পুজো মানেই অল্প জিরিয়ে নেওয়া। আর অল্পের হাত ধরেই আসে গল্প। জীবনের ফাঁকফোকরে কয়েক মিনিট একটু অন্য জীবনের ডেরায় ঘুরে আসা। একটু চক্কর মেরে আসা আরেকটা জীবনে। সে জীবন, নিজের জীবন থেকে খুব দূরের নয়। আসুন পড়ে নিই, রোববার.ইন-এর পাতায় নবমীর গল্প। লিখেছেন অলোকপর্ণা।
জ্বরের ঘোরে যিশুকে পেল হারাধন। লোকে ভূত দেখে, ছাপোষা ভগবান দেখে, মৃত বাপ-ঠাকুরদাকে দেখতে পায় জ্বর এলে, যাঁরা দল ভারি করার তাগিদে জ্বোরো রুগির হাত-পা ধরে টানাটানি করে। কিন্তু হারাধন সেসব নয়, বিলাতি ঠাকুর দেখতে পেল জ্বরের ঘোরে। ‘মা, মা গো’ বলে সে ডাকছিল আছাড়িপিছাড়ি দিয়ে, জ্বরের বেদনায়, নিজের অসহায়ত্বে, আর সেইক্ষণে যিশুঠাকুর এলেন।
এসে হারাধনের পায়ের মাপ নিয়ে চলে গেলেন।
ঘাম দিয়ে জ্বর সারল আর হারাধন হুব্বা পড়ে রইল।
যিশুভগমানের গায়ে গুয়ে বরণ রেশমি জোব্বা। আলো পোঁদ উল্টে পড়ছে তাতে যেন। আলো ভিজে গেছে যেন।
যিশুদেবতার মুখে দাড়ি, হারাধনের চেয়ে লম্বা, দাড়ির আড়ালে চুলকুনি নাই, হাজা নাই। যিশুবাবার গায়ে ঘামের গন্ধও ছিল না, হারাধন জ্বরের ঘোরে তাকে জাপটে ধরার সময় শুঁকে দেখেছে। এই তল্লাটে অমন পোশাকে, সেপ্টেম্বরের রোদে ঘামের গন্ধ হয় না কেবল ভূত আর ভগবানেরই। অতএব উহা কোনও আফগানি ব্যক্তি নন, বটতলার তারকাটা তড়িৎ নয়, স্বয়ং যিশু– ভিনদেশি খ্রিস্ট।
তার চক্ষুদুই নির্লিপ্ত। সরকারি বাসের কন্ডাক্টারের মতো। টাকা বই কিছু বোঝে না। টিকিট কাটছে তো কেটেই যাচ্ছে, পায়ের মাপ নিচ্ছে তো নিয়েই যাচ্ছে। উপরন্তু গায়ে নিজস্ব উর্দি।
শুধু গা-টা বরফের মতো ঠান্ডা। মৃতর মতো। অথবা সরীসৃপের মতো। অথবা ছোটবেলার চাঁদমনসার পুকুরের জলের ন্যায়। সেই যে হারাধনের কাঁটা লেগেছে গতরে, সে আর নামছে না। শজারু বা ফণিমনসা হয়ে বসে আছে সে মেঝের এককোণে।
তার মনে পড়ে, একবার জবার গায়ে হাত লেগেছিল বাবলা গাছের পাতা ছাঁটতে গিয়ে। মেয়েটা গা ঘেঁষে দাঁড়িয়েছিল, তার গায়ের মৎস্যগন্ধ ম-ম করছিল পুকুরের ধারে। গাছ আর হারাধনের গায়ের কাঁটা এক হয়েছিল সেবার।
জবা, যিশু, জ্বর– সব এক হয়ে যায় জ্বরের কোপে।
ভালো করে মনে করলে দেখা যাবে, জবা বা যিশু তাকে জড়িয়ে ধরেনি, বরং ঠেলে সরিয়ে দিয়েছিল বাবলা গাছের দিকে, জ্বরের খাদানে। আর পায়ের মাপ নিতে বসে গেছিল। যেভাবে কাগজের ওপর পায়ের পাতা ফেলে পেন বুলিয়ে নেওয়া হয়, ঠিক সেইভাবে ঈশা হারাধনের বাঁ পায়ের মাপ নিয়েছিল এরপর।
কাগজ কোথায় পেল সে?
খাতা কলমের সঙ্গে স্যাঙাৎ নেই হারাধনের কোনওকালেই। ‘জ’ আর ‘ঘ’ গুলিয়ে যায়, ‘ত’ আর ‘ধ’-কে অভিন্ন মনে হয় এখন তখন। ‘ৎ’-এর কোনটা মনে পড়ে না। নিজের নামটুকু চিনতে পারে সে এখনও পরিচয়পত্রে। আছে তার একখানা পরিচয়পত্র, সে আর কিছু হতে পারুক বা না-পারুক সে ভোটার, ইহা তার জীবনের অন্যতম তাৎপর্যও বটে। কারণ হারাধনের আর কোনও পরিচয় নাই। সে কারও বাপ, দাদা, চাচা, মামা, খালা, জামাই নয়। তার পোঁদে-কোলে জনমানব নাই। হারাধনের একটি ভোটার অবতার বেঁচে আছে।
জ্বর হামাগুড়ি দিয়ে আসে যায়।
হারাধন ঘরের কোনায়, লাথ খাওয়া কুত্তার মতো, পড়ে থাকে।
পায়ের মাপ নিয়ে ঈশ্বরের সন্তান করবেটা কী?
হারাধন বোঝে তার পায়ের পাতা বাড়ছে অতর্কিতে। চোখ বুজেই সে টের পাচ্ছে পায়ের পাতা বাড়ছে, ফুলছে লুচি বা নুচির মতো। এইভাবে বাড়তে থাকলে এ-ঘরে টেকা দায় হবে আর হারাধনকে হাঁটতে হবে দু’হাতে। পা তখন হারাধনের মাথা হয়ে উঠবে। হারাধনের হয়ে সে-ই কথা বলে বেড়াবে সব জায়গায়, ভাষণ দেবে, গালি দেবে, হারাধনের বাম পা লাথাবে না আর। পা ভদ্দরলোক হয়ে উঠবে। পা ভদ্দরলোক হয়ে উঠতে চাইছে বুঝতে পেরে হারাধনের ভিতরে একটা ছটফটানি জ্বরের মাঝেও খাবি খায়।
জোর করে সে চোখ খোলে, আর চেষ্টা করে দেখার।
পৃথিবী ঘুরছে। আজ হারাধনকে জানান দিয়েই পৃথিবীটা ঘুরছে। হারাধন চোখ বোজে।
ভোটার হারাধন জ্বরকে ভয় করে না, সয়, যেমন আর পাঁচটা বিষয়।
এ-ও একদিন সেরে যাবে, বা কেটে যাবে। রেশ রেখে যাবে, নখ বা আঁচড়ের দাগ, কমজোর ফুসফুস, আধখাওয়া মাথা, ইত্যাদি ইত্যাদি। সে জানে জ্বর একটা অদৃশ্য ডোরাকাটা বাঘ। এই হলুদ/ এই কালো।
এই মন্দ/ এইই ভালো।
জ্বরের ঘোরে পদ্য করে হারাধন খিলখিলিয়ে হেসে ওঠে। দেওয়ালের টিকটিকি বলে, ‘মরণ!’
তবে ওষুধ কি নেই?
ওষুধ আছে দোকানে, হাসপাতালে, গাছের পেটে, ঘাস পাতার শিরায় শিরায়। তাকে আহরণ করতে হয়। অথবা হরণ। জ্ঞান লাগে, টাহা লাগে, পাইসা লাগে, কলজের জোর লাগে। হুব্বা হারাধন পেটে ভাঁজ ফেলে পাপোশ হয়ে পড়ে আছে ঘরের কোনায়। তার টাহা নাই, জ্ঞান নাই, জোর নাই, বউ নাই, বাছা নাই। ঔষধ আনিবার মানুষ নাই। জলপট্টি দেওয়ার লোক নাই। কোলে মাথা রেখে ঝিনুকে করে পথ্য গিলিয়ে দেওয়ার জেনানা যে কিনা হারাধনের মা ছিল একদিন, সেও নাই কষ্মিনকাল হতে।
তাতে দোষ নেই, পরোয়া নেই, হারাধনের দশটি স্মৃতি তা পেয়ে পেয়ে তাগড়াই হইছে, যাদের জাবর কেটে কেটে সে জ্বর পার করিতেছে এযাবৎকাল।
স্মৃতি এক
বালক হারাধন কালীকে কোলে নিয়ে অপেক্ষা করছে ট্যাকনের জন্য। ট্যাকন বলেছে পাল খাওয়াতে দেবে, পয়সা নেবে না। দূর থেকে ট্যাকন আসছে সাদা একটা প্রাণী নিয়ে। প্রাণীটা হাঁস না পাঁঠা না যিশু কে জানে।
একটি মেষশাবক হেঁটে এসে হারাধনের হাত চেটে দেয়, হারাধন দেখে যিশু তাকে জাপটে ধরছেন। যিশুর পেটে মাথা রেখে হারাধন ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদে। ‘জ্বর ভগবান, জ্বর সারায় দাও!’
স্মৃতি দুই
সাইকেলে করে লোকটা বাড়ি ফিরছিল। সাইকেল দাঁড় করিয়ে সে পেচ্ছাপ করতে নামে আলের নিচে। লুঙ্গি গুটিয়ে উবু হয়ে বসে। আলের অন্যধার থেকে এসে হারাধন সাইকেলের হ্যান্ডেলে ঝোলানো থলে থেকে মাছ চুরি করে পালায়।
রাতে গলায় কাঁটা ফুটেছিল।
তিন দিন ব্যথা ছিল।
স্মৃতি তিন
শ্যামলের বিয়েতে ট্যাক্সি করে হালিশহর যাওয়া হয়েছিল। হলুদ ট্যাক্সি। ৭ জন। ড্যাশবোর্ডে মা কালী, গলায় জ্যান্ত জবা ফুল।
জবা গলায় দড়ি দিয়েছিল, এমনিই। আর কিছু করার ছিল না তাই।
যিশু এসে লুফে নেয় হারাধনকে, দোদুল দোলায়। তারপর পায়ের মাপ নিয়ে ফিরে চলে যায়।
স্মৃতি চার
হারাধন জামা বানাতে গিয়েছে লোটাস টেলার্সে। কমলবাবু ফিতে দিয়ে তার ছাতি মাপছেন, হাত মাপছেন, ডানা, লেজ, শিং মাপছেন। পেটি, রাঙ, খাদ মাপছেন।
যিশু আসছে, মাথায় হাত বোলাচ্ছে। মাথা মাপছে।
স্মৃতি পাঁচ
দশটা বাচ্চা হারাধন জোগাড় করেছে খড়গপুর স্টেশনের বাইরে থেকে, তারা সকাল থেকে ময়লা কুড়োয়। কাচরা মাখে। বিকেলে হিসেব দেয়। রাতে আঠা শোঁকে।
স্মৃতি ছয়
জবা হারাধনকে বাবলা কাঁটায় ঠেলে দিচ্ছে। অথচ যেন, এরপরেই হারাধনের মূল্যবান হস্ত (তার মস্তকের চেয়ে অন্তত মূল্যবান) ছুঁয়েছিল জবার গলা, কাঁধ, সে রেখেছিল নাক জবার কানে।
জবা হারাধনের বাঁ পায়ের মাপ নেয় আর হাসে, খিলখিলিয়ে হাসে আর কয়, ‘কোনটুকু!’
স্মৃতি সাত
বাসরঘরে সাপের মতো যিশু আসছে, জ্বর মাপছে, বুকে টেনে নিচ্ছে। দূরে ঠেলে দিচ্ছে।
কাছে আসছে, আর দূরে যাচ্ছে। সমুদ্রের ঢেউয়ের মতো খামখেয়ালি যিশু। জ্বর করছে হারাধনের। ডর করছে।
স্মৃতি আট
এখানে হারাধন নেই। এ যেন হারাধনের পূর্বপুরুষের স্মৃতি। গুটিকয় ম্যামথ দাঁড়িয়ে, তাঁদের বীভৎস সব দাঁত। সামনে গঙ্গাসাগর। ম্যামথেরা বাবলা পাতা চেবাচ্ছে। বড় বড় দাঁত দেখিয়ে ভয় দেখাচ্ছে জ্বরকে।
জ্বর ভয় পাচ্ছে।
স্মৃতি নয়
স্মৃতি নয়
কল্পনা। হারাধনের বাঁ পা বড় হচ্ছে, চটির চেয়ে বড়, মাথার চেয়ে বড়, নেতার চেয়ে বড়, পতাকা হয়ে উঠছে হারাধনে বাঁ পায়ের পাতা, মিটিঙে যাচ্ছে, মিছিলে যাচ্ছে, জ্বরের ফাঁকতালে।
স্মৃতি দশ
একদিন জ্বর সেরে যাবে। সেদিন হারাধন বুকে হেঁটে গর্ত হতে বেরিয়ে আসবে, অবাক চোখে তাকিয়ে দেখবে আকাশ জুড়ে বিজ্ঞাপনের বিলবোর্ড। তাতে বাঁ পায়ের বিরাটাকৃতির চামড়ার জুতোর বিজ্ঞাপন, পুজোর বাজারে। হারাধনের পায়ের জন্য প্রস্তুত।
জ্বরের ঘোরে স্মৃতির বেশে ভবিষ্যৎ দেখে ফেলে হারাধন। আর তার কপাল চাপড়াতে ইচ্ছে হয়।
গালের হাজা চুলকোতে ইচ্ছে করে।
ঝাল চাটনি দিয়ে শিঙাড়া খেতে ইচ্ছে করে।
ইচ্ছে করে পরের জন্মে যিশু হতে।
‘ভগবান, পরের জন্মে তুমি কোরো। তুমি করে দিও।’
জ্বরের ঘোরে পড়ে থাকা যিশুকে বুকে তুলে নেয় ভগবান হারাধন। যিশুর মাথায় হাত বোলায়। বলে, ‘কাঁদে না, কাঁদে না।’ গায়ে তার নেই ঘামের গন্ধ, গালে তার নেই হাজা, বরং আলো লটকাচ্ছে গতরে।
সে যিশুকে বুকে ধারণ করে, তারপর যিশুর বাঁ পা নিজের বুকে তুলে নিয়ে পায়ের পাতার মাপ নেয়, এবং অন্তর্হিত হয়।
জ্বরের ঘোরে যিশু বোঝে, হারাধন এসেছিল।
জ্বর বা হারাধন, কেউ একজন এসেছিল।
কেউ তো অন্তত এসেছিল।
অলংকরণ: শান্তনু দে