মিডিয়ার দৌলতে কয়েকজন মণ্ডপ বা প্রতিমাশিল্পী বাদে অন্যদের নিয়ে তেমন আগ্রহ নেই মানুষের। ফলে সেইসব শিল্পীদের সারা বছরের শিল্পচর্চার পরিসর বিষয়ে কোনও ধারণাই তাঁরা রাখেন না। যেমন রাখেন না কাঁথা, মাদুর, সরা বা ডোকরাশিল্পীদের খোঁজ। রাখতেই হবে এমন কোনও কথা নেই। কিন্তু শুধুই ট্রেন্ড বা হুজুগে যে সাময়িক শিল্পপ্রীতি গড়ে ওঠে, তার সততা নিয়ে প্রশ্ন জাগে। বারোয়ারি পুজোয় থিমের বিবর্তনের যে চলমান ইতিহাস, তার সক্রিয় অংশ হয়েও তাকে সযত্নে পাশ কাটিয়ে চলার মধ্যে শিল্পচেতনার দৈন্যই প্রকাশ পায়।
বাঙালির শারদীয় শিল্পমনস্কতা প্রসঙ্গে ভাবতে গিয়ে প্রথমেই মনে এল চেক অধ্যাপক টমাস জার্সার প্রবন্ধ। একটি শূন্য চেয়ার কীভাবে শিল্পীর অবচেতনের গূঢ় অভিব্যক্তিকে ফুটিয়ে তুলতে পারে। ভ্যান গঘ থেকে শুরু করে ওয়েইনার, শিলে, ইওনেস্কো প্রমুখের ছবিকে ভিত্তি করে এগিয়েছেন জার্সা। একটিমাত্র শূন্য চেয়ার। তার মনস্তাত্ত্বিক দ্যোতনা বদলে-বদলে গেছে প্রতিটি ক্ষেত্রে। অথচ আশ্চর্য! সবক’টি ছবিই বাঁধা পড়েছে তীব্র এক অনস্তিত্বের সূত্রে। এবং সেই বিষাদমূক অনস্তিত্বের জমিতে চাঁদের ছায়ার মতো পড়েছে অস্তির সম্ভাবনা। জার্সার কথায়, ওই অস্তিত্বটুকুই আসলে শিল্পীর মুখ্য উদ্দিষ্ট: ‘পোর্ট্রেট অফ অ্যাবসেন্স’। শিল্প ও শিল্পীর অস্তিত্ব, যা কিনা ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে রয়েছে দর্শকের অস্তিত্বের সঙ্গে।
শিল্পের দর্শক চিরকালই কম। শিক্ষিত দর্শক তো আরওই কম। কারণ শিল্প তাৎক্ষণিক এন্টারটেইনমেন্ট দেয় না। অথচ শত্রুর মুখে ছাই দিয়ে গত দেড় দশক ধরে এর সম্পূর্ণ বিপরীত একটা চিত্র দেখা যাচ্ছে কলকাতার দুর্গাপুজোয়। পুজোর ক’টা দিন যেন শিল্পের সঙ্গে সাধারণ মানুষের সমন্বয়ের মহাসন্ধিক্ষণ। যানজট, ভিড়, শারীরিক অসুস্থতা সমস্ত অগ্রাহ্য করে অসংখ্য মানুষ ছুটে যাচ্ছেন সেই মহাপ্রসাদ আস্বাদন করতে। ছবিতে-ছবিতে ভরিয়ে দিচ্ছেন সোশ্যাল মিডিয়া; সঞ্চয় করে রাখছেন মুঠোফোনে। উৎসবের আবহ, হুজুগের মনস্তত্ত্ব, মিডিয়ার অদৃশ্য অঙ্গুলি, বৃহৎ বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানগুলির মার্কেটিং স্ট্র্যাটেজি– এই সমস্ত অনুঘটকের একপেশে উপস্থিতি সত্ত্বেও সাধারণ মানুষের এই স্বতঃস্ফূর্ত যোগদান, শিল্পের প্রেক্ষিত থেকে দেখলে, আপাত-সদর্থক বলেই মনে হতে পারে।
মুজতবা আলীর গার্ডকে রসগোল্লা খাওয়ানোর সেই বিখ্যাত গল্প স্মরণীয়। শিল্পের রসটুকু উৎসবের ছাঁচে ঢেলে সাধারণ মানুষের রসনা অবধি পৌঁছে দেওয়া। তাতে সাধারণ মানুষের তো বটেই, শিল্প এবং শিল্পীরও লাভ। কিন্তু দর্শকদের এই উন্মাদনা কতটা শিল্পপ্রেম, আর কতটা ‘ট্রেন্ড’-এ থাকার মরণপণ প্রয়াস– সে বিষয়ে কূটাভাস একেবারে এড়িয়ে যাওয়া যায় না। এবং বিষয়টি দ্বিপার্শ্বিক। একদিকে রয়েছে সাধারণ দর্শক। মণ্ডপের ভাবনা, থিম, তার অ্যাডাপ্টেশন, যথাযথ এগজিকিউশন, মণ্ডপ ও প্রতিমার সঙ্গে তার সাযুজ্য, আলো ও ইনস্টলেশনের ব্যবহার ইত্যাদি জটিল বিষয়গুলি নিয়ে তাঁদের একটা বড় অংশই খুব একটা মাথা ঘামান না। মিডিয়ার দৌলতে কয়েকজনের নাম জানলেও বেশিরভাগ মণ্ডপ বা প্রতিমাশিল্পীদের বিষয়েই তাঁদের তেমন কোনও আগ্রহ নেই। ফলে সেইসব শিল্পীর সারা বছরের শিল্পচর্চার পরিসর বিষয়ে কোনও ধারণাই তাঁরা রাখেন না। যেমন রাখেন না কাঁথা, মাদুর, সরা বা ডোকরাশিল্পীদের খোঁজ। রাখতেই হবে, এমন কোনও কথা নেই। কিন্তু শুধুই ট্রেন্ড বা হুজুগে যে সাময়িক শিল্পপ্রীতি গড়ে ওঠে, তার সততা নিয়ে প্রশ্ন জাগে।
আরও পড়ুন: কবিতাই লিখতে চেয়েছিলেন গণেশ পাইন
বারোয়ারি পুজোয় থিমের বিবর্তনের যে চলমান ইতিহাস, তার সক্রিয় অংশ হয়েও তাকে সযত্নে পাশ কাটিয়ে চলার মধ্যে শিল্পচেতনার দৈন্যই প্রকাশ পায়। অথচ প্রত্যেক মানুষেরই নিজস্ব একটি নান্দনিকতার বোধ রয়েছে। এবং পুজোর এই শিল্প-সমাবেশ জন-মননের সেই সূক্ষ্ম তন্ত্রীটিকে আংশিক হলেও স্পর্শ করতে পারে বলেই আমার বিশ্বাস। কিন্তু সেই ‘এস্থেটিক প্লেজার’ গলি পেরিয়ে বড় রাস্তায় পৌঁছনোর আগেই এসে পড়ে দুর্গোৎসবের ব্যবসায়িক প্রেক্ষিতটি। চাঁদের অপর পিঠ। সেখানে শিল্প পণ্যমাত্র। ব্যবসার জন্য একটি শ্রেণি চান ভিড়। যত দর্শক তত ক্রেতা, ততই লাভ। কিন্তু তাতে ক্ষতিগ্রস্ত হয় ইন্ডিভিজুয়ালের শিল্প-সম্পৃক্ততার পরিসর। এত কম সময়ে এত খুঁটিনাটি সূক্ষ্মতা দেখা এবং গ্রহণ করার অনিশ্চয়তার মধ্যে শিল্পের পাঠ সম্পূর্ণ হয় না। কেবল একটা তাৎক্ষণিক ইলিউশন তৈরি হয়। ইলিউশনটুকুই হয়ে ওঠে শিল্প। আর দর্শক হয়ে ওঠে ভিড়। ভিড়ের কোনও শিল্পবোধ থাকে না, ইতিহাসবোধ থাকে না। কেবল হুজুগ থাকে। তৈরি-করা হুজুগ। হুজুগ তাকে তাড়িয়ে নিয়ে বেড়ায় অমুক পার্ক থেকে তমুক সর্বজনীন, অমুক বারোয়ারি থেকে তমুক স্ট্রিট। আর ফাঁকা পড়ে থাকে চিত্রপ্রদর্শনীগুলি। একটি দৃষ্টান্ত দিই: এ বছর মহালয়ার দিনেই কলকাতার একটি বিখ্যাত পুজোর উদ্বোধনে ভয়ানক বিশৃঙ্খলার পরিবেশ তৈরি হয়েছিল। ভিড় সামাল দিতে প্রশাসনকে হিমশিম খেতে হয়। অথচ সেদিনই আকাদেমি অফ ফাইন আর্টসের ওয়েস্ট গ্যালারিতে চলছিল শিল্পী সুবোধ দাশগুপ্তের ছবির প্রদর্শনী। শেষ দিন। ঘটনাচক্রে আমিও সেখানে উপস্থিত ছিলাম। হাতে গোনা গুটিকয়েক দর্শক ব্যতীত খুব বেশি লোক সেখানে ছিল না। অনস্তিত্বের এমন বিষাদ-করুণ বাস্তব-প্রতিকৃতি কোনও শিল্পী আজ অবধি এঁকে উঠতে পেরেছেন কি?
ছবি: অর্ঘ্য চৌধুরী