একটা ঐতিহাসিক ভাবনায় পশ্চিমবাংলার দেওয়াল লেখা আলাদা। বাংলাদেশের বড় দুটো রাজনৈতিক লড়াই ভাষা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধের শিল্প নির্মাণ ও প্রয়োগে ভূমিকা নিয়েছিল ঢাকার আর্ট কলেজ, যার এখন নাম চারুকলা অনুষদ– এর ছাত্রছাত্রীরা, শিক্ষকরা। তখনকার ব্যানার, পোস্টার, দেওয়াল লেখা, অক্ষর নির্মাণ, অক্ষরের সঙ্গে ছবি শিল্পচর্চারই অংশ হয়ে গিয়েছিল। রাজনৈতিক শিল্পচর্চা, শিল্প প্রাতিষ্ঠানিক চর্চা, রাজনীতিকতায় শিল্পচর্চা। যেটা সম্ভবত পশ্চিমবাংলায় হয়নি।
এবারের দেওয়াল লেখার কথা পাশের দেশ বাংলাদেশ নিয়ে।
বাংলাদেশের দেওয়াল লেখা বাংলায়। যাঁরা এই অবধি পড়লেন, তাঁরা ভাবছেন তাই তো হওয়ার কথা। না, তা নয়। তা যাতে না হয়, তার জন্য পাকিস্তানের শাসকরা বাংলার বদলে উর্দুকে নিয়ে আসতে চেয়েছিল। বাংলাদেশ তখন পূর্ব পাকিস্তান। আর এখান থেকেই তখনকার পূর্ব পাকিস্তান, এখনকার বাংলাদেশের লড়াই। ভাষার জন্য, বাংলা ভাষার জন্য, বাংলা অক্ষরের জন্য সংগ্রাম। বাহান্নয় পূর্ব পাকিস্তানে যা ভাষা আন্দোলন, তা-ই একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধ, বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম।
এই সংগ্রামেরই মাঝখানে বাংলা ভাষা, বাংলা অক্ষর, বাংলায় লেখা, বাংলা অক্ষরে দেওয়াল লেখা।
আমাকে অনেকবার বাংলাদেশের নানা জায়গায় যেতে হয়েছে। প্রথমে আমার পড়ানোর জায়গা কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজে, পরে অন্য অন্য কাজে। অর্থনীতির কাজে গিয়ে আমি বাংলাদেশের রাজনীতিক ছবিতে আটকে যাই। কার্টুন, পোস্টার, দেওয়াল ছবি, দেওয়াল লেখা, অক্ষর নিয়ে ম্যুরাল দেওয়ালে।
ঢাকার দেওয়াল জুড়ে লেখা। প্রধানত রাজনীতি। বিশেষত শাহবাগ এলাকায়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিতরে, বাইরে, আশপাশে।
বাংলা দেওয়াল লেখার উৎসব একুশে ফেব্রুয়ারি, ভাষা দিবসে, শহিদ মিনারের আশপাশে, শহিদ মিনারের অন্য নাম ভাষা-শহিদ মিনার।
প্রতিবার একুশে ফেব্রুয়ারিতে শহিদ মিনারকে ঘিরে যে শিল্প উৎসব, তার পরিচালনায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদ। অনুষদের শিক্ষিকা শিক্ষক, প্রাক্তন ও বর্তমান ছাত্রীছাত্র। ক’দিন ধরে সকাল-রাত জুড়ে দেওয়াল লেখা।
শহিদ মিনারের ঠিক মুখোমুখি অনেকটা দেওয়াল জুড়ে বড় বড় অক্ষরে দেওয়াল লেখা– ‘আমার ভায়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি আমি কি ভুলিতে পারি।’ তার নিচে আমার বন্ধু চারুকলা অনুষদের শিক্ষক শিশির ভট্টাচার্যের ছবি। অক্ষর আর ছবির হাত ধরা।
এই দেওয়ালটার দু’পাশে অন্য অন্য দেওয়ালে লেখা, দেওয়াল লেখা। নানা বাঙালি মনীষীর, দুই বাংলার মনীষীর কথা লেখা। দেওয়ালে লিখে দিয়ে পড়ানো, মনে করানো, ভাবানো। দেওয়াল লেখায় তখন দর্শন, রাজনীতি, ইতিহাস, ভবিষ্যৎ।
শহিদ মিনারের সামনে বিরাট দেওয়াল। মাঝে মাঝে কয়েক সারি ইট বসিয়ে বাঁধানো, দেওয়ালের জোর বাড়ানোর জন্য। এই একটা একটা ভাগের দেওয়ালে একুশে ফেব্রুয়ারিতে নামজানা বাঙালিদের কথা লেখা হয়। তাদের লেখা কথাকে দেওয়ালে লেখা।
একুশে ফেব্রুয়ারিতে শহিদ মিনার চত্বরে শিল্প উৎসবের দায়িত্ব ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের। অনুষদের ডিন আমার পুরনো বন্ধু নিসার হোসেন। নিসারকে বলেছিলাম এবারের একুশের দেওয়াল লেখার ছবি তুলে পাঠাতে। নিসার এবার পাঠিয়েছে। খুব পুরনো দিনের বাঙালি লেখক থেকে এখনকার বাঙালি লেখকদের লেখার নির্বাচিত অংশ।
কেন এই লেখাগুলোই বাছা? এই লেখাগুলো দিয়ে কী বলতে চাওয়া? কোন ইতিহাসকে মনে করিয়ে দেওয়া? কেন মনে করিয়ে দেওয়া?– দেওয়াল তখন ইতিহাস, দর্শন, ভবিষ্যৎ, দিক নির্দেশ। পড়ে নিতে হবে। পড়িয়ে নেওয়া, দেওয়ালে লিখিয়ে, দেখিয়ে, বুঝিয়ে।
দেওয়াল লেখা তখন নিছক অক্ষর সমাবেশ নয়, আরও কিছু। মনে করানো, ভাবানো, তৈরি থাকানো। দেওয়াল লেখা তখন বই, কথা, ইতিহাসের, দর্শনের, গদ্যের, পদ্যের, এসবের রাজনীতির।
নিসারকে বলেছিলাম, লিখেছিলাম জানাতে এই সব কারা ঠিক করেন? কেন ঠিক করেন? কীভাবে নির্বাচন এই লেখার বিষয়? পরে যদি কখনও ঢাকায় যাই, জেনে নেব।
ঢাকার খানিকটা রাস্তার দেওয়ালে ম্যুরাল বানানো। ভাষা আন্দোলন নিয়ে ম্যুরাল। ম্যুরাল বাংলা অক্ষর। প্রায় দেওয়াল লেখা।
শুধু একুশের উৎসবেই দেওয়াল লেখা নয়। ঢাকা রাজনীতির, ছাত্র রাজনীতির শহর। বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিতরে, বাইরে দেওয়ালে ছাত্র রাজনীতির অক্ষর, দাবিদাওয়ার দেওয়াল লেখা, কখনও সঙ্গে দেওয়াল ছবি।
বাংলাদেশ দেওয়াল লেখার অক্ষর নিয়ে চর্চা করে, পরীক্ষানিরীক্ষা করে। খুব মন দিয়ে দেখলে সেসব ধরা পড়ে। অক্ষরের টান, গড়ন, ওপর-নিচের পরিসর নিয়ে পরীক্ষা করে।
একটা ঐতিহাসিক ভাবনায় পশ্চিমবাংলার দেওয়াল লেখা আলাদা। বাংলাদেশের বড় দুটো রাজনৈতিক লড়াই ভাষা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধের শিল্প নির্মাণ ও প্রয়োগে ভূমিকা নিয়েছিল ঢাকার আর্ট কলেজ, যার এখন নাম চারুকলা অনুষদ– এর ছাত্রছাত্রীরা, শিক্ষকরা। তখনকার ব্যানার, পোস্টার, দেওয়াল লেখা, অক্ষর নির্মাণ, অক্ষরের সঙ্গে ছবি শিল্পচর্চারই অংশ হয়ে গিয়েছিল। রাজনৈতিক শিল্পচর্চা, শিল্প প্রাতিষ্ঠানিক চর্চা, রাজনীতিকতায় শিল্পচর্চা। যেটা সম্ভবত পশ্চিমবাংলায় হয়নি।
ঢাকায় বাংলা অক্ষর প্রাতিষ্ঠানিক চর্চারও বিষয়। বাংলাদেশের নামকরা অক্ষরশিল্পী সব্যসাচী হাজরা বাংলা অক্ষর নিয়ে গবেষণামূলক বই বানিয়েছেন। বাংলাদেশের শিল্পীদের ছবিতে অক্ষর, দেওয়াল লেখা চলে এসেছে ছবির বিষয় হয়েও।
লেখাটি এবার শেষ করব। বাংলাদেশে আমার প্রিয় শিল্পী রফিকুন নবী। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের আগেকার ছাত্র, শিক্ষক। রফিকুন নবী রাজনৈতিক আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেছেন শিল্পী হিসেবেই।
আমাকে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘বাংলাদেশ’ পড়াতে হত। প্রথম ঢাকা যাওয়া পড়ানোর ও গবষণার তথ্য সংগ্রহে। সেবার, সেই প্রথম বারেই আমার পরিচয় রফিকুন নবীর কার্টুন চরিত্র ‘টোকাই’-এর সঙ্গে। আমি টোকাইকে ভালোবেসে ফেলি। টোকাই একজন পথবালক। রাস্তাই তার পৃথিবী। এমন একটি চরিত্রকে দিয়ে রফিকুন নবী জানিয়ে দেন তাঁর মতামত নানা বিষয়ে।
সেই টোকাইকে নিয়েই আমার এই লেখা শেষ করব।
রফিকুন নবীর টোকাইকে নিয়ে কার্টুনে দেওয়াল লেখা আছে। আমি একটা দেখাব। টোকাই তখন সাদা-কালোয় আঁকা। দেওয়াল লেখাটি পরিষ্কার করে আঁকা।
অনেক পরে রফিকুন নবী সাদা-কালোয় আঁকা টোকাইকে কার্টুন চরিত্র থেকে রং দিয়ে আঁকা ছবিতে দার্শনিক চরিত্রে, আমার ধারনায় রফিকুন নবীর আত্মভূমিকায়, নিয়ে আসেন।
সেই রং দিয়ে আঁকা টোকাই ছবিতেও দেওয়াল লেখা। যে লেখা ভেঙে গেছে, ছড়িয়ে গেছে, আবছা হয়ে গেছে। রফিকুন নবীর দেশ, রাজনীতি নিয়ে স্বপ্নের মতো। রফিকুন নবী ভাষা আন্দোলনে, মুক্তিযুদ্ধে পরবর্তীকালে শিল্পী-সৈনিক। আমার সঙ্গে আড্ডায় সে কথা আমার শোনা, বোঝা।
রফিকুন নবীর এখন ছবিতে দেওয়াল লেখা প্রতীকী, যারা পারবে পড়ে নেবে। দেওয়াল লেখা শুধুই অক্ষর লেখা নয়।
কৃতজ্ঞতা: নিসার হোসেন, মেহদি হক
…দেওয়াল লেখার কথা অন্যান্য পর্ব…
পর্ব ১। লেখার দেওয়াল সবসময় তৈরি থাকে না, তৈরি করে নিতে হয়
পর্ব ২। পাড়ার দেওয়াল লেখা দেখে পাড়াকে বোঝা যায়
পর্ব ৩। আন্দোলনের চিহ্ন যে দেওয়াল লেখারা, তাদের মুছে দেওয়া হয়েছে