শুয়োরের পাল চমকে উঠল! শিক্ষাদীক্ষায় পালিশঅলা, উঁচু ঘরের মানুষ এসে পিছিয়ে পড়াদের পথ দেখিয়েছে এমন তো ইতিহাসে অনেক! তা এই নতুন শুয়োরও তেমন নেতা হয়ে উঠল। সে বলল, ‘কৌশল নিয়ে ভাবতে হবে না, সে আমি ঠিক করছি। তোমাদের যেমন যেমন বলছি, তা মেনে চলো। আর তফাত আনো শরীরী ভাষায়, বাঘ সামনে এলে তার চোখে চোখ রেখে তাকাবে, ভয় পেলেও তা বুঝতে দেবে না।’
বারাণসী শহরের কাছে সেই গভীর বন। সেখানকার বুনো শুয়োররা একদিন হঠাৎ দেখে, গুহার সামনে তাদেরই এক স্বজাতি পায়চারি করছে। তার হাঁটার আত্মবিশ্বাসী ভঙ্গি, হৃষ্টপুষ্ট চেহারা দেখে প্রথমে ভয় ভয়ই করছিল। কিন্তু তার মিশুকে চাউনি দেখে ভরসা পেয়ে কয়েকজন কাছে এগিয়ে গেল, ‘তুমি কে বটে?’
–আমি তোমাদেরই মতো শুয়োর, দেখে বুঝতে পারছ না?
–হুঁ, কিন্তু কোথা থেকে উদয় হলে? চেহারাই বা এমন নাদুসনুদুস হল কী করে?
আগন্তুক খোলসা করে, নেহাত ছোট বয়সে এই বনেরই এক গর্তে পড়ে তার মরার দশা হয়! উদ্ধার করে শহরতলির এক ছুতোর। সেই ছুতোরের বাড়িতে যত্নআত্তিতে তার বড় হয়ে ওঠা। কিন্তু, সে এবার প্রশ্ন করে, বনের শুয়োরদের এমন হাড্ডিসার চেহারা কেন?
আমাদের কথা আর কী বলি, বয়স্ক শুয়োরটি ছলোছলো চোখে বলে, এই বনে এক বাঘ আছে, তার মনে দয়ামায়া নেই। হঠাৎ হঠাৎ সে আমাদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। ঘাড় মটকে তার গুহায় টেনে নিয়ে যায়, রক্তাক্ত করে, তারপর তার মন্ত্রণাদাতা এক তপস্বীর সঙ্গে ভাগ করে খায়। এই তো আজই ভোরে আমাদের একজনকে নিয়ে গেছে।
অন্য এক শুয়োর টিপ্পনী কাটে, ‘তুমি আর এসব শুনে কী করবে? বনের আলো-বাতাস মেখে আবার ফিরে যাবে ছুতোরবাড়ির আরাম-আদরে।’
–না আমি ফিরব না। তোমাদের সঙ্গেই থাকব। আমি এসে গেছি যখন, ঠিক একটা উপায় হবে। চিন্তা ক’রো না।
শুয়োরের পাল চমকে উঠল! শিক্ষাদীক্ষায় পালিশঅলা, উঁচু ঘরের মানুষ এসে পিছিয়ে পড়াদের পথ দেখিয়েছে এমন তো ইতিহাসে অনেক! তা এই নতুন শুয়োরও তেমন নেতা হয়ে উঠল। সে বলল, ‘কৌশল নিয়ে ভাবতে হবে না, সে আমি ঠিক করছি। তোমাদের যেমন যেমন বলছি, তা মেনে চলো। আর তফাত আনো শরীরী ভাষায়, বাঘ সামনে এলে তার চোখে চোখ রেখে তাকাবে, ভয় পেলেও তা বুঝতে দেবে না।’
পরদিন ভোরে শুয়োরদের হাবভাব দেখে বাঘ সত্যি ঘাবড়ে গেল! সে কটমট করে তাকালে তারাও উল্টে কটমটিয়ে চাইছে। সে পরম তাচ্ছিল্যে তাদের দিকে পাশ ফিরে থাকলে তারাও তাকে পাত্তা না দিয়ে নিজের মনে ঘুরে বেড়াচ্ছে। কোথায় সেই ভয় ভয় যাপন! বাঘের নিজেরই কেমন বুক দুরদুর করতে লাগল। সে গুহায় ঢুকে গেল।
তার মন্ত্রণাদাতা তাকে বোঝাল, ‘এই বদলটা এনেছে নিশ্চয়ই ওই নতুন শুয়োরটা, ও-ই এই দুবলা-পাতলা জন্তুগুলোর মনে সাহস জুগিয়েছে।’
মনে সাহস? কী সাংঘাতিক কথা! তাহলে উপায়? বাঘটা হন্তদন্ত হয়ে গুহার বাইরে এসে হুংকার ছাড়ল। নতুন শুয়োর চাপা গলায় অন্যদের আশ্বস্ত করল। তারপর কালকে সবাই মিলে খুঁড়ে রাখা গর্ত দুটোর মাঝখানে দাঁড়াল। রাগে আর আতঙ্কে জ্ঞানশূন্য বাঘ লাফ দিল তার দিকে। ঠান্ডা মাথায় নতুন শুয়োর ছোট গর্তটায় সরে গেল, বাঘ পড়ল বড় গর্তে।
তারপর যেমন হয়, অত্যাচারীকে অসহায় পেয়ে সব রোগা-পাতলা শুয়োরের দল তাদের নেতাকে ঘিরে উল্লাসে মাতল। কিন্তু নেতা বলল, চলো, আগে পালের গোদা সেই মন্ত্রণাদাতা ভণ্ড তপস্বীকে নিকেশ করি। সবাই দল বেঁধে দৌড়ল বাঘের গুহার দিকে। কিন্তু দেখা গেল, এক শত্রুকে মোকাবিলা করার সঙ্গে সঙ্গেই, এক্ষেত্রে যেমন হয়েই থাকে, অন্যজনও ফতুর হয়ে গেছে।
তারপর আর কী, আবিরের থালা হাতে নিয়ে অরণ্য বরণ করে নিল তার নতুন নেতাকে।
‘মহুয়া’র প্রচ্ছদের নেপথ্যে নন্দলালের আঁকা সহজ পাঠের ছবি রবীন্দ্রনাথকে নিশ্চয়ই প্রাণিত করেছিল। সহজ পাঠের আগে আমরা দেখেছি, ১৯২২ সালের শেষে আন্দ্রে কারপেলেস প্যারিস থেকে এনেছিলেন একগুচ্ছ কাঠখোদাই। এমনকী, বিশের দশকে রবীন্দ্রনাথ যে কয়েকবার বিদেশ সফরে গিয়েছেন, সেখানে জার্মানিতে ও ফ্রান্সে তাঁর রীতিমত চেনাজানা ঘটেছিল কাঠখোদাই মাধ্যমটির সঙ্গে।