Robbar

লা মাসিয়ার গুরুত্ব বোঝাচ্ছে ‘বিস্ময়’ ইয়ামালের উত্থান

Published by: Robbar Digital
  • Posted:July 13, 2024 7:12 pm
  • Updated:July 13, 2024 9:58 pm  

লামিনের জন্ম স্পেনে হলেও তাঁর রঙমিস্ত্রি বাবা মুনির নাসরাউয়ি মরোক্কোর লারাচে শহরের, আর ওয়েটার মা শেলা এবানার দেশ নিরক্ষীয় গিনি। মরোক্কোর কথা তাও কেউ কেউ জানেন, কিন্তু পশ্চিম আফ্রিকার গিনি উপকূল-সংলগ্ন নিরক্ষীয় গিনির কথা পরিচিত ছকের বাইরে। লামিনের ঠাকুমা ফতিমা ১৯৮৮ সালে মরোক্কো থেকে স্পেনে চলে যান। তিনবছর বয়সে শেলা ও মুনিরের বিচ্ছেদ। তবে পুত্রের ভবিষ্যতের কথা ভেবে তার শৈশব জুড়েই ছিলেন বাবা-মা। পরে মাতারো ও গ্রানোলার্স, দুই শহরেই লামিনে সময় কাটিয়েছেন দুই অভিভাবকের সঙ্গে।

সোহম দাস

চলতি ইউরোর সেমিফাইনাল শুরুর আগে ফ্রান্সের সেন্ট্রাল মিডফিল্ডার আদ্রিয়েন র‍্যাবিও মন্তব্য করে বসলেন টুর্নামেন্টের ‘সোনার ছেলে’কে নিয়ে– ‘ওর মধ্যে খেলোয়াড়ি প্রতিভা দুর্দান্ত। কিন্তু ইউরো কাপের সেমিফাইনালের চাপ সামলানো অন্য ব্যাপার। আমরা ঠারে-ঠারে বুঝিয়ে দেব, ফাইনাল খেলতে হলে, এখনও অবধি ও যা করেছে, তার চেয়েও বেশি কিছু ওকে করে দেখাতে হবে।’

তা, প্রথম সেমিফাইনাল ম্যাচের ২১ মিনিটের মাথায় সেই দুর্দান্ত খেলোয়াড়ি প্রতিভার অধিকারী ছেলেটি যখন তেকাঠির ২৭ মিটার দূর থেকে বাঁ-পায়ে বাঁকানো শটটি নিচ্ছেন গোল করার লক্ষ্যে, তখন তাঁর সামনে নিতান্ত অসহায় দেখাল ফ্রান্স দলের যে রক্ষণভাগকে, সেই রক্ষণভাগের সবচেয়ে সামনের খেলোয়াড়টি স্বয়ং আদ্রিয়েন র‍্যাবিও। শট নেওয়ার আগে লামিনে ইয়ামাল একবার ডানদিকে ঝুঁকলেন, সেইমতো তাঁকে অনুসরণ করলেন আদ্রিয়েন ও সেন্টার-ব্যাক উইলিয়াম স্যালিবা, কিন্তু এক সেকেন্ডের মধ্যেই বামমুখী হয়ে বাঁ-পায়ে ওই অসামান্য শিল্পের ঝলকানি, উইলিয়াম বা আদ্রিয়েন, কারওরই বিশেষ কিছুই তখন আর করার ছিল না। এক গোলে এগিয়ে থাকা ফ্রান্সকে এই অবস্থায় বাঁচাতে পারত গোলপোস্ট, কিন্তু মাপা শট গোলরক্ষক মাইক মাইনানের উড়ন্ত শরীরকে পরাস্ত করে গিয়ে লাগল পোস্টের ভেতরের দিকে, সেখান থেকে বল জড়াল জালে।

Euro 20224: Lamine Yamal's Messi-esque goal in semi-final vs France - India Today
ফ্রান্সের বিরুদ্ধে ইয়ামালের গোলের সেই মুহূর্ত

১৭ পূর্ণ করার মাত্র চারদিন আগে ইউরোর কনিষ্ঠতম গোলস্কোরার হিসেবে রেকর্ড-বইতে নাম লেখানোর পথে বাধা থাকল না কিছুই। এমনকী, আদ্রিয়েন র‍্যাবিওকে বেকুব বানিয়ে গোলটা করে লামিনে বিপক্ষ মিডফিল্ডারের কথাও দিব্যি রাখলেন। ম্যাচের পরে অগ্রজ মিডফিল্ডারের উদ্দেশে ছুঁড়ে দেওয়া তাঁর মৌখিক জবাবটিও রীতিমতো শিরোনাম হয়ে গিয়েছে গণমাধ্যমের প্রচারদুনিয়ায়।

১৪ জুলাই বার্লিনে অ্যাডলফ হিটলারের অলিম্পিক-দর্শনের স্মৃতি-কাঁটা-ধন্য অলিম্পিয়াস্টেডিয়নে ইউরোর ফাইনাল। স্পেনের মুখোমুখি এই নিয়ে টানা দুবার ইউরো ফাইনালে ওঠা ইংল্যান্ড। আগের বারের হারের ক্ষত সারিয়ে চ্যাম্পিয়ন হবে ইংল্যান্ড, নাকি চারবার ইউরো জিতে নতুন রেকর্ড সৃষ্টি করে জেড প্রজন্মের ‘বিস্ময় বালক’কে পারফেক্ট বার্থডে গিফট দেবে স্পেনীয়রা, তেমন কোনও ভবিষ্যদ্বাণী আগেভাগে করা অসম্ভব, তবে, ১৪ জুলাইয়ের ফলাফল যাই হোক, এই মুহূর্তে ব্র্যান্ডিংয়ের সবটুকু আলো যদি কেউ কেড়ে থাকতে পারেন, তাঁর নাম, লামিনে ইয়ামাল নাসরাউয়ি এবানা।

Lamine Yamal: The 16-Year-Old Who Just Sent Spain to the European Championship Final - WSJ
লামিনে ইয়ামাল

ফেসবুকে বাঙালি সমর্থকদের দেখছি। কেউ বলে দিচ্ছেন, লামিনে সর্বকালের সেরা তরুণ খেলোয়াড়, সঙ্গে বক্তব্যের জোর বোঝাতে শেষে গুঁজে দিচ্ছেন ‘পিরিয়ড’, কেউ আবার সুকান্তকে নকল করে দিব্যি ‘আঠেরো’র জায়গায় ‘ষোলো’ বসিয়ে কবিতা ছেড়ে দিচ্ছেন। আদ্রিয়েন র‍্যাবিওকে জবাব দেওয়া দেখে কোনও কোনও স্বঘোষিত বিজ্ঞ হয়তো তুলনা টানবেন ১৯৮৯ সালের ভারতীয় ক্রিকেট দলের পাকিস্তান সফরে ওয়াকার ইউনিসের বাউন্সারে নাক ফেটে রক্তারক্তির পরেও মাঠ ছেড়ে যেতে না চাওয়া, পরের বলেই চার মারা, সাড়ে ষোলোর সচিন টেণ্ডুলকরের সঙ্গে। এগুলোর মধ্যে যা খানিক ভাবাবে, তা অবশ্য এমন লঘু আবেগী ব্যাপার নয়। ব্যাপারটা সিরিয়াস রাজনীতির। আরও সঠিকভাবে বললে, উদ্বাস্তু-রাজনীতির। দু’-একটা পোস্ট সেসব নিয়েও চোখে পড়বে।

………………………………………………………………………………………………………

লামিনে যে প্রজন্মের প্রতিনিধি, সেই জেনারেশন জেড সম্পর্কে সমীক্ষাগত অভিমত বলছে, ইউরোপীয় ইউনিয়নের বাইরে জন্মানো এই প্রজন্মের প্রতিনিধিরা সবচেয়ে বেশি সংখ্যায় ছড়িয়ে আছেন যে তিন দেশে, তার মধ্যে একটি হল স্পেন। আন্তর্জাতিক ফুটবলে চূড়ান্ত সাফল্য পেতে বর্তমানে মেনল্যান্ড ইউরোপের বেশিরভাগ দেশের অভিবাসীদের উপর নির্ভরশীলতা, এ যেন ঔপনিবেশিক ইতিহাসের একবিংশ শতকীয় সংস্করণ। সেমিফাইনাল ম্যাচের পর মুনির নাসরাউয়ির পোস্ট করা লিওনেল মেসির কোলে শিশু লামিনের যে ছবি কখানা ঘিরে এখন হইচই, সে ছবির সঙ্গেও না-চাইতেই জুড়ে গিয়েছে এই ইতিহাস।

………………………………………………………………………………………………………

লামিনের জন্ম স্পেনে হলেও তাঁর রঙমিস্ত্রি বাবা মুনির নাসরাউয়ি মরোক্কোর লারাচে শহরের, আর ওয়েটার মা শেলা এবানার দেশ নিরক্ষীয় গিনি। মরোক্কোর কথা তাও কেউ কেউ জানেন, কিন্তু পশ্চিম আফ্রিকার গিনি উপকূল-সংলগ্ন নিরক্ষীয় গিনির কথা পরিচিত ছকের বাইরে। লামিনের ঠাকুমা ফতিমা ১৯৮৮ সালে মরোক্কো থেকে স্পেনে চলে যান। তিনবছর বয়সে শেলা ও মুনিরের বিচ্ছেদ। তবে পুত্রের ভবিষ্যতের কথা ভেবে তার শৈশব জুড়েই ছিলেন বাবা-মা। পরে মাতারো ও গ্রানোলার্স, দুই শহরেই লামিনে সময় কাটিয়েছেন দুই অভিভাবকের সঙ্গে। বস্তুত, লামিনে যে প্রজন্মের প্রতিনিধি, সেই জেনারেশন জেড সম্পর্কে সমীক্ষাগত অভিমত বলছে, ইউরোপীয় ইউনিয়নের বাইরে জন্মানো এই প্রজন্মের প্রতিনিধিরা সবচেয়ে বেশি সংখ্যায় ছড়িয়ে আছেন যে তিন দেশে, তার মধ্যে একটি হল স্পেন। আন্তর্জাতিক ফুটবলে চূড়ান্ত সাফল্য পেতে বর্তমানে মেনল্যান্ড ইউরোপের বেশিরভাগ দেশের অভিবাসীদের উপর নির্ভরশীলতা, এ যেন ঔপনিবেশিক ইতিহাসের একবিংশ শতকীয় সংস্করণ। সেমিফাইনাল ম্যাচের পর মুনির নাসরাউয়ির পোস্ট করা লিওনেল মেসির কোলে শিশু লামিনের যে ছবি কখানা ঘিরে এখন হইচই, সে ছবির সঙ্গেও না-চাইতেই জুড়ে গিয়েছে এই ইতিহাস।

17-year-old photo emerges: Messi poses with baby Lamine Yamal | Daily Sabah
মেসির সঙ্গে ছোট্ট ইয়ামালের বিজ্ঞাপনী ফটোশুট

এটুকু বাদ দিলে আরও খানিক যেটুক পড়ে থাকে, তা অবশ্য নিছকই খেলোয়াড়ি।

যাঁরা নিয়মিত স্পেনের জাতীয় ফুটবল লিগ লা লিগা দেখে থাকেন, তাঁদের কাছে লামিনেকে নিয়ে এত হইচই অবশ্য নতুন কিছু নয়।

২০২২-’২৩ মরশুমের শেষের দিকে সিনিয়র দলে তাঁকে প্রথম খেলিয়েছিলেন বার্সেলোনার ম্যানেজার জাভি হার্নান্ডেজ। দিনটা ছিল ২৩ এপ্রিল– ১৫ বছর ৯ মাস ১৬ দিন বয়সে অভিষেক ঘটা লামিনে অল্পের জন্য ভাঙতে পারেননি ক্লাবের ইতিহাসের শতাব্দীপ্রাচীন দুই রেকর্ড। ১৯১২ সালে পওলিনো আলকান্তারার অভিষেক ঘটেছিল ১৫ বছর ১৪০ দিন বয়সে, আর ১৯২০ সালে ১৪ বছর ২০০ দিন বয়সে খেলতে নেমে সেই রেকর্ড ভেঙেছিলেন আর্মান্দো সাজি। পরের মরশুমের শুরুর দিকে গ্রানাদার বিরুদ্ধে প্রথম সিনিয়র গোল, যুব ইউরোতেও ফ্রান্সের বিরুদ্ধে একটা চোখ-ধাঁধানো গোল করেছিলেন লামিনে।

এত এত রেকর্ডের কথা শুনে যে মুহূর্তে সম্ভ্রম জাগবে, সেই মুহূর্তেই আবার, তুত্তোস্পোর্টের তরফে প্রথম গোল্ডেন বয় (দ্য ইয়ংগেস্ট ট্রফি) পাওয়া সত্ত্বেও স্কুলের কড়াকড়ির কারণে অনুষ্ঠানের দিন উপস্থিত থাকতে পারেননি, এ খবরটা শুনলে লামিনে ক্রমশ আমাদের সকলের হয়ে উঠবেন। তখন কোথায় জাতীয় দলের হয়ে সেমিফাইনালে গোল, কোথায় কী!

খেলার ফাঁকে পড়াশোনা: ইয়ামাল

বার্সেলোনার বিশ্ববন্দিত ফুটবল কেন্দ্র লা মাসিয়া, যার প্রাক্তনী তালিকায় জ্বলজ্বল করে জাভি, লিওনেল মেসি, আন্দ্রেস ইনিয়েস্তা, কার্লেস পুওলদের মতো উজ্জ্বল নামগুলো, লামিনে এই লা মাসিয়ারই ছাত্র। ‘অ্যাকাডেমির খেলোয়াড় খেলানো’-র যে ধারা তৈরি করেছিল কাতালানদের হৃদয়-প্রতিম ক্লাবটি, তার সর্বোচ্চ নিদর্শন দেখা গিয়েছিল ওই সোনালী প্রজন্মের সময়েই। ২৫ নভেম্বর ২০১২– লেভান্তের বিরুদ্ধে ৬০ মিনিটে দানি আলভেসের বদলি হিসেবে যখন মার্টিন মনতোয়া মাঠে নামেন, সেই মুহূর্তে দলের ১১ জন খেলোয়াড়ের প্রত্যেকেই লা মাসিয়া-জাত। এহেন অ্যাকাডেমি, যা কিনা গত দশকেও শুরুর দিকে ছিল ক্লাব তথা স্পেনীয় ফুটবলের অন্যতম সাপ্লাই লাইন, তা ধীরে ধীরে গুরুত্ব হারাল। চড়া দামে ব্রাজিলের সান্তোস ক্লাব থেকে এলেন নেইমার, দীর্ঘদিন ধরে বড়ো ট্রফি না পাওয়া লিভারপুল থেকে চলে এলেন লুইস সুয়ারেজ, পরে তাঁর পদাঙ্ক অনুসরণ করে ফিলিপে কুতিনহোও। নেইমার চারবছরের বেশি টেকেননি, লুইস সুয়ারেজ অবশ্য কিছু বেশি বছর খেলেছিলেন, ছয়; তাঁরা ট্রফি দিয়েছিলেন বটে, তবে ফুটবল কেরিয়ারের প্রায় সবটাই বার্সাকে দিয়ে যাওয়া খেলোয়াড়দের মানসিকতা নিয়ে তাঁরা আসেননি, সে আশাও করেনি কেউ। ফিলিপে মাত্র দুবছর ফার্স্ট টিমে খেলে শেষ দু’বছর লোনে খেলেছিলেন বায়ার্ন মিউনিখ আর অ্যাস্টন ভিলায়, যে চ্যাম্পিয়ন্স লিগ পেতে লিভারপুল ছেড়ে বার্সায় আসা, লিভারপুল তার পরের বছরই বার্সাকে হারিয়ে চ্যাম্পিয়ন্স লিগের ফাইনালে ওঠে এবং জেতে। ফিলিপে অবশেষে চ্যাম্পিয়ন্স লিগ পান বায়ার্নের হয়ে, তার মধ্যে পুরনো দলকে ৮-২ গোলে হারানোর দিন দু’খানা গোলও করেছিলেন, তারপর, ক্রমশ ফুরিয়ে যাওয়া।

সুয়ারেজ-নেইমার-মেসি: বার্সেলোনার সোনালী অতীত

…………………………………………………………………..

আরও পড়ুন: বিপক্ষের ডিফেন্স কিংবা বর্ণবাদ ছিঁড়ে ফুটবল শাসন করছেন নিকো উইলিয়ামস

…………………………………………………………………..

বিশ্বমানের খেলোয়াড় তৈরির দীর্ঘ ঐতিহ্য থেকে বার্সেলোনার এই সরে আসা নিয়ে যেমন ক্ষোভ ছিল সমর্থকদের, তেমনই সোশ্যাল মিডিয়াতেও বিরোধীপক্ষরা মিনিটের পর মিনিট নষ্ট করেছেন স্ট্যাটিস্টিক্স খুঁজে বার করে ইতিহাস-খণ্ডনে।

এই মুহূর্তে লামিনে ইয়ামালের যা ফর্ম, সঙ্গে গাভি বা আনসু ফাতিদের উপস্থিতিও যেহেতু অস্বীকার করার উপায় নেই, তাতে লা মাসিয়া তথা বার্সেলোনার আবারও সেই ধারার পুনরুরত্থান ঘটা নিয়ে আশাবাদী হওয়াই যায়। আর, এই ট্রান্সফার ডিলের প্রাবল্যের চাপে হাঁসফাঁস করতে থাকা ফুটবলের এমন ‘অ্যাকাডেমিক’ অক্সিজেন বুঝি খুব প্রয়োজনীয়ও।

……………………………………………………

ফলো করুন আমাদের ফেসবুক পেজ: রোববার ডিজিটাল

……………………………………………………