যত প্রস্তুতিই থাক না কেন, কীভাবে যেন হাতের পাঁচ গলে সব সুযোগ আলগা হয়ে যায়। কে বা কারা যেন লুকিয়ে হাসতে থাকে আমাদের বিপর্যয় দেখে। থেমে যাব? নিজের উপর সমস্ত আত্মবিশ্বাস হারিয়ে ফেলব? নাকি শেষ ভরসা হিসেবে বেছে নেব ছোট ছোট পদক্ষেপকে? চার-ছক্কা না হয় ব্যাট থেকে নাই-বা বেরোল। শর্ট রান নিয়ে যাব। এক পা, দু’-পা করে বিভ্রান্ত করে দেব বিপক্ষকে। পিচে পড়ে থাকতে হবে, বল থেকে নজর সরালে হবে না। আর সুযোগ এলেই পুল শট। বল সোজা বাউন্ডারির বাইরে। কখনও অস্ত্র হবে বিরাটের শর্ট-রান, কখনও-বা প্রতিপক্ষকে দুমড়ে-মুচড়ে দেওয়া রোহিতের প্রহার।
চরৈবতি, চরৈবতি, চরৈবতি…
উপনিষদের মন্ত্র। থামতে যাদের মানা, তাদের জন্য। এগিয়ে চলো। আরও একটা পা, আরও একটা, আরও… জীবন যখন শুকায়ে যায়, করুণাধারা হারায়ে যায় ফল্গুধারার গুপ্তগুহায়। তৃষ্ণার্ত পথিক নিদারুণ শূন্যতায় বরুণদেবের কারুণ্যকে অপ্রয়োজনীয় মনে করে। তখনও যেন কানের কাছে কে বলে যায়, চরৈবতি!
সেই মন্ত্রেই যেন বিরাট কোহলি ছুটছেন, ছুটেই চলেছেন। ২২ গজের দিনদুনিয়ায় গতিতত্ত্বের কঠিন অঙ্ক কষা আপনার নৈমিত্তিক কাজ। নৈর্ব্যক্তিকও বটে। কে বলে আপনাকে বিরাট রাজা? আপনি তো একাই এক অক্ষৌহিণী পদাতিক সেনাদল। বর্শার আঘাতে ঘায়েল অশ্ব, ধরিত্রী গ্রাস করেছে রথের অর্ধেক চাকা। কুছ পরোয়া নেহি। থাকিতে চরণ, মরণে কি বা ভয়।
আরেকজন আছেন। তিনি আবার ছুটোছুটির তত্ত্বে খুব একটা বিশ্বাসী নন। তাঁর জীবনমন্ত্র- মারি তো গণ্ডার, লুটি তো ভাণ্ডার। সিক্স প্যাকের বালাই নেই। মাঝেমধ্যে ভুলে-টুলে যাওয়া অভ্যাস। নাতিবৃহৎ মধ্যপ্রদেশ দেখে মনে হবে, এ লোক আমার-আপনার মতোই। রোহিত শর্মাকে ‘মুম্বই চা কিং’ বলতেই পারেন। আসলে তাঁর নাম এই বলে খ্যাত হোক, তিনি আমাদের লোক। কোহলি যদি অর্জুনের তীরের গতিতে ছুটে বেড়ান, তাহলে রোহিতের অস্ত্র যেন ভীমের গদা! দু’জনে একে-অপরের পরিপূরক। রোজ মার খেতে খেতে ক্লান্ত দেশবাসীকে জীবনযুদ্ধের মন্ত্র শেখান। প্রিয় ভারতবাসী, আপনি চাইলে শিখতেই পারেন, রোজকার চক্রব্যূহ থেকে বেরিয়ে আসার জন্য দুই মহারথীর অস্ত্রবিদ্যা।
সব বল ব্যাটে ঠিকভাবে সংযোগ হবে না। যত প্রস্তুতিই থাক না কেন, কীভাবে যেন হাতের পাঁচ গলে সব সুযোগ আলগা হয়ে যায়। কে বা কারা যেন লুকিয়ে হাসতে থাকে আমাদের বিপর্যয় দেখে। থেমে যাব? নিজের উপর সমস্ত আত্মবিশ্বাস হারিয়ে ফেলব? নাকি শেষ ভরসা হিসেবে বেছে নেব ছোট ছোট পদক্ষেপকে? চার-ছক্কা না হয় ব্যাট থেকে নাই-বা বেরোল। শর্ট রান নিয়ে যাব। এক পা, দু’-পা করে বিভ্রান্ত করে দেব বিপক্ষকে। পিচে পড়ে থাকতে হবে, বল থেকে নজর সরালে হবে না। আর সুযোগ এলেই পুল শট। বল সোজা বাউন্ডারির বাইরে। কখনও অস্ত্র হবে বিরাটের শর্ট-রান, কখনও-বা প্রতিপক্ষকে দুমড়ে-মুচড়ে দেওয়া রোহিতের প্রহার।
……………………………………..
কোহলি যদি অর্জুনের তীরের গতিতে ছুটে বেড়ান, তাহলে রোহিতের অস্ত্র যেন ভীমের গদা! দু’জনে একে-অপরের পরিপূরক। রোজ মার খেতে খেতে ক্লান্ত দেশবাসীকে জীবনযুদ্ধের মন্ত্র শেখান। প্রিয় ভারতবাসী, আপনি চাইলে শিখতেই পারেন, রোজকার চক্রব্যূহ থেকে বেরিয়ে আসার জন্য দুই মহারথীর অস্ত্রবিদ্যা।
……………………………………..
অতএব, রান বিরাট রান। সিঙ্গলস থেকে ডবলস। অক্লান্ত থেকে অনন্তের দিকে। হাত-চোখের সমঝোতা বিশ্বাসঘাতকতা করতে পারে গোপনে। লোভ আর অভ্যাসের দ্বন্দ্বের আচমকাই ব্যাট চলে যেতে পারে ফিফথ স্টাম্পে। শিল্পীর তুলি ভুল রেখায় বেঁকে গেলে রঙের হিসেব-নিকেশে চোখে পড়ে তারতম্য। সংগীতের সরগম একবার তাল কেটে বাঁধা গতে ফিরে এলেও ফাঁকি দিতে পারে না অভিজ্ঞের কানকে। কিন্তু হাতুড়ির নিনাদ শব্দ-বর্ণ-গন্ধে যেমনই হোক না কেন, পাথর ভাঙার কাজই করে। সশব্দে, ঘাম-রক্ত ঝরিয়ে। রিফ্লেক্স আচমকা বেইমানি করতে পারে, কিন্তু দুটো পায়ের ওপর ভরসা বড্ড স্পষ্ট, বড্ড প্রকট। ওই হাতুড়ির শব্দের মতো। যাওয়ার আগে জানিয়ে দিয়ে যাবে, এবার ২২ গজ থেকে অবসর আসন্ন। বিরাট জানেন সেই তত্ত্ব। তাই ফিটনেসে এতটা জোর। তাই এত অবিরত ছুটে যাওয়া।
শর্মাজি কা বেটার ক্রিকেট দর্শনে এসব কবচ-কুণ্ডল নেই। লোহিত সাগরে ভীম ভাসমান টর্পেডো-সম রোহিত শর্মা। শুরুতেই প্রতিপক্ষের কোমর ভেঙে দাও। তাতে ঝুঁকি অনেক বেশি। একটা স্লোয়ার বল ব্যাটে-বলে না হলেই ব্যাক টু প্যাভিলিয়ন। হিট নয়তো মিস। লোকে বলবে, কী দরকার ছিল এত মাতব্বরি করার! ঝুঁকিহীন নিস্তরঙ্গ জীবন যেরকম চলে সেরকম নিজের ছন্দে বয়ে যেত। চেনা খোপ থেকে বেরোব না। যদি কখনও ভাগ্যদেবতা মুখ তুলে তাকান তো দয়াদাক্ষিণ্যের উন্নতি করে নেব। নয়তো, স্টেপ আউটে ছক্কা? নৈব নৈব চ…
……………………………………………..
আরও পড়ুন সৌরাংশু-র লেখা: হিংসার পৃথিবী জয়ের বীজমন্ত্র জানে এই ‘টিম ইন্ডিয়া’
……………………………………………..
কিন্তু আপনি থামবেন না হিটম্যান। সব ভুলে যেতে পারেন, শুধু ট্রফি জিততে ভোলেন না আপনি। খোঁচা লেগে বিরাট আউট হতেই পারেন। কিন্তু প্রতিপক্ষকে শুধু ছুটিয়ে ক্লান্ত করে দিতে পারেন। বহু আয়াসে উঠে যেতে পারেন রানের সিংহাসনে। মাঠে নামার সময় আপনারা কোন গতিতত্ত্বের সূত্র মুখস্থ করেন, জানি না। তবে দুই ক্রিকেট তত্ত্ব আমআদমির হাতে তুলে দেয় পাশুপত-অস্ত্র। জীবনের অঙ্ক মাঝেমধ্যে বেইমানি করে। পাতার পর পাতা ভরাট করেও শেষ হিসেব মেলে না। হাতে পড়ে থাকে ভাঙা পেনসিল। আমি-আপনি ক্লান্ত হয়ে পড়ি। সমালোচকের নাগপাশ ভেঙে দেয় হৃদয়, মেরুদণ্ড। কিন্তু সেই ভাঙা পেনসিলেও যে মাঠে রূপকথার গল্প লেখা যায়, তা দেখিয়ে দিলেন দু’জনে।
এভাবেই বারবার ফিরে আসুন। নিজেদের গল্প লিখুন, বাইশ গজে ডান্ডিয়া খেলে দেখিয়ে দিন জীবন বড্ড সুন্দর। শুধু নিজের ছন্দে বাঁচতে জানতে হয়।
………………………………………..
ফলো করুন আমাদের ফেসবুক পেজ: রোববার ডিজিটাল
………………………………………..