সম্প্রতি আলিয়া ভাট খোলাখুলিই বলেছেন, মেয়ে রাহার জন্মের পর তাঁর জীবনে ‘মি-টাইম’ বলতে আর কিছু নেই। না, এই না-থাকা নিয়ে তাঁর বিশেষ আক্ষেপ রয়েছে এমনটা নয়। তবু নেই যে, এ কথাও তো সত্যি। সেই সত্যিকে সব মায়েরাই জানেন, সে তিনি গৃহবধূ হোন কি দশটা-পাঁচটার চাকরিজীবী কিংবা এমার্জেন্সি ডিউটির সঙ্গে যুক্ত রুটিন-ভাঙা মা। এবং, তাঁদের অনেকেরই নিজেকে সময় দিতে না পারা নিয়ে ততখানি আক্ষেপ থাকে না, যতটা আক্ষেপ ঘুণপোকার মতো জিইয়ে থাকে সন্তানকে পাছে কম সময় দেওয়া হল কি না ভেবে। এই অপরাধবোধ থেকেই মায়েরা নিজের ক্ষমতাকে টেনে বাড়াতে থাকেন, টানতে টানতে ছিঁড়ে ফেলেন নিজেকেই।
প্রচ্ছদ শিল্পী: দীপঙ্কর ভৌমিক
মাসখানেক আগেই কলকাতা হাই কোর্ট এক মামলার সূত্রে রাজ্যকে মনে করিয়ে দিয়েছে, সন্তানের জন্য সবেতন পিতৃত্বকালীন ছুটি পাওয়ার হক বাবারও রয়েছে। মায়ের জন্য যেমন ৭৩০ দিনের চাইল্ড কেয়ার লিভ বরাদ্দ, ঠিক সেই সুবিধা পেতে পারেন কোনও সন্তানের বাবাও। কেননা, সরকার এবং রাজ্যবাসী উভয়েরই মনে রাখা উচিত যে, সন্তানপালনের দায়িত্ব যতখানি মায়ের, ততখানি বাবারও।
লেডিজ সিট থেকে মহিলা সংরক্ষণ বিল, সব বিষয়ে মেয়েদের ‘বাড়তি’ সুবিধা পাওয়া নিয়ে যাঁরা ভিতরে ভিতরে রাগ গিলতে থাকেন রোজ, এই রায়ে তাঁরা সম্ভবত খুশিই হয়েছেন। কারণ, সমাজের একটা বড় অংশই ‘সমানাধিকার’ বলতে নারীর পুরুষের সমান অধিকার পাওয়াকে বোঝে না। বোঝে, পিছড়ে বর্গ হিসাবে নারীজাতিকে দীর্ঘদিনের অপ্রাপ্তি মেটাতে যেটুকু সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হচ্ছে, যাবতীয় প্রাপ্তি সত্ত্বেও ফাউ হিসাবে সেই সুযোগে পুরুষের ভাগ বসানোকে। কিন্তু এই পাওয়া না-পাওয়ার হিসেবের বাইরে যে কথাটা পড়ে থাকে, তা-ই এই রায়ের সবচেয়ে জরুরি অংশ। যে, সন্তানপালনের দায়িত্বে মা ও বাবার সমানাধিকার, সেই দায়িত্ব একা মায়ের নয়।
আবহমান কাল ধরেই সমাজ কিন্তু আমাদের এর উল্টো কথাটাই শিখিয়ে এসেছে।
একে তো এ সমাজে কোনও মেয়ের সন্তান হওয়া নিয়ে ঘরে-বাইরে সকলের যত মাথাব্যথা, সেই শিশুটিকে লালনপালনের বিষয়ে তেমন কোনও দায়িত্ব নেই। সেইসব দায় ও দায়িত্ব মায়ের ওপরেই ঠেলে দিয়ে এ সমাজ নারী এবং পুরুষের কালেকটিভ সাইকিতে গেঁথে দিয়েছে এই প্রবাদ, ‘মা হওয়া নয় মুখের কথা/ কেবল প্রসব করলে হয় না মাতা।’ তাহলে মা হওয়া যায় কেমন করে? এককথায় উত্তর, সন্তানের জন্য নিজেকে সম্পূর্ণ বিলুপ্ত করে দিয়ে। নিজের শখ-সুখ, নিজের চাওয়া-পাওয়া, নিজের ইচ্ছে-অনিচ্ছে সবকিছুকে একেবারে নেই করে দেওয়াই ‘ভালো মা’ হয়ে ওঠার গাইডলাইন। আর এই নির্দেশিকা অক্ষরে অক্ষরে মেনে চলতে গেলে যা হয়, তার মধ্যে প্রথম এবং শেষ ফলশ্রুতি, জীবন থেকে নিজের সময় বলতে বস্তুটি এক্কেবারে হারিয়ে যাওয়া। সেই হারানো, মধ্যবিত্ত ঘরের সংসার-সামলানো গৃহবধূ থেকে বলি-নায়িকা আলিয়া ভাট, সবার জীবনে কোনও না কোনও ভাবে সত্যি হয়ে আসে।
সম্প্রতি আলিয়া ভাট খোলাখুলিই বলেছেন, মেয়ে রাহার জন্মের পর তাঁর জীবনে ‘মি-টাইম’ বলতে আর কিছু নেই। না, এই না-থাকা নিয়ে তাঁর বিশেষ আক্ষেপ রয়েছে এমনটা নয়। তবু নেই যে, এ কথাও তো সত্যি। সেই সত্যিকে সব মায়েরাই জানেন, সে তিনি গৃহবধূ হোন কি দশটা-পাঁচটার চাকরিজীবী কিংবা এমার্জেন্সি ডিউটির সঙ্গে যুক্ত রুটিন-ভাঙা মা। এবং, তাঁদের অনেকেরই নিজেকে সময় দিতে না পারা নিয়ে ততখানি আক্ষেপ থাকে না, যতটা আক্ষেপ ঘুণপোকার মতো জিইয়ে থাকে সন্তানকে পাছে কম সময় দেওয়া হল কি না ভেবে। এই অপরাধবোধ থেকেই মায়েরা নিজের ক্ষমতাকে টেনে বাড়াতে থাকেন, টানতে টানতে ছিঁড়ে ফেলেন নিজেকেই।
আসলে, সমাজ কোনও নারীর কাছে সন্তানকে প্রায় প্রোফেসর শঙ্কুর সর্বরোগহর মিরাকিউরলের মতো হাজির করে। পলিসিস্টিক ওভারি হলে বিধান আসে বাচ্চা নেওয়ার, আবার বরের সঙ্গে ঝগড়া হলেও নিদান দেওয়া হয় যে বাচ্চা নিলেই ঠিক হয়ে যাবে। সুতরাং, এহেন পরশপাথরকে সব ছেড়েছুড়ে আগলে রাখার একরকম অলিখিত বিধানও একইসঙ্গে তৈরি হয়ে যায় মেয়েদের সামনে। পরিবার যতই ‘আমরা আছি’-র আশ্বাসে সন্তানধারণের প্ররোচনা দিক, সন্তানকে নাওয়ানো-খাওয়ানো-পড়ানো-বায়নাক্কা সামলানোর মতো ঝক্কির অধিকাংশটাই দেখতে দেখতে বরাদ্দ হয়ে যায় মায়েরই জন্য। সন্তানকে রেখে দূরদেশে পড়তে যাওয়া কাদম্বিনী গঙ্গোপাধ্যায় কিংবা আলেকজান্দ্রা কোলনতাই-রা নেহাতই ব্যতিক্রম, সাহিত্যিক এবং কেন্দ্রীয় সরকারি আমলা যশোধরা রায়চৌধুরীর অভিজ্ঞতা জানায়, সন্তানের অসুখ বা পরীক্ষার সময়ে অফিসে গেলে শিশুটি কোনও গুরুজনের মুখে মায়ের সঙ্গে রাক্ষসীর তুলনা শুনত। কবি এবং মিডিয়াকর্মী অদিতি বসুরায় লিখছেন, ‘আবশ্যিক আত্মত্যাগ না থাকলে সন্তানপালন হয় না। মুশকিল হল, আপনি আবার কাজের সময়ে অদৃশ্য থাকেন– যেই না উপন্যাস সমগ্র খুলে বসেছেন বা নেটফ্লিক্স অন করেছেন কিংবা কফিশপে কুড়ি মিনিটের গুলতানিতে যাচ্ছেন– আপনার বাদবাকি ১৮ ঘণ্টার কার্যকলাপ ওই কুড়ি মিনিট বা মেরেকেটে চল্লিশ মিনিটের আড়ালে পড়ে যাচ্ছে।’
………………………………………………….
ডিভোর্স প্রক্রিয়ার মধ্যে থাকা অনেক মেয়েই ট্রমায় থাকেন, তিনি পেশাগত কারণে বেশি ব্যস্ত হয়ে পড়লে, অন্য কোনও পুরুষের সঙ্গে বন্ধুত্বের দিকে এগোলে, এমনকী নিজের শখ-শৌখিনতার কারণে সন্তানকে সাময়িক একলা রেখে গেলেও তার প্রভাব পড়বে সন্তানের কাস্টডি নির্ধারণে। এসব কিছুই তাঁর মি-টাইম, কিন্তু লিঙ্গনির্ধারিত সামাজিক ভূমিকা আদালতেরও মাথায় কাজ করে বলেই অন্যপক্ষের আইনজীবী এবং বিচারকও মনে করতে পারেন, সন্তানকে দেখভালের জন্য মাকে নিরূপা রায়-মডেলেই আটকে থাকতে হবে।
………………………………………………….
মেয়েদের লেখালিখি বা শিল্পচর্চার অভ্যাস হামেশাই অবশ্য সেহেন অকাজের মধ্যেই গণ্য হয়। ‘A woman must have money and a room of her own if she is to write fiction’– ভার্জিনিয়া উলফ এ কথা জানিয়েই দিচ্ছেন, কেননা তিনি জানতেন মেয়েদের জন্য কোনও নিজস্ব সময় বরাদ্দ করে না পরিবার-সমাজ-রাষ্ট্র। নিজের সব সময়কে সবার মধ্যে বিলি করে দিতে থাকা সেইসব মায়েদের পাশেই আবার রয়ে যাচ্ছেন ‘উনিশে এপ্রিল’-এর মায়ের মতো সেইসব মেয়েরাও, নাচের পেশা ও প্যাশনকে একইসঙ্গে ধরে রেখে যিনি নিজের সবটুকু সময় সন্তানের জন্য উৎসর্গ করেননি, আর করেননি বলেই যে ‘খারাপ মা’ স্বামী-সন্তান-পড়শিদের কাছে নিন্দিত। যে মা স্বামীর কাছ থেকে বিচ্ছেদের পথে হাঁটছেন, এই নিন্দা তাঁর আর তাঁর সন্তানের মধ্যে বাধার প্রাচীর হয়ে দাঁড়ায়। ডিভোর্স প্রক্রিয়ার মধ্যে থাকা অনেক মেয়েই তাই ট্রমায় থাকেন, তিনি পেশাগত কারণে বেশি ব্যস্ত হয়ে পড়লে, অন্য কোনও পুরুষের সঙ্গে বন্ধুত্বের দিকে এগোলে, এমনকী নিজের শখ-শৌখিনতার কারণে সন্তানকে সাময়িক একলা রেখে গেলেও তার প্রভাব পড়বে সন্তানের কাস্টডি নির্ধারণে। এসব কিছুই তাঁর মি-টাইম, কিন্তু লিঙ্গনির্ধারিত সামাজিক ভূমিকা আদালতেরও মাথায় কাজ করে বলেই অন্যপক্ষের আইনজীবী এবং বিচারকও মনে করতে পারেন, সন্তানকে দেখভালের জন্য মাকে নিরূপা রায়-মডেলেই আটকে থাকতে হবে। তাই সন্তানের কাস্টডি সংক্রান্ত এক মামলায় যখন পাঞ্জাব হাই কোর্ট বলে, বিবাহবিচ্ছিন্না মায়ের অন্য সম্পর্ক থাকলেই তিনি খারাপ মা হয়ে যান না, তখন আশা জাগে, মায়েদেরও তবে মি-টাইম থাকার অধিকারকে স্বীকৃতি দেওয়া হচ্ছে।
পরিচর্যার গুণ জরুরি বটে, কিন্তু অন্যের পাশাপাশি নিজের যত্নও যে নিতে হয়, আপন ও অপরকে সমভাবে লালন করতে হয়– এ-ও এক জরুরি শিক্ষা। মায়েদের সেই শিক্ষা দেওয়ার বদলে বিশেষ কিছু সীমিত ভূমিকার সঙ্গেই নারী-অস্তিত্বকে অবিচ্ছেদ্যভাবে জুড়ে দেওয়ার পাঠ দিয়েছে মাতৃত্ব, মনে করিয়েছিলেন বোভোয়া। মাতৃত্ব ব্যক্তির চেয়ে বেশি করে কনসেপ্ট হয়ে উঠেছে যেখানে, সেখানে মা আমার আমি-র কথা ভাববেন কী করে! তাই ছেলে বড় হয়ে যাচ্ছে বলে বিন্দুর আর বাহারি খোঁপা বাঁধা হয় না। ছেলেকে সঙ্গে নিয়ে যাওয়া যাবে না বলেই হাজারি ঠাকুরের মায়ের কোনও দিন সমুদ্র দেখা হয় না আর। আত্মকে বিলুপ্ত করে দেওয়া মায়ের সেই নির্ধারিত ছাঁচ সন্তানের মনে চারিয়ে যায় বলেই মায়ের নিজস্ব ভুবনকে সেও মান্যতা দিতে শেখে না। অন্যদিকে যে মুহূর্তে কোনও মা ‘সন্তানের জন্য সব ছেড়েছি’-র দুনিয়ায় পা রাখেন, সেই দুনিয়ায় বাঁচতে বাঁচতে ক্রমশ তিনি ভুলে যান যে এই ছেড়ে দেওয়ার নেপথ্যে রয়েছে তাঁর স্বনির্বাচন, সেই নির্বাচনের নেপথ্যেও অধিকাংশ সময়েই দাঁড়িয়ে রয়েছে ‘ঠিক চিহ্নে ভোট দেওয়ার’ সামাজিক-পারিবারিক বাধ্যতা। নিজের সমস্ত কিছু ত্যাগ করা মায়ের শেষ পর্যন্ত সম্বল হয়ে ওঠে ছেড়ে দেওয়ার অহংকারটুকুই। আর এই প্রেক্ষিতেই, তাঁর যাবতীয় ত্যাগ আসলে একরকম জমার খাতা হয়ে ওঠে, সন্তানের প্রতিষ্ঠিত হওয়ার বিনিয়োগ-সময় পেরিয়ে যা তাঁকে ‘রিটার্ন’ এনে দেবে। যাবতীয় অপ্রাপ্তির নিরিখে ওই সম্ভাব্য প্রাপ্তিকে অধিকার মনে করে মা তার দায় চাপিয়ে দেন সন্তানের ওপর, ঠিক যেমন করে সমাজ একদিন তাঁর মি-টাইমকেও সন্তানের অধিকার হিসাবেই দেখার দায় চাপিয়ে দিয়েছিল।
……………………………………………………
আরও পড়ুন তৃষ্ণা বসাক-এর লেখা: বাবাদেরও কি খারাপ লাগে না সন্তানকে ছেড়ে কাজে যেতে?
……………………………………………………
যে কোনও সম্পর্কেই খানিক আঁকড়ে ধরা আর খানিক ছেড়ে দেওয়ার গল্প থাকে বটে। কিন্তু সেইসব ত্যাগ তিতিক্ষাকে যখনই সর্বংসহার রূপকথায় উন্নীত করা হয়, তখনই সেই বাহারি আলোতে চাপা পড়ে যায় অনেক চাপা দেওয়ার বয়ান। নিজের একটা আস্ত জীবনের বদলে মায়েদের হাতে তেমন করেই মহত্ত্বের নিশান তুলে দেওয়া হয়েছে বরাবর। একইসঙ্গে সেই ‘মা’-এর অলৌকিক আলোকবর্তিকাকে উজ্জ্বল করা হয়েছে ‘খারাপ মা’-দের, কিংবা মা-না-হওয়া মেয়েদের গ্লানির অন্ধকারে ঠেলে। যে নারী মা হয়েও নিজস্ব সময় কেড়ে নেওয়ার ফাঁদ এড়িয়েছে, কিংবা যে নারীরা মি-টাইম কাড়তে দেবে না বলে স্বেচ্ছায় বেছেছে সন্তানহীনতা, তাদের সকলকে অস্বীকার করে দিনে দিনে উজ্জ্বল হয়েছে ‘ভালো মা’-র ঐশী প্রতিমা। এবার না-হয় সেই মায়েরাও উল্টো পিঠের সবাক মেয়েদের হাত ছুঁয়ে ফেলুন। সন্তানের অভ্যাসের আরামের তুলনায় না-হয় খানিক বেশি আত্মকেন্দ্রিক হোন। সন্তানের কথা ভেবে মায়ের আর মায়ের কথা ভেবে সন্তানের জীবন আবর্তিত হওয়ার চক্র ভেঙে দেওয়ার অভ্যাস হোক আমাদের। তাঁর সমগ্র জীবনের চালিকাশক্তি কী, সে কথা বলতে গিয়ে কোলনতাই সেই কবেই বলেছিলেন, ‘To go my way, to work, to struggle, to create side by side with men, and to strive for the attainment of a universal human goal (for nearly thirty years, indeed, I have belonged to the Communists) but, at the same time, to shape my personal, intimate life as a woman according to my own will and according to the given laws of my nature.’
নিজস্বতার ডাকে সব মায়েরাই একদিন সাড়া দিতে পারবেন, এটুকু চাওয়াকে কি আজও আমরা বড্ড বেশি বলে ভাবব?
…………………………………………………
ফলো করুন আমাদের ফেসবুক পেজ: রোববার ডিজিটাল
…………………………………………………