ইংরেজিতে তাদের বলে ‘গ্রাউন্ডসম্যান’। বাংলায় মাঠকর্মী। ঠিক হলে পিঠ চাপড়ানি পাবে না। কিন্তু ভুল হলে রক্ষে নেই। দিন-রাত্তির মাঠে ঘাম শুকোনো লোকগুলোর জাত নেই, পাত নেই, জীবনের দাম নেই। খেলা আসে, খেলা যায়। এদের হাতে পড়ে থাকে ভিক্ষার দু’-পাঁচশো। তাদের হাতে তুলে মহম্মদ সিরাজ তুলে দিলেন নিজের পুরস্কারের টাকা। ছেলেবেলায় পিতাকে অটো চালিয়ে অন্নসংস্থান করতে দেখেছে, ক্ষুধার ক্ষার-বৃষ্টিতে ভিজেছে, তাই বড় হয়ে পাঁচ হাজার ডলারের শামিয়ানায় ক’জন আর্ত চরিত্রকে আশ্রয় দিয়েছে।
দিস ক্যাশ প্রাইজ গো’জ টু দ্য গ্রাউন্ডসমেন। ইয়ে উয়ো লোগ বহত হি ডিজার্ভ করতে হ্যায়। আগর উয়ো লোগ নহি হোতে, তো ইয়ে টুর্নামেন্ট সাকসেসফুল নহি হোতা। ইয়ে ক্যাশ প্রাইজ উনলোগকে লিয়ে বহত হি কম হ্যায়। বাট ইয়ে ক্যাশ প্রাইজ ডিজার্ভ করতে হ্যায় উয়ো লোগ…।
না, একদম না। হাততালি-জয়ধ্বনি একদম নয়। ছেলেটা অসামান্য কিছু করেনি। কিচ্ছু না। করেছে বটে, কিন্তু খেলার মাঠে। ছ’টা উইকেট নিয়েছে, পঞ্চাশ রানে বিপক্ষকে অলআউট করেছে, এশিয়া কাপ জিতেছে, সাবাশ মিয়াঁ। কিন্তু খেলা শেষের রবি-সন্ধেয় ভাঙা ইংরেজি আর সাবলীল হিন্দিতে ছেলেটা যা বলছে এখন, বলতে দিন। যা বলছে, ওরই বলার কথা। যা দিচ্ছে, ওরই দেওয়ার কথা। দেখছেন না কেমন ছেলেটার কষ-দাঁতে কেমন খিদে লেগে রয়েছে? আজও? শৈশব-কৈশোরে লেগে থাকত যেমন। দুটো রুটির খিদে। দু’মুঠো ভাতের খিদে। দেখার চোখ থাকলে দেখা যায় এখনও। গা ঘেঁষে দাঁড়ালে পাওয়া যায় উনুনে সেঁকা হাত রুটির ঘ্রাণ, ভাতের ম-ম গন্ধ। আরে, ছেলেটা তো জানে যে ক্ষুধার পিত্ত-প্রবাহ গলতে শুরু করলে ঠিক কতটা টনটন করে পেট। পাড়ায়-বেপাড়ায় টেনিস বল ‘মার্সিনারি’ হয়ে দাপিয়ে বেড়ানোর ‘তোফা’ যে ওর এককালে তাই ছিল। হয় বিরিয়ানি, নয় বার্গার। বিনিময়ে গোটা কয়েক উইকেট, গতিতে ব্যাটারের হাত থেকে তার গাণ্ডীব ফেলে দেওয়া। ছেলেটা তো জানে যে, প্রেমদাসা মাঠে গভীর প্রশান্তিতে আজ হাত-পা ছড়িয়ে বসে থাকা মিশমিশে অবয়ব-দলের পূর্ণিমা বা ঈদের চাঁদ শুধু এবং শুধুমাত্র ঝলসানো রুটি। ওরা বয়সে বড় হলেও আদতে যে ছেলেটারই ছেলেবেলা।
যাদের ইংরেজিতে বলে ‘গ্রাউন্ডসম্যান’। বাংলায় মাঠকর্মী।
ইংরেজি বা বাংলা, যে গালভরা নামেই ডাকুন না কেন, এদের একটা সার্বজনীন ডাকনাম আছে। উপেক্ষা! ফুটবলে গোলকিপারের গাল ফুলে থাকে, ক্রিকেটে উইকেটকিপারের। আসলে খেলার বিধানে লেখা আছে, তাদেরটা ‘থ্যাঙ্কলেস জব’। ঠিক হলে পিঠ চাপড়ানি পাবে না। কিন্তু ভুল হলে রক্ষে নেই। তাই কি? সত্যিই কি ‘গোলি’ বা ‘উইকি’দের জীবন ততটাও অবহেলার, যতটা দিন-রাত্তির মাঠে ঘাম শুকোনো লোকগুলোর? যাদের জাত নেই, পাত নেই, জীবনের দাম নেই। বজ্র-বিদ্যুৎ-রোদ-ঝড়-জলে গা পুড়িয়ে পড়ে থাকাটাই যাদের রেওয়াজ। দুটো দিন জ্বর হওয়া কিংবা দুটো খেলার টিকিটেও অধিকার নেই যাদের। খেলা আসে, খেলা যায়। এদের হাতে পড়ে থাকে ভিক্ষার দু’-পাঁচশো। উনুনে ভাত চড়ে না তাতে। সংসার চলে না। ক্ষুধা বাড়ে দাবানলের মতো, রাতে হাতছানি দেয় মশার কামড়ের রাজ-শয্যা। টিভিতে ছেলেটার ঘোষণার পর প্রেমদাসায় দেখেননি এদের সার-সার ফ্যালফ্যালে চোখ আর ফ্যাকাসে হাসি? দেখেননি, এশিয়া কাপ ফাইনাল শেষে ঘোষণার আকস্মিকতায় ওরা কতটা বিহ্বল? দেখেননি, ভিনদেশি এক নায়ককে ঘিরে কীভাবে পাগলের মতো ছবি তুলছিল ওরা?
তবু বলছি, ছেলেটা অসাধারণ কিছু করেনি। যা করা উচিত, তাই করেছে। ছেলেটা ভারতের আত্মাকে বুঝেছে। গীতা-কোরান-বাইবেলের অমোঘ সত্যকে উপলব্ধি করেছে। আর দিন শেষে প্রকৃত ‘রাজধর্ম’ (এ দেশে ক্রিকেটারদের যশ-অর্থ-প্রতিপত্তি রাজা-গজাদের চেয়ে কম নয়) পালন করেছে। ছেলেবেলায় ছেলেটা পিতাকে অটো চালিয়ে অন্নসংস্থান করতে দেখেছে, ক্ষুধার ক্ষার-বৃষ্টিতে ভিজেছে, তাই বড় হয়ে পাঁচ হাজার ডলারের শামিয়ানায় ক’জন আর্ত চরিত্রকে আশ্রয় দিয়েছে। পাঁচ হাজার ডলার। প্রায় লাখ চারেক টাকা। লঙ্কা মুদ্রায় লাখ পনেরো। মন্দ নয়, কী বলেন? শ’খানেকের এক হপ্তার ডাল-ভাত এতে হবে না? শ্রীলঙ্কা নামের এক দীন দেশের দরিদ্র কিছু মেঠো-মানুষ সোনামুখ করে ক’টা দিন খাবে না? একটু বাঁচবে না?
আবারও লিখছি, ছেলেটা অসামান্য কিছু করেনি। কিচ্ছু না। নাচানাচি করার মতোও কিচ্ছু করেনি। তালি বাজানোর মতোও না। শুধু ছেলেটা যা করেছে, তা আমার করা উচিত। আপনার করা উচিত। সবার করা উচিত। তবু আমরা করি না। অনেকেই করি না। পারলেও করি না। ছিঃ, ছিঃ, দেখুন দেখি, এত বলেও ছেলেটার নাম এখনও বলা হল না।
মহম্মদ সিরাজ। ওরফে, ‘হোমো সেপিয়েন্স’।
মানুষ!