দামিনী ও তিতাস, দু’জনেই নিঃসংকোচে জানিয়েছেন, কোন সংকোচে তাঁরা এতদিন এই নোংরা সত্যটাকে প্রকাশ্যে আনতে পারেননি। সমাজ, পরিবার, থিয়েটার– তিনক্ষেত্রেই অস্তিত্বের (সঙ্গে সঙ্গে তাঁদের একেবারেই জীবন-জীবিকার) আত্যন্তিক চাহিদা, অধিকার ও চাপের নিত্যনৈমিত্তিক বাধায় তাঁদের এতদিন গোপন রাখতে হয়েছে তাঁদের প্রতারণার বৃত্তান্ত। লজ্জা পিছিয়ে দিয়েছে তাঁদের। অথচ লজ্জা যাঁদের পাওয়ার কথা, তাঁরা নির্লজ্জ আত্মপ্রত্যয়ে (প্রতারিতাদের লজ্জায় গোপনীয়তা রক্ষার ভরসাতেই) দাপিয়ে বেড়িয়েছেন, সমাজে, পরিবারে, থিয়েটারে সম্মান-সম্ভ্রম ভোগ করে গেছেন।
প্রথমে দামিনী, তারপর তিতাস, তারপর অরুন্ধতী (তিনজনই বয়সে আমার চেয়ে অনেকটা ছোট হলেও তিনজনকে আমি শ্রদ্ধা করি– হ্যাঁ, শ্রদ্ধাই করি, প্রথম দু’জনকে তাঁদের নাট্যকৃতির সম্পদের গুণে, আর তৃতীয় জনকে জাতীয় স্তরে নাট্যচর্চা ও নাট্যপ্রসারে তাঁর অঙ্গীকারবদ্ধ শুশ্রূষার কারণে)– তিনজনের বয়ানে বাংলা থিয়েটারে দীর্ঘ পরম্পরাগত একটি দুরাচার এই প্রথম নথিবদ্ধ হল, চিহ্নিত হল বাংলা থিয়েটারের ইতিহাসে।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………..
পড়ুন দামিনী বেণী বসু-র লেখা: তোমার শেখানো পথেই প্রশ্ন করছি, প্রতিবাদ করছি, তোমার তো খুশি হওয়া উচিত লালদা
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
এই তিনজনের বয়ানের গুরুত্ব যেমন ঐতিহাসিক, তেমনই ভবিষ্যতের পক্ষে এক সতর্কতা-দ্যোতক প্রখর প্রতিবাদী হুঁশিয়ারি। তিনজনকে অভিনন্দন জানাই এই সাহসী পদক্ষেপের জন্য। দরকার ছিল এই সাহসের। দামিনী ও তিতাস– দু’জনেই নিঃসংকোচে জানিয়েছেন, কোন সংকোচে তাঁরা এতদিন এই নোংরা সত্যটাকে প্রকাশ্যে আনতে পারেননি। সমাজ, পরিবার, থিয়েটার– তিনক্ষেত্রেই অস্তিত্বের (সঙ্গে সঙ্গে তাঁদের একেবারেই জীবন-জীবিকার) আত্যন্তিক চাহিদা, অধিকার ও চাপের নিত্যনৈমিত্তিক বাধায় তাঁদের এতদিন গোপন রাখতে হয়েছে তাঁদের প্রতারণার বৃত্তান্ত। লজ্জা পিছিয়ে দিয়েছে তাঁদের। অথচ লজ্জা যাঁদের পাওয়ার কথা, তাঁরা নির্লজ্জ আত্মপ্রত্যয়ে (প্রতারিতাদের লজ্জায় গোপনীয়তা রক্ষার ভরসাতেই) দাপিয়ে বেড়িয়েছেন, সমাজে, পরিবারে, থিয়েটারে সম্মান-সম্ভ্রম ভোগ করে গিয়েছেন।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………..
পড়ুন তিতাস সমূহ-র লেখা: যৌন হেনস্তার প্রতি উদাসীনতা, অমনোযোগ ক্ষমতার ‘পুরুষোচিত ঔদ্ধত্যই’
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
বাংলা থিয়েটারের সঙ্গে আমার গত ৬৫ বছরের ঘনিষ্ঠতা ও আদানপ্রদানের সূত্রে অভিনেত্রী বন্ধুদের কাছে তাঁদের এমনই প্রতারণা ও ‘অপব্যবহার’-এর বৃত্তান্ত শুনেছি। তাঁরা যাঁদের অভিযুক্ত করেছেন, তাঁদের আমি চিনি। অভিযোগকারিণীরা চাননি, তাঁদের নিজেদের ও তাঁদের প্রতারকদের পরিচয় প্রকাশ্যে আসুক (যার কারণ, দামিনী ও তিতাসের বয়ানেই পূর্বোক্ত)। এমন ক্ষেত্রে আমাদের কী করণীয় ছিল, তার দাবি দামিনী ও তিতাসের কাছে শুনতে আমি অন্তত প্রস্তুত, ও সাধ্য হলে তা পূরণ করতে প্রস্তুত। প্রসঙ্গত, একথাও আজ নথিবদ্ধ থাক, এমন অনেক ক্ষেত্রে অভিনেত্রীদের স্বামীরাও এই প্রতারণায় অভিযুক্ত। অন্তত একটি ক্ষেত্রে আমি জানি, অভিনেত্রীর কন্যা– তিনি নিজেও অভিনেত্রী– তাঁর মায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছেন, আচরণে, লিখিত বয়ানে। স্বভাবতই যশোবান নির্দেশক-অভিনেতা পিতার যশোচ্ছটায় স্নাত হয়ে প্রাপ্যাতীত স্বীকৃতির স্বার্থে।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
নেশায় বিভোর গিরিশচন্দ্র, খানিকক্ষণ ঘুমিয়ে নেশা কাটতে আরও মদের হুকুম দিলে, গভীর রাতে বিনোদিনীকে বাড়ি থেকে বেরিয়ে ‘খারাপ’ পাড়ার মদের দোকান খুলিয়ে ‘যুগল ইয়ার’– গিরিশচন্দ্র-অমৃতলালের জন্য আরও মদ সংগ্রহ করে আনতে হয়! তারপর বিনোদিনীর ‘আমার কথা’-র ভূমিকায় গিরিশচন্দ্র অসভ্যতার চূড়ান্ত। যখন তিনি বিনোদিনীকে তিরস্কার করেন ‘গুরুদেব’-এর অধিকারে– তাঁর ‘নীচকুলোদ্ভবা’ কন্যাকে স্কুলে ভর্তি করতে না পেরে সমাজের উপরিস্থিত সম্ভ্রান্ত নাট্যামোদীদের সাহায্য চেয়ে হতাশ হয়ে তাঁদের প্রতি বিনোদিনীর ‘কটাক্ষ’-এর অপরাধে।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
আন্তর্জাতিক নারীবাদী আন্দোলনের জোয়ারে ‘মি টু’ (‘আমাকেও’) বলে, প্রতারণা ও বঞ্চনার বয়ান লজ্জা-সংকোচের প্রাচীর ভেঙে প্রকাশ্যে আনার টানেই বাংলা থিয়েটারে এই অর্গল মুক্তি ঘটল। নয়তো চলতেই থাকত ওই ইতর-পরম্পরা, যাতে অভিনেত্রী বিনোদিনীর নাম প্রকাশ্যে এনেই অমৃতলাল বসু লিখতে পারেন:
‘আমি আর গুরুদেব যুগল ইয়ার
বিনির বাড়িতে যাই খাইতে বিয়ার।’
তারপর কী অপরিসীম কৌতুকী-পরিহাসে তিনি বিনোদিনীকে চিহ্নিত করতে পারেন মাতাল পুরুষ-কর্তাদের নির্দেশপালনে বাধ্য সেবাদাসী রূপে! নেশায় বিভোর গিরিশচন্দ্র, খানিকক্ষণ ঘুমিয়ে নেশা কাটতে আরও মদের হুকুম দিলে, গভীর রাতে বিনোদিনীকে বাড়ি থেকে বেরিয়ে ‘খারাপ’ পাড়ার মদের দোকান খুলিয়ে ‘যুগল ইয়ার’– গিরিশচন্দ্র-অমৃতলালের জন্য আরও মদ সংগ্রহ করে আনতে হয়! তারপর বিনোদিনীর ‘আমার কথা’-র ভূমিকায় গিরিশচন্দ্রের চূড়ান্ত অসভ্যতা, যখন তিনি বিনোদিনীকে তিরস্কার করেন ‘গুরুদেব’-এর অধিকারে– তাঁর ‘নীচকুলোদ্ভবা’ কন্যাকে স্কুলে ভর্তি করতে না পেরে সমাজের উপরিস্থিত সম্ভ্রান্ত নাট্যামোদীদের সাহায্য চেয়ে হতাশ হয়ে তাঁদের প্রতি বিনোদিনীর ‘কটাক্ষ’-এর অপরাধে। গিরিশচন্দ্র সংশোধিত ‘আমার কথা’-র সূচনাতেই বিনোদিনী নিজেকে ‘পাপিষ্ঠা’ বলে বর্ণনা করে পাঠকদের ‘সহানুভূতি’ প্রার্থিনী। ভূমিকায় গিরিশচন্দ্রের শাসানি, ভদ্দরলোক পুরুষকুলকে ‘কটাক্ষ’ করলে সেই ‘সহানুভূতি’ তাঁর জুটবে না। বিনোদিনীর জীবন নিয়ে বাংলায় যাত্রা-থিয়েটারের আদিখ্যেতার দীর্ঘ-বিহারে চোরা ইতিহাস তথা প্রণোদনা (এ বিষয়ে যে ক’টি নাটক বা পালা লিখিত হয়েছে, তার মধ্যেও অন্তঃসলিলা) ওই ‘পাপিষ্ঠা’-র পাপজীবন স্বীকারে ‘সহানুভূতি’/‘সমবেদনা’র পুরুষালি উদারতা! সাধু ভাষায় রচিত ‘আমার কথা’-র দুই দশক পর নিজস্ব স্বচ্ছন্দ চলিত ভাষায় লিখিত ‘আমার অভিনেত্রী জীবন’-এ কোনও পাপস্বীকারের আত্ম অবমাননা নেই, বরং সোচ্চার হয়ে ওঠে, ‘আমার’ এবং ‘অভিনেত্রী’ সত্তার সদর্প ঘোষণা। কোনও নাট্যকার-নির্দেশকই বিনোদিনীর দৈত বয়ানের এই নাটকীয় দ্বন্দ্বকে তুলে ধরার স্পর্ধা দেখাননি।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
আরও পড়ুন: সেদিনের মতো আজও বিনোদিনীদেরই প্রশ্ন করা হয়
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
সত্যের উদঘাটনের পথে এই দ্বন্দ্ব-অন্তরায়ের মধ্যে যেটুকু আমার সাধ্য ছিল, গত ৪০ বছর ধরে আমি ‘থীমা’ নামে যে ক্ষীণশক্তিধর প্রকাশনা সংস্থার অঙ্গী, তার উদ্যোগে আমরা প্রকাশ করে চলেছি ‘অভিনেত্রী আখ্যান’ নামে একগ্রন্থমালা: শোভা সেনকে দিয়ে লিখিয়েছি ‘ওঁরা, আমরা, এরা’ (তাঁর পূর্বজ, সমপ্রজন্মান্তর্গত ও তরুণতর অভিনেত্রীদের সাক্ষাৎকারভিত্তিক আত্মকথন), বন্ধু রুশতী সেনকে দিয়ে লিখিয়েছি মায়া ঘোষের সঙ্গে আলাপচারিতা ও গবেষণানির্ভর ‘মায়া ঘোষ: মঞ্চই জীবন’, রেবা রায়চৌধুরীর আত্মজীবনী ‘জীবনের টানে শিল্পের টানে’, দীর্ঘ আলাপচারিতায় তাঁরই নিজের বয়ানে গ্রন্থনা করেছি ‘কেতকী দত্ত: নিজের কথায়, টুকরো লেখায়’, সংকলন-সম্পাদনা করেছি ‘বিনতা রায়ের বিবিধ রচনা’। কাজ চলছে আরও প্রকাশনার, এই প্রকল্পে। সামান্যই হয়তো মূল্য বা অভিঘাত এই প্রয়াসের। তবুও!
এইসব অক্ষম প্রয়াসে কোনও দিনই ছুঁতে পারব না ‘বহুরূপী’-র ‘রক্তকরবী’-র সেই মুহূর্ত, যেখানে স্বজীবনের যাবতীয় বঞ্চনা-বেদনার অভিমান ঠেলে রোমাঞ্চকর ভারঋদ্ধ-স্বরে নন্দিনী-রূপিণী তৃপ্তি মিত্রের সেই উচ্চারণ, সর্দারের উদ্দেশে:
‘আমি নারী বলে আমারে ভয় করো না। বিদ্যুৎশিখার হাত দিয়ে ইন্দ্র তাঁর বজ্র পাঠিয়ে দেন। আমি সেই বজ্র বয়ে এনেছি, ভাঙবে তোমার সর্দারির সোনার চূড়া।’
তৃপ্তিদির নিজের কথার স্মৃতির আবেশেই বলতে পারি, তাঁর সেই মঞ্চোচ্চারণে ছিল দামিনী-তিতাসের ক্রুদ্ধ আবেগ, অন্তরগভীরে সঞ্চিত।
এ ব্যাপারে লক্ষ্মীনাথ বেজবরুয়া রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে তর্ক করেছিলেন। ১৯১০-এ লক্ষ্মীনাথের সম্পাদনায় প্রকাশিত হয়েছিল ‘বাঁহী’ পত্রিকা। এই পত্রিকায় লক্ষ্মীনাথ অসমিয়া ভাষা-সংস্কৃতির নিজত্বকে যুক্তিনিষ্ঠভাবে প্রকাশ করেছিলেন।