রেফারি মানে ৯০ মিনিটের (কখনও তা আরও বেশি) ফুটবল মাঠে হত্তাকর্তা বিধাতা। প্রজাতিতে তারা দেশ-বিদেশ মিলিয়ে বহুবিধ । তবে এই মুহূর্তে তাদের মধ্যে অবশ্যই ‘উৎকৃষ্ট’ এবং আলোচনার পাত্র ভারতীয়রা। নিন্দুক এই জালিম সমাজ (পড়ুন সমর্থক) তাদের যদিও ‘গায়ে মানে না আপনি মোড়ল’ বলেই চেনে। সে চিনুক গে, তাতে রেফারিদের থোড়াই কেয়ার।
গীতায় আছে, ‘কর্ম করে যাও, ফলের আশা করো না।’ কুরুক্ষেত্রে যখন কৌরব-পাণ্ডব একে অপরকে একহাত বুঝে নেওয়ার সলতে পাকাচ্ছে, ঠিক তখনই মওকা বুঝে অর্জুনের কাছে কথাটা পেড়ে ছিলেন শ্রীকৃষ্ণ। বাকিটা ইতিহাস।
কথাটা তৃতীয় পাণ্ডবের জন্য কতটা কার্যকর হয়েছিল, সে মহাভারত গুলে খাওয়া বইপোকারা বলতে পারবেন, তবে কলিকালে সেই কথার যথার্থ কদর যদি কেউ করে থাকে, সে হল রেফারি।
রেফারি মানে ৯০ মিনিটের (কখনও তা আরও বেশি) ফুটবল মাঠে হত্তাকর্তা বিধাতা। প্রজাতিতে তারা দেশ-বিদেশ মিলিয়ে বহুবিধ । তবে এই মুহূর্তে তাদের মধ্যে অবশ্যই ‘উৎকৃষ্ট’ এবং আলোচনার পাত্র ভারতীয়রা। নিন্দুক এই জালিম সমাজ (পড়ুন সমর্থক) তাদের যদিও ‘গায়ে মানে না আপনি মোড়ল’ বলেই চেনে। সে চিনুক গে, তাতে রেফারিদের থোড়াই কেয়ার! কথায় আছে তো, হাতি চলে বাজার…। যাক গে যাক, সে’সব আর ভেঙে না-ই বা বল্লাম। আরে বাবা, যার নামের শেষে আরি (‘আড়ি’ বলাই উচিত ছিল), তার সঙ্গে পক্ষ-বিপক্ষ মিলিয়ে, সে ইস্ট হোক কিংবা মোহন, ক্যাচাল যে লাগবে, তাতে আর আশ্চর্যের কী!
এই তো সেদিন। যুবভারতীতে ডার্বি। সুপার কাপ জেতার পর ইস্টবেঙ্গল টগবগ করছে। হয় এসপার, নয় ওসপারের জন্য চেগে মোহনবাগানও। সব ঠিক ছিল। তাকে বলে পিকচার পারফেক্ট। ওমা, কোথা থেকে কিষ্কিন্ধাবাসীর মতো লঙ্কাকাণ্ড ঘটিয়ে গেলেন রেফারি! বলা নেই, কওয়া নেই, যেন নেপোলিয়ন বোনাপার্ট। এলুম দেখলুম, আর জয় করলুম। আর সেকি ঠাটবাট! একবার একে কার্ড দেখায় তো তারপর ওকে। মুড়ি-মিছরির একদর! লাল-হলুদের স্প্যানিশ কোচ তো রেগে গুম। সবুজ-মেরুনের হাবাসও কম যান না। শেষে আসরে নামলেন দু’দলের সমর্থকরা। ম্যাচটা তারা জিততে এসেছিলেন, ড্র দেখতে নয়। বেটাচ্ছেলে রেফারির দয়ায় সেটাও জলে গেল! অতএব, বাছা বাছা শব্দে রেফারির পিতৃপক্ষ-মাতৃপক্ষকে স্মরণ করা শুরু। ঐতিহাসিক ভাবেই রেফারির গায়ের চামড়া মোটা, ফলে তাদের কিছু গায়ে লাগে না। কানে খাটো, চোখে ছানি– যাই বলেই অপবাদ দিন না কেন, মুখে বাঁশি উঠলেই তারা নিজেদের ত্রিকালজ্ঞ মনে করেন। হয়তো বৃন্দাবনের কেষ্টও ভাবেন। তবে ‘ফুরররর… ফুরররর’ করে যাই বাজান, তা মধুর নয়, সাক্ষাৎ বিষের বাঁশি। সব্বাই হাড়ে হাড়ে টের পান।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
কথায় আছে, প্রহারেণ ধনঞ্জয়। সমর্থকরাও কম যান না। সত্যই তো হাত থাকতে মুখে কেন! ‘ভাগের মা গঙ্গা পায় না’ মার্কা ড্র কিংবা হেরে নাক কাটা গেলে ফুটবল-জনতা মন ভালো করার ওষুধ খোঁজে। খুঁজে খুঁজে রেফারিকেই বার করে। তারপর মনের আশ মিটিয়ে হাত ও মনের সুখ করে নেয়। অতীতে ময়দানে এমন ঘটনা আকচারই ঘটেছে। আজও ঘটে। ভবিষ্যতেও যে ঘটবে না, তার গ্যারান্টি নেই।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
এ শুধু গত ডার্বি নয়, যুগে যুগে শাশ্বতকালের ঘটনা। যাকে বলে নিত্যনৈমিক ব্যাপার-স্যাপার। ভুলের পারঙ্গমতায় রেফারি নামক জাতিটি ব্যুৎপত্তি লাভ করেছে, এক্কেবারে পিএইচডি। যেন প্রতিজ্ঞা করে নেমেছেন, কতটা খারাপ খেলানো যায়। যাচ্ছেনও। শুধু ডার্বি নয়, আইএসএল হোক কিংবা আই লিগ কিংবা ডুরান্ড, মায় শেষ খুঁজে না পাওয়া কলকাতা লিগ– সবেতেই দৃশ্যটা কমবেশি এক, উনিশ-বিশ। এই তো আইএসএলেই গতবছর বেঙ্গালুরু-কেরল ব্লাস্টার্স ম্যাচে ভুল সিদ্ধান্তের জেরে কেরল দল তুলে নেয়। সে নিয়ে কম ধুন্ধুমার হয়নি। কিংবা স্মৃতি হাতড়ে মনে করুন, আটের দশকে ইডেনে সেই কুখ্যাত বড়ম্যাচ। রেফারির হাত ফসকে ম্যাচটা গিয়ে ঠেকছিল গ্যালারিতে। কত তাজাপ্রাণ অকালে ঝরে ছিল, তা সকলের জানা। এমন নমুনা ভারতীয় ফুটবলে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে প্রচুর। রেফারি সমাজের সেসব গুণকীর্তন এক জায়গায় করলে আস্ত মহাভারত হয়ে যাবে।
তবে কথায় আছে, প্রহারেণ ধনঞ্জয়। সমর্থকরাও কম যান না। সত্যই তো হাত থাকতে মুখে কেন! ‘ভাগের মা গঙ্গা পায় না’ মার্কা ড্র কিংবা হেরে নাক কাটা গেলে ফুটবল-জনতা মন ভালো করার ওষুধ খোঁজে। খুঁজে খুঁজে রেফারিকেই বের করে। তারপর মনের আশ মিটিয়ে হাত ও মনের সুখ করে নেয়। অতীতে ময়দানে এমন ঘটনা আকচারই ঘটেছে। আজও ঘটে। ভবিষ্যতেও যে ঘটবে না, তার গ্যারান্টি নেই। তবে ঠাকুর বলেছেন, ‘যে সয়, সে রয়।’ রেফারিরাও তেমনই পণ করে নিয়েছেন। চলনে-বলনে তাঁদের দু’-কান কাটা মনোভাব, ফুটবল রসাতলে গেলেও তাঁদের যায় আসে না।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
আরও পড়ুন: কলকাতায় গিয়েই খেলব ভেবেছিলাম, মোহনবাগানে ট্রায়াল দিতে হবে ভাবিনি
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
কিন্তু দেশে আইন আছে। ফুটবল আছে। আর তাদের সঙ্গে আছেন সর্বময় ফুটবল কর্তারা। উন্নতি ছাড়া তারা আর কিছু গায়ে মাখেন না। রেফারিদের বেচাল বোলচাল আর চিঠি-পাল্টা চিঠির গুঁতোয় তাঁরা ফাঁপরে পড়ে যান। সিস্টেমের খোলনলচে বদলাতে কোমর বাঁধার উপক্রম করেন। কিন্তু যে-দেশে ভিএআর (ভার) সুদূর নীহারিকা, সেখানে এসব তর্জন-গর্জনই সার। সেটাই তো স্বাভাবিক। কোন কালে শেফ ব্লাটার ‘ঘুমন্ত দৈত্য’ বলে ভারতীয় ফুটবলের নাকে সুড়সুড়ি দিয়ে গিয়েছেন। তারপর ফেডারেশন আড়মোড়া ভেঙে পাশ ফিরে শুয়েছে, ঘুম ভাঙতে এখনও ঢের দেরি।
সব দেখেশুনে কেষ্ট-ঠাকুরের কথা বড্ড মনে পড়ছে হে– ‘কর্ম করে যাও, ফলের আশা করো না।’