ক্রিকেট, ফুটবল এবং দাবা তিনটি স্বতন্ত্র ক্রীড়া। খেলোয়াড়দের অদম্য জেতার জেদ, পরিকল্পনা এবং দক্ষতার স্ফূরণ ছাড়া তেমন কোনও মিল নেই। অমিল প্রচুর এবং সেগুলি প্রকট। কিন্তু এই তিনটি খেলার মধ্যে একটি দুঃখজনক মিল রয়েছে– তিনটি অতি জনপ্রিয় খেলার কোনওটিতেই সুবিশাল আফ্রিকা মহাদেশ থেকে উঠে আসা কোনও বিশ্বখেতাবজয়ী নেই। সম্ভাবনা, প্রতিভা এবং শ্রমের অভাব নেই। কিন্তু, না, কোনও বিশ্বচ্যাম্পিয়ন নেই।
৩.
দাবা খেলার আধুনিক আন্তর্জাতিক ধরনটি কিন্তু পিতৃতান্ত্রিক কাঠামোর বিপ্রতীপ। কুইন (ভারতীয় ভাষায় মন্ত্রী, উজির বা আরবিতে ফিরজান ইত্যাদি, কিন্তু সর্বদেশ-স্বীকৃত আধুনিক প্রতিশব্দ ‘কুইন’। স্প্যানিশে লা দামা মানে রানি) অতিশক্তিমান। কুইন বোর্ডের মূল-ঘুঁটি, যার গতিবিধি সর্বত্র সবদিকে। অন্যদিকে, কিং বা রাজা নেহাতই দুর্বল এক ঘুঁটি। যার গতিবিধি মাত্র একটি স্কোয়ারে চলাচলে সীমাবদ্ধ। রাজা এতই দুর্বল যে চেক বা কিস্তি পড়বে এমন স্কোয়ারে সে যেতে পারে না।
দাবার নারীপ্রধান হওয়া যেমন প্রতিস্পর্ধী, তেমনই প্রধান দুর্বলতা বর্ণবৈষম্য। হোয়াইট ও ব্ল্যাকের লড়াইয়ে হোয়াইট প্রথম দান দেওয়া শুরু করে। ব্ল্যাকের দান শুরুর অনুমতি নেই। দাবার প্রবলেম সমাধানের অধিকাংশ বইতে সাদার জিত-কিস্তিমাতের প্রবলেম বেশি সংখ্যায় থাকে। কালোর জিত-কিস্তিমাতের প্রবলেম কম। কেন?
জর্জ অরওয়েলের ‘১৯৮৪’ উপন্যাসে উইনস্টনকে মনে আছে? প্রায়ই একটি ক্যাফেতে গিয়ে দাবার প্রবলেম সমাধান করত উইনস্টন। তার মনেও একসময় এই প্রশ্নটি আসে যে, সবসময় সাদাই কেন কিস্তিমাত করে? বা, ‘সাদার দান, সাদা কীভাবে জিতবে?’ এমন প্রবলেম কেন দেওয়া থাকে সবসময়? ২০২০ সালে জর্জ ফ্লয়েডকে হত্যার পরে বর্ণবিদ্বেষবিরোধী আন্দোলনে সমর্থন জানিয়ে অনীশ গিরি এবং ম্যাগনাস কার্লসেন দাবার বোর্ডে মুখোমুখি হন। কার্লসেন কালো নিয়ে প্রথম দান দেন, দাবার প্রথাগত ‘বর্ণবিদ্বেষী’ ধারণাকে প্রত্যাহ্বান জানাতে। নিঃসন্দেহে দারুণ উদ্যোগ, কিন্তু, তাঁরাও নিশ্চিত জানেন যে, বাস্তবে এমনটা অসম্ভব। তাহলে দাবার ওপেনিং-এর যাবতীয় তত্ত্ব পাল্টে যাবে। খেলার নীতিকৌশল বদলে যাবে। উল্লেখ্য, দাবাতত্ত্বের (বই, ওপেনিং ও এন্ডগেমের তত্ত্ব) প্রায় সবটুকুই ইউরোপে তৈরি। আর, ইউরোপীয় দাবা ঘরানাতেই (উনিশ শতকে) সাদা প্রথম দান দেবে এমন নিয়ম বলবৎ হয়েছিল।
‘সিংহ যতদিন না লিখতে শিখবে, ততদিন প্রত্যেক শিকারের গল্পে শিকারিই বিজয়ী ঘোষিত হবে’– আফ্রিকার প্রাচীন প্রবাদ।
দাবাখেলার শুরু ভারতে– সিংহভাগ ঐতিহাসিক ও দাবাবিশারদ এই বিষয়ে একমত। যদিও কিছু ঐতিহাসিকের মতে ইজিপ্টেও দাবার সমতুল্য খেলার প্রচলন ছিল। সেনেট। দু’জন প্রতিদ্বন্দ্বী খেলত। তিনটি উল্লম্ব স্তম্ভ (ফাইল) এবং ১০টি সমান্তরাল স্তম্ভ (র্যাঙ্ক) থাকত বোর্ডে; অর্থাৎ মোট ৩০টি স্কোয়ার। দু’রকমের ঘুঁটি থাকত, মোট ১০টি। আধুনিক দাবায় ৮টি ফাইল ও ৮টি র্যাঙ্ক অর্থাৎ মোট ৬৪টি স্কোয়ার থাকে। ঘুঁটি সাদার এবং কালোর মিলিয়ে মোট ৩২টি। পার্থক্য বেশ প্রকট হলেও দাবার উদ্ভব প্রাচীন মিশরে– এমন দাবি ভাসিয়ে তুলেছিলেন জোসেপ ব্রুনেট। তাঁর দেওয়া যাত্রাপথের হদিশে, মিশর থেকে গ্রিক ও রোম হয়ে তারপর আলেকজান্ডারের সময়ে ভারত ও পারস্যে প্রবেশ করেছিল দাবা। নেফারতিতির সমাধিতে আঁকা একটি ছবিতে রানিকে দাবার মতো কয়েকটি ‘পিস’ সাজিয়ে খেলতে দেখা যাচ্ছে, যে পিসগুলির আকৃতি অনেকটা কিং-কুইন-রুকের মতো। সের্খিও নেগ্রি এই বিষয়ে লেখা প্রবন্ধে উল্লেখ করছেন ‘বুক অব দ্য ডেড’-এর কথা, যেখানে উল্লেখ আছে মৃত ব্যক্তি একটি বোর্ড-গেম খেলছে। ‘সেনেট’ নামক খেলাটির অর্থ যাত্রাপথ বা অন্তর্বর্তী পথ। মৃত ব্যক্তির আত্মা মৃত্যু-পরবর্তী যাত্রাপথে বোর্ডে খেলাটি খেলছে, এমনই তার তাৎপর্য। তবে, প্রাচীন ভারত, পারস্য ও চিনদেশে দাবার যে আঙ্গিক প্রচলিত ছিল, তা থেকে আধুনিক দাবার বিবর্তন-পথের হদিশ পাওয়া অনেক বেশি যুক্তিপূর্ণ ও যথাযথ। নেগ্রির প্রবন্ধেও তেমনই ইঙ্গিত। বরং ইথিওপিয়ার ‘সেন্তেরেজ’ খেলাটির সঙ্গে দাবার বেশি সাদৃশ্য লক্ষণীয়। নেগুজ, ফের্জ, ফিল, ফেরেসেনিয়া, ডের এবং মেদেক– আদতে রাজা, মন্ত্রী, গজ, ঘোড়া, নৌকা এবং বোড়ের প্রতিরূপ। দাবার মতো বোড়ের প্রথম দানে দুই ঘর যাওয়ার নিয়ম নেই, সর্বদা মাত্র এক ঘর এগোতে পারে তারা। ফের্জ তথা মন্ত্রীর ক্ষমতাও সেন্তেনেজে সীমিত, কোনাকুনি মাত্র একঘর গতিবিধি তার। উল্লেখযোগ্য পার্থক্য রয়েছে কিস্তিমাতের ক্ষেত্রেও। কিংয়ের সঙ্গে ন্যূনতম একটি পিস যদি না থাকে, তাহলে কিং-কে চেকমেট করা যাবে না। দাবায় কিন্তু একলা কিংকে চেকমেট করা বৈধ। আর, দাবার মতো সাদার দান দিয়ে খেলা শুরু করা নয়, দু’জন প্রতিপক্ষ একইসঙ্গে শুরুর দান দেয় সেন্তেনেজে। বহু আগে নাকি লাল কাপড়ের ওপরে সাদা সুতো দিয়ে সেলাই করে ছক বানানো হত; তার ওপরে হাতির দাঁতের তৈরি পিস-পন বসত। পরে অবশ্য সেলাই করা হত কালো সুতো দিয়ে। প্রাচীন ভারতীয় দাবায় ক্যাসলিং বা দুর্গ-নির্মাণের ধারণা ছিল না। কিন্তু ইথিওপিয়ার দাবায় ইউরোপীয় দাবার আগে থেকেই ক্যাসলিং-এর প্রচলন ছিল।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
ভারত হোক বা দক্ষিণ আমেরিকা কিংবা আফ্রিকার কোনও দেশ– নিজস্ব দাবাপদ্ধতি সরিয়ে রেখে ঔপনিবেশিক ইউরোপীয়দের তত্ত্ব মতো সাজিয়ে নিয়েছেন উপনিবেশিতরা। ফলে, ইউরোপীয় দাবাড়ুদের তুলনায় খানিক পিছিয়ে থেকে শুরু করতে হয়েছে তাঁদের। ইউরোপীয়দের প্রবর্তিত দাবানীতিতে অভিযোজিত হতে সময় লেগেছে। ততদিনে ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্রে দাবা প্রতিযোগিতা আয়োজন করে শীর্ষস্থানগুলি দখল করে নিয়েছেন ইউরোপীয় দাবাড়ুরা। সেই ইতিহাসই আধুনিক দাবার প্রামাণ্য ইতিহাস হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
সেন্তেনেজের ইতিহাস মিশরীয় সেনেটের মতো প্রাচীন না। পঞ্চদশ শতকে রাজাদের অন্যতম বিনোদন ছিল এই খেলা। গবেষক রিচার্ড প্যাঙ্কহার্স্ট জানাচ্ছেন যে, উনিশ শতকে ফরাসি ও ব্রিটিশ ভাগ্যসন্ধানীরা সেন্তেনেজ খেলায় অংশ নিয়েছেন ইথিওপিয়ায় এসে। কখনও রাজার সঙ্গে, কখনও সভাসদের সঙ্গে সেন্তেনেজ খেলে নিজেদের দেশের দাবার সঙ্গে তুলনা করেছেন তারা। সম্ভবত পারস্য থেকে আরব দেশ হয়ে ইথিওপিয়ায় দাবার প্রচলন হয়েছিল এবং ইউরোপীয় দাবার আগেই তার নিজস্ব বিবর্তন ঘটেছিল। তবে, ভারত হোক বা দক্ষিণ আমেরিকা কিংবা আফ্রিকার কোনও দেশ– নিজস্ব দাবাপদ্ধতি সরিয়ে রেখে ঔপনিবেশিক ইউরোপীয়দের তত্ত্ব মতো সাজিয়ে নিয়েছেন উপনিবেশিতরা। ফলে, ইউরোপীয় দাবাড়ুদের তুলনায় খানিক পিছিয়ে থেকে শুরু করতে হয়েছে তাঁদের। ইউরোপীয়দের প্রবর্তিত দাবানীতিতে অভিযোজিত হতে সময় লেগেছে। ততদিনে ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্রে দাবা প্রতিযোগিতা আয়োজন করে শীর্ষস্থানগুলি দখল করে নিয়েছেন ইউরোপীয় দাবাড়ুরা। সেই ইতিহাসই আধুনিক দাবার প্রামাণ্য ইতিহাস হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে।
ক্রিকেট, ফুটবল এবং দাবা তিনটি স্বতন্ত্র ক্রীড়া। খেলোয়াড়দের অদম্য জেতার জেদ, পরিকল্পনা এবং দক্ষতার স্ফূরণ ছাড়া তেমন কোনও মিল নেই। অমিল প্রচুর এবং সেগুলি প্রকট। কিন্তু এই তিনটি খেলার মধ্যে একটি দুঃখজনক মিল রয়েছে– তিনটি অতি জনপ্রিয় খেলার কোনওটিতেই সুবিশাল আফ্রিকা মহাদেশ থেকে উঠে আসা কোনও বিশ্বখেতাবজয়ী নেই। সম্ভাবনা, প্রতিভা এবং শ্রমের অভাব নেই। কিন্তু, না, কোনও বিশ্বচ্যাম্পিয়ন নেই। ফুটবল এবং ক্রিকেটে প্রতিদ্বন্দ্বিতা স্পষ্ট– যথাক্রমে দক্ষিণ আমেরিকা এবং ইউরোপ আর এশিয়া ও ইউরোপের (ক্যারিবিয়ান দ্বীপপুঞ্জের ওয়েস্ট ইন্ডিজ রয়েছে) মধ্যে। দাবায় বিশ্বচ্যাম্পিয়নদের সিংহভাগ ইউরোপের (সোভিয়েত ও রাশিয়া পূর্ব ইউরোপের দেশ), একজন যুক্তরাষ্ট্রের, একজন বিশ্বচ্যাম্পিয়ন কিউবার এবং দু’জন এশিয়ার (বিশ্বনাথন আনন্দ এবং ডিং লিরেন)। দাবায় মোট গ্র্যান্ডমাস্টারের সংখ্যাও আফ্রিকার দেশগুলিতে খুব বেশি নয়। দাবায় শারীরিক দক্ষতার সঙ্গে (ধ্রুপদী গেমে টানা কয়েকঘণ্টা একাগ্র মনোনিবেশ করে বসে থাকা কিংবা দ্রুতগতির র্যাপিড ও ব্লিৎজ দাবায় দুরন্ত অভ্যাসগত প্রতিবর্ত ক্রিয়ার সঙ্গে চূড়ান্ত মনঃসংযোগ) নিরন্তর মেধার অনুশীলনও প্রয়োজন হয়। ইউরোপীয় বা যুক্তরাষ্ট্রে অনুপ্রবেশকারী শ্বেতাঙ্গরা বরাবরই এশিয়া, আফ্রিকা ও দক্ষিণ আমেরিকার উপনিবেশিতদের মন্দমেধাসম্পন্ন মনে করেছে। মেধা ও বুদ্ধির পারদর্শিতার খেলায় তারাই শ্রেষ্ঠ– এমনটা প্রচার করেছে। কিন্তু অ-ইউরোপীয়দের ইউরোপীয় দাবা-ঘরানায় অভিযোজন, সুদীর্ঘ কয়েক শতকব্যাপী আর্থ-রাজনৈতিকভাবে নিষ্পেষিত হতে থাকা এবং শীর্ষস্তরের ইউরোপীয় দাবায় নিয়মিত অংশগ্রহণের সুযোগসুবিধের (আর্থিক ও পরিকাঠামোগত) অভাব অ-ইউরোপীয়দের দাবায় পিছিয়ে রেখেছে। মেধা তাঁদেরও কিছু কম নেই, যখনই তাঁরা সমতুল্য সুযোগ ও পরিকাঠামো পেয়েছেন, তখনই নিজেদের মেধাজাত ও শ্রমনিষ্ঠ দাবাজ্ঞানের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করেছেন।
‘I just want a playable position, but I cannot move my pieces. The European pieces are all over the centre, they control every square. I am reduced to playing Kh8… Kg7 only. If we play the same game, I can not equalize because they have 20 tempos more.’ – Watu Kobese.
আফ্রিকার দাবাড়ু কিংবা আফ্রিকান বংশপরিচয়সম্পন্ন দাবাড়ুদের ক্ষেত্রে আরও এক বড় বাধা ছিল বর্ণবিদ্বেষী ক্ষমতাবানদের তৈরি করা নিন্দনীয় নিয়ম। কৃষ্ণাঙ্গ দাবাড়ুরা অভিজাত দাবা ক্লাবে চর্চার সুযোগ পেতেন না। তাঁরা প্রতিযোগিতায় অংশ নিলে শ্বেতাঙ্গদের ভ্রূ-কুঁচকে উঠত। যুক্তরাষ্ট্রে ১৯৫০-র সময় পর্যন্ত সাদার্ন চেস অ্যাসোসিয়েশন, শিকাগো চেস ক্লাব এবং বেশ কিছু অভিজাত প্রতিযোগিতায় কৃষ্ণাঙ্গদের প্রবেশ নিষিদ্ধ ঘোষিত হয়েছিল। জেমস ম্যাক্যুন স্মিথ (১৮১৩-৬৫) যুক্তরাষ্ট্রে ডাক্তারি পড়ার অনুমতি পাননি, শ্বেতাঙ্গদের সঙ্গে দাবাচর্চার অনুমতি তো দূর অস্ত। প্রতিবন্ধকতা সত্ত্বেও তিনি স্কটল্যান্ড থেকে ডাক্তারি পাশ করেছিলেন। স্প্যানিশ, ইতালিয়ান ও হিব্রু ভাষা শিখেছিলেন। আর, দাবা শিখেছিলেন। সামাজিক প্রতিষ্ঠা অর্জনের পরে নিয়মিত দাবা খেলতেন, দাবার নিবন্ধ লিখতেন। প্রথম আমেরিকান দাবা কংগ্রেসে যোগ দেওয়ার অভিজ্ঞতা লিখেছিলেন একটি দাবা-পত্রিকায়। ১৮৫৯ সালে ‘দ্য ন্যাশনাল এরা’ পত্রিকায় ‘চেস’ নামে এক দীর্ঘ প্রবন্ধ লিখেছিলেন। তাৎপর্যপূর্ণভাবে একটি অনুচ্ছেদে লিখেছেন, যখন ওয়াল স্ট্রিটে ব্রডওয়েতে অর্থনৈতিক সংকটে মানুষ ছটফট করছে, যখন রাজনৈতিক অস্থিরতায় সমাজ অশান্ত হয়ে আছে, তখন শান্ত-সমাহিত থাকার একমাত্র উপায় সংগীত, নাচ, মদ, হাশিশ কিচ্ছু না, শুধুই দাবা! পল মরফি আর লুই পলসেনের ফাইনাল রাউন্ডের ম্যাচ নিয়ে দীর্ঘ আলোচনা করছেন। স্ট্যানলি, রাফায়েল-সহ অন্যদের গেমের রিপোর্ট লিখতে গিয়ে ইতিহাস, সাহিত্য, যুদ্ধনীতি টেনে আনছেন। রোম্যান্টিক যুগের দাবা-ওপেনিং ও সার্বিক দাবানীতিতে ব্যুৎপত্তি না থাকলে অমন লেখা কেউ লিখতে পারে না! আজকের যুগেও বহু অল্পবুদ্ধির লোক দাবাকে ক্রীড়া বলতে কুণ্ঠাবোধ করে। দাবায় নাকি শারীরিক সক্ষমতার প্রয়োজন নেই! অথচ, ১৬৭ বছর আগে জেমস ম্যাক্যুন স্মিথ লিখছেন, ‘From the nature of the faculties which it calls into play, we regard chess as a physical as well as intellectual exercise, requiring muscular work as well as brain work. Cricket, billiards, chess, rise from the physico-intellectual to the intellectuo-physical; and chess, billiards, cricket, reverse the order… Lookers on at chess feel their muscles twitching, their fingers clasping and moving imaginary men, and their heads aching when the game is done.’ অন্য ক্রীড়ার মতো দাবাতেও কম বয়েসে সবচেয়ে বেশি সাফল্য অর্জন করা যায়; শরীরের বয়ঃবৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে বৌদ্ধিক উদ্ভাবনী ক্ষমতা কমতে থাকে দাবাড়ুর। জেমস ম্যাকুনও একথা লিখেছিলেন। দাবার প্রতি এত ভালবাসা, দাবা নিয়ে এত যুক্তিগ্রাহ্য আলোচনা, অথচ জেমস ম্যাক্যুনের একটিও দাবার গেম ডেটাবেসে নেই।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
আরও পড়ুন: মন্ত্রী হতে আমি আসিনি, হয় দাবা খেলব, নয় ভেনেজুয়েলায় বিপ্লব আনব– বলেছিলেন চে গেভারা
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
থিওফিলাস থম্পসনের গেম ডেটাবেসে রয়েছে। তাঁর পূর্বপুরুষকে ‘ক্রীতদাস’ বানিয়ে নিয়ে আসা হয়েছিল আফ্রিকা থেকে। থিওফিলাসের জন্ম মেরিল্যান্ডে, ক্রীতদাস শিবিরে। গৃহযুদ্ধের পরে দাসত্ব থেকে মুক্তি পেয়েছিলেন থিওফিলাস, পড়াশোনা শিখেছিলেন। মাত্র ১৬ বছর বয়েসে দাবা খেলা দেখে দেখে শিখলেন, করেসপন্ডেন্স দাবায় কয়েকজন প্রতিষ্ঠিত দাবাড়ুকে হারালেন। চিঠিতে দান দিয়ে দিয়ে দাবাখেলার যে রীতি প্রচলিত ছিল, সেখানেও বেশ কয়েকজন প্রতিভাবান দাবাড়ুকে হারালেন। কিন্তু, থিওফিলাসের মূল কৃতিত্ব অন্যত্র। মাত্র ১৮ বছর বয়েসে দাবার প্রবলেম অর্থাৎ পাজলের বই লিখেছিলেন। মোট ১০০টি পাজল ছিল তাতে, বইয়ের শেষদিকে সেগুলির সমাধান। লন্ডনের বিখ্যাত দাবাপত্রিকায় উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করে লেখা হয়েছিল, ‘দাবার পাজলের ওপর লেখা বইটি একজন দাবাড়ুর ধারণাগত ও গঠনমূলক দুটি দিকের জন্যই প্রয়োজনীয়। লেখক থম্পসন অতুলনীয় মেধাসম্পন্ন এবং অসীম সম্ভাবনার অধিকারী।’
ডুবুকে দাবা জার্নাল, মেরিল্যান্ড দাবা পত্রিকায় নিয়মিত তাঁর খেলার দান ও বিশ্লেষণ ছাপা হত। ডুবুকে জার্নালে দাবার পাজল পাঠাতেন থিওফিলাস। কিন্তু হঠাৎই দাবাজগৎ থেকে বেমালুম গায়েব হয়ে যান থিওফিলাস। বহু ধোঁয়াশা এবং রহস্যময় দাবিদাওয়ার পরে ‘চেস ড্রাম’ পত্রিকার গবেষণায় জানা যায় যে, মাত্র ২৬ বছর বয়সে মারা গেছিলেন থিওফিলাস।
থিওফিলাস থম্পসন (সাদা) বনাম চার্লস ব্লাড (কালো)
1.e4 e5 2.f4 exf4 3.Bc4 Qh4+ 4.Kf1 g5 5.d4 d6 6.Nc3 Bg7 7.g3 Bh3+ 8.Kf2 Qh6 9.Nd5 Kd8 10.Qd3 Be6 11.Nf3 fxg3+ 12.hxg3 Qg6 13.Bxg5+ f6 14.Bf4 Nc6 15.Nxc7 Bxc4 16.Qa3 Kxc7 17.Qxd6+ Kb6 18.Qc5+ Ka6 19.Qxc4+ Kb6 20.a4 a5 21.Qc5+ Ka6 22.Bc7 1-0
থিওফিলাসের পছন্দ ছিল রোম্যান্টিক দাবানীতি। শুরু থেকেই আক্রমণে যাও, পিস-পজেশনের পরোয়া কোরো না, বিপক্ষের আক্রমণের পাল্টা আক্রমণাত্মক রণনীতি নাও, প্রয়োজনে পিস বলিদান দিয়ে অন্য পিস-পন সচল করে আক্রমণের রণকৌশল ইত্যাদি। থিওফিলাস যাঁকে হারিয়েছিলেন, সেই চার্লস ব্লাড ১৮৬২-৬৩ সালে গৃহযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন। দাসপ্রথা উচ্ছেদের পক্ষে সেনাদলে যোগ দিয়েছিলেন ব্লাড। যুদ্ধ থেকে ফিরে শখের দাবায় মনোনিবেশ করেন। প্রায়শই তিনি বিপক্ষের বিরুদ্ধে একটি রুক বা নাইট বাদ দিয়ে খেলতেন।
(চলবে)
তথ্যঋণ
দ্য চেসড্রাম, চেস-ডট-কম, গ্রাউন্ডআপ, চেসহাব, চেসগেমস এবং ফিডের ওয়েবসাইট
আর্চি ওয়াটার্স পেপার্স
চেস প্রবলেমস– থিওফিলাস থম্পসন
ফিডের সাম্প্রতিক রেটিং তালিকা