ভারত হয়তো টেস্টটা জিততে পারেনি, কিন্তু তিনি, সরফরাজ খান জানিয়ে দিলেন ভাণ্ডারে কত বিবিধ রতন রয়েছে। হাঁটু মুড়ে স্পিনারকে ছক্কা হাঁকালেন। অফ স্ট্যাম্পের বাইরে ব্যাট পেতে দিয়ে নিরলসভাবে চার বন্যা বইয়ে দিলেন। আর কে ভুলবে, শরীরকে নুইয়ে উইকেটের পিছনে ফ্লিকটা! একটা আলুথালু কিন্তু প্রচণ্ড স্মার্ট ব্যাপার। আর পিচের মাঝখানেই লম্ফঝম্প করে রান আউট থেকে বাঁচালেন পন্থকে। দেখে হাসির রোল উঠল রোহিত-বিরাটদের মুখেও।
সরফরাজ খান হওয়ার জন্য কতটা পথ পেরোতে হয়? অপেক্ষার ওপর পলিরাশি জমতে জমতে তৈরি হওয়া বিচ্ছিন্ন দ্বীপে কি জন্ম নেয় বিশল্যকরণী? অথচ সেঞ্চুরি-হাফসেঞ্চুরির সঞ্জীবনী ছুঁয়েও বুক পেতে সয়ে যেতে হয় বঞ্চনা নামের এক তিতকুটে বিষ। তার মন্থনেই বোধহয় জন্ম নেয় সরফরাজের অমৃত প্রতিভার ভাণ্ড! বেঙ্গালুরুতে অবিশ্বাস্য ১৫০-র পরও কি টিম ইন্ডিয়ায় পাকাপাকি হবে তাঁর জায়গা?
প্রশ্নটা অযৌক্তিক মনে হওয়ার কথা নয়। সরফরাজের সঙ্গে পায়ে পায়ে অতীতের দিকে হাঁটলে যে সফরটা হবে, সেই রাস্তার প্রতিটা বাঁকের হলদেটে সাইনবোর্ডে লেখা রয়েছে ‘অপেক্ষা’ শব্দটির ইউ-টার্ন। নিউজিল্যান্ডের বিরুদ্ধে বেঙ্গালুরু টেস্টেও তো সুযোগ পাওয়ার কথা ছিল না। আচমকা শুভমান গিলের চোট দরজা খুলে দেয় সরফরাজের সামনে। নয়তো বাংলাদেশ সিরিজের মতো এখানেও সময় যাপন করতে হত রিজার্ভ বেঞ্চে বসেই। যেভাবে সরফরাজের কেটেছে একের পর একটা বছর। রনজিতে মুম্বইয়ের হয়ে দু’-দুটো সিজনে ৯০০-র উপর রানও কি যথেষ্ট ছিল না জাতীয় দলের দরজা খোলার জন্য?
সবুরে মেওয়া ফলে। সরফরাজের অপেক্ষার ছায়া দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হয়েছে। মেঘে মেঘে কেটেছে বেলা। একদিন ধৈর্যের বাঁধ ভেসে যায় কপোতাক্ষ জলে। গত বছর রনজিতে লাগাতার সেঞ্চুরি হাঁকিয়ে ভেঙে যায় অর্গল। আঙুল তুলে ছুটে যান কার দিকে? উঁচিয়ে রাখা আঙুলের উল্টো দিকে নিশ্চয়ই শুধু চেতন শর্মাদের মতো নির্বাচকরা থাকেন না। বরং উদ্ধত তর্জনীর কাউন্টার অ্যাটাক লিখে রাখে এক তরুণের অসহায় আস্ফালনকে। কীভাবে যেন মিলে যায় গোটা প্রজন্মের আর্তনাদ! সময়-সমাজ-রাজনীতির চক্রব্যূহে মার খেতে খেতে ক্লান্ত হয়ে যারা চোখে চোখ রাখতে পারার আত্মবিশ্বাস হারিয়ে ফেলে, তাদের জন্য সরফরাজ বলে ওঠেন, ‘ছিলাম, আছি, থাকব’।
…………………………………………………
পরের টেস্টে গিল ফিরবেন, বাদ পড়তে পারেন কেএল রাহুল। ফলে আপাতত টেস্ট টিমের পাঁচ বা ছয় নম্বরে সরফরাজকেই দেখা যাবে। তবু বালির বাঁধে যে ভরসা রাখতে নেই, সেটা এতদিনে নিশ্চয়ই বুঝে গিয়েছেন সরফরাজ। ভারতীয় ক্রিকেটে প্রতিভার অভাব নেই। প্রতি মুহূর্তে থাকবে টার্গেট পূরণের উত্তুঙ্গ চাহিদা। দুয়েকজন বাদে কারওর জায়গাই পাকা নয়। একটা খারাপ সিরিজ, দু’-চারটে বাজে আউট ফের ভাগ্যের চাকা ঘুরিয়ে দিতে পারে উলটো দিকে। সামনে বর্ডার-গাভাসকর সিরিজ। সুযোগ পেলে সেখানেই অগ্নিপরীক্ষা সরফরাজের।
…………………………………………………
ঠিক এই অ্যাটিট্যুডটাই নাকি সমস্যা! সরফরাজের ক্ষেত্রে উঠেছে শৃঙ্খলার অভাবের অভিযোগ। দিল্লির বিরুদ্ধে সেঞ্চুরির পর ওই আগ্রাসী আচরণ না-হয় একটা। আর বাকিটা? স্পষ্ট উত্তর নেই। খুড়োর কল সামনে ঝুলিয়ে অপেক্ষা করো। একটু বেগড়বাই করলেই পড়বে চোখরাঙানির সামনে। সেই ফাঁকে টেস্টে সুযোগ পেয়ে যাবেন শ্রীকর ভরতরা। এমনকী রিজার্ভ দলে থাকবেন সূর্যকুমারও। এখানেও যদি শেষ না হয়, তাহলে রইল ফিটনেস নিয়ে কথাবার্তা। সরফরাজ তো সিক্স প্যাক নিয়ে চটকদার বিজ্ঞাপনে মুখ থুড়ি শরীর দেখানোর মানুষ নন। ওই যাকে বলে নাদুসনুদুস, সেটাই। চোখেমুখে এখনও কৈশোরের আত্মভোলা ছাপ। যে যতই ইয়ো ইয়ো টেস্টের বেঞ্চমার্ক পার করে যান না কেন, গড়পড়তা ভারতীয় কটাক্ষে তিনি আনফিট।
বঞ্চনার কোনওটাই হয়তো ইচ্ছাকৃত নয়। আইপিএলের মঞ্চে তো সত্যিই তিনি ব্যর্থ। হাজার ওয়াটের আলোর তলায় ‘জাত’ চেনাতে পারেননি তিনি। রনজি-দলীপ-ইরানির সংসারে ডাল-ভাত মুখে দিয়ে অফিস ছুটেছেন, আইপিএলের হাইওয়ে ধরে গতি বাড়াতে পারেনি তাঁর ব্যাটের স্পিডোমিটার। তবু মাটি কামড়ে পড়ে থেকে লড়াই করে গিয়েছেন। অবশেষে চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে ভারতের জার্সিতে অভিষেক। হাতে টেস্ট ক্যাপ তুলে নেওয়ার সময় পাশে দাঁড়িয়ে থাকা বাবা নৌশাদ খানের চোখ জলে ভেসে যাচ্ছে। জড়িয়ে ধরলেন গর্বিত মাকে। ব্যস, একটা মধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলের জন্য আর কী চাই? এই তো জীবন কালীদা!
রাজকোটে ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে সেই টেস্টের প্রথম ইনিংসে ৬২ রান। অভিষেকেই দুই ইনিংসে হাফসেঞ্চুরি। পরের টেস্টটা খুব একটা ভালো যায়নি। তার পরেই আবার হাফসেঞ্চুরি। মাঝে এসেছে আইপিএল, টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ। ফের প্যান্ডোরার বক্সে বন্দি হয়ে গিয়েছিলেন সরফরাজ। বাংলাদেশ সিরিজেও প্রথম দলে জায়গা হয়নি। কিন্তু ঘরোয়া ক্রিকেটে রান করা থামাননি। ইরানি ট্রফিতে মুম্বইয়ের হয়ে হাঁকিয়েছেন দুশো। আর সেটা এমন একটা সময়ে যখন তাঁর ভাই মুশির খান গাড়ি দুর্ঘটনায় মারাত্মক আহত। ডবল সেঞ্চুরি করে সরফরাজ জানিয়ে ছিলেন, একটা শতরান তাঁর নিজের, আর একটা ভাইয়ের জন্য। সেই বাঁধনহারা আগ্রাসন নয়। অনেক স্থিতধী, শান্ত। পরিবারের বড় দাদার মতো কর্তব্যবোধে পরিপূর্ণ।
……………………………………………………
আরও পড়ুন অর্পণ দাস-এর লেখা: বিদায়বেলায় তোমার পাশে ‘কিতনে আদমি থে গব্বর?’
……………………………………………………
নিউজিল্যান্ডের বিরুদ্ধে বেঙ্গালুরুতেও ঠিক সেটাই চোখে পড়ল। প্রথমে বিরাট ও পরে পন্থের সঙ্গে জুটি বেঁধে ভারতকে বিপদসীমার ওপারে নিয়ে গেলেন। করলেন চোখ ধাঁধানো ১৫০। ভারত হয়তো টেস্টটা জিততে পারেনি, কিন্তু তিনি, সরফরাজ খান জানিয়ে দিলেন ভাণ্ডারে কত বিবিধ রতন রয়েছে। হাঁটু মুড়ে স্পিনারকে ছক্কা হাঁকালেন। অফ স্ট্যাম্পের বাইরে ব্যাট পেতে দিয়ে নিরলসভাবে চার বন্যা বইয়ে দিলেন। আর কে ভুলবে, শরীরকে নুইয়ে উইকেটের পিছনে ফ্লিকটা! একটা আলুথালু কিন্তু প্রচণ্ড স্মার্ট ব্যাপার। আর পিচের মাঝখানেই লম্ফঝম্প করে রান আউট থেকে বাঁচালেন পন্থকে। দেখে হাসির রোল উঠল রোহিত-বিরাটদের মুখেও। সরফরাজ কখনও ‘গার্ডেন মে ঘুমনেওয়ালা বান্দা’, তো কখনও প্রবল দায়িত্বশীল।
কিন্তু তাতেও কি কাজ মিটল? পাল্লা ভারী না-এর দিকেই। পরের টেস্টে গিল ফিরবেন, বাদ পড়তে পারেন কেএল রাহুল। ফলে আপাতত টেস্ট টিমের পাঁচ বা ছয় নম্বরে সরফরাজকেই দেখা যাবে। তবু বালির বাঁধে যে ভরসা রাখতে নেই, সেটা এতদিনে নিশ্চয়ই বুঝে গিয়েছেন সরফরাজ। ভারতীয় ক্রিকেটে প্রতিভার অভাব নেই। প্রতি মুহূর্তে থাকবে টার্গেট পূরণের উত্তুঙ্গ চাহিদা। দুয়েকজন বাদে কারওর জায়গাই পাকা নয়। একটা খারাপ সিরিজ, দু’-চারটে বাজে আউট ফের ভাগ্যের চাকা ঘুরিয়ে দিতে পারে উলটো দিকে। সামনে বর্ডার-গাভাসকর সিরিজ। সুযোগ পেলে সেখানেই অগ্নিপরীক্ষা সরফরাজের।
আশঙ্কা তো আরও এক জায়গায়। ওই দুটো খারাপ আউট বা গুরুত্বপূর্ণ সময়ে ব্যর্থতায় আক্রমণ আসতে পারে মাঠের বাইরে থেকেও। ঘৃণামিশ্রিত হিংস্র বাউন্সার ধেয়ে আসবে নাম-পদবি লক্ষ্য করে। তেরঙ্গার প্রতি দায়বদ্ধতা সংক্রান্ত কল্পিত আক্রোশে অস্বস্তিতে ফেলতে পারে তিক্ত-কষায় বিদ্রুপের বডিলাইন। যার হাত থেকে রেহাই পায়নি মহম্মদ শামি কিংবা অর্শদীপ সিংও।
…………………………………………..
ফলো করুন আমাদের ফেসবুক পেজ: রোববার ডিজিটাল
…………………………………………..
মনে পড়তে পারে আমির খানের ‘পিকে’ সিনেমার সেই বিখ্যাত সংলাপ। সবাই বিশ্বাস করেছিল সুশান্ত সিং রাজপুত অভিনীত সরফরাজ চরিত্রটি ‘ধোঁকা’ দেবে। সিনেমায় যেরকম হয়, সেরকমভাবেই ফিরে এসেছিল সরফরাজ। আসলে আমাদের সন্ধিগ্ধ মনে বাসা বেঁধে আছে সংকীর্ণতা। প্রতি মুহূর্তে ‘ধোঁকা’ তো দিয়ে চলি নিজেদেরই। কিন্তু এই সরফরাজ ‘ধোঁকা’ দেয়নি, দেবে না। এটুকুই বিশ্বাস। শুধু যে পথ আপনাকে এতদিন ছুটিয়ে মেরেছে, সেই হলদে সাইনবোর্ডগুলো ভুলবেন না সরফরাজ।
স্পেশাল ইভেন্টগুলো খুব উপভোগ করতাম, যেমন, নেতাজি ইনডোর স্টেডিয়ামে সেকেন্ড চ্যানেলের উদ্বোধনী অনুষ্ঠান, দিনটি ছিল ১৯ নভেম্বর, ইন্দিরা গান্ধীর জন্মদিন। সেবারের অনুষ্ঠানে কলকাতার বহু নামী শিল্পী যেমন ছিলেন, তেমন ছিলেন বম্বের অনেক নামজাদা সঙ্গীতশিল্পী।