একটি সুপরিচিত সাংবাদিক সংস্থাকে কি এত সহজে ‘সন্ত্রাসবাদী’ হিসেবে দাগিয়ে দেওয়া যায়? এখানেই যৌথ প্রয়াসে সরকারি মিডিয়ার ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। তারা কিন্তু ইতিমধ্যেই জোরগলায় ট্রায়াল শুরু করে দিয়েছে। জানিয়েছে, চিনের থেকে টাকা নিয়ে চিনের হয়ে প্রচার চালিয়েছে নিউজক্লিক। কীভাবে? কোন খবরের মাধ্যমে? নিউজক্লিকের সব সংবাদ তো জনসমক্ষে আছে। যদি তারা চিনের দালালই হয়, তবে পুলিশ তাদের সরকারবিরোধী রিপোর্ট, দিল্লি দাঙ্গার ওপর করা রিপোর্ট, কৃষক আন্দোলনের সময়কার রিপোর্ট নিয়ে হেনস্তা করল কেন?
৩ অক্টোবর ভোরবেলা দিল্লির বেশ কিছু বাড়িতে হানা দেয় দিল্লি পুলিশের স্পেশাল সেল। যাঁদের বাড়িতে হানা দেওয়া হয়, তাঁরা সকলেই ‘নিউজক্লিক’ নামক সংবাদসংস্থার সঙ্গে যুক্ত সাংবাদিক বা টেকনিক্যাল স্টাফ। এঁরা প্রত্যেকেই যে নিউজক্লিকের নিয়মিত কর্মী, তা নয়। কেউ হয়তো ফ্রিলান্সার, কেউ কন্সালট্যান্ট, কেউ কোনও এককালে কলাম লিখতেন, কেউ বহু আগে ভিডিও শো করতেন, ইত্যাদি। প্রায় ৫০ জন সাংবাদিক, স্টাফ এবং অন্যান্য মানুষ হেনস্তা হলেন দিনভর। দিনের শেষে তাঁদের প্রত্যেকের মোবাইল (বেশ কিছু ক্ষেত্রে বাড়ির লোকের মোবাইল), ল্যাপটপ সব বাজেয়াপ্ত হল। আপাতত অন্যরা ছাড়া পেলেও, নিউজক্লিকের ফাউন্ডার এডিটর প্রবীর পুরকায়স্থ এবং এইচ.আর. হেড অমিত চক্রবর্তী গ্রেপ্তার হলেন, দেশের সবচেয়ে বজ্রকঠিন আইন ইউএপিএ-র আওতায়।
সাংবাদিকের গ্রেপ্তার, তাও আবার দেশের সবচেয়ে ভয়ংকর সন্ত্রাসবাদ-বিরোধী আইনের সাহায্যে! প্রতিবাদের ঝড় ওঠার কথা ছিল হয়তো সাংবাদিক এবং নাগরিক মহলে। কিন্তু কিছু ক্ষীণ প্রতিবাদের সঙ্গে আমরা দুটো জিনিস দেখলাম– এক, অস্বস্তিকর নিরবতা সকলের মাঝে এই গ্রেপ্তারি নিয়ে, আর অন্যদিকে সরকারি সংবাদমাধ্যমে (লোকপ্রিয় নাম গোদি মিডিয়া) উল্লাস এই রেইড, গ্রেপ্তারি এবং সংবাদমাধ্যমের ওপর সরাসরি হামলা নিয়ে! সোজা কথায় বলতে গেলে, গণতান্ত্রিক অধিকারের ওপর নির্মম ফ্যাসিবাদী হামলার আরও একটি যৌথ প্রয়াস সফল হল!
যৌথ কেন বলছি? কারণ বহুদিন ধরেই কেন্দ্র সরকার, গোয়েন্দা সংস্থা (পুলিশ/সিবিআই/ইডি) এবং মিডিয়ার একাংশ, একটি যৌথ উদ্যোগে সবরকমের বিরোধী স্বরের ওপর খুব সুচারুভাবে অভিযান চালাচ্ছে। এবং এদের মূল হাতিয়ার ইউএপিএ, দেশের সবচেয়ে কঠোর সন্ত্রাসবিরোধী আইন। এর আগে ঠিক এই একই যৌথ অভিযান দেখেছি আমরা মহারাষ্ট্রের ভীমা কোরেগাঁও কেসে আর দিল্লি দাঙ্গা বিরোধী কেসে!
যখন প্রবীর আর অমিত গ্রেপ্তার হন, তাঁদের কী কারণে গ্রেপ্তার করা হচ্ছে, সেটা জানায়নি পুলিশ, এমনকী, এফআইএর-এর কোনও কপি পর্যন্ত দেয়নি। আইপিসি অনুযায়ী তা বেআইনি হলেও, ইউএপিএ-তে সেই ছাড় রয়েছে। এবার প্রশ্ন হল, একটি সুপরিচিত সাংবাদিক সংস্থাকে কি এত সহজে ‘সন্ত্রাসবাদী’ হিসেবে দাগিয়ে দেওয়া যায়? এখানেই যৌথ প্রয়াসে সরকারি মিডিয়ার ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। তারা কিন্তু ইতিমধ্যেই জোরগলায় ট্রায়াল শুরু করে দিয়েছে। জানিয়েছে, চিনের থেকে টাকা নিয়ে চিনের হয়ে প্রচার চালিয়েছে নিউজক্লিক। কীভাবে? কোন খবরের মাধ্যমে? নিউজক্লিকের সব সংবাদ তো জনসমক্ষে আছে। যদি তারা চিনের দালালই হয়, তবে পুলিশ তাদের সরকারবিরোধী রিপোর্ট, দিল্লি দাঙ্গার ওপর করা রিপোর্ট, কৃষক আন্দোলনের সময়কার রিপোর্ট নিয়ে হেনস্তা করল কেন? এসব প্রশ্ন সরকারি মিডিয়া তোলে না। তারা শুধু চিৎকার করে গলা ফাটিয়ে পুলিশের দেওয়া তথ্যকে ‘সত্য এবং ঘটনা’ বলে চালাতে থাকে।
পাঁচ বছর ধরে চলা ভীমা কোরেগাঁও কেসে, বহু মানবাধিকার ও সাংস্কৃতিক কর্মী, উকিল এবং লেখক এখনও জেলেবন্দি। যখন ভীমা কোরেগাঁও-এর মামলা রজু করা হয়, এবং এক এক করে অরুণ ফেরেরা, ভারনন গঞ্জালভেস, সুধা ভরদ্বাজ, আনন্দ তেলতুম্বে এবং অনেকে গ্রেপ্তার হন ইউএপিএ-র আওতায়, তখনও আমরা দেখেছিলাম গোদি মিডিয়ার উল্লাস। বলা হয়েছিল, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে খুন করার এক বিরাট এবং বিশেষ ষড়যন্ত্রে লিপ্ত এই কর্মীরা। পুলিশ জানাল, কিছু চিঠি পাওয়া গেছে এই মর্মে। দু’দিন ধরে সেসব চিঠির কাঁটাছেঁড়া হল মিডিয়ায়। দেশবাসী আশ্বস্ত হল যে, বিরাট একটা সন্ত্রাসচক্রকে নিরস্ত করেছে পুলিশ। এক বছর পরে চার্জশিট দাখিল হলে দেখা হল সেসব চিঠির কোনও উল্লেখই নেই। এই কেসের বিচার শুরু হওয়ার কোনও প্রক্রিয়া শুরুই হয়নি এখনও। পাঁচ বছর কেস চলতে থাকার পর প্রমাণাভাবে একে একে জামিনে ছাড়া পাচ্ছেন একাধিক বছর জেলে কাটানো অভিযুক্তরা। তবে অনেকে এখনও বন্দি, ৮৪ বছরের জেসুইট পাদ্রি স্ট্যান স্বামী জেলের মধ্যেই মৃত্যু বরণ করেছেন বিনা বিচারে, বিনা চিকিৎসায়।
সেরকমই দিল্লি দাঙ্গার ইউএপিএ কেস। ২০২০ সালে দিল্লিতে ভয়ংকর দাঙ্গায় ৫৩ জন মানুষ প্রাণ হারান। তার ৩৬ জন মুসলমান, ১৫ জন হিন্দু, দু’জনের পরিচয় অজানা। দাঙ্গার পরে প্রায় ৭৫০ কেস দাখিল হয়, তার মধ্যে একটি, দাঙ্গার ষড়যন্ত্রের কেস হিসেবে দাখিল হয়, এবং ইউএপিএ-র আওতায় আসে। সেই কেসে বন্দি প্রায় সকলেই মুসলমান এবং তারা প্রত্যেকে দাঙ্গার আগে যে দেশজোড়া সিএএ/এনআরসি বিরোধী আন্দোলন চলেছিল, তাতে শামিল ছিল। পুলিশের বক্তব্য অনুযায়ী, যদিও এই দাঙ্গায় মুসলমানরাই বেশি আক্রান্ত, তাদের ঘর, দোকান, মসজিদ পুড়ে ছাই হয়ে গেছিল, তবুও এই দাঙ্গার প্ররোচনা সিএএ/এনআরসি বিরোধী শান্তিপূর্ণ আন্দোলনের কর্মীরাই দিয়েছে। কীভাবে? সেটা পুলিশ বহু বছর নিয়ে প্রমাণ করার চেষ্টা করবে, না পারলে সবাই একদিন ছাড়াও পেয়ে যাবে, কিন্তু অভিযুক্তদের জীবনের বহু বছর জেলের ভিতরেই কেটে যাবে। এই কেসের ক্ষেত্রেও আমরা দেখেছি, প্রতিবার চার্জশিট জমা করার পর, অভিযুক্তদের আগে মিডিয়া সে চার্জশিটের নাগাল পায়। এবং তারপর পুলিশের সামনে করা কিছু জবানবন্দির (যা আদালতে সাক্ষ্য প্রমাণ হিসেবে আদৌ গণ্য হয় না) তার ভিত্তিতে, সরকারি মিডিয়া উমর খালিদ, শার্জিল ইমাম, খালিদ সাইফি, গুলফিশাদের প্রতিবার অপরাধী ঘোষণা করে। টিভি স্ক্রিনে উল্লাস চলে। এই মিডিয়া ট্রায়াল চলতে থাকে, অথচ আসল ট্রায়াল, এই কেসেও তিন বছর হয়ে যাওয়ার পরেও শুরুই হয়নি।
অতএব, যদিও আমরা দেখছি, যে প্রবীর বা অমিতের বিরুদ্ধে তথাকথিত সাক্ষ্যপ্রমাণ বলে যা চালানো হচ্ছে, তা আদপে হাস্যকর, তাও আমরা জানি, যে ওদের সামনের আইনি লড়াইটি অতীব দীর্ঘ ও নিদারুণ। ইউএপিএ পুলিশকে সেই ছাড় দেয় কেসকে দীর্ঘায়িত করার। কমপক্ষে ছ’মাস নিতে পারে পুলিশ, শুধুমাত্র চার্জশিট দাখিল করতে। প্রথম থেকেই অত্যন্ত কঠোর আইন হলেও, বর্তমান সরকারের আমলে ইউএপিএ আরও ভয়ংকর হয়ে উঠেছে। প্রথমত, ২০১৯ সালে সরকার আইন পাশ করে জানায়, যে কোনও সন্ত্রাসবাদী সংগঠন বা নেটওয়ার্কের সঙ্গে যুক্ত না, এর’ম ব্যক্তিকেও ইউএপিএ-র আওতায় গ্রেপ্তার করা যাবে। (যা আগে হত না)। ফলে যে কোনও নাগরিককেই এখন সন্ত্রাসবাদী বলে গ্রেপ্তার করা যাবে! ইউএপিএ-তে কেস দাখিল করা হলে এটা ধরে নেওয়া হয় যে, অভিযুক্ত ব্যক্তি দেশের স্থিতিশীলতা, অখণ্ডতা এবং সার্বভৌমত্বকে ক্ষতি করেছে বা করার চেষ্টা করেছে বা করতে চেয়েছে। এবং সাধারণ আইপিসিতে কেউ গ্রেপ্তার হলে ধরে নেওয়া হয়, সে innocent until proven guilty. কিন্তু ইউএপিএ-তে সেই প্রতিষ্ঠিত ধারণাটি উলটে হয়ে যায় guilty until proven innocent! এবং ২০২০-তে জহুর আহমেদ শাহ ওয়াতালি-র কেসে সুপ্রিম কোর্ট জানায়, জামিন দেওয়ার সময় আদালত অভিযুক্তর বিরুদ্ধে আনা প্রমাণের সত্যতা যাচাই করবে না, সেটা বিচার শুরু হলে করা হবে। এর ফলে জামিন পাওয়া প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ে ইউএপিএ মামলায়।
বছরের পর বছর চলতে থাকে মামলা। এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রেই প্রমাণাভাবে ছাড়া পেয়ে যায় অভিযুক্তরা। এদেশে যত মানুষ ইউএপিএ-র আওতায় গ্রেপ্তার হয়েছে, তার মাত্র ২.৮% সাজা পেয়েছে। বাকিরা বহু বছর জেলে কাটিয়ে ছাড়া পেয়েছেন বা দেশের কোনও এক প্রান্তে, জেলের ভেতর বসে মুক্তির দিন গুনছেন।
প্রবীর বা অমিতের নাম সেই দীর্ঘ তালিকায় যুক্ত হল। প্রবীরের সত্তরোর্ধ্ব, অসুস্থতা বা অমিতের শারীরিক প্রতিবন্ধকতা, কিছুই গণ্য হবে না। যেমন হয়নি স্ট্যান স্বামী, ভারভারা রাও বা জি.এন. সাঁইবাবার সময়। মানবিকতার মূল্যগুলি আমাদের দেশে বহু আগেই ফিকে হয়ে গেছে। সমস্ত বিরোধীস্বর টিপে ধরে বন্ধ করার মারাত্মক প্রয়াস চলছে নিরলস। টিভি স্ক্রিনে চিৎকার করে এ অন্যায়ের সমর্থন করার লোকের অভাব নেই। প্রতিটা এরকম অনৈতিক গ্রেপ্তারির সঙ্গে সঙ্গে আরও একবার ক্ষয়ে যায় গণতন্ত্র। শক্ত হয় ফ্যাসিবাদের ভিত্তি। অথচ এই জল্লাদের উল্লাসমঞ্চই এখন আমাদের দেশ।