৩৫ বছর আগে কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভার বৈঠকে তাঁর ‘দানবীয়’ মানহানি আইনটি প্রত্যাহার করতে গিয়ে রাজীব গান্ধী যে কথাগুলি বলেছিলেন, ভারতের সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা নিয়ে যুগে যুগে সেই কথাগুলিই বলে আসা হচ্ছে। বছর পাঁচেক আগে যখন নরেন্দ্র মোদি সরকারের তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রক বিজ্ঞপ্তি দিয়ে বলেছিল, ভুয়া সংবাদ পরিবেশন করলে সংশ্লিষ্ট সাংবাদিকের অ্যাক্রিডিটেশন কার্ড বাতিল হবে, তখনও একই কথা শেনা গিয়েছিল। ফলে দিল্লি পুলিশের বিশেষ সেল যখন ইউএপিএ ধারায় সংবাদমাধ্যমের কর্মীদের বাড়িতে জিজ্ঞাসাবাদ করতে যায় তখনও অনিবার্যভাবে স্বাধীন সংবাদমাধ্যম ও বাকপ্রকাশের স্বাধীনতার প্রসঙ্গটি ওঠে।
বোফর্স কেলেঙ্কারি নিয়ে যখন উত্তাল দেশ, তখন তড়িঘড়ি সংসদে একটি মানহানির বিল পাশ করে বিপাকে পড়েছিলেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধী। অভিযোগ উঠেছিল ওই মানহানির বিল সংবাদমাধ্যমের কণ্ঠরোধ করার একটি প্রচেষ্টা ছাড়া কিছু নয়। বোফর্স কেলেঙ্কারি ফাঁস হয়েছিল সংবাদমাধ্যমে। বোফর্স কামান কেনার জন্য ঘুষের টাকা গান্ধী পরিবার বা তাঁদের ঘনিষ্ঠ কারও কাছে পৌঁছেছিল কি না, তা দেশবাসী সুনির্দিষ্ট করে এখনও জানতে পারেনি। কিন্তু বোফর্স কেলেঙ্কারি নিয়ে সংবাদমাধ্যমে লাগাতার প্রতিবেদন তোলপাড় ফেলেছিল দেশে। যার পরিণামে ক্ষমতাচ্যুত হয়েছিলেন রাজীব গান্ধী।
বলা হয়, মসনদ হারানোর ভয়ে বোফর্স কেলেঙ্কারি নিয়ে লাগাতার প্রতিবেদন প্রকাশ বন্ধ করতেই রাজীব মানহানির আইনকে কঠোরতম করে ১৯৮৮ সালের আগস্টে একদিনের আলোচনায় সংসদে পাশ করিয়েছিলেন সংশোধনী বিল। ওই বিলের বিরুদ্ধে অভূতপূর্ব প্রতিবাদ দেখেছিল দেশ। কংগ্রেস দলের মধ্যেও অসন্তোষ তৈরি হয়েছিল। যে নাটকীয়তার সঙ্গে রাজীব মানহানির নয়া আইনটি করেছিলন, প্রতিরোধের মুখে সেইরকম নাটকীয়তার সঙ্গেই তিনি আইনটি মন্ত্রিসভার বৈঠক ডেকে প্রত্যাহার করে নেন। মন্ত্রিসভার বৈঠকে আইনটি প্রত্যাহার করতে গিয়ে রাজীব বলেছিলেন, ‘ভারতের গণতন্ত্রের অন্তর্নিহিত শক্তি ও গতিশীলতার অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ স্বাধীন সংবাদমাধ্যম। সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা ছাড়া আমাদের গণতন্ত্র চলতে পারে না। স্বাধীনতা আন্দোলনের মধ্যে দিয়ে পাওয়া আমাদের অবিনশ্বর মূল্যবোধগুলিই দেশের স্বাধীন সংবাদমাধ্যমকে গড়ে তুলেছে।’
৩৫ বছর আগে কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভার বৈঠকে তাঁর ‘দানবীয়’ মানহানি আইনটি প্রত্যাহার করতে গিয়ে রাজীব গান্ধী যে কথাগুলি বলেছিলেন, ভারতের সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা নিয়ে যুগে যুগে সেই কথাগুলিই বলে আসা হচ্ছে। জরুরি অবস্থার সময়ও একই কথা শোনা গিয়েছিল। বছর পাঁচেক আগে যখন নরেন্দ্র মোদি সরকারের তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রক বিজ্ঞপ্তি দিয়ে বলেছিল, ভুয়া সংবাদ পরিবেশন করলে সংশ্লিষ্ট সাংবাদিকের অ্যাক্রিডিটেশন কার্ড বাতিল হবে, তখনও একই কথা শোনা গিয়েছিল। সমালোচনার চাপে ওই বিজ্ঞপ্তি প্রত্যাহার করে মোদি সরকার। ফলে দিল্লি পুলিশের বিশেষ সেল যখন ইউএপিএ ধারায় সংবাদমাধ্যমের কর্মীদের বাড়িতে জিজ্ঞাসাবাদ করতে যায় তখনও অনিবার্যভাবে স্বাধীন সংবাদমাধ্যম ও বাকপ্রকাশের স্বাধীনতার প্রসঙ্গটি ওঠে।
‘নিউজক্লিক’ নামে পোর্টালটির বিরুদ্ধে চিনের অর্থ নিয়ে ভারতের বিরুদ্ধে প্রচারের অভিযোগটি সামনে আসে মূলত আগস্টে তাদের বিরুদ্ধে হওয়া এফআইআরের পর। এই অভিযোগের সূত্র নিউ ইয়র্ক টাইমস-এ প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন। ‘নিউজক্লিক’ পোর্টালটির পরিচালনায় যাঁরা রয়েছেন, তাঁদের অনেকেই ঘোষিত বামপন্থী। কেউ কেউ হয়তো সিপিএমের সদস্যও। চিনের কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে ভারতের বামপন্থীদের একাংশের যোগাযোগ নিয়ে দীর্ঘকাল ধরেই নানারকম বিতর্ক হয়ে এসেছে। ফলে ‘নিউজক্লিক’কে ঘিরে যে অভিযোগ সামনে আসছে, তা একেবারে অভিনব নয়। আবার এই অভিযোগের সত্যতাও কোনওভাবে প্রমাণিত নয়। অভিযোগ যখন উঠেছে, তখন তদন্ত হতেই পারে। কিন্তু তদন্তের ধরন ও সময় নিয়ে যে প্রশ্ন উঠছে, তা উড়িয়ে দেওয়ার নয়।
লক্ষ লক্ষ পোর্টালের মতোই ‘নিউজক্লিক’ একটি। এই বিতর্কে জড়ানোর আগে পোর্টালটির বিশেষ পরিচিতিও ছিল না। এইরকম একটি পোর্টালের বিরুদ্ধে একটি মার্কিনি সংবাদপত্রে অভিযোগ উঠতেই তদন্তকারীরা কেন এত তৎপর হয়ে উঠল এবং বেছে বেছে মোদি সরকারের সমালোচক এমন কিছু সাংবাদিককে কেন পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদের আওতায় নিয়ে আসা হল, সেই সঙ্গত প্রশ্ন সামনে চলে এসেছে। কেন ইউএপিএ-র মতো এত কড়া আইন প্রয়োগ হল, প্রশ্ন সেটাও। লোকসভা ভোটের আগে সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে পুলিশের পদক্ষেপ সরকারের অভিসন্ধি নিয়ে প্রশ্ন তুলবেই। কেন্দ্রীয় সরকারের তরফে বলা হয়েছে, অভিযোগ গুরুতর। দেশের অখণ্ডতা ও সার্বভৌমত্ব নিয়ে প্রশ্ন। সেই কারণেই ইউএপিএ আইনের প্রয়োগ।
‘নিউজক্লিক’-এর সঙ্গে যুক্ত প্রায় ৫০ জনের বাড়িতে দিল্লি পুলিশের বিশেষ সেল হানা দিতেই প্রতিবাদে সরব হয়েছে কংগ্রেস, তৃণমূল-সহ বিরোধী ‘ইন্ডিয়া’ জোটের দলগুলি। দেশের বিভিন্ন প্রেস ক্লাব ও এডিটর্স গিল্ডও প্রতিবাদ জানিয়েছে। গ্রেফতার হওয়া ‘নিউজক্লিক’-এর প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক ও মানব সম্পদ বিভাগের কর্তার মুক্তির দাবি উঠেছে। ভোটের আগে এটা সংবাদমাধ্যমকে সবক শেখানোর চেষ্টা, মোদি বিরাধীরা সেই অভিযোগ করছেন। এই প্রসঙ্গে আসছে ইন্দিরা গান্ধীর জরুরি অবস্থার সময় সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা কেড়ে নেওয়ার কথা এবং রাজীব গান্ধীর মানহানি আইনের সংশোধনের কথাও। ইন্দিরা ও রাজীবের সময় সমাজমাধ্যম ছিল না। প্রথাগত সংবাদমাধ্যমের গুরুত্ব ও মর্যাদাও ছিল অনেক প্রবল। সমাজমাধ্যমের যুগে সরকার আর সংবাদমাধ্যমকে সেভাবে পরোয়া করে কি না, সেটাও অবশ্য গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। আগামিদিনে এইসব প্রশ্ন ঘিরে বিতর্ক জোরালো হবে বলে আশা করা যায়।