প্রতিভা বিকাশের নির্দিষ্ট কোনও বয়সের মাপকাঠি থাকতে পারে না। শচীনের ১৫-তে, বৈভবের ১৪-তে হয়েছে বলে আমার-আপনার সন্তানের সেই নির্দিষ্ট বয়সেই বিকাশ ঘটবে, এমনটা হতে পারে না। কেউ যদি ১৮ বা ১৯ বছর বয়সে নিজেকে যোগ্য প্রমাণ করতে পারে, নিজের প্রতিভার প্রতি সুবিচার করতে পারে, তাহলে অন্যায়ের কিছু নেই। ১৪ বছর বয়সে বৈভব না হওয়া তাই স্বাভাবিক। ১৬ বছর বয়সে বৈভব না-হয়ে উঠতে পারাটা কোনও অস্বাভাবিক ব্যাপার নয়। একজন সফল বৈভবের জন্য হাজার হাজার অসফল কিশোর-কিশোরী মানসিক সমস্যায় ভুগতে পারে না।
১৪ বছরের এক কিশোর। শিশুসুলভ নিষ্পাপ মুখ। সেই মুখই চাঞ্চল্য সৃষ্টি করেছে ক্রিকেটবিশ্বে। শনিবার সোয়াই মানসিংহ স্টেডিয়ামে তার ব্যাট থেকে ঠিকরে বের হওয়া এক বিস্ফোরক ৩৫ বলে শতরানের ইনিংস এখন পাড়ার চায়ের ঠেক থেকে কর্পোরেট-রুম– সর্বত্র আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে। আলোচনায় স্রেফ একটাই নাম– বৈভব সূর্যবংশী!
ক্রিকেট-দুনিয়া এই মুহূর্তে বৈভবের অতিমানবীয় ইনিংসের ঘোরে আচ্ছন্ন। একটা ১৪ বছরের ছেলের পক্ষে কীভাবে এই বিধ্বংসী ব্যাটিং সম্ভব, তার রহস্যভেদে এই মুহূর্তে ব্যস্ত ক্রিকেট-বিশেষজ্ঞরা। প্রাক্তন ক্রিকেটার থেকে ক্রিকেট অনুরাগী– অনেকেই একটা চেনা প্রশ্নকে ‘ট্রেন্ড’ করে ফেলেছেন সোশাল মিডিয়ায়, যেন আয়নার সামনে দাঁড় করিয়ে দিয়েছেন নিজেকেই, নিজের ফেলে আসা কৈশোরকে, অজান্তে নিজের অপত্যকেও– ‘হোয়াট হোয়ার ইউ ডুয়িং অ্যাট ফরটিন?’
বৈভবের এই প্রতিভার বিচ্ছুরণ গুরুত্বপূর্ণ কিছু প্রশ্ন উত্থাপন করে দিয়েছে, বিশেষ করে অভিভাবকদের মনে। ১৪ বছর বয়সি ছেলেমেয়ে মানেই বৈভব সূর্যবংশী নয়। তা হবেও না। সত্যিটা হল, তাদের এমনটা হওয়ার প্রয়োজনও নেই। বৈভব প্রতিভাবান, আর পাঁচজনের চেয়ে আলাদা। বিশ্বক্রিকেটের নিরিখে তার মতো ক্রিকেটার স্বাভাবিকের পর্যায়ভুক্ত নয়, ‘ব্যতিক্রম’ হিসেবেই গণ্য হবে। কিন্তু সেই ব্যতিক্রমকে স্বাভাবিক ধরে নিয়ে ১৪তম বয়সকে প্রতিভা বিচ্ছুরণের মাপকাঠি হিসেবে তুলে ধরা বোকামি হবে। হচ্ছেও।
বৈভবের সাফল্যের মাপকাঠিতে বছর চোদ্দোর অন্য কোনও উচ্চাকাঙ্ক্ষী ক্রিকেটারকে কম বা বেশি প্রতিভাবান বলে চিহ্নিত করা যায় না। ফলে ভারতের কোনও প্রদেশেই, কোনও বাবা-মায়েরই তাদের ১৪ বা ১৫ বছর বয়সি সন্তানকে বৈভব হওয়ার জন্য চাপ দেওয়ার প্রয়োজন নেই। অথচ ভারতে, আমরা জানি, এটাই ঘটবে। হয়তো তা ইতিমধ্যে ঘটতে শুরুও করেছে।
………………………………..
বৈভবের এই প্রতিভার বিচ্ছুরণ গুরুত্বপূর্ণ কিছু প্রশ্ন উত্থাপন করে দিয়েছে, বিশেষ করে অভিভাবকদের মনে। ১৪ বছর বয়সী ছেলেমেয়ে মানেই বৈভব সূর্যবংশী নয়। তা হবেও না। সত্যিটা হল, তাদের এমনটা হওয়ার প্রয়োজনও নেই। বৈভব প্রতিভাবান, আর পাঁচজনের চেয়ে আলাদা। বিশ্বক্রিকেটের নিরিখে তার মতো ক্রিকেটার স্বাভাবিকের পর্যায়ভুক্ত নয়, ব্যতিক্রম হিসেবেই গণ্য হবে। কিন্তু সেই ব্যতিক্রমকে স্বাভাবিক ধরে নিয়ে ১৪তম বয়সকে প্রতিভা বিচ্ছুরণের মাপকাঠি হিসেবে তুলে ধরা বোকামি হবে। হচ্ছেও।
………………………………..
বৈভব যদি ১৪ বছর বয়সে পারে, তাহলে ১৬ বছর বয়সে তুমি কেন পারবে না, নিজ-সন্তানকে ঘিরে এমন ভাবনা অনেক অভিভাবকের মধ্যেই কাজ করতে শুরু করেছে। আর সেই ভুল মানসিকতার ফলস্বরূপ মাথাচাড়া দিচ্ছে সেই চাপের মুখে ঠেলে দেওয়া সন্তানদের মানসিক স্বাস্থ্যের বিষয়টি। ক্রিকেটার হওয়ার স্বপ্ন দেখা ছেলে বা মেয়েটি যদি ১৪ বছর বয়সে নিজের প্রতিভার প্রতি সুবিচার না করতে পারে, নিজেকে প্রতিষ্ঠিত না করতে পারে, আবেগপ্রবণ বাবা-মা যদি তার ওপর চাপ সৃষ্টি করে বিপদের মুখে ঠেলে দেয়, তাহলে কী হতে পারে? উত্তরটা আমাদের সকলের জানা। তবু তা জেনেও আমরা তাদের বিপদের মুখে ঠেলে দিচ্ছি। আমার-আপনার সন্তানকে বৈভব হতে হবে, জীবনধারণের এমন কোনও শর্ত নেই।
বৈভবকে কেন্দ্র করে ‘বিস্ময় বালক’ শব্দটি নতুন করে ফের আলোচনায় ফিরে এসেছে। যার শিকড়-সন্ধানে আমরা ফিরে যেতে পারি, ১৯৮৯-এর নভেম্বরে, পাক সফররত এক বছর ষোলোর কিশোরের কাছে। ওয়াকারের বিষাক্ত বাউন্সের ছোবল যাকে থামাতে পারেনি, আব্দুল কাদিরের মতো স্পিন-ম্যাজিশিয়ানের ইন্দ্রজাল তাঁকে আবিষ্ট করতে পারেনি। সেই শচীন তেণ্ডুলকর, নয় ও পরবর্তী দু’দশক– কয়েক প্রজন্মের কাছে হয়ে উঠেছিলেন শ্রেষ্ঠত্বের মাপকাঠি। সবাই চাইত তাদের সন্তান শচীন হোক। শচীনের মতো তাদের সন্তানও ১৫ বছর বয়সে ওয়াসিম ও ওয়াকারের মুখোমুখি হোক এবং জয় পাক।
বাস্তবে এমনটা ঘটেনি। ঘটেনি কারণ, শচীন ব্যতিক্রমী এক প্রতিভা, দশ লক্ষ শিশুর মধ্যে খুঁজলে হয়তো তাঁর মতো একজনকে পাওয়া যাবে। কিন্তু তাতে ৯৯.৯৯ শতাংশের অবস্থা পাল্টাবে না। আসলে প্রতিভা বিকাশের নির্দিষ্ট কোনও বয়সের মাপকাঠি থাকতে পারে না। শচীনের ১৫-তে, বৈভবের ১৪-তে হয়েছে বলে আমার-আপনার সন্তানের সেই নির্দিষ্ট বয়সেই বিকাশ ঘটবে, এমনটা হতে পারে না। কেউ যদি ১৮ বা ১৯ বছর বয়সে নিজেকে যোগ্য প্রমাণ করতে পারে, নিজের প্রতিভার প্রতি সুবিচার করতে পারে, তাহলে অন্যায়ের কিছু নেই। ১৪ বছর বয়সে বৈভব না হওয়া তাই স্বাভাবিক। ১৬ বছর বয়সে বৈভব না-হয়ে উঠতে পারাটা কোনও অস্বাভাবিক ব্যাপার নয়। একজন সফল বৈভবের জন্য হাজার হাজার অসফল কিশোর-কিশোরী মানসিক সমস্যায় ভুগতে পারে না।
আইপিএলের মতো আন্তর্জাতিক মানের টুর্নামেন্টে বৈভব যা করে দেখিয়েছে, তা অবিশ্বাস্য। এমন ইনিংস সচরাচর দেখা যায় না। তাই এমন মহাকাব্যিক ইনিংসকে ঘিরে মুগ্ধতার বন্যা বইবে, ক্রিকেট-অনুরাগীরা সেই ইনিংসকে উদযাপন করবে, সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু তারপরেও এটাই ধ্রুবসত্য, বৈভবকে আমরা ক্রিকেট-মানচিত্রে আদর্শ হিসেবে গ্রহণ করতে পারব না। কারণ, সে আদর্শ নয় বরং ব্যতিক্রম। এবং সেভাবেই তাকে গ্রহণ করা উচিত। তাকে অনুসরণ না করলেও চলবে।
দেশের নানা প্রান্তে দশ বছরের নিচে ক্রিকেট-শিক্ষার্থী যারা রয়েছে, তাদের হয়তো এই বার্তাই দেওয়া হবে, বৈভব হতে গেলে কঠোর পরিশ্রম করে যাও। এটা এক ধরনের সামাজিক চাপ। তাতে কি তারা স্বাভাবিক ভাবে নিজেদের মেলে ধরতে পারবে? মনে হয় না। আইপিএলে যে কোটি টাকার প্রলোভন, সেই প্রলোভন অভিভাবকদের পক্ষে এড়িয়ে যাওয়া কঠিন। সেই ফাঁদে পা দিয়ে তারা ছেলেমেয়ের ভবিষ্যৎ-কে উজ্জ্বলের বদলে আরও অন্ধকারাচ্ছন্ন করে তুলছেন, এটাও নির্মম সত্য। অসহনীয় চাপের পৃথিবীতে তাদের ঠেলে না দিয়ে তারা যে কাজে সাবলীল, তাতেই উৎসাহ জোগানো সঠিক পদক্ষেপ হবে। বৈভব ১৪ বছরে আইপিএলের মতো ক্রিকেট লিগে মানিয়ে নিতে পারছে, শতরানে নজর নজির গড়ছে, কারণ, সে স্পেশাল। সবাই ‘স্পেশাল’ হয় না। তাই বৈভবকে উপভোগ করুন, অন্ধ অনুকরণ না করে।
…………………………………….
ফলো করুন আমাদের ওয়েবসাইট পেজ: রোববার ডিজিটাল
…………………………………….