মনুষ্যত্ব চলে গেলে মানুষ যে বড় নিঃস্ব হয়ে যায়। এদের কে বোঝাবে, এমন প্রকাশ্য খেয়োখেয়ি দীর্ঘ সম্পর্কের বুনিয়াদ ধ্বংসই করে শুধু, কখনও তা গড়ে না। এদের কে বোঝাবে, মাঝরাতে বিপদ হলে পড়শির ফুটবল সমর্থনের রং দেখে না কেউ। দেখে না সে ইস্টবেঙ্গল না মোহনবাগান। সব ভুলে তখন তাকেই পরিত্রাহী ডাকে। এদের কে বোঝাবে, মানুষের রক্তের রং আজও সবুজ-মেরুন কিংবা লাল-হলুদ নয়। তা লাল এবং লাল!
‘খোল, জার্সি খোল বোকা…। তিন গোল খেয়েছিস, তার পরেও লজ্জা নেই?’
‘দাঁড়া না, দাঁড়া। শনিবার শুধু জিততে দে। বাড়ি দেখে রেখেছি হা…র। রাতে বাড়ির সামনে গিয়ে গালাগাল করব দ্যাখ!’
‘খেলা শেষ হলে বেরিয়ে যাবি না। কাদাপাড়া মোড়ে দাঁড়াবি। বেজন্মাগুলোকে ফিরতে তো হবে ওখান দিয়ে। কলিঙ্গে জিতেছি ওদের সঙ্গে। কিন্তু হাতের সুখ হয়নি! শনিবার যুবভারতীতে জিতি। নাম ভুলিয়ে ছাড়ব তারপর!’
‘গাড়লের দল জিতেছে তো সুপার কাপ। সেটাও বারো বছর পর। অথচ নাচনকোঁদন দেখলে মনে হচ্ছে, বিশ্বকাপ জিতেছে! এবার জিতলে টিমের সঙ্গে সাপোর্টারগুলোকেও যদি উলঙ্গ না করি, নাম বদলে ফেলব শালা!’
জনশ্রুত কথোপকথন সব। অকথ্য অংশটুকু বাদ দিয়ে অপরিস্রুত পেশ করা। আর সবই ইস্টবেঙ্গলের সুপার কাপ জয়-উত্তর প্রথম ডার্বি কেন্দ্রিক। আজ বাদে কাল যা হবে, শহরের জ্বর বাড়িয়ে, থার্মোমিটার ফাটিয়ে। ওপরের ‘বাকসিদ্ধ’-রা কেউ মোহনবাগান। কেউ ইস্টবেঙ্গল। কেউ ঘটি। কেউ বাঙাল। ধ্যার! আহাম্মকের মতো সত্যযুগের ভাষায় সম্বোধন করছি কেন? মোহনবাগান-ইস্টবেঙ্গল, ঘটি-বাঙাল এ সমস্ত বিশেষ্য-বিশেষণ ফারাওয়ের আমলে চলত। এখন দু’পক্ষেরই খাসা দু’খানা নাম আছে। যা বড়ই সরেস। তা বলেই না হয় ডাকি।
ভিখারি মাচা! উদ্বাস্তু লোটা!
বাংলা, বাঙালির বড় দুর্যোগের সময় এখন। বাঙালির আজ আর একটা রবি ঠাকুর-শরৎ চাটুজ্জ্যে নেই। সত্যজিৎ-মৃণাল নেই। উত্তম-সৌমিত্র নেই। সর্বনাশা ঘুণপোকার দল যেন আষ্টেপৃষ্ঠে ক্রমশ গিলে ফেলছে বাঙালিকে, ঝুরঝুরে করে দিচ্ছে এ বাংলার সাহিত্য-সংস্কৃতি। খেলাতেও তো। ক্রিকেট-ফুটবলে আর দিকপাল প্রতিভা উঠে আসে না আজ। ভারতীয় ফুটবল টিম কিংবা ইস্ট-মোহনে ঘুমন্ত পিদিমের মতো মিটমিট করে দু’-একটা বাঙালি জোনাকি। একটা শুভাশিস। একটা শৌভিক। একটা সায়ন। বাঙালির আজও আছে বলতে, এক অস্থির আবেগ। নেশা ধরিয়ে দেওয়া ভালোবাসা। যে দুইয়ের শলা-পরামর্শে জন্ম নেয় পাগলপারা এক মায়া-শব্দ, যার নাম সমর্থন।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
ফেসবুকেই দেখলাম, এক পরিচিত কী অবলীলায় তার ভ্রাতৃসমের পুরনো পোস্ট কবর থেকে খুঁড়ে সোজা সোশ্যাল মিডিয়ায় ছেড়ে দিল! ইস্টবেঙ্গলের সুপার কাপ জয়ের ঘোরে, আসন্ন ডার্বিকে কেন্দ্র করে। অথচ মাস কয়েক আগে সে মহোদয় নিজেই সেই ভ্রাতৃসমকে নিমন্ত্রণ করে বিয়ের ভোজ খাইয়েছে! আক্রান্তের ঘনিষ্ঠবর্গ আবার অপমানের সংবাদ শ্রবণ মাত্র আক্রমণকারীকে নেমে পড়ল ‘সবক’ শেখাতে। ধমকানো-তড়পানো-চমকানো সহযোগে। দুটোই ভুল, দুটোই অস্বাভাবিক।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
হে বাঙালি, তুমি কি তার ভাষাও ভুলিয়াছ? তুমি কি সম্পূর্ণ ভুলিয়াছ খেলার মাঠের শিষ্টাচার?
না। পৃথিবীর যে দেশেই হোক না কেন, ডার্বি বাঁধলে দুটো টিমের সমর্থকরা মাঠে গিয়ে কথামৃত পাঠ করবেন, কেউ প্রত্যাশা করে না। ফুটবলে তো আরওই না। ফুটবল খেলাটাই রক্তে আগুন ধরিয়ে দেওয়ার খেলা। প্রতি পলকে যেখানে পৌরুষ মিশে থাকে। এবং ডার্বির তেজ ম্যাঞ্চেস্টারে যা, মিলানে যা, কলকাতাতেও তা। কিন্তু তার পরেও যে একটা পৃথিবী পড়ে থাকে। ৯০ মিনিটে যার মেয়াদ ফুরয় না। ভদ্রতা-সভ্যতা-পারস্পরিক সম্মানের পৃথিবী। মহাভারতের কুরুক্ষেত্র যুদ্ধে কৌরব-পাণ্ডব ও তাদের অক্ষৌহিনী সেনা পর্যন্ত যা ভোলেনি। একটা ডার্বি কি কুরুক্ষেত্রের চেয়েও বুনো?
কীসব ছাপার অযোগ্য ভাষা, কী অসামান্য সে ভাষার প্রয়োগ এখন। অহো! শুনলে বধিরকে বড় ভাগ্যবান মনে হয়! লেখার শুরুতে যে চার স্রাব-নমুনা দিয়েছি, প্রশ্ন করায় এক উত্তর এসেছে বারবার। লাল-হলুদ, সবুজ-মেরুন, দু’তরফ থেকেই। কী না, ‘ওরা আগে বলেছে, ওরা আগে করেছে’। হায় রে, এ অবার্চীনদের কে বোঝাবে, ‘অ্যান আই ফর অ্যান আই, মেকস দ্য হোল ওয়ার্ল্ড ব্লাইন্ড!’ দোষারোপ আর পাল্টা দোষারোপ সেই অনন্ত দুই সমান্তরাল বিষ-রেখা, যার লয়-ক্ষয়-বিনাশ নেই। সব কিছুর আরও সাড়ে বারোটা বাজিয়ে ছেড়েছে অধুনা ‘মিম কালচার’। তবে দুঃখের হল, ‘চা, চিনি, দুধে…’ কিংবা ‘গঙ্গাপাড়ে ফেলে গদি…’ বাংলা ভাষার দীনতার সঙ্গে সমর্থনের হীনতাই বাড়িয়েছে শুধু। কৌলিন্য আমদানি করেনি। এর সঙ্গে নিশ্চিন্তে যোগ করুন অশালীন আক্রমণ। যেখানে বন্ধু বন্ধুকে ছাড়ছে না। সতীর্থ সতীর্থকে বুঝছে না। গরল বের করছে প্রকাশ্যে। সোশ্যাল মিডিয়ায়। সবাই যা ইচ্ছে লিখে দিচ্ছে। আগাপাশতলা না ভেবে। পরিণতি না চিন্তা করে। শুধু এবং শুধুমাত্র জিঘাংসার তাড়নায়।
এই তো দিন কয়েক আগে। ফেসবুকেই দেখলাম, এক পরিচিত কী অবলীলায় তার ভ্রাতৃসমের পুরনো পোস্ট কবর থেকে খুঁড়ে সোজা সোশ্যাল মিডিয়ায় ছেড়ে দিল! ইস্টবেঙ্গলের সুপার কাপ জয়ের ঘোরে, আসন্ন ডার্বিকে কেন্দ্র করে। অথচ মাস কয়েক আগে সে মহোদয় নিজেই সেই ভ্রাতৃসমকে নিমন্ত্রণ করে বিয়ের ভোজ খাইয়েছে! আক্রান্তের ঘনিষ্ঠবর্গ আবার অপমানের সংবাদ শ্রবণ মাত্র আক্রমণকারীকে নেমে পড়ল ‘সবক’ শেখাতে। ধমকানো-তড়পানো-চমকানো সহযোগে। দুটোই ভুল, দুটোই অস্বাভাবিক। আবারও লিখছি, ডার্বির দিন কেউ গীতাপাঠ করে না। খিস্তি-খেউড় তার চিরকালীন রেওয়াজ। আবহমানকাল ধরে তা চলে আসছে। কিন্তু সোশ্যাল মিডিয়ায় সমর্থনের নামে এমন ‘বিষ্ঠাত্যাগ’ এই প্রথম দেখছি! এককালে ইস্টবেঙ্গল ডার্বি জিতলে পরদিন মোহনবাগান পাড়া দিয়ে হাতে ইলিশ ঝুলিয়ে হাঁটা রীতি ছিল। মোহনবাগান জিতলে বাজারে চড়চড়িয়ে বাড়ত চিংড়ির দাম। আসলে চড়া সুরে, মোটা দাগের রেষারেষি ছিল না তখন। নেপথ্যে মগজ বলে একটা বস্তু কাজ করত মানুষের। রেষারেষিতেও রসবোধ থাকত। অবশ্য এখন সে সব লিখে লাভই বা কী? তখন তো0 ইস্ট-মোহন বা ঘটি-বাঙাল লড়াই হত। বিদ্বেষের কালিতে মাচা বনাম লোটা কাহিনি তখনও যে লেখা হয়নি!
লেখা তাই নিরর্থক। বলা তাই নিষ্ফলা। কী করা যাবে, মনুষ্যত্ব চলে গেলে মানুষ যে বড় নিঃস্ব হয়ে যায়। এদের কে বোঝাবে, এমন প্রকাশ্য খেয়োখেয়ি দীর্ঘ সম্পর্কের বুনিয়াদ ধ্বংসই করে শুধু, কখনও তা গড়ে না। এদের কে বোঝাবে, মাঝরাতে বিপদ হলে পড়শির ফুটবল সমর্থনের রং দেখে না কেউ। দেখে না সে ইস্টবেঙ্গল না মোহনবাগান। সব ভুলে তখন তাকেই পরিত্রাহী ডাকে। এদের কে বোঝাবে, মানুষের রক্তের রং আজও সবুজ-মেরুন কিংবা লাল-হলুদ নয়। তা লাল এবং লাল!
খারাপ লাগে শুধু দুই দৃশ্যপটের কথা ভাবলে। এই মিম সংস্কৃতির আমলেই ঘটা দুই দৃশ্যপট। একটা ঘটনা, একটা ছবি। সন-তারিখ মনে নেই। মাঝে এক রাজনৈতিক নেতা ইস্টবেঙ্গল ক্লাবের উৎপত্তি ঘিরে কুরুচিকর মন্তব্য করেছিলেন একবার। ভাবেননি, প্রত্যুত্তরে মোহনবাগান সমর্থকদের থেকে তাঁকে অমন বিদ্রোহের ‘বাঁশপেটা’ খেতে হবে! দ্বিতীয়টা, ইস্টবেঙ্গলের শতবর্ষের সময়কার ছবি। লাল-হলুদ তখন পরপর হারছে। পরিস্থিতি সঙ্গীন বললেও কম বলা হয়। সেই সময় ছবি বেরয় একখানা। যেখানে এক বন্ধু, আর একের হাত ধরে টেনে তুলছে। তলায় লেখা: চল, চল, ওঠ। কিচ্ছু হয়নি। আরও একশো বছর তোকে খেলতে হবে।
অসামান্য লেগেছিল দেখে। খেলা থাকবে। খেলার হানাহানি থাকবে। কিন্তু পাতলা চাদরের মতো তাকে জড়িয়ে থাকবে সহমর্মিতা। এটাই তো স্বাভাবিক, এটাই দস্তুর। আজ মনে হয়, ভুল ছিলাম। ভুল ভেবেছিলাম। আসন্ন শনিবাসরীয় ডার্বি ও তাকে ঘিরে দুই টিমের সমর্থককুল সৃষ্ট ‘দ্বেষের দেশ’ দেখে মনে হচ্ছে, ওই দুই ঘটনা, নেহাত দুর্ঘটনা মাত্র। ডার্বির আদিম যুগ থেকে কোনও ভাবে পথ ভুল করে এই দুনিয়ায় চলে এসেছিল!
পুনশ্চ: এই লেখা কাউকে আঘাত করার উদ্দেশ্য নিয়ে নয়। ইস্টবেঙ্গল-মোহনবাগান, কোনও দলের সমর্থককেই নয়। তার পরেও খারাপ লাগলে আন্তরিক দুঃখিত। আসলে খারাপ লাগা থেকে এ লেখা। কী জানেন, ভালোবাসা শত যুদ্ধেও জেতা যায় না। আজও না। ঘৃণা যায়।
শনিবার যুবভারতীতে এরপর পরাজিতের দিকে হাত বাড়িয়ে একবার দেখবেন না কি? বলবেন একবার, বন্ধু চল, হাতটা দে?