ক্রিশ্চিয়ানো আপনি যুগধর্ম মেনে কাঁটার মুকুট মাথায় নিয়েছেন। বর্তমানের সাধ্য কী আপনাকে ধারণ করে। একমাত্র ইতিহাস পারে আপনার স্বরূপ বুঝতে। আমরা, এই আপনার ভক্তকুল, সেই কালের যাত্রা-ধ্বনি শোনার অপেক্ষায়। মুগ্ধতার পরশ মেখে আমরা তাই আপনাকে দেখে যাই। আফসোস করে বলি, ‘এই পৃথিবী একবার পায় তারে, পায় নাকো আর।’
প্রিয় সিআর,
আমি তোমার দ্বিধায় বাঁচি, তোমার দ্বিধায় পুড়ে যাই, এমন দ্বিধার পৃথিবীতে, তোমায় চেয়েছি পুরোটাই।
মিনার রহমানের মায়া জাগানো গানটা শুনলে, কেন কে জানে, আপনার কথা মনে পড়ে ক্রিশ্চিয়ানো রোনাল্ডো। আজ্ঞে, আপনার কথা। এই মোহভরা পৃথিবীতে, রোদনভরা বসন্তে আপনি তো আমাদের আশ্রয়ের খড়কুটো। লড়তে লড়তে দেয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়া জীবনে, আপনি যে আমাদের বেঁচে থাকার অক্সিজেন। পড়ন্ত বিকেলের মনখারাপে আপনিই যে আমাদের হৃদয়ে জ্বলতে থাকা দ্রোহের স্ফুলিঙ্গ।
কী করব বলুন, আপনার ঊনচল্লিশের সবুজ ডানায় আজও যে স্বপ্ন-জোনাকিরা বসে। আর আমরা, আপনার ভক্ত-প্রহ্লাদ, তামাম অনুরাগীকুল সেই স্বপ্নে বিভোর হয়ে মায়াজাল বুনতে থাকি। আপনার চিরপ্রতিদ্বন্দ্বীর হাতে আজ বিশ্বকাপ। শ্রেষ্ঠত্বের কবজ-কুণ্ডল। কিন্তু আমাদের হৃদয়ে শ্রেষ্ঠত্ব বলতে তবু আপনি, ক্রিশ্চিয়ানো রোনাল্ডো। রক্তমাংসের শরীরে, ওই সবুজ-গালিচায় আপনি এখনও সেই শ্রেষ্ঠত্বের ভাষ্যরচনা করে চলেছেন। সে মুগ্ধতার তল এখনও আমরা খুঁজে পাই না।
আসলে ধর্ম-বর্ণ-চরিত্রের মতো মনুষ্য চাহিদাতেও বিভেদ আছে। একদল মানুষ থাকে, যারা কায়িক শ্রেষ্ঠত্বে বিবশ ভ্রমর হতে চায়। আর একদল আছে, যারা উপেক্ষিত, ঈশ্বরের আশিস থেকে বঞ্চিত। সংসারের জোয়াল ঠেলে-গুঁতিয়ে চলাই তাদের জীবন-নিয়ম। ঐশ্বরিক বিচ্ছুরণের বিলাসিতায় বাঁধা পড়লে তাদের চলে না। অনুপ্রেরণার জ্বালানি খুঁজতে হয় আশপাশ থেকে, তাদেরই মতো কোনও রক্ত-মাংসের থেকে। আপনি সেই দ্বিতীয় শ্রেণির কামরার প্রতিনিধিদের দেবতা ক্রিশ্চিয়ানো। সংসারে যে শুধু দিয়েছে, প্রতিদানে পায়নি কিছু। কাব্যে উপেক্ষিত প্রতিনায়ক আপনি। অথচ মজা দেখুন, আপনার জৈবিক কায়াকে অস্বীকার করতে আপনার প্রতিদ্বন্দ্বী শিবিরকে ঐশ্বরিক ছায়ায় আশ্রয় নিতে হয়। তুলনায় টেনে আনতে হয় বিশ্বকাপ, গ্রহান্তরের উপমা।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
ক্রিশ্চিয়ানো এই ঊনচল্লিশেও আপনার পায়ে দামাল-জাদু। সৌদি লিগের অপার ঐশ্বর্যে আপনি বৈদূর্যমণির মতো আলো ছড়াচ্ছেন। তারপরেও এই মেঘলা শীতে, আপনার ফর্মের ঔজ্জ্বল্য ঢাকতে বিরুদ্ধ শিবিরকে বিশ্বকাপ তুলে ধরতে হয়, ব্যালন ডি’অরের দাঁড়িপাল্লা হাতে হিসেবের খাতা বিছিয়ে বসতে হয়। বসুক ওরা। সিআর, ওদের ক্ষমা করুন নিজগুণে। ওরা পুসকাস চেনে না, ওরা ইউসেবিও চেনে না, ওরা ক্রুয়েফ চেনে না, চেনে না সক্রেটিস, জিকোদের, যাঁরা ফুটবলকে শস্যশ্যামলা করে গিয়েছিলেন বিশ্বজয়ের স্বর্ণ-ট্রফি না ছুঁয়েও।ঠিক আপনার মতোই।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
মনখারাপ করবেন না। হয় জানি, তবু করবেন না। এই নশ্বর-পৃথিবী আপনাকে কবেই বা বুঝল বলুন ক্রিশ্চিয়ানো! বোঝেনি। আপনার সাফল্যের রাজপথে নিন্দুকরা কাঁটা ছড়িয়েছে চিরকাল। আপনি হেলায় তাদের উপেক্ষা করেছেন। সমালোচনা আপনাকে ঋদ্ধ করেছে, কুৎসাকে অবহেলা করেছেন সম্রাটসুলভ অবজ্ঞায়। নয়তো কেনই বা বলবেন, ‘আমাকে নিয়ে সমালোচকদের মনে প্রচুর সংশয়। এসব দেখে ভালো লাগে। ভালো লাগে সমালোচনাদের ভুল প্রমাণ করতে। আমি সফল। সমালোচনা আমাকে স্পর্শ করে না।’ যা শুনে মনে হয়, এই আমরা, আপনার তামাম ভক্ত-কুল সোল্লাসে বলি– ক্রিশ্চিয়ানো, আপনি সাক্ষাৎ নীলকণ্ঠ। মনের জানালা দিয়ে আমরা স্পষ্ট দেখতে পাই, বিষহরি-সুলভ নির্লিপ্তি নিয়ে সমালোচকদের উপেক্ষার পৃথিবীতে ছুড়ে যেন আপনি বলছেন, ‘ধাঁধার থেকেও জটিল তুমি, খিদের থেকেও স্পষ্ট/ কাজের মধ্যে অকাজ খালি, মনের মধ্যে কষ্ট/ স্বপ্ন হয়েই যখন-তখন, আঁকড়ে আমায় ধরো/ তাই তো বলি আমায় বরং ঘেন্না করো, ঘেন্না করো।’
ক্রিশ্চিয়ানো এই ঊনচল্লিশেও আপনার পায়ে দামাল-জাদু। সৌদি লিগের অপার ঐশ্বর্যে আপনি বৈদূর্যমণির মতো আলো ছড়াচ্ছেন। তারপরেও এই মেঘলা শীতে, আপনার ফর্মের ঔজ্জ্বল্য ঢাকতে বিরুদ্ধ শিবিরকে বিশ্বকাপ তুলে ধরতে হয়, ব্যালন ডি’অরের দাঁড়িপাল্লা হাতে হিসেবের খাতা বিছিয়ে বসতে হয়। বসুক ওরা। সিআর, ওদের ক্ষমা করুন নিজগুণে। ওরা পুসকাস চেনে না, ওরা ইউসেবিও চেনে না, ওরা ক্রুয়েফ চেনে না, চেনে না সক্রেটিস, জিকোদের, যাঁরা ফুটবলকে শস্যশ্যামলা করে গিয়েছিলেন বিশ্বজয়ের স্বর্ণ-ট্রফি না ছুঁয়েও।ঠিক আপনার মতোই।
কেউ বুঝুক না বুঝুক। কেউ চিনুক না চিনুক। আপনাকে তো চিনেছিল মার্তুনিস নামের ওই ইন্দোনিজ ছেলেটা। বছর কুড়ি আগে যখন সুনামির করাল গ্রাসে তলিয়ে গিয়েছিল যার গ্রাম। সাত বছরের ছোট্ট ছেলেটা খড়কুটো আঁকড়ে বেঁচে গিয়েছিল অবিশ্বাস্যভাবে। কে জানে, গায়ে লেপ্টে থাকা ওই রোনাল্ডো-জার্সিই হয়তো তাকে জুগিয়েছিল শত প্রতিকূলতার মধ্যে লড়াইয়ের রসদ। কিংবা ওই হায়দারের কথা ভাবুন। লেবাননে প্রাণঘাতী-হামলায় চোখের পলকে বাবা-মাকে হারিয়ে অনাথ হয়ে যাওয়া ছেলেটা শুধু আপনার সান্নিধ্যের টানে ছুটে গিয়েছিল সান্তিয়াগো বার্নাব্যুতে। ক্লাবলনে তাঁকে জড়িয়ে কেঁদেছিলেন আপনি। আমরা জানি, আপনি একা নন, সেদিন কেঁদেছিল এই রক্ত-মাংসের গোটা পৃথিবী।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
আরও পড়ুন: কার্লেস কুয়াদ্রাত, ইস্টবেঙ্গলের আত্মার সঙ্গে আপনার শিকড়ের যোগ
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
আচ্ছা বলুন তো ক্রিশ্চিয়ানো, যুদ্ধবিধ্বস্ত গাজার ওই নাম না জানা স্কুল-পড়ুয়াগুলো যখন একছুটে এসে দাঁড়িয়েছিল তাঁদের নতুন নির্মিত স্কুল-বাড়িতে, তাদের মুখের হাসির চেয়েও কি ওই সোনার মোড়া বিশ্বকাপ দামি? যা গড়ে দিয়েছিলেন আপনি? দাতা-কর্ণের মতো আপনি হেলায় নিলামে বিলিয়ে দিয়েছেন সোনার বুট, পরে ব্যালন ডি’অর। কার্লোস মার্টিন্স, আপনার একসময়ের সতীর্থ, তাঁর ছেলের ‘বোন ম্যারো’ ডোনার হতে আপনার লেগেছিল কয়েক সেকেন্ড। দশ মাসের এরিক ওর্টিজ আজকে দশ বছর। সে না জানুক, তার পরিবার জানে, ক্রিশ্চিয়ানো রোনাল্ডো আসলে কে? ভাগ্যিস, নুহুজেট গুলিয়ান আজ নেই। বেঁচে থাকলে সে-ও অবাক হয়ে দেখত, আপনিও এই মনুষ্যলোকে ঘৃণার পাত্র হন! টার্মিনাল ক্যানসারে আক্রান্ত যে কিশোরকে গাড়ি পাঠিয়ে নিজের হোটেলে নিয়ে এসেছিলেন। তার সংক্ষিপ্ত জীবনের শেষ সাধ পূরণে।
ক্রিশ্চিয়ানো আপনি যুগধর্ম মেনে কাঁটার মুকুট মাথায় নিয়েছেন। বর্তমানের সাধ্য কী আপনাকে ধারণ করে। একমাত্র ইতিহাস পারে আপনার স্বরূপ বুঝতে। আমরা, এই আপনার ভক্তকুল, সেই কালের যাত্রা-ধ্বনি শোনার অপেক্ষায়। মুগ্ধতার পরশ মেখে আমরা তাই আপনাকে দেখে যাই। আফসোস করে বলি, ‘এই পৃথিবী একবার পায় তারে, পায় নাকো আর।’ আজ আপনার ঊনচল্লিশ। প্রার্থনা করি, শতায়ু হন। প্রার্থনা করি, আরও ১৩৯ বছর ধরে জীবিত থাকুক আপনার বিদ্রোহী ফুটবলের ‘সোনিক সাউন্ড’।
সিইইইউউউ!
ইতি,
আপনার এক অজ্ঞাতকুলশীল গুণমুগ্ধ