গ্যালারি যখন কালো রঙের বিষাদ নিয়ে চেপে বসে মাথায়, যেন টুঁটি টিপে ধরে পৃথিবীর আদিম শাসকের দল! বিদ্যুৎ খেলে শরীরে। বর্ণবাদের মাঝখান দিয়ে নিকো উইলিয়ামস শুধুই ড্রিবল করে। আশ্চর্য ছন্দে। সম্মুখে তিনকাঠির গোল। ব্যাকগ্রাউন্ডে যেন বব মার্লে গাইছেন, ‘য়োন্ট ইউ হেল্প টু সিং/ দিস সং অফ ফ্রিডম?/ কজ অল আই এভার হ্যাভ/ রিডেম্পশান সং…’
গ্যালারি থেকে ভেসে আসছিল রেসিস্ট স্লোগান। বাঁদরের ডাক। লেফট উইং ধরে যে ২১ বছরের ছেলেটা ড্রিবল করছিল, ছিটকে ছিটকে বেরোচ্ছিল আর দুই পায়ে চলকে উঠছিল আগুন– তার রং কালো। মাথায় ঝুঁটি। মুখজুড়ে যেন নিরপরাধ হাসি। অ্যাথলেটিকো বিলবাও-এর জার্সি গায়ে। ১১ নম্বর। রেফারির কাছে সে উগড়ে দেয় অসন্তোষ! খেলা থেমে যায়। এ হল লা-লিগার নতুন নিয়ম। স্পেন এবং স্প্যানিশ ফুটবল ফেডারেশান কতখানি বর্ণবাদের বিরুদ্ধে– তা পরিমাপের হাস্যকর একক! তাই রেসিস্ট স্লোগান থামে না। পরবর্তী টার্গেট, ছেলেটির দাদা। তার গায়েও অ্যাথলেটিকো বিলবাও-এর জার্সি। রাইট উইঙ্গার। দুই ভাই মিলে ছিঁড়ে দেয় বিপক্ষের ডিফেন্স। অথবা বর্ণবাদ। তারপর অ্যাথলেটিকো বিলবাও-এর ট্রফিরুমে একশো মানিক জ্বলে ওঠে। ৪০ বছর পর। কোপা দেল রে চ্যাম্পিয়ন! একদিন ম্যাচ শেষে ছেলেটা সাংবাদিকদের বলে, ‘উই হ্যাভ গট অ্যান ইন্টার্নাল অ্যান্ড এক্সটার্নাল ফাইট এগেইন্সট দিস!’
যুদ্ধ। নিকো উইলিয়ামস। ফুটবল। তিনটি সমরেখ বিন্দু। যার গভীরে গভীরতর ক্ষত! দগদগে ঘা। আজীবন জ্বলবে। শক্তি দেবে। ড্রিবলের। নয়ের দশক। পশ্চিম আফ্রিকার দ্বিতীয় জনবহুল দেশ ঘানা। যেন ধুঁকছে। মাত্রাতিরিক্ত ঋণ। নিম্নমানের দ্রব্যমূল্য। মুদ্রার অবমূল্যায়ন। সে-মুহূর্তে, দেশ ছেড়েছিল ফেলিক্স এবং মারিয়া। বাধ্য হয়েই। সঙ্গে আরও একগুচ্ছ মানুষ। আলো খুঁজছে বেরিয়েছে। উদ্দেশ্য ব্রিটেন। পেরিয়ে গিয়েছে সাহারা মরুভূমি। কেবল পায়ে হেঁটে। মাঝপথে আক্রমণ করেছে ডাকাত। লুঠ করে নিয়েছে যেটুকু সঞ্চয়। তারপরই, উত্তর আফ্রিকান উপকূল ঘেঁষে, স্পেনীয় শহর মেলিল্লা-র পুলিশ তাঁদের গ্রেফতার করেছে। আর মারিয়া? সে সন্তানসম্ভবা। তারপর মেলিল্লা শহর থেকে বিলবাও। যে ক্যাথলিক পাদ্রির সহায়তায় জন্মগ্রহণ করছে, ইনাকি উইলিয়ামস, নিকোর বড়ভাই, সেই পাদ্রি সদ্যজাত ইনাকি-কে উপহার দিচ্ছে একটা ফুটবল ক্লাবের জার্সি। লাল-সাদা। অ্যাথলেটিকো বিলবাও। কী এমন মহাজাগতিক শক্তি ফুটবলে মজুত আছে? এ-পৃথিবীর সমস্ত ঈশ্বরকে সে অস্বীকার করতে প্রস্তুত?
উত্তরাধিকার সূত্রে, কেউ বিঘত বিঘত জমি পেয়ে থাকে। কেউ পায় সিন্দুকভরা টাকা। আর কেউ পায়, জার্সি! নিকো উইলিয়াস সেই ছেলেটা! ইউরো কাপ-এর গ্রুপ লিগে, ইতালির বজ্রকঠিন ডিফেন্স ভাঙতে ভাঙতে নিকোর মনে পড়ছিল তার বাবা সামান্য খুঁড়িয়ে হাঁটে! সেদিন ম্যান অফ দ্য ম্যাচের ট্রফি হাতে সে বলল, ‘এভ্রিথিং উই ডু ইজ় ফর আওয়ার পেরেন্সটস্!’ গায়ে স্পেনের জার্সি। সেই স্পেন, যে দল ইউরো কাপে একটা ঝড়। যে দলের মাঝমাঠে খেলেন অতিমানবীয় রদ্রিগো। যে দলের রাইট উইং-এ খেলছে আরেক ম্যাজিকাল কিশোর। বছর সতেরোর লামিন ইয়ামাল। নিকোর প্রিয়বন্ধু। ক্রমশ বিপক্ষের ত্রাস হয়ে উঠছে যারা। শেষ ষোলোর ম্যাচে স্পেনের বিরুদ্ধে জর্জিয়া। নিকো গোল করলেন। গোল করালেন। প্রিয়বন্ধুর সঙ্গে নাচলেন। একসঙ্গে ধুয়ে দিলেন জর্জিয়ান ডিফেন্স। ম্যাচ শেষে জানা গেল, তাঁর পাসিং অ্যাকিউরেসি ১০০%। স্পেন ৪-১ গোলে জয়ী।
শেষ মরশুমে, অর্থ্যাৎ ২০২৩-’২৪ সিজনে, অ্যাথলেটিকো বিলবাও-এর জার্সিতে নিকো উইলিয়ামসের পারফরমেন্স কেমন? ৩৭টি ম্যাচে, ৮টি গোল এবং ১৯খানা অ্যাসিস্ট! মেসিভক্ত। তবু নেইমারই ঈশ্বর। নেইমারের খেলা দেখেই সে বড় হয়েছে। অসম্ভব গতি। দুর্দান্ত ড্রিবল-শক্তি। স্পেনের কোচ লুইস ডে লা ফুয়েন্তের ভরসাস্থল।
হে পাঠক, মনে হতে পারে এ-লেখা প্রাচীন উপকথার গল্প। কিংবা কোনও ক্লাসিক উপন্যাসের পাতা। অথচ, এ ঘটছে আমার আপনার পৃথিবীতে। ভাস্কর চক্রবর্তী যেমন লিখেছিলেন, ‘সারা পৃথিবীটাই কবিতা দিয়ে তৈরি। একেকদিন, ভেতরকার দরজা জানলাগুলো সব খুলে যায়।’ সেইসব দরজা-জানলা খুলেই বেরিয়ে আসেন কখনও লুকা মদ্রিচ। যুগোস্লোভিয়ার যুদ্ধে, শৈশব কেটেছিল রিফিউজে ক্যাম্পে। সার্বিয়ান বোমের ফাঁপা শেলগুলোর মাঝখান দিয়ে যে ড্রিবল করত। ল্যান্ডমাইনের মাঝখান দিয়ে যে ড্রিবল করত। কেবল ড্রিবলই করত। নিকো উইলিয়ামস হয়তো তেমন কেউ। গ্যালারি যখন কালো রঙের বিষাদ নিয়ে চেপে বসে মাথায়, যেন টুঁটি টিপে ধরে পৃথিবীর আদিম শাসকের দল! বিদ্যুৎ খেলে শরীরে। বর্ণবাদের মাঝখান দিয়ে সে শুধুই ড্রিবল করে। আশ্চর্য ছন্দে। সম্মুখে তিনকাঠির গোল। ব্যাকগ্রাউন্ডে যেন বব মার্লে গাইছেন, ‘য়োন্ট ইউ হেল্প টু সিং/ দিস সং অফ ফ্রিডম?/ কজ অল আই এভার হ্যাভ/ রিডেম্পশান সং…’
ইতিমধ্যেই বার্সেলোনা, চেলসির মতো ইউরোপের জায়ান্ট ক্লাবগুলো যেন উতলা। নিকোকে তাদের ক্লাবে সই করানো চাই! আচ্ছা, ইনাকির গল্পটার কী হল? জেনে আশ্চর্য হবেন। ইনাকি ঘানার জাতীয় দলে ফুটবল খেলে। দেশ সম্পর্কে যে বিভ্রান্ত ধারণাটি ইদানীং বাজারে খুব প্রচলিত, ইনাকি সেই ধারণাটি এক্কেরে গুঁড়িয়ে দেয়। যে টানে সে ঘানার জার্সি গায়ে চাপিয়েছে, দেশপ্রেম কিংবা দেশভক্তি আসলে ওই মায়া। দুই ভাই। এক ক্লাব। অথচ, দেশের জার্সি ভিন্ন!
ইনাকি জন্মেছিল বিলবাও শহরে। নিকো, পামপ্লোনা শহরে। ততদিনে অ্যালেক্স চলে গিয়েছেন ইংল্যান্ডে। মা কাজ করেন স্পেনের তিনটি স্থানীয় ক্যাফেতে। ইনাকি চেনায় ফুটবল। শেখায় ড্রিবল। নিকোর গায়ে তুলে দেয়, একটা জার্সি। ফুটবলের তাড়না। যা ঘুমোতে দেয় না। যা সভ্যতাকে চিৎকার করে বলে, ফুটবল ইজ নট জাস্ট আ গেম! ঘানা থেকে মরুভূমি পেরিয়ে স্পেন। স্পেনের মেলিল্লা থেকে বিলবাও। বিলবাও থেকে পামপ্লোনা। একটা নিরন্তর অভিবাসন। জন্মের আগেই উদ্বাস্তু! আর প্রত্যেক অভিবাসনের গহীনে, হিংসা রক্ত আর যন্ত্রণার সঙ্গে ফুটবল যে কীভাবে জড়িয়ে যায়, কোন মন্ত্রবলে, তা বুঝেই উঠতে পারলাম না ছাই।