দেশবাসী তার দুর্দশার জন্য নিজেকেই দায়ী করে, আর এক মসীহার কল্পনা করে, যিনি কিনা সকল চোখের জল মুছিয়ে কোলে তুলে নেবেন সোনার দেশের সোনার মানুষকে। ভারতীয় ক্রিকেট সেই পথেই হেঁটেছে। ধারাভাষ্যকারদের কেউ কেউ সেই মসীহাতন্ত্রই গড়ে তোলেন শব্দের মায়াজালে। মনে হবে, ব্যাটার নামছেন না, যেন কোনও দৈবাদৃষ্ট যুগপুরুষ নামছেন, মানবজাতির ক্রমমুক্তির আলো জ্বালতে। যেন বোলার নন, গোলেমালে কুরুক্ষেত্র বাধিয়ে তোলা রণাঙ্গনে নামছেন অর্জুন মহাবীর। তবু ক্রিকেট তো ক্রিকেটই। এখনও দৈব না হয়ে মানুষের ভরসাতেই থেকে গেছে। ভুলচুক কিছু না কিছু হয়। আর মায়াবন বিহারণের ভিতর একজন সুনীল গাভাসকর থেকে যান, যিনি ক্রমাগত প্রশ্ন তোলেন। সমালোচনা করেন।
স্টুপিড, স্টুপিড, স্টুপিড!
নাচের মুদ্রার যদি অনুবাদ করা যেত, তবে সুনীল গাভাসকরের উচ্ছ্বাস-নৃত্যকে এভাবেই হয়তো ভাষায় প্রকাশ করা যেতে পারত। খিটখিটে লোকটা। ঠোঁটকাটা। ওল্ড স্কুল খানিক! হয়তো বা! অবতারপুজোর দেশে নেহাতই বেমানান। একান্ত মানুষ-সন্ধানী। যে মানুষ রক্তমাংসের, ফলে দোষ-গুণের। গুণীর কদরে তাঁর ত্রুটি নেই, তবু গুণীর দোষ নিয়ে দু’কথা বলতেও তিনি ছাড়েন না। চাঁচাছোলা। এদিকে ভগবান যে গোলোযোগ সইতে পারেন না, সে তো জানা কথা। অথচ প্রশ্নহীন ভক্তির দেশে তিনি যেন মূর্তিমান ‘গোলোযোগ’। নিম-তিতা দু’চারটে প্রশ্ন তুলবেনই। সমালোচনা করবেনই। লোকটা তাই ভক্তদের কাছে সাক্ষাৎ জ্বালাতন। যুগপৎ অজীর্ণ এবং অস্বস্তি। সেই তিনি নাচছেন। উদ্বেল। শিশুর মতো আনন্দে। তবে, এর অনুবাদে স্টুপিড-ধ্বনি বাজছে কেন? তালাশে ভারতীয় ক্রিকেটের অবতারবাদের শপিংমলে খানিক ঘুরে আসা যেতে পারে।
অবশ্য শুধু ক্রিকেট বলা ভুল। ‘হোয়াট ডু দে নো অফ ক্রিকেট হু ওনলি ক্রিকেট নো’– সিএলআর জেমসের প্রবাদ হয়ে যাওয়া উক্তি দিয়েই তালা খুলে ফেলা যায়। সুনীল আর গাভাসকরের মাঝে ‘মনোহর’ থাকলেও, মনোহারি কথাবার্তায় তিনি একেবারেই চোস্ত নন। কমেন্ট্রি করতে বসলে কেবল ক্রিকেট আর ক্রিকেট। সের-সায়রি নেই। শব্দ ভাষা আর কণ্ঠস্বরের ক্রেসেন্ডোয় কাল্পনিক দেশনির্মাণ নেই। কোথায় সেই সুপারপাওয়ারের গরিমা কীর্তন! আর কোথায় বা সেই ক্রিকেট-দেবতার ছাব্বিশ ইঞ্চি ছাতির বর্ণনা! বেরসিক লোকটা বলে ফেলবেনই যে, দলের যখন দরকার তখন তরুণ ব্যাটার দায়িত্বজ্ঞানহীন শট খেলেন কী করে! এটা শট সিলেকশন হল? এ আবার কেমনধারা প্রশ্ন! ক্রিকেটের সনাতন-যজ্ঞে যখন কেবলই স্তুতির ঘি, সেখানে আবার প্রশ্ন কীসের? লোকটা জানেন না কি, ওই তরুণ ব্যাটার কত উদ্ভাবনী শট খেলেছেন অতীতে। তাঁকে নিয়ে কত আগামীর স্বপ্ন। ক্রিকেটজনতার চোখের মণি। তাঁর দিকে আবার প্রশ্ন ছুড়ে দেওয়া কেন! লোকটার স্বভাবই তাই। নিজেরই মুদ্রাদোষে তিনি কেবল হচ্ছেন আলাদা। বিরাট কোহলি যে বিরাট কোহলি, তাঁকেও তিনি প্রশ্ন করেন। এমনকী রোহিত শর্মাকেও। বস্তুত গোটা ভারতীয় দলের পান থেকে চুন খসলেই তিনি সমালোচনা করে থাকেন। আর এই সমালোচনা, প্রশ্নের কাঁকুরে-সংস্কৃতি মোটে সহ্য করতে পারে না স্বপ্ন-দিয়ে-তৈরি অচ্ছে-দিনের ভারতবর্ষ।
রোগটা তো আজকের নয়। বিশ্বায়ন-উত্তর ক্রিকেট যদি ভারতবর্ষেরই প্রতিরূপ হয়, তাহলে খেয়াল করে দেখা যায়, ওই অবতার নির্মাণ প্রক্রিয়া। ক্রিকেটের আগেও দেশের চাই নায়ক। যে-নায়ককে মাঠেই হতে হবে লার্জার-দ্যান-লাইফ। পুঁজি তাঁর জন্যই সমস্ত বিপণনের পসরা সাজিয়ে বসবে। নায়ক অবশ্য আগেও ছিলেন। তবে উদার অর্থনীতির দেশ যে নায়ক চেয়ছে, তা আগের থেকে অনেকটাই আলাদা। যত দিন যাবে সে-নায়ক ক্রমশ অপাপবিদ্ধ হয়ে উঠবেন। নায়কের সিংহাসনে অভিষেক হবে নতুন ব্যক্তির। বদলাতে বদলাতে সে-নায়ক ক্রমশ প্রশ্নাতীত হয়ে উঠবেন। এমনই যে, যিনি ভালো কভার ড্রাইভ মারতে পারেন, তাঁর কথায় বিদ্বেষ থাকলেও তা ধর্তব্যের মধ্যে ধরা যাবে না। এমনকী প্রাক্তন নায়কদের কেউ কেউ এমন কাজ করে বসবেন যে, স্বার্থ সংঘাতের প্রসঙ্গ উঠবে। কিন্তু টুঁ শব্দটি নয়। একজন আছেন অবশ্য, বলে বলে শেষে হতোদ্যম হয়ে বলে ফেলবেন, এসব সাফসুতরো করা আর সম্ভব নয়, ‘লস্ট কেস’। বেচারি রামচন্দ্র গুহ! এক আন্দোলন অংশ নিতে গিয়ে প্রশ্নের মুখে পড়েছিলেন, আপনি কে? ভারতের ক্রিকেটজনতাও একই প্রশ্ন করলে অবাক হওয়ার কিছু নেই। বুঝেশুনেই ক্রিকেট নিয়ে আর কলম ধরবেন না বলে রেখেছেন তিনি। কথা হল, সেই রামচন্দ্র গুহ, সুনীল গাভাসকরের সমালোচনা করতেও পিছপা হননি। অতীতের মায়াময় ইতিহাস প্রশ্ন করায় বাধা হয়নি। হওয়ার কথাও ছিল না।
…………………………………
অথচ ঘুমের ঘোরেই যে কালনাগিনী ঢোকে মঙ্গলকাব্যের দেশ তা সম্যক অবহিত। অতএব ছিদ্র যদি থেকেই থাকে তা চিহ্নিত না করে উপায় নেই। রাজনৈতিক পরিসরে যাঁরা করেন তাঁদের খাঁচায় পোরা যায়। দলীয় রাজনীতির বাইরে সে কাজ করলে অরাজনৈতিক গাল পাড়া যায়। আর ক্রিকেটের ধারাভাষ্যে তা করলে, খেঁকুটে ওল্ড স্কুল বলে মিম বানানো যায়। মোদ্দা সুর একটাই, সমালোচনা দেশের গৌরবের অন্তরায়। নাছোড়বান্দা গাভাসকর শুধু তা মানেন না। এমন নয় যে, তাঁর সব সমালোচনা যৌক্তিক। সময়ের পুরনো আস্তর তাঁর দৃষ্টিতেও আছে কোথাও কোথাও।
…………………………………
হচ্ছে যে, তার কারণ ওই না-প্রশ্নের-দেশ। দক্ষিণপন্থী রাজনীতি শুধু ভারতের রাজনৈতিক চেহারা বদলে দিয়েছে তা নয়। পাল্টে দিয়েছে ভারতীয়-মানস। বালীবধের অপরাধে তাই শ্রীরামচন্দ্র প্রশ্নের মুখে পড়তে পারেন। তবে নব ভারতায়ণে প্রশ্ন আর সমালোচনার জায়গা নেই। ধরেই নেওয়া হয়েছে যে, দেশের সমালোচনা করা আসলে দেশের শত্রুদের সাহায্য করা। শত্রু কে? প্রাসঙ্গিক প্রশ্ন। অতএব আগে একখানা শত্রু খাড়া করে নিতে হবে। সেই শত্রুর নিরিখেই হবে যাবতীয় সাফল্যের খতিয়ান। ফলে আগেই বিদায় বিরুদ্ধমতের। বা একাধিক মত যে সহাবস্থানে থাকতে পারে, এমত ধারণা কোনওক্রমে প্রশ্রয় দেওয়া যাবে না। যিনি করবেন তাঁকে বকে-ঝকে, ভয় দেখিয়ে, শেষমেশ দেশবিরোধী বলে দাগিয়ে দেওয়া যাবে সহজেই। উমবের্তো একো বলবেন, এই যে ধারণার নির্মাণ, যেখানে ফ্যাসিজমের ছায়াপাত, সেখানে disagreement is treason. অর্থাৎ কি না একেবারে ‘ক্রিমিন্যাল অ্যাক্ট’, শত্রুকে সাহায্য করার মতো গর্হিত অপরাধ। এই জাতীয়তাবাদী নির্মাণের মধ্যে ভুল-চুকের জায়গা নেই। এই যে স্বপ্ন-মোড়া আর স্মৃতি-ঘেরা দেশ, সেখানে আর যাই হোক সমালোচকের জায়গা নেই। তা সে রাজনীতি হোক বা ক্রিকেট। বর্তমান ভারতবর্ষে এই নির্মাণ অনেকাংশে সম্পূর্ণ হয়েছে। ফলে দেশবাসী তার দুর্দশার জন্য নিজেকেই দায়ী করে, আর এক মসীহার কল্পনা করে, যিনি কি না সকল চোখের জল মুছিয়ে কোলে তুলে নেবেন সোনার দেশের সোনার মানুষকে। ভারতীয় ক্রিকেট সেই পথেই হেঁটেছে।
ধারাভাষ্যকারদের কেউ কেউ সেই মসীহাতন্ত্রই গড়ে তোলেন শব্দের মায়াজালে। মনে হবে, ব্যাটার নামছেন না, যেন কোনও দৈবাদৃষ্ট যুগপুরুষ নামছেন, মানবজাতির ক্রমমুক্তির আলো জ্বালতে। যেন বোলার নন, গোলেমালে কুরুক্ষেত্র বাধিয়ে তোলা রণাঙ্গনে নামছেন অর্জুন মহাবীর। তবু ক্রিকেট তো ক্রিকেটই। এখনও দৈব না হয়ে মানুষের ভরসাতেই থেকে গেছে। ভুলচুক কিছু না কিছু হয়। আর মায়াবন বিহারণের ভিতর একজন সুনীল গাভাসকর থেকে যান, যিনি ক্রমাগত প্রশ্ন তোলেন। সমালোচনা করেন। আর সোশ্যাল মিডিয়ার অক্ষৌহিণী সেনা তুলোধোনা করে তাঁকে বুঝিয়ে দেয়, তুমি কে হে! মেনে-নেওয়ার নিশ্ছিদ্র লৌহবাসরে তুমি এমন ছিদ্রান্বেষী কেন!
অথচ ঘুমের ঘোরেই যে কালনাগিনী ঢোকে মঙ্গলকাব্যের দেশ তা সম্যক অবহিত। অতএব ছিদ্র যদি থেকেই থাকে তা চিহ্নিত না করে উপায় নেই। রাজনৈতিক পরিসরে যাঁরা করেন তাঁদের খাঁচায় পোরা যায়। দলীয় রাজনীতির বাইরে সে কাজ করলে অরাজনৈতিক গাল পাড়া যায়। আর ক্রিকেটের ধারাভাষ্যে তা করলে, খেঁকুটে ওল্ড স্কুল বলে মিম বানানো যায়। মোদ্দা সুর একটাই, সমালোচনা দেশের গৌরবের অন্তরায়। নাছোড়বান্দা গাভাসকর শুধু তা মানেন না। এমন নয় যে, তাঁর সব সমালোচনা যৌক্তিক। সময়ের পুরনো আস্তর তাঁর দৃষ্টিতেও আছে কোথাও কোথাও। তা নিয়ে যদি তিনি সমালোচিত হন, তাতে আপত্তির কিছু নেই। তবে, ক্রিকেট নিয়ে এদেশে সমালোচনার অধিকার যদি কারও থেকে থাকে, তবে নিসন্দেহে তিনিই যোগ্য। এ-সত্য অস্বীকার করার উপায় নেই। কোটি দর্শকের আবেগ, সোশ্যাল-স্তুতি, সায়রির রংমশালের থেকেও জরুরি তাঁর সমালোচনা। কেননা তা ক্রিকেটের স্বার্থে। ভারতের স্বার্থে। ভারতীয় ক্রিকেটের ভবিষ্যতের স্বার্থে। প্রশ্নহীনতার রক্তাল্পতায় ভুগতে থাকা দেশ তা যেন স্বীকার করতেই ভুলে গেছে। ভুলে গেছে, সমালোচনা মানেই একজন দেশকে ভালোবাসেন না, তা নয়। বরং দেশকে একটু বেশি ভালোবাসেন বলেই তিনি ধৃতরাষ্ট্র হয়ে ওঠেননি।
সুনীল গাভাসকরের নাচ তা-ই নেহাত আনন্দনৃত্য নয়। বরং এই নতুন ভারতের সামনে পুরনো ভারতের ফিরে আসা। যে ভারত প্রশ্ন-সমালোচনাকে দেশপ্রেমের অন্তরায় হিসাবে ভাবতে শেখেনি কখনও। সুনীল যেন নেচে বুঝিয়ে দিলেন, তিনি দেশকে, দেশের ক্রিকেটকে ততটাই ভালোবাসেন, যতটা পন্থ-কোহলি-শর্মা। সমালোচনা ক্রিকেটকেই আর একটু প্রসারিত করে। দেশের গণতান্ত্রিক পরিসরকেই। তা দেশের বিরোধিতা নয়, বরং আগুনে পোড়া খাঁটি দেশপ্রেম। বিরোধীস্বরের স্তব্ধতার এই যুগে সুনীলের নাচ তাই দেশের ভিতরে দেশের বয়ান। প্রশ্নহীনতার মরু পেরিয়ে যে-দেশ একান্তে প্রশ্নে প্রশ্নে শ্যামলে শ্যামল নীলিমায় নীল। কারা যেন দেশের এই চরিত্রকেই অস্বীকার করছিল? তাঁদের মুখের উপর জবাব হয়েই আনন্দে নাচছেন সুনীল মনোহর গাভাসকার। আর তাঁর নাচের মুদ্রায় যেন জেগে উঠছে একটিই ধ্বনি– স্টুপিড, স্টুপিড, স্টুপিড।
…………………………………..
ফলো করুন আমাদের ফেসবুক পেজ: রোববার ডিজিটাল
…………………………………..