথম দিন প্যানের ওপর এক দশাসই রামছাগলকে বিশ্রাম নিতে দেখেছিল বলে নদীর ওপারেই যা সারার সেরে আসত সে। পৌনে দশটায় যদি স্কুলের নির্দিষ্ট ঘাটে নামা না যায়, ভাটা এসে যাবে। জল নেমে যাওয়ায় অনেকটা নিচ থেকে থকথকে কাদা পেরিয়ে দূরে দূরে পাতা ইটে পা ফেলে খাঁজ কাটা বাঁধের গায়ে টিকটিকির মতো পা রেখে উঠতে হবে। প্রথম দিনেই দিদিমণি পড়ে ধপাস! সহযাত্রী করুণায় শিখিয়ে দিলেন জুতো পরে তো নয়ই, হাতে জুতো নিয়ে ওই সাবানের মতো মাটিতে পায়ের বুড়ো আঙুল গেঁথে গেঁথে এগোতে হবে। বাঁধের ওপরে উঠে টিউবয়েলে পা ও জুতো থেকে আঠালো কাদা ছাড়িয়ে নিতে পারলে তবে চলা।
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………..
নৌকায় তার সঙ্গে সওয়ার হবে পায়ে জুতো মোজাহীন কিন্তু সর্বাঙ্গে চকচকে শীত জামা পরা খোকা সহ কিশোরী মা, সার সার গুড়ের টিন, কষে বেঁধে রাখা বাছুর। নৌকো বাঁধ বরাবর চলবে আর বাঁধের গায়ে ঘাটে ঘাটে থামবে। উঠবে নামবে– মুরগি, ছাগল, তেলের টিন, স্টিলের আলমারি, নব দম্পতি, ব্রিফকেস হাতে সরকারি বাবু, ঘরে ফেরা ছেলেমেয়ে আর মীন ধরার ইয়া ইয়া হাঁড়ি। বাঁধের ওপর আস্ত একটা হুমহুমিয়ে চলা পালকি দেখে টাইম ট্রাভেলের সাধ মিটে যাবে দিদিমণির। নিচে অনন্ত জল, মুখে চড়া রোদ, জোয়ারে ডুবে যাওয়া সারি সারি সুন্দরী হেতাল গাছের শুধু ডগাটুকু জেগে আছে। দিদিমণির ধারণা ছিল সুন্দরবনের এলাকা মানেই বাঘের ভয়, মধু সংগ্রহ এবং তজ্জনিত বিপদ, সুন্দর রায়, বনবিবির প্রতি ভক্তি আর প্রাচীন সভ্যতার নোনা ধরা ইট।
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………..
দ্বীপের শেষতম গ্রামে এই ইট-বাঁধানো একটিই উঁচু রাস্তা। গ্রামের ‘লাইফ লাইন’ বলা চলে, ফলে এর জাবর কাটা গরু, ওর চঞ্চল পাঁঠা ছাগল, রোদে শুকোতে দেওয়া কাঁথা, হামাগুড়ি দেওয়া শিশু, ছড়ানো ধান-সহ বলা যেতে পারে গোটা গেরস্থালি টপকে টপকে ধান কাটা মাঠের গোড়ার খোঁচা বাঁচিয়ে দোতলা স্কুল বাড়ির সামনে এসে দাঁড়াতে হবে। তার একটি মাত্র ঘরে দরজা জানানো সম্পূর্ণ হয়েছে বলে সেটি স্টাফ রুম এবং হেডমাস্টারের ঘর। মোবাইল নেটওয়ার্ক নেই, বিদ্যুৎ নেই, কাঠের বিবর্ণ বেঞ্চে দু’-একটি হাত পাখা পড়ে আছে। ত্রিসীমানায় দু’চারটে নারকেল গাছ ছাড়া ছায়াদানকারী গাছের অস্তিত্ব অবধি নেই। এই পুরো প্রেক্ষাপটে সান্ত্বনা, মায়া মাখা মুখ কতগুলি ছেলে-মেয়ে, তাদের কারও কারও হাওয়াই চটির স্ট্যাপে সেফটিপিন আঁটা।
প্রথম প্রজন্মের পড়ুয়া এদের মুখেও শোনা গেল বাঁধ ভেঙে জল ঢুকেছে। জমির নুন সাফ করা চাট্টিখানি কথা নয়, ফলে চাষ ছেড়ে তাদের বাবা-কাকারা পাড়ি দিচ্ছে দক্ষিণের শ্রম বাজারে, আর মায়েরা কলকাতা ও তৎসংলগ্ন অঞ্চলে গৃহশ্রম লাঘবে। ভাঙা সংসারে পড়ে থাকছে বৃদ্ধ-বৃদ্ধা, অশক্তরা আর এই পাঠরত অসহায় ছানাপোনাগুলি। এই সন্দেশখলি দ্বীপ অঞ্চলের গা-ঘেঁষে আরেক বাংলা-বলা-দেশ। সেখান থেকে বাঘ যেমন এপার ওপার করে, জল পুলিশ এড়িয়ে স্বেচ্ছায় বা ভ্রমে মৎস্যজীবীরা চলাচল করছে, তেমনই অস্ত্রও তার নিজস্ব নিয়মে পারাপার করে। ক্লাসরুমের দেওয়ালে সার সার বেত টানানো দেখি দিদিমণি ভাবে সে বুঝি সিপিয়াটোনের ছেলেঠ্যাঙানো বাংলা ছবির জগতে চলে এসেছে। টিচার ইনচার্জ নস্করবাবু যেদিন ক্লাস টেনের একটি ছেলেকে বেদম পেটাতে শুরু করল, সে হাঁ হাঁ করে তেড়ে গেছিল। তাকে নিরস্ত্র করল কিছুদিন আগে জয়েন করা আরেক মাস্টার। চুপিসারে জানাল ওই ছেলেটি অ্যাসেম্বল করা রিভলবার নিয়ে এসেছে। পার্শ্ববর্তী দ্বীপ যা অন্য দেশের সীমায়, সেখানে পাচার হবে বলে পাঁচশো টাকার বরাত পেয়েছে সে! এই অবধিও ঠিক ছিল। এমনকী, স্কুলের সেক্রেটারি যিনি ঠাকুরদার নামে স্কুলের জমিটি দিয়েছেন এবং পেশায় কাঠমিস্ত্রি, তিনি কোনও ভাবে খবর পেয়েছিলেন দিদিমণি লেখেন টেখেন এবং অনুরোধ করেছিলেন পুজোর সময় অভিনীত হওয়ার জন্যে একটা পালা লিখে দেওয়ার। তখনও দিদিমণি মান বাঁচাতে সম্মত হয়েছিলেন। কিন্তু গোল বাঁধল ঘাটে চাঁদা চাওয়ায়। শুনতে পেল সে, চাকরি স্থায়ী হলেই একটা মোটা মাপের খাওয়াদাওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে তাকে। নির্দেশ এসেছে ঘাটের গায়ে লাগানো মাছবাজার থেকে। দিদিমণি চিন্তিত। ফেরার সময় মাঝেমধ্যেই এক বয়স্ক শক্তপোক্ত লোক ওঠেন, দিদিমণির পাশে বসেন মাঝেমধ্যে। বাসের হাটুরে লোকদের মধ্যে একটু অন্যরকম। নিজেই আগ্রহ নিয়ে দু’চারটে কথা বলেন। দিদিমণি ভরসা পেয়ে সমস্যার কথা অর্থাৎ বাথরুম যাওয়া বিষয় নিয়ে নিজের বিপন্নতার কথা শেয়ার করে, চাঁদা চাওয়ার কথা বলে। লোকটি বিনয়ের সঙ্গে বলে সরবেড়িয়া থেকে আরও কয়েকটি এলাকা পেরিয়ে যেখানেই দিদিমণি নামতে চায় সেখানেই বাথরুমের ব্যবস্থা হয়ে যাবে আর চাঁদা নিয়ে চিন্তার কিছু নেই। দিদিমণি এইসব এলাকায় এরকম একা একা চলাফেরার বিপদ নিয়ে প্রশ্ন করলে উত্তর পায় যে শিক্ষক-শিক্ষিকাদের কেউ বিরক্ত করে না এবং দিদিমণির তো কোনওরকম ভয় থাকার দরকারই নেই। তিনি আছেন। ক’দিন পরেই প্রাচী থেকে বাস ছাড়ার সময় প্রায় ফাঁকা বাসে কন্ডাক্টার উসখুস করে এবং তারপরে বলে ফেলে, আপনি ওঁর সঙ্গে অত কথাও বলবেন না আর বসবেনও না।
দিদিমণি খানিক বিস্মিত এবং বিরক্ত। এই নজরদারি আর অতিরিক্ত কৌতূহল তার চিরকালের না পসন্দ। কন্ডাক্টার তবু মরিয়া। বলেন, ওঁরা দু’-তিন পুরুষের ডাকাত। ওই যে আপনি হাকুঞ্জিদের সব দোকানবাড়ি দেখছেন, উনি ওই বাড়ির। এখন সব ভেড়ির ব্যবসায়ে নেমেছে এরা। বলা বাহুল্য, দিদিমণি প্রস্তরবৎ। না, ওই বিদ্যালয়ে দিদিমণি আর বেশিদিন চাকরি করতে পারেনি। সাত-আট বছর পরেও রাজনৈতিক পালাবদলের পরে কিছু কাজে ওই স্কুলে গেছে সে। ততদিনে সব দরজা-জানলা বসে গেছে। শুনেছে বিধ্বংসী আয়লার ওই দোতলা স্কুল বাড়ি হয়ে উঠেছিল আশ্রয়স্থল। উপর্যুপরি প্রাকৃতিক দুর্যোগে বহু ছাত্র শিশু শ্রমিক হিসেবে লঙ্কা খেতে, গ্রিল আর রং কারখানায় ছড়িয়ে পড়েছে। ভেড়ির সংখ্যা চতুর্গুণ বেড়েছে। সরকারি বাসে করে এমন দোর্দণ্ডপ্রতাপেরা আজকাল আর যাতায়াত করে না। আদিগন্ত বিস্তারিত জলাশয়ের ফাঁকে ফাঁকে মাঝেমধ্যেই দেখা যায় বিসদৃশ বাংলো বাড়ি আর সামনে দাঁড়ানো ফটফটে এসইউভি, মোটরবাইক সারি। শেরউড বনের রবিনহুডের বদলে ওটিটির সেন্সরশিপহীন, বিকারগ্রস্ত, শার্প শুটারে ভরে গেছে জল ও জঙ্গল।