বাজারে জনপ্রিয় বোর্নভিটাতে চিনির পরিমাণ বেশি, এবং সেই কারণে তা কোনও মতেই স্বাস্থ্যকর হতে পারে না, এমন একটা অভিযোগ আগেই উঠেছিল, খানিক হইচই হয়েছিল সোশাল মিডিয়ায়, মামলা অবধি গড়িয়েছিল ব্যাপার! অনলাইনে কেনাকাটা করতে গেলেই কমার্সের সংস্থাগুলোর সাইটে ‘হেলথ ড্রিংক’ তালিকাভুক্ত অনেক ড্রিংক থাকে, যা দেখে অনেকেই ঝপাঝপ কিনে ফেলেন সেইসব পানীয়। কিন্তু মজার কথা, ২০০৬-র খাদ্য সুরক্ষা বিধিতে হেলথ ড্রিংক বলে কোনও শ্রেণির উল্লেখই নেই। তাই সম্প্রতি একটি সার্কুলারে কেন্দ্র নির্দেশ দিয়েছে ওই ‘হেলথ ড্রিংক’-এর তকমা থেকে সব পানীয়কেই সরাতে হবে, ক্রেতাদের এইভাবে ধোঁকা দেওয়া চলবে না।
‘সাচ বোলে তো মারে লাটঠা, ঝুটা পে জগৎ ভুলায়ে
গলি গলি মে গয়লা ফিরে, মদিরা বৈঠে বিকায়ে’
‘মনোজদের অদ্ভুত বাড়ি’-তে মনোজ প্রায়ই অ্যালবাম খুলে একটা বিশেষ ছবি দেখত। একটা ছেলে সিঁড়িতে বসে আছে ছবির পোজ দিয়ে, পাশে একটা দুধের গেলাস। ছেলেটার অন্যমনস্কতার সুযোগ নিয়ে একটা বেড়াল এসে দুধ খেয়ে নিচ্ছে। কাহিনির শেষে দেখা গেল, সে ছেলে এক রাজকুমার। তবে রাজার ছেলেই হোক, কি সাধারণ প্রজার– দুধের গেলাস ছিল একদা সবারই বেড়ে ওঠার সঙ্গী। খোকাবাবু আর খুকুমণিরা মাঠ থেকে ক্ষিপ্ত হয়ে ফিরে তপ্ত দুধ খেত– এ খুব বেশিদিনের কথা নয়। কিন্তু ছবিটা কেমন বদলে গেল!
স্বাধীনতার পরপরই ভারতের শিশুদের শরীরের অপুষ্টির বিষয়টি মূল্ধন করে এ দেশে বার্লি-ভিত্তিক পানীয়ের রমরমা শুরু। অনেক জায়গায় দুধ জোটে না শিশুদের, তাই দুধের ‘বিকল্প পানীয়’ বাজার দখল করতে শুরু করল। ক্রমে দুধ খাওয়াটা আর আদৌ ‘ইন থিং’ রইল না। এল নানা স্বাদের এবং গন্ধের হেলথ ড্রিংক, তাদের বাজার ধরার যুদ্ধে উলুখাগড়া মায়েরা উঠে এলেন বিজ্ঞাপনের মুখ হিসেবে। বিজ্ঞাপনে তাঁদের বিনিদ্র রাত কাটাতে দেখা গেল যে এলেবেলে পানীয় খাওয়াচ্ছেন, বাচ্চা কি আদৌ তাতে পুষ্টি পাচ্ছে, এই দুশ্চিন্তায়!
…………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
নাইফ। সলমন রুশদি। পাঠপ্রতিক্রিয়া: টাইগার পতৌদির ক্রিকেটই ছিল একচোখের দৃষ্টি হারানো বিষণ্ণ রুশদির অনুপ্রেরণা
…………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
‘আপনার শিশুর চাই দুধের সমান পুষ্টি তাই খাওয়ান…’
‘আপনার শিশুর চাই এত এত প্রয়োজনীয় খাদ্যগুণ…’
টিং টিটিং টিং
শুধু ব্র্যান্ডেড পোশাক বা জুতো নয়, কে কোন হেলথ ড্রিংক খায়, তাও কখনওসখনও হয়ে উঠল স্মার্টনেসের অভিজ্ঞান! ‘তীক্ষ্ণ বুদ্ধি পেতে গেলে, ফার্স্ট হতে গেলে, লম্বা হতে গেলে, মস্তিষ্ক, হাড়, পেশির বিকাশে, জীবন যুদ্ধে এগিয়ে থাকতে গেলে’ এইসব খেতে হয়। আর যারা এগুলো খায় না বা খেতে পায় না– তাদের একটা পিছড়ে বর্গ তৈরি হয়ে গেল অজান্তেই। যাকে বলা যায়, ‘হেলথ ড্রিংক পুওর’ আর ‘হেলথ ড্রিংক রিচ ক্লাস’। কে আর জানতে চায়,
‘গরীব মানুষ,
তোমার কি খিদে পায়, কত ক্যালরির খিদে পায়,
খিদে পেলে তোমার কি খুব কষ্ট হয় ?
তোমার কি ছেলেমেয়ে আছে ?
তাদের জননী কি তোমার সমান ভাত খায় ,
সমান ক্যালরির?’
(তারাপদ রায়)
যেসব মায়েরা আগে ‘বাচ্চার পাতে একটু দুধ দিতে পারি না’ বলে মনোকষ্টে ভুগতেন, তাঁদের অধুনা সংস্করণরা, যে কোনও মূল্যে বাজারচলতি ড্রিংকটি ঘরে আনবেনই আনবেন, কারণ এটি দুধের মতো নিছক পুষ্টিকর পানীয় নয়, এটি সামাজিক ইজ্জতের সওয়াল, বাচ্চার পুষ্টির সঙ্গে যেমন কোনও আপস করা যায় না, তেমনই সামাজিক সম্মানের সঙ্গেও না। এটাও টিং টিটিং টিং।
কিন্তু এই হেলথ ড্রিংক সত্যিই কতটা হেলদি? বাজারে জনপ্রিয় বোর্নভিটাতে চিনির পরিমাণ বেশি, এবং সেই কারণে তা কোনও মতেই স্বাস্থ্যকর হতে পারে না, এমন একটা অভিযোগ আগেই উঠেছিল, খানিক হইচই হয়েছিল সোশাল মিডিয়ায়, মামলা অবধি গড়িয়েছিল ব্যাপার! অনলাইনে কেনাকাটা করতে গেলেই কমার্সের সংস্থাগুলোর সাইটে ‘হেলথ ড্রিংক’ তালিকাভুক্ত অনেক ড্রিংক থাকে, যা দেখে অনেকেই ঝপাঝপ কিনে ফেলেন সেইসব পানীয়। কিন্তু মজার কথা, ২০০৬-র খাদ্য সুরক্ষা বিধিতে হেলথ ড্রিংক বলে কোনও শ্রেণির উল্লেখই নেই। তাই সম্প্রতি একটি সার্কুলারে কেন্দ্র নির্দেশ দিয়েছে ওই ‘হেলথ ড্রিংক’-এর তকমা থেকে সব পানীয়কেই সরাতে হবে, ক্রেতাদের এইভাবে ধোঁকা দেওয়া চলবে না।
…………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
যেসব মায়েরা আগে ‘বাচ্চার পাতে একটু দুধ দিতে পারি না’ বলে মনোকষ্টে ভুগতেন, তাঁদের অধুনা সংস্করণরা, যে কোনও মূল্যে বাজারচলতি ড্রিংকটি ঘরে আনবেনই আনবেন, কারণ এটি দুধের মতো নিছক পুষ্টিকর পানীয় নয়, এটি সামাজিক ইজ্জতের সওয়াল, বাচ্চার পুষ্টির সঙ্গে যেমন কোনও আপস করা যায় না, তেমনই সামাজিক সম্মানের সঙ্গেও না। এটাও টিং টিটিং টিং।
…………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
বেশিরভাগ হেলথ ড্রিংকের বিজ্ঞাপনেই লেখা থাকে বার্লি থেকে এই ধরনের খাবার প্রস্তুত করা হয়, কিন্তু হিডন ক্লজের মতো চিনি যে প্রচুর থাকে, সেটা কোথাও বলা থাকে না। সত্যিই কি দুধের পুষ্টিগুণ থাকে এইসব হেলথ ড্রিংকে? নাকি স্রেফ এনার্জি বাড়ানোর জন্য মাত্রাতিরিক্ত চিনি অর্থাৎ গ্লুকোজে ঠাসা থাকে এইসব হেলথ ড্রিংক? গবেষণা বলছে, এই সমস্ত বাজারজাত হেলথ ড্রিংক কিন্তু শরীরের জন্য হয়ে উঠতে পারে মারাত্মক!
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, WHO জানিয়েছে, ২ হাজার ক্যালোরিযুক্ত খাদ্যে ১০০ ক্যালোরি (৫ শতাংশ) চিনি খাওয়া স্বাস্থ্যসম্মত। এক গ্রাম চিনি চার ক্যালোরি সরবরাহ করে। অন্যদিকে বিভিন্ন হেলথ ড্রিংক কোম্পানিগুলির প্রোডাক্টে দেখা যাবে, কোনওটায় ৪ গ্রাম চিনিতে ৩২ ক্যালোরি আসছে, কোনওটায় ২০ গ্রামে ৪০ ক্যালোরি বা ১৭ ক্যালোরি। অর্থাৎ বিপদসীমার অনেক ওপরে চিনি। এবং এগুলো কোনওভাবেই ‘দুধের পরিপূরক’ নয়। ২০০৬ সালে ‘নিউট্রিশন’ জার্নালের পাঁচটি গবেষণাপত্র জানাচ্ছে এই হেলথ ড্রিংকগুলি খাওয়াই উচিত নয়! তাছাড়া বেশ কিছু পানীয় তাদের লেবেলে প্রকৃত পুষ্টির তথ্য অনেক রং চড়িয়ে লেখে, যেটা দেখে বিভ্রান্ত হন ক্রেতারা।
সমান খারাপ এনার্জি ড্রিঙ্কও। এক বোতল এনার্জি ড্রিংকস পানের ২৪ ঘণ্টা পর রক্তচাপ বৃদ্ধি, ক্লান্ত অনুভব করা এবং কোষ্ঠকাঠিন্য– অন্তত এই তিনটি লক্ষণ প্রবলভাবে দেখা যাওয়ার সম্ভাবনা। এনার্জি ড্রিংকসে প্রচুর পরিমাণে চিনি থাকে, যা শরীরের জন্য ক্ষতিকর। পানীয়তে থাকা ফসফরিক অ্যাসিড ও কার্বনেট এই চিনিকে খানিক প্রশমিত করে ঠিকই, তবে বেশি মাত্রার অ্যাসিড ও কার্বনেটও শরীরের জন্য ক্ষতিকর। সাঁ সাঁ শব্দ করে খোলা পানীয়তে কার্বনেটেড এবং অতিরিক্ত অ্যাসিড ব্যবহার করা হয়, যা শরীরে সাময়িক চনমনে ভাব এনে দেয়। বিশ্বব্যাপী বিখ্যাত এনার্জি ড্রিংকস রেড বুলে ক্ষারের মাত্রা থাকে পিএইচ স্কেলে ৩ দশমিক ৩। এত ক্ষার দাঁতের এনামেল গলিয়ে ফেলে দাঁতের স্থায়ী ক্ষতি করে দেয়।
কিন্তু এই হেলথ ড্রিংক আর এনার্জি ড্রিংকের বাজারের জাল পৃথিবী জুড়ে এমনভাবে বিছানো, আর এত শক্তিশালী এদের নেটওয়ার্ক, যে, মানুষ নিজে বুঝে সরে না এলে, সরকারি সার্কুলারে এদের কেশাগ্র স্পর্শ করা যাবে কি? অথচ আমাদের হাতের কাছেই আছে বিকল্প পথ। চুপচাপ ছাতুর শরবত খেয়ে স্কুলে যাচ্ছে কত শিশু, যা আমাদের দেশের আবহাওয়ায় আদর্শ ও স্বল্প মূল্যের হেলথ ড্রিংক। আর কত কত মা চায়ে আফিম মিশিয়ে বাচ্চাদের খাইয়ে কাজে বেরিয়ে যাচ্ছে? এরা একদিন এসে বলতে পারে ওসব হেলথ ড্রিংক-টিংক বুঝি না, ‘ভাত দে হারামজাদা, তা না হলে মানচিত্র খাব’। (রফিক আজাদ)