ভোট চলছে সারা দেশে। ৮৫ বছরের বেশি বয়স্ক বরিষ্ঠ জনগণ বা বিশেষভাবে সক্ষম জনগণের জন্য প্রিসাইডিং অফিসার পৌঁছে যাবে ঘরে ঘরে। নিশ্চিত করা, যাতে নাগরিক অধিকার প্রয়োগ করতে পারেন সবাই। শুধু পারবে না ওরা। ভোট চলতে চলতে ভোট শেষ হয়ে যাবে। ওদের আঙুলের ছাপ থাকবে না ছবির পাশে নাম লেখার ফাঁকটুকুতে। কেউ বলেনি কোনও বিশেষ ট্রেন আসবে। কোনও শ্রমিক স্পেশাল ট্রেন এসে দাঁড়াবে না।
প্রচ্ছদ: অর্ঘ্য চৌধুরী
গোমোরের জল তখন ম্যানগ্রোভের শিকড় ছাড়িয়ে উঠে এসেছে শরীরগুলো ডুবিয়ে দিয়ে। জোয়ার চলছে নদীতে। সবে বর্ষা পার করে সোনালি রোদ উঠতে শুরু করেছে নোনা কাদা মাটির সুন্দরবনে। গমরের পাশেই সর্দার পাড়ার বেড়ার ঘরটায় বসে বারবার কথা বলতে বলতে হোঁচট খাচ্ছে সঞ্জীব সর্দার। মৃদু মৃদু হাওয়ায় দুলে দুলে উঠছে ওর হাতশূন্য শার্টের বাঁ-হাতাখানা। দু’এক বার মনে করে করে কথাগুলো বলছে। পাশ থেকে থামিয়ে দিয়ে গোপাল সর্দার শুধরে দিচ্ছে ওর নিজের জীবনের ইতিহাস।
–হাতখানা আর একটুও নেই? এমন হল কীভাবে?
–কালীপূজার রাতে।
–বাজি পোড়াতে গিয়ে পুড়ে গিয়েছিল?
‘কালীপূজা’ কথাটা শুনেই প্রশ্নটা এত তাড়াহুড়ো করে ফেলেছিলাম সঞ্জীব কিছুটা ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে মাথা নেড়ে কীরকম একটা সম্মতি জানিয়েছিল। সেই মুহূর্তে গোপাল পাশ থেকে বলে উঠল, ‘আরে না না, ও ভালো বলতে পারে না। মশারির মধ্যে কালীপূজার দিন রাতের বেলা শুয়েছিল। পাশে কেরোসিনের লম্ফ জ্বলছিল। মশারি থেকে বেড়ার দেওয়ালেও আগুন ধরে গিয়েছিল। ওর হাতখানা পুরো পুড়ে গেছিল তখন।’
প্রথমে ঘা হল সেই পোড়া হাতে। তারপর তো সেই হাত কেটে বাদ দিতে হল। পাশ থেকে অন্য ছেলেগুলো সম্মতিসূচক আরও কিছু বলে চলেছে।
সর্দার পাড়ার এই এক হাতের সঞ্জীব আর দু’-হাতের বাকিরা সবাই ফিরেছে তখন লকডাউনের পর ত্রিপুরা থেকে। ওএনজিসি-র কাজে গিয়েছিল। পাশের পাড়ার লোকাল ঠিকাদার ঠিকমতো কিছুই বলেনি কাজটা ঠিক কেমন জায়গায়। শুধু বলেছিল বোরিংয়ের কাজ। তেল তোলার কাজ। ওখানে অন্য ঠিকাদারের আন্ডারে কাজ। সুন্দরবনের ঝড়-জল-বন্যায় সাঁতারে দক্ষ এই মানুষগুলো বড় বড় পাহাড়ের মাঝে পড়ে প্রথমটায় খেয়েছিল ভ্যাবাচ্যাকা।
–জঙ্গল-ঝোপঝাড়ে গুয়ে-মুতে শ্মশানে-মশানে আমাদের মাটি খোঁড়ার কাজ করতে হত। আর সে কি এমন জায়গা নাকি! সে জায়গায় উঁচু উঁচু পাহাড়। এক জায়গায় জঙ্গল-মঙ্গল সাফ করে কাজ করি। সেইখানেই থাকি তাম্বু বেঁধে। যেই মালিক বুঝল কাজ শেষ– বলে দিত আরেক জায়গায় চলে যেতে। সেই তক্ষুনি মেশিনপত্র নিয়ে ভারী ভারী লোহালক্কড়-পাইপ নিয়ে চলে যেতাম পরের স্পটে। আবার সেই এক-দেড় কিলোমিটার দূরের কোনও স্পটে পাহাড় বেয়ে উঠতে হত।
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
নদী-ঘেরা এই দ্বীপগুলির ছেলেরা পাহাড়ের গা বেয়ে জঙ্গল কেটে কেটে উঁচু নিচু এবড়োখেবড়ো পথ বেয়ে মেশিনপত্র কাঁধে নিয়ে ওঠার পরিশ্রম মেনে নিয়েছিল। মেনে নিয়েছিল দু’হাতে বা এক হাতে বুক-পেট দিয়ে পাথুরে রুক্ষ মাটিতে বোরিং করার কসরত। মেনে নিয়েছিল মাসের পর মাস চাল-ডাল ফুটিয়ে খাওয়ার কষ্ট। মেনে নিয়েছিল রাত-ভোরে যখন তখন কাঁচা ঘুম ভেঙে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় মালিকের আদেশ মেনে নীরবে মেশিনপত্র নিয়ে যাত্রা শুরু করা।
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
–গাড়ি দিত যাওয়ার সময়?
–গাড়ি? গাড়ি কোথায় ওসব পাহাড়ে জঙ্গলে। মেশিনপত্তর কলকবজা ঘাড়ে করে নিয়েই উঠতে হত। আবার সেইখানে নতুন জায়গা পরিষ্কার করে জঙ্গল কেটে তাম্বু বাঁধো। মোটকথা সে শ্মশান হোক আর ভাগাড় হোক– যেইখানে তেল পাওয়া যাবে সেইখানেই কাজ করতে হবে, সেইখানেই থাকতে হবে আমাদের। কাজে গিয়েছি কোনও আপত্তি ওরা শুনবে কেন?
সঞ্জীব সর্দার পা-দুটো গুটিয়ে বেঁচে থাকা হাতটাকে দিয়ে হাঁটুটাকে জড়িয়ে বসে এক মনে শুনে চলেছিল গোপাল সর্দারের মুখের কথাগুলো। বারবার চোখ চলে যাচ্ছে ফ্যানের হাওয়ায় নড়তে থাকা ওর লাল ফুল হাতার শার্টের হাতাটার দিকে।
জিজ্ঞাসা করলাম, এই সঞ্জীবও তোমাদের সঙ্গে যেত ওরকম মালপত্র কাঁধে তুলে? সঞ্জীব খুব আস্তে কী যেন একটা বলতে গিয়েছিল তার আগেই গোপাল সর্দার বেশ আগ্রহ দেখিয়ে বলল, ‘হ্যাঁ। আমরা সবাই যেতাম। ও যেত আমাদের সঙ্গেই। সবারই মাল তুলতে হত। রাত নেই, বেরাত নেই, ঘুমের মধ্যেও যখন-তখন কোম্পানির লোক এসে ডেকে তুলত: এই স্পটের কাজ শেষ এবার আরেক স্পটে যেতে হবে। ব্যাস! অমনি রেডি হয়ে যেতাম।
বোরিংয়ের কাজ সেই বহু আগে দেখা। যখন বাড়ি বাড়ি টিউবওয়েল। যে প্রশ্নটা মনের ভেতর এতক্ষণ ঘুরপাক খাচ্ছিল, জিজ্ঞাসা করে ফেললাম হাত-কাটা ছেলেটাকেই। তুমি একহাতে কীভাবে বোরিংয়ের কাজ করতে? এক হাতে অত শক্তি দিতে পারতে ?
বলল, পারতাম। এক হাতে ধরতাম আর বুক-পেট দিয়ে ঠেলতাম।
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
আরও পড়ুন: মৃত্যু নিয়ে এই লেখা পড়তে অসুবিধে হলে থেমে যাবেন
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
ত্রিপুরার ওদের ওই বোরিংয়ের কাজের মাঝেই হঠাৎ বিদেশ থেকে এসে পড়ল ভাইরাস। হঠাৎ করে বন্ধ হতে শুরু করল সবকিছু। দেশজুড়ে শুরু হল লকডাউন। কাজ গেল থেমে। সপ্তাহ শেষে বাজার যা যতটুকু গাড়ি করে আসত তার পরিমাণ গেল কমে। তাবু বেঁধে শুরু হল একসঙ্গে এক-দেড়শো জনের বাস। গাদাগাদি করে শোয়া। জলের অভাব। বেড়ে গেল বাড়ি ফেরার অনিশ্চয়তা। বারবার ওখানকার ঠিকাদারকে ফোন করে করে হতাশ হয়ে যখন শেষে ফিরে আসার ক্ষীণ আশা দেখা দিল, তখন জেনেছিল ওদেরই মাস চার-পাঁচেকের উপার্জনের টাকা থেকে কেটে নিয়ে কাটা হবে ফেরার ফ্লাইটের টিকিট। খরচ-খরচা তাতে কী হয়েছিল জানা নেই। কিন্তু বাড়ি ফিরে জেনেছিল– ওদের পাওনার কিছুই আর বাকি নেই!
নদী-ঘেরা এই দ্বীপগুলির ছেলেরা পাহাড়ের গা বেয়ে জঙ্গল কেটে কেটে উঁচু নিচু এবড়োখেবড়ো পথ বেয়ে মেশিনপত্র কাঁধে নিয়ে ওঠার পরিশ্রম মেনে নিয়েছিল। মেনে নিয়েছিল দু’হাতে বা এক হাতে বুক-পেট দিয়ে পাথুরে রুক্ষ মাটিতে বোরিং করার কসরত। মেনে নিয়েছিল মাসের পর মাস চাল-ডাল ফুটিয়ে খাওয়ার কষ্ট। মেনে নিয়েছিল রাত-ভোরে যখন তখন কাঁচা ঘুম ভেঙে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় মালিকের আদেশ মেনে নীরবে মেশিনপত্র নিয়ে যাত্রা শুরু করা।
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
আরও পড়ুন: মৃত্যু নিয়ে এই লেখা পড়তে অসুবিধে হলে থেমে যাবেন
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
আবারও মেনে নেবে ওরা। ‘ওরা’ মানে শুধু ওই সুন্দরবনের গোসাবা ব্লকের সর্দার পাড়ার ছেলেগুলো নয়। রাজ্যের আনাচকানাচে পাড়া পাড়া থেকে যাওয়া লাখ লাখ ছেলে। যারা এই আজকেও কেউ আছে নদীর চড়ে, কেউ পাহাড়ে, কেউ মরুভূমিতে, কেউ তেতে-ওঠা শহরের আন্ডার কন্সট্রাকশান বিল্ডিংয়ের কোনও ন্যাড়া ছাতে। কেউ মশলা মাখছে, ইট বইছে, বোরিং করে তেল তুলছে, দাউ দাউ করে জ্বলে ওঠা উনুনের উপর কালো কড়াইতে ফুটন্ত তেলে খুনতি নাড়ছে, জল টেনে তুলছে, হোটেলের ঢাউস ঢাউস বাসন মাজছে, বরফের উপর ফ্যাকাসে পা-দুটো নিয়ে দাঁড়িয়ে আইসক্রিম বানাচ্ছে, দড়ি বেয়ে উঠে যাচ্ছে ওই আকাশছোঁয়া কোন পিলারের উপর।
ভোট চলছে সারা দেশে। ৮৫ বছরের বেশি বয়স্ক বরিষ্ঠ জনগণ বা বিশেষভাবে সক্ষম জনগণের জন্য প্রিসাইডিং অফিসার পৌঁছে যাবে ঘরে ঘরে। নিশ্চিত করা, যাতে নাগরিক অধিকার প্রয়োগ করতে পারেন সবাই। শুধু পারবে না ওরা। ভোট চলতে চলতে ভোট শেষ হয়ে যাবে। ওদের আঙুলের ছাপ থাকবে না ছবির পাশে নাম লেখার ফাঁকটুকুতে। কেউ বলেনি কোনও বিশেষ ট্রেন আসবে। কোনও শ্রমিক স্পেশাল ট্রেন এসে দাঁড়াবে না ওই ছেলেদের নিয়ে হাওড়া বা শিয়ালদহ মালদা বা বালুরঘাট…