জিতলে যেমন ফুর্তি হয়, হারলে মনখারাপ। ভারতের ইতিহাসে ক্রিকেট ব্যাপারটা এরকমই ছিল। আনন্দে খাসির বিরিয়ানি, দুঃখে উপোস। পরিস্থিতির বদল ঘটেছে। জিতলে ফুর্তি রয়েছে, কিন্তু হারলেই ঘৃণা– ঘৃণার যৌথ সামাজিক বিচ্ছুরণ। আমাদের এখন কোনও মনখারাপ নেই। আমরা হারতে শিখছি না, হারকে ঘৃণা করতে শিখছি। হে সমর্থক, যে ক্রিকেটকে ধর্ম বলে মেনেছ, সে ধর্মে জেতা একমাত্র সত্য নয়। হার, ড্র-ও খেলার অংশ। এবং ঘৃণা অংশ নয়।
বেশ কিছু বছর ধরেই এমনটা হয়ে আসছে। শীত কী বস্তু, শহর কলকাতার মানুষ টের পেতে না পেতেই তা হাওয়া! পড়ব-পড়ব করেও আজকাল ঠান্ডাটা তেমন পড়ে না। আজ হিমেল পরশ, তো কাল চাপা গরম। পরশু আবার হালকা-পলকা বৃষ্টির ছাট। কল্লোলিনীর আবহাওয়া খামখেয়ালির ককটেল যেন। কোনদিন কেমন যাবে– আপনি ধরতে পারবেন না!
যেমন ধরতে পারবেন না ইন্ডিয়ান ক্রিকেট নামক মহার্ঘ্য বস্তুটিকে। খামখেয়ালিপনার সাক্ষাৎ আতুঁড় যেন। দু’দিন আগে যে ক্রিকেটারকে ‘দেবতা’র আসনে বসিয়ে পুজো করছেন অনুরাগীরা, দু’দিন পর তাঁকেই দেখবেন মাটিতে আছড়ে ফেলে ক্ষোভের লাভায় পিষে ফেলছে! হ্যাঁ, এমনটাই এখন দেখতে অভ্যস্ত ভারতীয় ক্রিকেটমহল। অতীতে শচীন থেকে রাহুল, সৌরভ থেকে ধোনি– সকলেই এই আগুনে পুড়েছেন। এখন মুখ বদলেছে। কিছু ছবিটা বিশেষ বদলায়নি। বিরাট কোহলি তাঁর জ্বলন্ত উদাহরণ। কিন্তু ভারত অধিনায়ক রোহিত শর্মা? তাঁর সঙ্গে যা চলছে, তাকে আর যাই হোক, ক্রিকেট ধর্ম বলা চলে না, বললে বলতে হয়– অধর্ম! ভারত অধিনায়কের সঙ্গে প্রতি পদে অনাচারই করছে ভারতীয় ক্রিকেট দর্শক। সেই অনাচারের বধ্যভূমি আমাদের সোশাল মিডিয়া। সেখানে হিটম্যানের উদ্দেশে যে উপহাসের নরকযন্ত্রণা তারা ছুড়ে দিচ্ছে, তা মোটেই রোহিতের প্রাপ্য নয়।
পারিবারিক কারণেই বর্ডার-গাভাসকর ট্রফির প্রথম টেস্টে টিমে ছিলেন না রোহিত। ক্রিকেট আগে নাকি পরিবার– তিতকুটে সেই প্রশ্নে জর্জর কম হয়ে হয়নি হিটম্যানকে। অতীতে যে গরল পান করতে হয়েছে ‘পরিত্রাতা’ বিরাটকেও। অ্যাডিলেডে দিন-রাতের টেস্টে বিপর্যয়ের পর সেই ক্ষোভের আগুনটাই ভিসুভিয়াস হয়ে বেরিয়ে এসেছে ভারতীয় সমর্থকদের অন্তর থেকে। যেন রোহিত দলে ফেরায়, অধিনায়কত্বে ফিরে আসাতেই এই বিশ্রী হার– বুমরা নেতৃত্বে থাকলে বুঝি এমনটা হত না! অথচ রোহিত-বিরাট উত্তর ভারতীয় ক্রিকেটের মুখ হিসেবে যাঁকে ধরা হচ্ছে, সেই শুভমান গিলের টেস্টে গড় তিরিশের নিচে। গোলাপি বলে চোখে ধাঁধা দেখছেন ‘প্রিন্স’, সাক্ষী ক্রিকেটবিশ্ব। নীতিশকুমার রেড্ডিকে বাদ দিলে ‘টিম ইন্ডিয়া’র তারুণ্যের তেজ দূরবিনে চোখ রেখে খুঁজতে হয়। অথচ তারপরেও শোরগোল ওঠে, ‘বিরাট হাটাও, রোহিত হাটাও…’ বলে। সুদূর অস্ট্রেলিয়া থেকে গুজবের বুদ্বুদ ভেসে ভেসে আসে, ‘বর্ডার-গাভাসকর ট্রফি বিরাট-রোহিতদের শেষ টেস্ট সিরিজ!’ সমর্থকদের বেদবাক্য শুনলে মনে হয়, ভারতীয় ড্রেসিংরুমে ব্র্যাডম্যান-সোবার্স বসে আছেন, রোহিত-বিরাটের জন্য সুযোগ পাচ্ছেন না!
………………………………………..
রোহিত এবং রোহিতদের এই অবমূল্যায়নে একটা ব্যাপার পরিষ্কার। চাইলেই ক্রিকেটের সমর্থক হওয়া যায়, সমঝদার হওয়া যায় না। আর এই সমঝদারিত্ব পৃথিবীর যে প্রান্তেই থাক, ভারতে অন্তত নেই। তাদের মধ্যে ধৈর্যের অভাব স্পষ্ট। আরও বড় অভাব ক্রিকেটার নামক যোদ্ধাদের প্রতি শ্রদ্ধা, বিশ্বাস রাখার মানসিকতা। তাই এদেশে ক্রিকেটই ‘ধর্ম’ বলাটাই অধর্ম, মিথ্যাচার। যাঁরা এই মিথ্যাচার করেন, সেই সমর্থকরা কি আয়নায় একটু মুখ দেখবেন?
………………………………………..
কী বলবেন একে? হাস্যকর নয়? ছন্দে নেই রোহিত, রান পাচ্ছেন না। ঠিক কথা। ব্যাটিং-অর্ডারে রদবদল কোথাও যেন ঘেঁটে দিয়েছে চেনা মুম্বইকরের মেজাজ। অ্যাডিলেডে যা চোখ এড়ায়নি সুনীল গাভাসকর, রবি শাস্ত্রীদের মতো প্রাক্তনদের। কিন্তু ক্রিকেটে সাফল্য কিংবা ব্যর্থতা কোনওটাই চিরস্থায়ী নয়। রোহিতও তার ব্যতিক্রম নন। অথচ তাঁর ক্রিকেট-সত্তাকে মাটিতে টেনে আছড়ে ফেলতে দু’বারও ভাবেনি ভারতীয় ক্রিকেট সমর্থকরা। আসলে তাদের কাছে জয়টাই শেষ কথা। জিতলে তুমি জয়ধ্বনি পাবে, হারলে মুণ্ডপাত। এই চেনা সমীকরণের বাইরে আজও বের হতে পারেনি ভারতীয় ক্রিকেট। বরং সময় যত গড়িয়েছে, খেলায় হারের যন্ত্রণা, দুঃখ বদলে গিয়েছে ক্ষোভে। ক্রিকেট-জনতার মধ্যে তাই আজ দুঃখবোধ দেখা যায় না, দেখা যা মেলে, তা আসলে বিক্ষোভের লেলিহান শিখা। তার ঘেরাটোপেই আজ জতুগৃহ ভারতীয় ক্রিকেট। তাই সিরিজে কামব্যাকের স্বপ্ন জারি থাকলেও সমর্থকদের হাহাকার শোনা যায়, ‘গেল গেল’ রবে হাহুতাশ ঝরে পড়ে। কে বলবে, এই বিরাট-রোহিতরাই ছ-মাস আগে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ জয়ের মায়াবী রাত উপহার দিয়েছিলেন সমর্থকদের। সে মুহূর্তকে সমর্থকরা অনায়াসেই ভুলে গেলেন, অক্লেশে।
রোহিত এবং রোহিতদের এই অবমূল্যায়নে একটা ব্যাপার পরিষ্কার। চাইলেই ক্রিকেটের সমর্থক হওয়া যায়, সমঝদার হওয়া যায় না। আর এই সমঝদারিত্ব পৃথিবীর যে প্রান্তেই থাক, ভারতে অন্তত নেই। তাদের মধ্যে ধৈর্যের অভাব স্পষ্ট। আরও বড় অভাব ক্রিকেটার নামক যোদ্ধাদের প্রতি শ্রদ্ধা, বিশ্বাস রাখার মানসিকতা। তাই এদেশে ক্রিকেটই ‘ধর্ম’ বলাটাই অধর্ম, মিথ্যাচার। যাঁরা এই মিথ্যাচার করেন, সেই সমর্থকরা কি আয়নায় একটু মুখ দেখবেন?
…………………………………………
ফলো করুন আমাদের ফেসবুক পেজ: রোববার ডিজিটাল
…………………………………………