প্রতিবাদের মঞ্চ হিসেবে বার্লিন গেমস একইভাবে স্মরণীয় হয়ে আছে ভারতীয় অ্যাথলিটদের কাছেও। ভারতীয় জাতীয়তাবাদের দীপ্ত বহিঃপ্রকাশ দেখা যায় হিটলারকে প্রতি স্যালুট না করার অভিপ্রায়ে। ভারতের অধিকাংশ সংবাদপত্রে অবশ্য এই প্রতিবাদ জায়গা পায়নি। শুধুমাত্র ‘ক্যালকাটা স্টেটসম্যান’, যারা অলিম্পিক কভার করতে গিয়েছিল, তাদের পলিটিক্যাল পেজে ঠাঁই পেয়েছিল ভারতীয় অ্যাথলিটদের এই প্রতিবাদ। যদিও স্পোর্টস পেজে অলিম্পিক নিউজ থাকলেও সেখানে সুপরিকল্পিতভাবেই রাখা হয়নি এই খবর।
স্পোর্টস এবং পলিটিক্স- একে অপরের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। অলিম্পিকের মঞ্চকে কোনওভাবেই তার থেকে আলাদা করা যায় না। সাম্প্রতিককালে ক্রিকেট বিশ্বকাপ হোক কিংবা ফুটবলের ইউরোর আসর, খেলাধুলোর নানা মঞ্চে রাজনৈতিক প্রতিবাদ প্রচারের আলো কেড়ে নিয়েছে। অতীতে যে এমন ঘটনা ঘটেনি, তা কিন্তু নয়। বিশেষ করে অলিম্পিকের মঞ্চে এমন ঘটনা বিরল নয় মোটেই। প্রমাণস্বরূপ, ১৯৬৮-র মেক্সিকো অলিম্পিক্সে ‘ব্ল্যাক স্যালুট’-এর কথা স্মরণ করা যেতে পারে।
অলিম্পিকের মতো খেলার সর্বোত্তম আসরকে রাজনৈতিক প্রতিবাদ জ্ঞাপনের মঞ্চ হিসাবে ব্যবহার করার নিরিখে ভারতীয় প্রতিনিধি দলের ভূমিকাও কিছু কম ছিল না। বরং সেব্যাপারে ভারতীয় প্রতিনিধি দলের এক সুদীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে।
১৯৩৬-এর বার্লিন গেমস সেই মঞ্চ, যেখানে অলিম্পিকের উদ্বোধনী অনুষ্ঠান মঞ্চে উপস্থিত অ্যাডলফ হিটলারকে প্রথামাফিক ‘হিটলার স্যালুট’ দিতে অস্বীকার করে অলিম্পিকে অংশগ্রহণকারী ভারতীয় দল। জার্মান চ্যান্সেলরের উদ্দেশে ভারতীয়দের এমন ‘বিসদৃশ’ আচরণ নিয়ে তোলপাড় পড়ে যায় বার্লিন জুড়ে। তবে শুধু ভারতীয়রাই নয়, সেই অলিম্পিকে অংশগ্রহণকারী আরও একটি প্রতিনিধি দল ‘ফ্যুয়েরার’কে হাত তুলে অভিবাদন জানাতে অস্বীকার করে। তাঁরা হল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধি টিম।
………………………………………………………..
দেশের মাটিতে জাতীয়তাবাদের যে আগুন জ্বলে উঠেছিল, তারই স্ফূলিঙ্গ বার্লিন গেমসের উদ্বোধনী আসরে প্রতিফলিত হয়েছিল অ্যাথলিটদের মধ্যে। তবে উভয়ের মধ্যে সরাসরি কোনও যোগসূত্র ছিল কি না, তার নির্ভরযোগ্য কোনও প্রমাণ নেই। তা সত্ত্বেও খেলাধুলোর মঞ্চে সেদিন ভারতীয় অ্যাথলিটরা যে রাজনৈতিক প্রতিবাদকে নির্ভীকচিত্তে তুলে ধরার সৎ সাহস দেখিয়েছিলেন, তা আজও তুলনারহিত।
………………………………………………………..
ভারতীয়দের তুলনায় মার্কিনীদের প্রতিবাদই প্রচারের আলো কেড়ে নিয়েছিল বিশেষ করে। ব্রিটিশ-অনুগত সংবাদপত্রগুলির শিরোনামে জায়গা করে নেয় মার্কিন প্রতিযোগীদের জার্মান চ্যান্সেলরের বিরুদ্ধে এই তীব্র প্রতিবাদ। ভারতীয়দের বিদ্রোহী মনোভাবের জায়গা হয় সামান্যই। আসলে প্রতিযোগিতার শুরু থেকে গেমসে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অংশগ্রহণ নিয়ে অনিশ্চয়তার কালো মেঘ ঘনিয়ে উঠেছিল। আমেরিকার মিল্টন গ্রিন, নরম্যান ক্যানার্সের মতো ইহুদী অ্যাথলিটরা গেমস বয়কটের ডাক দিয়েছিলেন। ফলে গেমসের শুরু থেকে চর্চার কেন্দ্রে ছিল মার্কিন দল। ন্যাৎসি বিরোধিতার পাশাপাশি জার্মান চ্যান্সেলরের ইহুদী-বিরোধী মনোভাব মার্কিন অ্যাথলিটদের গেমসে স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ নিয়ে আতঙ্কিত করে তুলেছিল। শেষপর্যন্ত ক্রীড়াপ্রশাসক ও পরবর্তী আইওসি সভাপতি অ্যাভেরি ব্র্যান্ডেজের মধ্যস্থতায় তাঁরা গেমসে অংশগ্রহণে সম্মত হলেও উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে পোডিয়ামের সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় জাতীয় পতাকা অর্ধনমিত করা কিংবা হাত তুলে জার্মান চ্যান্সেলরকে অভিবাদন জানাতে অস্বীকার করে। এরজন্য স্টেডিয়ামে উপস্থিত দর্শক-সাধারণের প্রবল ব্যারাকিংয়ের মুখেও পড়তে হয় মার্কিন দলকে। যদিও বার্লিন গেমস আমেরিকানদের কাছে স্মরণীয় হয়ে আছে নাৎসি আধিপত্য ভেঙে মার্কিন অ্যাথলিট জেসি ওয়েন্সের সাফল্য অর্জনের জন্য।
প্রতিবাদের মঞ্চ হিসেবে বার্লিন গেমস একইভাবে স্মরণীয় হয়ে আছে ভারতীয় অ্যাথলিটদের কাছেও। ভারতীয় জাতীয়তাবাদের দীপ্ত বহিঃপ্রকাশ দেখা যায় হিটলারকে প্রতি স্যালুট না করার অভিপ্রায়ে। ভারতের অধিকাংশ সংবাদপত্রে অবশ্য এই প্রতিবাদ জায়গা পায়নি। শুধুমাত্র ‘ক্যালকাটা স্টেটসম্যান’, যারা অলিম্পিক কভার করতে গিয়েছিল, তাদের পলিটিক্যাল পেজে ঠাঁই পেয়েছিল ভারতীয় অ্যাথলিটদের এই প্রতিবাদ। যদিও স্পোর্টস পেজে অলিম্পিক নিউজ থাকলেও সেখানে সুপরিকল্পিতভাবেই রাখা হয়নি এই খবর।
জানা যায়, জি ডি সোধিঁ, বার্লিন গেমসে ভারতীয় দলের অন্যতম কার্যকর্তা, তাঁর প্রেরণাতেই এই প্রতিবাদ কর্মসূচি গ্রহণ করেছিল ভারতীয় অ্যাথলিটরা। এই সোধিঁর অনুপ্রেরণাতেই চারের দশকের শেষের দিকে গড়ে উঠেছিল প্যান-এশিয়ান ইউনিটি। তৈরি হয়েছিল এশিয়ান গেমস আয়োজনের পরিকল্পনা। তাৎপর্যপূর্ণ বিষয়, বার্লিনে ‘ফ্যুয়েরার’-এর সামনে এই যে প্রতিবাদ, তা যে ব্রিটিশ প্রভাবান্বিত, তা মোটেই বলা যাবে না। বার্লিন গেমসের বছর দু’য়েক আগে, মিউনিখ কনফারেন্সে শান্তির ললিত বাণী শোনাতে দেখা গিয়েছিল ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী নেভিল চেম্বারলিনকে। পাশাপাশি সেসময় হিটলারের প্রতি যে তোষণনীতি ব্রিটিশ সরকার গ্রহণ করেছিল, তাও সর্বজনসুবিদিত। তাই জার্মান চ্যান্সেলরকে স্যালুট না করা একান্তই ভারতীয় সিদ্ধান্ত। এবং এই প্রতিবাদ মতাদর্শগতভাবে মহাত্মা গান্ধী ও জওহরলাল নেহরুর নেওয়া নাৎসি-বিরোধী অবস্থান থেকে উদ্ভুত, তা অনস্বীকার্য।
………………………………………………………………………….
আরও পড়ুন অমিতাভ চট্টোপাধ্যায়-এর লেখা: চোট সারানোর সময় নেই, তাই আঙুল বাদেও দ্বিধাহীন ম্যাথিউ ডসন
………………………………………………………………………….
বিশের দশক থেকেই ইউরোপ জুড়ে যে যুদ্ধের আবহ নির্মাণ হয়েছিল তার জন্য ব্রিটেনকে দায়ী করে বারবার প্রতিবাদ জানিয়েছেন গান্ধীজি। এমনকী সাম্রাজ্যবাদের প্রতিরূপ হিসেবে ফ্যাসিবাদ ও নাৎসিবাদের কঠোর সমালোচনা করতেও ছাড়েননি তিনি। ১৯৩৮-এর পর ‘হরিজন’ পত্রিকায় ক্রমাগত হিটলার বিরোধিতায় কলম ধরতে দেখা গিয়েছে গান্ধীজিকে। পাশাপাশি চিঠি লিখে জার্মান চ্যান্সেলরকে হিংসার পথ থেকে সরে দাঁড়ানোর অনুরোধ করতেও দেখা যায় মহাত্মাকে। ত্রিপুরা কংগ্রেসের অধিবেশনে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ ও ফ্যাসিবাদ– উভয় থেকে দূরত্ব বাড়ানোর কথাও ঘোষণা করেন গান্ধীজি।
দেশের মাটিতে জাতীয়তাবাদের যে আগুন জ্বলে উঠেছিল, তারই স্ফূলিঙ্গ বার্লিন গেমসের উদ্বোধনী আসরে প্রতিফলিত হয়েছিল অ্যাথলিটদের মধ্যে। তবে উভয়ের মধ্যে সরাসরি কোনও যোগসূত্র ছিল কি না, তার নির্ভরযোগ্য কোনও প্রমাণ নেই। তা সত্ত্বেও খেলাধুলোর মঞ্চে সেদিন ভারতীয় অ্যাথলিটরা যে রাজনৈতিক প্রতিবাদকে নির্ভীকচিত্তে তুলে ধরার সৎ সাহস দেখিয়েছিলেন, তা আজও তুলনারহিত।
………………………………………………………..
ফলো করুন আমাদের ফেসবুক পেজ: রোববার ডিজিটাল
………………………………………………………..