যে ফি-বৃদ্ধি প্রত্যাখ্যান করল ডেনমার্কের পুরুষ ফুটবল দল, ফলস্বরূপ, লাভবান হবে সে দেশের যত ইনভেস্টর, ব্যবসায়িক শ্রেণি! পকেট ফুলে-ফেঁপে উঠতে পারে। ব্যয়ের খাত কমে গেছে যেহেতু। তবু, তবু ডেনমার্কের মহিলা ফুটবল দল উদ্যম পাবে নতুন। বৃদ্ধি পাবে তাঁদের ফুটবল-দক্ষতা। দেশের ফুটবল পরিকাঠামো উন্নত হবে। নতুন তারকা উঠে আসবে মহিলা ফুটবল টিম থেকে।
যেদিকে তাকাচ্ছি, বাইনারি সেদিকেই। এই তো, বছর চার-পাঁচ আগে, প্রিয়াঙ্কা চোপড়া ক্ষোভে ফেটে পড়লেন আর বললেন, ‘বলিউড অথবা হলিউড– ইন্ডাস্ট্রি আসলে পুরুষতান্ত্রিক। নইলে একটি ছবিতে সমমানের চরিত্রে অভিনয় করলেও, পুরুষ অভিনেতাটির পারিশ্রমিক তুলনায় বেশি কেন?’
এহেন বাইনারি-র অন্দরে খেলা করে একটা পাওয়ার গেম। প্রচ্ছন্ন। কিন্তু, তীব্র। যেন অবদমনের আদিম আকাঙ্ক্ষা! যেহেতু পারিশ্রমিকের সঙ্গে ওতপ্রোত জড়িয়ে আছে সামাজিক মর্যাদা, ফলে নারী-অভিনেতাকে চেপে ধরে একপৃথিবী কুণ্ঠা। অথচ, তাঁর শ্রমে কোনও গলতি ছিল না। অসততাও ছিল না। অভিনয় দক্ষতায়, সে একজন সুপারস্টার হিরোর সমকক্ষ। টেক্কা দিতে ভীষণরকম সক্ষম। তবু, সেই শ্রম লঘু হল।
প্রিয়াঙ্কা চোপড়ার সাক্ষাৎকারটি নিয়ে সোশাল মিডিয়া উত্তাল হয়েছিল। দিকে দিকে হ্যাশট্যাগ। লিফলেট। আন্দোলন। এবং তারপর ঘুম। তারপর রাজনীতি, থিয়েটারের মঞ্চ অথবা খেলার মাঠ– কর্তার ভূতের মতো পাওয়ার গেম! জাঁকিয়ে বসছে আরও। ঘাড়ে। মাথায়। রক্তে।
যদি বলি সে-ভূত তাড়ানোর অভিপ্রায়ে, মাঠে নেমেছে ডেনমার্কের পুরুষ ফুটবল দল, বিস্মিত হবেন খুব? ইউরো কাপের ভরাট মার্কেটটা সামান্য গরম হবে, তাই না? ভাবজগতে ফের একবার উঁকি দিয়ে যাবে: ফুটবল স্রেফ ৯০ মিনিটের একটি খেলা নয়। এরপর নিশ্চিতভাবে মনে পড়ে যাবে ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ডের সেই সিদ্ধান্তটির কথাও! যেখানে বলা হয়েছিল, পুরুষ এবং নারী– উভয় দলের ক্রিকেটারদের পারিশ্রমিক সমান।
ডেনমার্ক ফুটবল ফেডারেশন অবশ্য এমন কথা বলেননি। বলেছেন, জাতীয় দলের ১১জন খেলোয়াড়। একত্রে। ঠিক কী বলেছেন তাঁরা? চার বছরের নতুন চুক্তিতে সই করার মুহূর্তে, দেখা গেল, চুক্তিপত্রে পুরুষ দলের খেলোয়াড়দের ফি-বৃদ্ধি পেয়েছে। তাঁরা সেটি প্রত্যাখান করলেন তৎক্ষণাৎ। অর্থাৎ, এই ফি-বৃদ্ধি হোক, কোনওমতেই চাইছেন না। বরং চাইছেন, ডেনমার্কের মহিলা ফুটবল খেলোয়াড়দের ‘বেসিক পে’ যেন পুরুষদের সমপরিমাণে পৌঁছয়!
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
ক্রিশ্চিয়ান এরিকসেনের কথা মনে আছে? বিগত ইউরো কাপে, ফিনল্যান্ডের বিপক্ষে খেলা চলাকালীন, ডেনমার্কের যে দুরন্ত খেলোয়াড়টি মাঠেই লুটিয়ে পড়েছিলেন! হৃদযন্ত্র বিকল হয়ে পড়েছিল আচমকা! অসুখ সেরে, জাতীয় দলে তিনিও কামব্যাক করেছেন। সেই দলে আছেন র্যাসমাস হয়ল্যান্ড-এর মতো উঠতি সুপার-স্ট্রাইকার। সেই দলে আছেন, অভিজ্ঞ ডিফেন্ডার সিমোন খায়ের। এককভাবে নয়। বলিউডি সুপারহিরো-সম কোনও কেত নয়, ডেনমার্কের সম্পূর্ণ পুরুষ দল পাশে এসে দাঁড়াচ্ছে নারী ফুটবল দলের।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
হে পাঠক, আপনাদের ক্রিশ্চিয়ান এরিকসেনের কথা মনে আছে? বিগত ইউরো কাপে, ফিনল্যান্ডের বিপক্ষে খেলা চলাকালীন, ডেনমার্কের যে দুরন্ত খেলোয়াড়টি মাঠেই লুটিয়ে পড়েছিলেন! হৃদযন্ত্র বিকল হয়ে পড়েছিল আচমকা! অসুখ সেরে, জাতীয় দলে তিনিও কামব্যাক করেছেন। সেই দলে আছেন র্যাসমাস হয়ল্যান্ড-এর মতো উঠতি সুপার-স্ট্রাইকার। সেই দলে আছেন, অভিজ্ঞ ডিফেন্ডার সিমোন খায়ের। এককভাবে নয়। বলিউডি সুপারহিরো-সম কোনও কেত নয়, ডেনমার্কের সম্পূর্ণ পুরুষ দল পাশে এসে দাঁড়াচ্ছে নারী ফুটবল দলের। একবিংশ শতাব্দীর পৃথিবীতে যা হতে পারত অত্যন্ত অনায়াস!
স্বাভাবিক, এ-ঘটনায় আমরা উল্লসিত হচ্ছি, আনন্দিত হচ্ছি। বলছি, এ কার্য প্রায়-মহৎ! আমরা এও বুঝতে পারছি, আবিশ্বে লিঙ্গসাম্যের সপক্ষে যে দীর্ঘ আন্দোলন, এ-ঘটনা সে আন্দোলনে বারুদ জোগাবে। আরেকটু গভীরে ভাবতে হবে, এ-ঘটনার ইঙ্গিত। একটি দেশের ফুটবল টিম, সে দেশেরই আইডেন্টিটির একখণ্ড। যাঁদের মূল উদ্দেশ্য, দেশের প্রতিনিধিত্ব! বিশ্ব-ফুটবলের দরবারে দেশকে জিতিয়ে দেওয়া। তাই ফি-বৃদ্ধি নয়, ফুটবলের শ্রী-বৃদ্ধি। সেখানে লিঙ্গ আর শ্রেণির বিভেদ তৈরি করে হবেটা কী মশাই! দেশের জার্সিটাই তো পরম পরিচয়! ডেনমার্কের পুরুষ দলের ভাবনার এই পরিসরটি উদার। খুব আহামরি। দৃষ্টান্তমূলক। ঘাপটি মেরে পড়ে থাকা কোনও পুরুষতান্ত্রিকতা নেই।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
আরও পড়ুন রোদ্দুর মিত্র-র লেখা: জাতীয় সংগীতের এমন ব্যবহার আগে ঘটেনি
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
তবে পরিসরটি আরও বিস্তৃত হতে পারত। কেমন? ধরা যাক, একজন মানুষ শ্রমের ন্যায্য মূল্য থেকে বঞ্চিত। অর্থাৎ, যা তাঁর প্রাপ্য, তা পাচ্ছে না। অথচ, আপনি পাচ্ছেন। এইবার একজন সহকর্মী হিসেবে, আপনার দায়িত্ব কী? সেই মানুষটিকে তাঁর প্রাপ্যের উচ্চতায় তুলে আনা। সমমর্যাদায় উন্নীত করা। আপনি নিশ্চয়ই স্বয়ং কোনও অন্যায্য মূল্যের কাছে পৌঁছবেন না। সহনাগরিকের কর্তব্যও এটুকুই তো! নয় কি?
যে ফি-বৃদ্ধি প্রত্যাখ্যান করল ডেনমার্কের পুরুষ ফুটবল দল, ফলস্বরূপ, লাভবান হবে সে দেশের যত ইনভেস্টর, ব্যবসায়িক শ্রেণি! পকেট ফুলে-ফেঁপে উঠতে পারে। ব্যয়ের খাত কমে গেছে যেহেতু। তবু, তবু ডেনমার্কের মহিলা ফুটবল দল উদ্যম পাবে নতুন। বৃদ্ধি পাবে তাঁদের ফুটবল-দক্ষতা। দেশের ফুটবল পরিকাঠামো উন্নত হবে। নতুন তারকা উঠে আসবে মহিলা ফুটবল টিম থেকে। ফুটবল-সংস্কৃতি যাবতীয় বাইনারি মুক্ত হয়ে সমৃদ্ধ হবে কি? দুরন্ত আশা। তবু রাখছি। মানুষ তো মশাই! কারণ, আজ তো ইউরো কাপে ডেনমার্কের প্রথম খেলা!
………………………………………….
ফলো করুন আমাদের ফেসবুক পেজ: রোববার ডিজিটাল
………………………………………….