আজ যারা শাসন ক্ষমতায়, বড় বড় দেওয়াল তাদের দখলে। কাল তারা না থাকলে, তাদের অক্ষর মুছে যায়। আজ যারা নতুন ক্ষমতায় এল, বড় দেওয়াল তাদের দখলে। বড় রাস্তার বড় দেওয়াল। আগের বড়রা এখন, ছোটরা ছোট দেওয়ালে। তারা এখন ছোট রাস্তা, গলিপথের দেওয়ালে। নানা সময়ের দেওয়াল লেখার আলোকচিত্র সাজালে শাসকদের রাজনৈতিক ইতিহাসের একটা বই বানিয়ে ফেলা যায়। দেওয়াল লেখা শাসনের রাজনৈতিক ইতিহাসের উপাদান। আজ দ্বিতীয় পর্ব।
২.
দেওয়াল লেখা শুধু ভোটের সময় নয়। শুধুই ভোটের জন্য নয়।
দেওয়াল লেখায় ঘোষণা লেখা। নানা বিষয়ে জানানো– পাড়ায় জলসা, ফুটবল টুর্নামেন্ট, রক্তদান শিবির…। পাড়ার ছেলেদেরই লেখা। ‘ছেলেদের’ কথাটা ইচ্ছে করেই লিখলাম। আমি কখনও মেয়েদের দেওয়াল লিখতে দেখিনি। আমার দেখা ভুল হতেও পারে।
কারখানা এলাকায় শ্রমিকদের দাবি নিয়ে দেওয়াল লেখা। বন্ধ করে রাখা কারখানার গায়ে কারখানা খোলার দাবি নিয়ে লেখা। আমি, বন্ধুদের সঙ্গে যৌবনে কারখানা এলাকায় গিয়েছি দেওয়াল লিখতে। আমাদের পাড়া থেকে তারাতলা হাইরোড ইন্ডাস্ট্রিয়াল বেল্ট বেশি দূরে নয়। যারা শ্রমিক আন্দোলনে ছিল, তারা চেনাজানা। আমরা লিখতাম, মজদুরদের লেখা শেখাতাম। পারিশ্রমিক যতবার চাওয়া চা, লাল সুতো বিড়ি, কাজ শেষ হলে আলুর দম, পাউরুটি।
মজদুররা শিখে গেলে আমাদের ছুটি। সমস্যা ছিল ওরা চাইত ওদের সব দাবি লিখতে। অতটা দেওয়াল পাওয়া মুশকিল। কারখানার দেওয়াল এবড়োখেবড়ো, খরখরে, নোংরা, শ্যাওলা। তাকে লেখার মতো করা বহুত মেহনত।
বন্ধ কারখানা মালিকরা খোলেনি, সরকার খোলায়নি। দেওয়ালে লেখা অক্ষর হালকা হতে হতে মুছে গেছে। কারখানা খোলার দাবি নিয়ে মজদুর লড়াইয়ের মতোই।
দেওয়াল লেখা তো ইতিহাসের পাতা।
আজ যারা শাসন ক্ষমতায়, বড় বড় দেওয়াল তাদের দখলে। কাল তারা না থাকলে, তাদের অক্ষর মুছে যায়। আজ যারা নতুন ক্ষমতায় এল, বড় দেওয়াল তাদের দখলে। বড় রাস্তার বড় দেওয়াল। আগের বড়রা এখন, ছোটরা ছোট দেওয়ালে। তারা এখন ছোট রাস্তা, গলিপথের দেওয়ালে।
নানা সময়ের দেওয়াল লেখার আলোকচিত্র সাজালে শাসকদের রাজনৈতিক ইতিহাসের একটা বই বানিয়ে ফেলা যায়। দেওয়াল লেখা শাসনের রাজনৈতিক ইতিহাসের উপাদান।
কোনও একটা পাড়ার বা এলাকার সামজিক ইতিহাসের উপাদানও দেওয়াল লেখা, যার কথা এই লেখাটার প্রথম দিকে বলেছি।
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
পড়ুন প্রথম পর্ব: লেখার দেওয়াল সবসময় তৈরি থাকে না, তৈরি করে নিতে হয়
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
পাড়ার দেওয়াল লেখা দেখে যেমন পাড়াকে বোঝা যায়, পাড়ার বাইরে বড় রাস্তার বড় দেওয়াল লেখা দেখে তেমন রাজনীতি বোঝা যায়।
ছোট জায়গা পাড়ার মোড়, মেজ জায়গা হাজরা পার্ক, বড় জায়গা শহীদ মিনার, আরও বড় জায়গা ব্রিগেড। দেওয়ালে লেখা জমায়েতের জায়গা পড়ে বুঝে নেওয়া যায় কোন পার্টির এখন কতটা ক্ষমতা। লাল পার্টির দেওয়াল লেখায় বাড়তি পাওয়া লাল পতাকা। মিছিল আঁকা, লাল পার্টির রাজনীতি অন্তর্জাতিক। দেওয়াল লেখায় চলে আসে দেওয়াল ছবি। আন্তর্জাতিক নেতাদের ছবি, কথা, উদ্ধৃতি।
দেওয়ালে অক্ষর লেখার থেকে শক্ত কাজ দেওয়ালে ছবি আঁকা। দেওয়াল শিল্পী হতে হয়।
দেওয়াল লেখা হয়েছে জেলখানার ভিতরেও। সাতের দশকে যাদের বন্দি করে রাখা হয়েছিল, তারাও দেওয়াল লিখেছে।
জেলখানার কুঠরির দেওয়ালে কয়লা ঘষে ঘষে পাওয়া কালো রং, গাছের পাতা ঘষে ঘষে অন্য রং এভাবেই।
জেলখানায় নানা রাজনৈতিক অনুষ্ঠান, যেমন মে ডে, সেদিন জড়ো হওয়া, জেল পুলিশের গুলিতে কোনও জেলবন্দি কমরেড মারা গেলে তাঁকে মনে রেখে জড়ো হওয়া। দেওয়ালে তাঁর নামের আগে ‘কমরেড’ নামের পরে ‘আমরা তোমায় ভুলছি না ভুলবো না’।
সত্তরের দেওয়াল লেখা অন্যরকম। কোনও কমরেড পুলিশের গুলিতে মারা গেলে থানা থেকে এসে বলে যেত কোনও মর্গের নাম করে সেখান থেকে নিয়ে যেতে। শ্মশানে তাঁকে দাহ করে নিতে যাওয়া চিতায় পড়ে থাকা কাঠকয়লা দিয়ে শ্মশানে রোদ-বৃষ্টিতে দাঁড়ানোর ঘরের দেওয়ালে লেখা ‘তোমায় আমরা ভুলছি না, ভুলবো না’। পরে শ্মশানে গিয়ে খুঁজেছি।
কখনও চাপা পড়ে যাওয়া একটা-দুটো অক্ষর, কখনও সবটাই হারিয়ে যাওয়া। দেওয়াল লেখার অক্ষররাও হারিয়ে যায়, চাপা পড়ে যায়।
দেওয়াল লেখার দেওয়াল চাইলেই পাওয়া যাবে, তার কোনও নিশ্চয়তা নেই। বাড়ির মালিক চায় না তার দেওয়াল লিখে নষ্ট করে দেওয়া হোক। তবে ভিতু মালিক আর মস্তান পার্ট কর্মী হলে তো কোনও উপায় নেই।
উপায় অন্য ভাবে এসেছে। দেওয়াল বানাও খাঁজ খাঁজ করে, এই উপরে উঠল, এই নিচে নামল। এই দেওয়ালে লেখা যাবে না। দেওয়াল মাঝারি সাইজের গোল গোল পাথর, বড় স্টোন চিপ বসিয়ে দাও। দেওয়ালে লেখা যাবে না। দেওয়ালের গায়ে ঠাকুর দেবতার ছবি আঁকা সেরামিক টাইল বসিয়ে দাও। দেওয়াল আঁকা যাবে না।
যতই দেওয়াল লেখার দেওয়াল বন্ধ করে দেওয়া, ততই লেখার নতুন দেওয়াল খাঁজ বের করা। আবিষ্কার। রেল স্টেশনের প্ল্যাটফর্মের নিচের জায়গাটা, ট্রেন এলে দেখা যাবে না, ট্রেন চলে গেলে দেখা যাবে, পড়া যাবে। রেলের ওয়াগনের গায়ে, চলমান দেওয়াল, দোকানের সাটার। দোকান বন্ধ থাকলে দেখা, তাই সই, খোলা থাকলে না-দেখতে পাওয়া।
দেওয়াল লেখা এক পলিটিকাল প্রোগ্রাম। কখনও জানা জায়গায়, কখনও অজানা জায়গায়। খোঁজা, খুঁজতে থাকা অনন্ত, অনন্তর। পলিটিকাল অ্যাকশন।
দেওয়াল পাওয়া গেলেই দেওয়াল দখল। দখলের চিহ্ন হয় একটা দেওয়ালের ওপর থেকে নিচে নামার সময় একটা মাথা নামানো তীর চিহ্ন আঁকা , আবার ডানদিকে বাঁদিকে যতটা পাওয়া যায় তার শেষে একটা শোয়ানো তীর চিহ্ন । লেখা ‘রিজার্ভড ফর’ একটা পার্টির শর্টকাট নাম। তারপর কত বছরের জন্য রিজার্ভড, মানে দখলদারি সেটাও বসিয়ে দেওয়া ‘আপটু’ লিখে তারপর বছরটা বসিয়ে দেওয়া।
সময় লেখা থাকলেই যে অন্য দল মানবে তার কোনও মানে নেই। কোনও দলের কোনও এলাকায় ক্ষমতা কমে গেলে, রিজার্ভড দেওয়ালের দখল একদল থেকে অন্য দলের হাতে চলে যাবে। দেওয়াল ক্ষমতা বদলের চিহ্ন।
দেওয়াল নির্বাচন বেশ ভেবেচিন্তে করতে হয়। যে রাস্তা দিয়ে সবচেয়ে বেশি লোকজন যায়। বাজার যাওয়ার পথ, স্কুলে যাওয়ার রাস্তা, স্টেশনে ঢোকা, স্টেশন থেকে বেরনোর পথ, সিনেমা হলের পাশের দেওয়াল, রিকশা স্ট্যান্ডের পাশের জায়গা– এসব দখল করে নেয় ক্ষমতায় থাকা দল।
বিরোধী দলের জন্য পড়ে থাকে গলিপথ, ছোট রাস্তা, বড়দের নজরে না পড়া জায়গা। গেরিলা ওয়ারফেয়ার।
দেওয়াল লেখার দেওয়াল খোঁজা এটা পলিটিকাল প্রোগ্রাম। রাজনীতিক ক্ষমতার বিরুদ্ধে রাজনৈতিক অন্তর্ঘাত।
দেওয়াল লেখা আপদমস্তক একটি রাজনৈতিক বিষয়।