পুজো মানেই অল্প জিরিয়ে নেওয়া। আর অল্পের হাত ধরেই আসে গল্প। জীবনের ফাঁকফোকরে কয়েক মিনিট একটু অন্য জীবনের ডেরায় ঘুরে আসা। একটু চক্কর মেরে আসা আরেকটা জীবনে। সে জীবন, নিজের জীবন থেকে খুব দূরের নয়। আসুন পড়ে নিই, রোববার.ইন-এর পাতায় ষষ্ঠীর গল্প। লিখেছেন প্রতিভা সরকার।
বাঁশবনে ঢোকার আগে তমালী দেখে এসেছে ঘরের আড়া থেকে ঝুলছে দুটো দড়ির বৃত্ত। শক্তপোক্ত, ঘাড়ের কাছে গিঁট দেওয়া। গলায় পরে নিলেই হল। একটু ছটফট, তারপরই সব মান-অপমানের ঊর্ধ্বে।
সুরেশ টেনেটুনে দেখে বলল, ‘হাতি ঝুললেও ছিঁড়বে না। যা, তুই যা যা করবি ভেবিছিস কইরে আয়। গরুটার গলার দড়ি খুইলে দিবি আর লাউ গাছের গোড়ায় এট্টু বেশি কইরে জল ঢালিস দিনি। আবার কবে কে দেবে, ঠিক কী! সবে উলসে উঠিছিল চারা গাছটা!’ বলে সে আধপোড়া বিড়ি কান থেকে খসিয়ে খুব জোরে জোরে টান দিতে লাগল।
দুপুর দুপুর না ঝুলে পড়ে উপায় নেই তাদের। তাপস হাজরা বলে গেছে সূর্য ডোবা অবধি অপেক্ষা করবে, তারপর এমন শিক্ষা দেবে সুরেশ আর তার বউকে, যে সারা গ্রামের লোক শিউরে উঠবে! এইটাই তমালীর খুব আশ্চর্য লাগে, সুরেশ না হয় লোকের টাকা ফেরত দিতে পারেনি, তার সদ্য বিয়ে করা বউ– অন্য গাঁয়ের মেয়ে তমালী কী দোষ করল! সে তো ভালো করে এ গ্রামের রাস্তাঘাটও চেনে না। সেদিন যে তাপস দলবল নিয়ে এসে তাদের স্বামী-স্ত্রীকে ন্যাড়া-ফ্যাড়া করে, মুখে চুনকালি মাখিয়ে প্রবল বেইজ্জতিটা করলে, তার পরদিনই লজ্জায়-ঘেন্নায় বাপের বাড়ি পালিয়ে যাবে ভেবেছিল তমালী। কিন্তু সিঁদুর-পরা ন্যাড়া মাথা নিয়ে অচেনা রাস্তায় বেশিদূর যেতে পারবে না, তাপসের লোকেরা ঘাড় ধরে ফিরিয়ে আনবে– এই বুদ্ধিটা আছে বলেই সে-ভাবনার গাছ গোড়াতেই কেটে দিতে হল। মনখারাপ হলে ঘরের লাগোয়া এই বাঁশবনে এসে অন্যদিনও হাপুস নয়নে কাঁদত, সেদিনও কাঁদল।
কোন চাকরি কাকে দেবে বলে সুরেশ কার টাকা খেয়েছে, তমালী এইসব আদৌ জানে না। বিয়ের তিন মাস পর, এই এখনও জানে না। তবে বিয়ের পর থেকেই সে বোঝে, লোকটার মনে বড় ভয়। বাতাসে সুপুরির খোল মাটিতে আছড়ে পড়লেও তার চোখ বড় বড় হয়ে যায়। ঝড় এসে দরজা চাপা দেওয়ার ডাঁশায় খটাখট আওয়াজ তুললে, সে চৌকি থেকে লাফিয়ে নামে, কে কে ওইখানে! পাড়ার ভুলোটাকে তমালী দু’বেলা দু’মুঠো দেয়, তাই সেটা রাতবিরেতে তাদের বাড়ি পাহারা দেয়। অন্ধকারে কিছু খচমচ করলে সেটা ভৌ করে, আর সুরেশ ঘুম ভেঙে তমালীকে জড়িয়ে ধরে হাহাকার করে, ‘‘টাকা আমার কাছে নাই। আমি তো শুধু তুলিছি। দু’-পয়সার কমিশন খেয়িছি। আর তো কিছু চক্ষে দেখিনি। এই তরে ছুঁইয়ে বলতিছি বউ।’’
তমালী সান্ত্বনা দিতে গিয়ে দেখে ভিতু লোকটার চোখ বেয়ে জলের ধারা বুক ভিজিয়ে দিচ্ছে, আর বুকের ভেতর যেন হামানদিস্তায় ঘা দিচ্ছে, এমন আওয়াজ!
প্রথম প্রথম তমালী স্বামীকে ভেবেছে জব্বর ভিতু, মাঝে মাঝে বিরক্ত হয়েছে। তবে মন তো খারাপ হয়েইছে, কারণ একে তো সিঁথেয় সিঁদুর পরানো স্বামী, তাছাড়া সুরেশকে তার খারাপ মানুষ মনে হয়নি কখনও। বোকা এবং ভিতু হলে সংসারে তাদের শেষ আশ্রয় হয় গন্ধভরা গোয়াল, নয় তো ভেঙে পড়া ঢেঁকি ঘর, এ তো বিধবা মায়ের একমাত্র মেয়ে হয়ে সে নিজের জীবনেও দেখেছে। না হলে পল্টুদার সঙ্গেই তার বিয়ে হত। বাজারে তাদের ওষুধের দোকান। বড় বাগানওয়ালা বাড়ি। তার বদলে এই এত দূরে আত্মীয়-স্বজনহীন অচেনা-অজানা একটা লোকের সঙ্গে রাজ্যের ঝামেলায় জড়িয়ে পড়া! ক্রমে সে বুঝতে পারে ব্যাপার খুব ঘোরতর। দু’-পয়সা কমিশন খেয়ে লোকটা গাড্ডায় পড়েছে, আর মধুর ভাণ্ড তুলে নিয়ে চলে গেছে অন্য মানুষ! কিন্তু সেসব তো বছরকার পুরনো ঘটনা। তখনও সুরেশ বিয়ে করেনি। টাকা ফেরত না পেয়ে সবাই যে তাকেই এমন চেপে ধরবে, সেটা বিয়ে করার সময় বোঝেনি বোধহয়। এখন বেচারার মাথায় না আছে কোনও মুরুব্বি, না আছে ব্যাঙ্কের অ্যাকাউন্টে কোনও মালকড়ি। উপরন্তু উল্টো বাগের নেতা তাপস হাজরার ভায়রাভাই টাকা ফেরত পায়নি বলে সে-ও এর মধ্যে ঢুকে পড়লে খেলা জমে একেবারে ক্ষীর হয়ে উঠেছে।
কিন্তু তমালী এর মধ্যে এল কোত্থেকে! সে তো তখন পিকচারে ছিলই না। গাঁয়ের মানুষ সেসব বুঝবে না, দল বেঁধে যখন-তখন এসে পালিয়ে বেড়ানো সুরেশ কোথায় জানতে চায়, বউয়ের গয়নাগাঁটি বেচে টাকা মেটানোর পরামর্শ দেয়। আর সঙ্গে চলে মুখখিস্তি। যত দিন যায়, ততই সেগুলো ধারালো হতে থাকে। একদিন যখন কে একজন সুরেশকে খারাপ পাড়ায় গিয়ে বউ বেচে টাকা শোধ করার কথা বললে, তমালী ছুটে গিয়ে বাড়ির পিছনের বাঁশবনে ঢুকে পড়ল।
সেদিনের পর থেকেই রোজ এখানে পালিয়ে আসে সে। জায়গাটা বড় ছায়া ছায়া, নীচের ঘাস এত ঠান্ডা, শীতলপাটি বিছানো যেন। গাদা শুকনো পাতার ওপর বসে তমালী প্রায়ই গুছিয়ে কাঁদতে বসে মুখ আকাশমুখো করে। যার সঙ্গে ভালো করে চেনাজানাই হল না, এর মধ্যেই যদি তার ঠগ-জোচ্চোর পরিচয় বেরিয়ে যায়, তখন চোখের জল ছাড়া আর কী সম্বল থাকে তার ঘরের মানুষের? দিনমানে সুরেশ ঘরে থাকে না, ফেরে গভীর রাতে, লোকের গঞ্জনা এড়াতে এইখানে এসে বসে থাকা অভ্যেস করে ফেলল তমালী। বাঁশবনের সীমানা শেষ হলে আরও কতরকম ঝোপঝাড়, গাছপালা, নানা রকম সবুজ যেন তার কান্নাভেজা চক্ষু দু’টিকে জুড়িয়ে দেয়। কত পাখি, খরগোশ, শেয়াল থাকে এই আশ্রয়ে। দুটো মজা ডোবা পাশাপাশি, মাছ ঘাই মারে, জল ছিটকে ওঠে, চুপিচুপি বেজি এসে তেষ্টা মিটিয়ে যায়। পুঁতির মতো চোখ দিয়ে তমালীকে দেখে। যেন বলতে চায়, এখানে কী কত্তে এয়েছ। তবু তমালী সন্ধের ঘোর না নামা অবধি বসেই থাকে। কখনও বৃষ্টিতে ভেজে, কোঁচড়ের মিইয়ে যাওয়া মুড়ি খায় বা টিফিন কৌটো করে আনা জলভাত। তারপর অন্ধকারে চুপি চুপি ঘরে ঢোকে। গ্রামের লোকের হেনস্তার ভয়ে ফোড়ন দিয়ে কিছু রাঁধতে অবধি সাহস পায় না।
গরুর দড়ি খুলে, লাউ গাছে এক বালতি জল ঢেলে ওই জায়গাটির জন্য শেষবারের মতো তমালীর মন কেমন করে উঠল। এই ক’দিন বেমক্কা গরম পড়েছিল, আজ কিন্তু আকাশ মেঘের ভারে ঝুলে পড়েছে, টিপ টিপ বৃষ্টি পড়া শুরু হল বলে, গাছের ছায়ায় খানিকটা সময় বসে থেকে কান্নাকাটি করে কলজে জুড়িয়ে আসা যাক! সত্যি খুব ভয় করছে তার। চারপাশ থেকে নিজেকে বেমালুম খুলে নিয়ে নিজের হাতে গলায় ফাঁস লাগিয়ে ঝুলে পড়া কি চাট্টিখানি কথা? কিন্তু অবলা বিধবা মায়ের একমাত্র মেয়ে সে, পাড়ার লোকে চাঁদা তুলে তার বিয়ের ব্যবস্থা করেছিল, স্বামী না থাকলে তার আর আপন বলতে রইল কে! সুরেশকে একা বাঁশের আড়া থেকে ঝুলতে দেখলে তাকে কি মানুষ ছেড়ে দেবে! চোখের জল মুছিয়ে টাকার দায় থেকে মুক্তি দেবে? আপন মনে ঠোঁট ওল্টায় তমালী। উলটে না জানি আরও কী কী হেনস্তা করবে তাকে। এমনিতেই রেপ থেকে শুরু করে গলার নলি ফাঁক করে দেওয়ার হুমকি তাকে দু’বেলা শুনতে হয়ে। সত্যি কথা বলতে কী, সেই ভয়েই গলায় ফাঁস লাগাতে রাজি হয়েছে তমালী, না হলে এখনও তার ভারি বেঁচে থাকার ইচ্ছে!
ভাবতে ভাবতে বাঁশঝাড়ের ভেতর ঢুকে যায় তমালী, দু’হাতে নুয়ে পড়া সরু ডাল উঁচু করে সেঁধিয়ে যেতে চায় বনের ছায়ার অন্ধকারে, যেন সে এক অন্য জগৎ, যেখানে সব অপমান এড়ানোর জন্য মরতে ভারি উদগ্রীব সুরেশ বা রক্তপিপাসু গ্রামবাসীরা কেউই তার নাগাল পাবে না! এমন সময় তার ন্যাড়া মাথায় টপ করে দু’ফোঁটা জল পড়ে। ওপরে তাকিয়ে দেখে মেঘ নেমে এসেছে যেন সবচেয়ে উঁচু গাছটার প্রায় মাথায় মাথায়, এদিকে আবার হেলে যাওয়া সূর্যের এক ফালি সোনালি আলো এসে পড়েছে ডোবার জলে। তার মা বলত, এই সময়টা খুব শুভ সময়। এই বৃষ্টি আর রোদ মাখামাখি হলে গাছের পাতা, শিকড়ে, ডালে ডালে ধরিত্রী মাতা রসের যোগান বাড়িয়ে দেন, চরাচর জুড়ে যত পশুপাখি সকলের মনে আনন্দ উপছে পড়ে। হরিণের পাল সবুজ ঘাসের ওপর শুয়ে পড়ে পিঠ ঘসে, পাখিরা এমনি এমনি ডাকাডাকি করে উড়তে থাকে, এমনকী, বনের রাজা যে বাঘ, সে অবধি শিকারের ঘাড়ে ঝাঁপিয়ে পড়ার আগে এক মুহূর্তের জন্য আনমনা হলে হতেও পারে। মোদ্দা কথা, নতুন প্রাণশক্তির এক হিল্লোল সব কিছুর ওপর দিয়ে অদৃশ্য বেগে বয়ে যায়। মানুষের পরাণও নাকি এইরকম সময়ে কী এক আনন্দে নেচে ওঠে। কুৎসিতকে লাগে সুন্দর, সুন্দরকে সুন্দরতর!
তমালীর মনে পড়ে গেল, ছোটবেলায় মামাতো ভাইবোনেদের সঙ্গে সঙ্গে সেও এইরকম আলো-আঁধারিতে আনন্দে হাততালি দিয়ে উঠত, রোদ-বৃষ্টি এক হয়িছে/ ভুঁড়োশিয়ালির বিয়া লেগিছে!
তার ছোটবেলাকে ফিরিয়ে এনে সত্যিই বৃষ্টির বেগ যত বাড়তে থাকে, ততই চারপাশের গাছগাছালির মাথায়, সর্বাঙ্গে ঝলমলিয়ে ওঠে এক অদ্ভুত রাঙা আলো। হঠাৎ ডোবার ওই ধারে তার চোখের সোজাসুজি লম্বা ঘাস নড়ে ওঠে, কিছু যেন গুঁড়ি মেরে বেরিয়ে আসছে ওখান থেকে! মোচার মতো দেখতে, প্রায় তারই সমান লম্বা, পাশাপাশি দাঁড়ানো বাঁশের তিন তিনটে কোঁড়ের পিছনে লুকিয়ে পড়ে তমালী। এবার তাকে কেউ দেখতে পাবে না, কিন্তু মাথা একটু এদিক-ওদিক করে নিলেই সামনের ডোবা, গাছপালা বিস্তীর্ণ প্রান্তর, তার ফাঁকে চাষের জমি, আরও দূরে ভিন গাঁয়ের সীমানা– সব সে পরিষ্কার দেখতে পাবে। কিন্তু ওটা কী, কী ওটা? অত জোরে নড়ছে কেন ঘাসবনটা? এবার ভয়ে তার সর্বাঙ্গ ঝনঝন করে ওঠে, তাপস হাজরার লোক নয় তো? জেনে ফেলেছে না কি তার এই লুকোনো আশ্রয়ের কথা?
বৃষ্টির ফোঁটাগুলোতে রোদ ঝলকাচ্ছে, যেন প্রত্যেকটাই এক একটা রামধনু! তার মধ্যে সবুজ ঘাসের বন ভেদ করে ফাঁকা জায়গায় বেরিয়ে এসেছে কমলা পিঠের এক ভুঁড়ো শেয়ালি। বৃষ্টিতে ভিজতে যেন সে খুব আনন্দ পাচ্ছে এইভাবে পিছনের পায়ে অল্পক্ষণের জন্য দাঁড়িয়ে এক পাক ঘোরা, তারপরই আবার চারপায়ে এদিক-ওদিক একটু ছুটোছুটি। এই-ই করে যাচ্ছে সে! খুব নিবিষ্ট চোখে জানোয়ারটাকে দেখতে থাকে তমালী, জলে তার বুকের সাদা লোম জমাট বেঁধেছে জায়গায় জায়গায়। পিছনের দু’পায়ে খাড়া হওয়ার চেষ্টা করলেই কমলা পিঠ নজরে আসছে। আনন্দে তার মুখ খানিকটা খুলে গেছে, সেখানে উঁকি দিচ্ছে শ্বদন্ত, নেতানো লালচে জিভের ডগা। মাথায় জল পড়ছে বলে মাঝে মাঝেই সে মাথা কান ঝেড়ে নিচ্ছে। কিন্তু হিংসা বা ধূর্ততার ছায়ামাত্র নেই শেয়ালির মার্বেলের মতো চোখে। যেন প্রকৃতির এই আলোছায়ার বৈপরীত্যে সে বেজায় আনন্দ পেয়েছে। থাকতে না পেরে মাটির অনেক ভেতরের গভীর গর্ত থেকে বেরিয়ে এসে তাই তার এই অদ্ভুত নাচনকোঁদন।
অনেকক্ষণ দেখার পর তমালী বুঝল শেয়ালির নাচে এক আশ্চর্য ছন্দ আছে। ল্যাজ মাটিতে ছুঁইয়ে দু’পায়ে দাঁড়ানো, সামনের পা দু’টিকে হাতের মতো শরীরের দু’পাশে ভাঁজ করে রাখা, আবার চারপায়ে চরকি কাটা, ছুটে যাওয়া ঘাস বনের দিকে, কিন্তু ভেতরে না ঢুকে আবার চলে আসা ডোবার ধারে, মাঝে মাঝে মুখ উঁচু করে আকাশ দেখা– এ যেন বিরাট কোনও আনন্দের অংশভাগ, যে আনন্দ ছন্দোময় আর অকারণ! তমালী আবছা বুঝল রোদবৃষ্টির হাত ধরাধরির মতোই এইরকম আনন্দময় মুহূর্তও মানুষ অথবা পশুর জীবনে খুব বিরল।
হাওয়ার শনশন, মেঘের গর্জন, দ্রুত মিলিয়ে যাওয়া সেই অদ্ভুত রাঙা আলো, মাটি আর গাছপালা থেকে উঠে আসা সোঁদা গন্ধ, ডোবার জলে বৃষ্টির ফোঁটার অজস্র ছোট বড় বৃত্ত, নৃত্যরত ভুঁড়ো শেয়ালি– সবার সঙ্গে একেবারে একাত্ম হয়ে গেল তমালী। এখন তাকে কেউ দেখলে বাঁশঝাড়ে বড় হতে থাকা কোঁড় অথবা ঘাপটি মেরে বসে থাকা একটি শেয়াল ভেবে বসতে পারে। তার চারপাশের গাছপালা পশুপাখি সব মিলে তমালীকে যেন বোঝাতে লাগল, এ ছন্দ মুক্তির ছন্দ, এ আনন্দ বেঁচে থাকার আনন্দ!
তমালী চোখ বোজে। অন্ধকারে দুলে ওঠে ঝুলন্ত দড়ির দু’টি বৃত্ত, হাওয়ায় অল্প দুলছে পাশাপাশি। সুরেশ নিশ্চয়ই এতক্ষণে খুব অস্থির হয়ে উঠেছে। দিনমানেও বউকে খুঁজতে সে ঘরের বাইরে বেরনোর সাহস পায় না, এটাই বাঁচোয়া। কিন্তু ঘরবার সে নিশ্চয়ই শুরু করে দিয়েছে। এই প্রথম স্বামীর দায়িত্ব সম্বন্ধে সচেতন হয়ে বউকে সঙ্গে নিয়ে সে তাপস হাজরারা আসার আগেই ঝুলে পড়তে চাইছে। না হলে তার অবর্তমানে যদি তমালীর চরম অসম্মান কেউ করে!
ইঃ, মুখ বাঁকিয়ে ন্যাড়া মাথায় ভালো করে আঁচল জড়ায় তমালী, কেউ যেন তাকে চিনে না ফেলে। চ-র-ম অসম্মান! অসম্মানের আর বাকি আছে কী! এই তো আমার স্বামী রে, ভাত দেওয়ার বেলায় নাই, কিল মারার গোঁসাই! নানা যুক্তি মাথার ভেতর সাজাতে থাকে তমালী, কারণ এখন তার প্রত্যেকটি রোমকূপ ফেটে বেরচ্ছে আর্তি, ছোটো, পালাও, যেমন করে হোক বাঁচতে তোমাকে হবেই। ভুঁড়ো শেয়ালির মতোই সে লাফিয়ে বাঁশঝাড় থেকে বেরয়। ছুটতে থাকে প্রাণপণ, সবুজ রেখার মতো দূরের গ্রামের দিকে। সেখানে তাপস হাজরার লম্বা হাত পৌঁছয় কি না, কে জানে! তবু অকারণ আর দুরন্ত এক ছন্দ ভর করে তমালীর পায়ের পাতায়। দূর থেকে দূরতর হতে থাকে আড়া থেকে পাশাপাশি ঝোলা দুই দড়ির গিঁট দেওয়া বৃত্ত।
অলংকরণ: শান্তনু দে