পাস্ট! অতীত! প্রাণে ধরে বা বলিও কীভাবে? এই যে শ্যেন, তার উপর দিয়ে বয়ে যাওয়া দমকা হাওয়ার জলতরঙ্গ, গত ২০ দিন ধরে পৃথিবীকে আবেশে দমবন্ধ করে রেখেছিল না? এ তো সেই শ্যেন, যার ধারে বসেছিল প্যারিস অলিম্পিকের উদ্বোধনী অনুষ্ঠান। এ সেই শ্যেন, যার জল-হৃদয় ধরে দুলতে-দুলতে এসেছিল দেশ-বিদেশের বজরা। এত তাড়াতাড়ি সব ভোলা যায়? এক রাত্তিরে সব মোছা যায়? স্মৃতির দালান-খিলান যে পড়ে থাকে। যেমন ওই। শ্যেনের ধারে দুঃখী হট ডগের দোকানখানি। গত রাত পর্যন্ত কেমন জেগে ছিল। এখন কেমন ঘুমোচ্ছে!
ঈর্ষা, ঈর্ষা, বুঝলেন, নিখাদ ঈর্ষা! এক কালে পৃথিবীর সবচেয়ে উঁচু স্থাপত্য ছিল আইফেল টাওয়ার। আমেরিকার সহ্য হল না! ফস করে একখানা ‘টুইন টাওয়ার’ তৈরি করে ফেলল! দেখা দেখি এখন আরও হয়েছে কত! বুর্জ খলিফা, অমুক, তমুক। কিন্তু প্রাণ? আছে নাকি আমাদের আইফেলের মতো আর কোথাও? আভিজাত্য? বলুন না, দাঁড়ায় নাকি আইফেলের পাশে? এই যে আপনারা, এলেন অ্যাদ্দুর, টাওয়ার আইফেল দেখতেই তো! যেতে তো পারতেন আমেরিকা বা আরব। গিয়েছেন কি? আরে বাবা, এ দুনিয়ায় ফ্রান্সই পারে সে জিনিস করতে। আর পারে বলেই ফ্রান্স সেরা!
সকাল দশটা। অলিম্পিক-উত্তর প্রথম সকাল। ঝরঝরে ইংরেজি আর ফরফরে আদব-কায়দায় যে শ্বেতাঙ্গ এ মুহূর্তে ভালোমানুষ মাদ্রাজি পরিবারকে রীতিমতো ‘বশীকরণ’ করে ফেলেছেন, অপার বিস্ময়ে তাঁকে দেখছিলুম। ওহ, সরি। শ্বেতাঙ্গ নন ইনি। শ্বেতাঙ্গিনী। কিন্তু চোস্ত কারবার যা, তাতে স্যুট-টাইয়ের কর্পোরেট বাবুদের সাতবার কিনে, পাঁচবার মানিকতলা বাজারে বেচে দেবেন! কী বলছেন, কেন বলছেন, পরম পিতাই জানেন! কিন্তু বলছেন। এবং মাদ্রাজি দম্পতি সাদরে সে বক্তৃতা উদরস্থ করছে!
‘কেম হিয়ার ফর অলিম্পিক?’
ভারতীয় দেখে ২২ বছরের প্রগলভতা গ্রাস করেছিল বোধহয় একটু। যতই হোক, দেশের লোক। খেয়ালই করিনি, সে ‘বাকসিদ্ধ’ শ্বেতাঙ্গিনী কখন সরব থেকে নীরব হয়ে গিয়েছেন! এবং কটমটিয়ে যে দৃষ্টি নিয়ে এই উটকো উপযাজকের দিকে তাকিয়ে, সত্যযুগ হলে ভস্ম হয়ে যেতাম নির্ঘাৎ! স্বাভাবিক। কাজের সময় কে আর মেলা ভ্যাজভ্যাজ সহ্য করে? এ সময়, পর্যটনের সময়। টাওয়ার আইফেল ঘুরিয়ে দেখানোর সময়। রোজগারের সময়। অলিম্পিক ইজ ডান অ্যান্ড ডাস্ট। পাস্ট।
পাস্ট! অতীত! প্রাণে ধরে বা বলিও কীভাবে? এই যে শ্যেন, তার উপর দিয়ে বয়ে যাওয়া দমকা হাওয়ার জলতরঙ্গ, গত ২০ দিন ধরে পৃথিবীকে আবেশে দমবন্ধ করে রেখেছিল না? এ তো সেই শ্যেন, যার ধারে বসেছিল প্যারিস অলিম্পিকের উদ্বোধনী অনুষ্ঠান। এ সেই শ্যেন, যার জল-হৃদয় ধরে দুলতে-দুলতে এসেছিল দেশ-বিদেশের বজরা। এত তাড়াতাড়ি সব ভোলা যায়? এক রাত্তিরে সব মোছা যায়? স্মৃতির দালান-খিলান যে পড়ে থাকে। যেমন ওই। শ্যেনের ধারে দুঃখী হট ডগের দোকানখানি। গত রাত পর্যন্ত কেমন জেগে ছিল। এখন কেমন ঘুমোচ্ছে! আসলে বিসর্জনের রেশ শুধুই বিসর্জনে সীমাবদ্ধ থাকে না যে। তার ব্যাপ্তি মনখারাপে। গঙ্গাধারের দুর্গা পুজোয় যা, শ্যেন পাড়ের অলিম্পিকেও তা। সর্বত্র ঘষটে-ঘষটে যাপনের আঁক নতুন করে কষতে হয়। কয়েক পশলা মনখারাপকে সঙ্গী করে।
সাত-পাঁচ ভাবতে-ভাবতে, ট্রোকাডেরো থেকে মঁমার্তগামী মেট্রো চড়ে বসেছি খেয়াল করিনি। কামরায় দেখলাম, জনাকয়েক ফরাসি তরুণ আড্ডা জুড়েছে। ফরাসি বুঝি না তেমন। ‘মঁসিয়ে’ আর ‘ম্যাসি বকু’ পর্যন্ত দৌড়। খাড়া কান দিয়ে বার কয়েক ‘অলিম্পিক’ শব্দটা খাপছাড়া ভাবে গলে গেল। কে জানে, হয়তো বা অলিম্পিকে ফ্রান্সের পদক নিয়ে কথা হচ্ছে। প্যারিসে যে প্রত্যাশাকে ছাপিয়ে গিয়েছে ফ্রান্স। সামান্য ঘুম-ঘুমও পাচ্ছে। প্যারিস, প্যারিসের হৃদয় মঁমার্তকে চিনব বলে গত রাত্তিরে উডি অ্যালেনের ‘মিডনাইট ইন প্যারিস’ চালিয়ে বসেছিলাম। শুনেছি, মঁমার্ত যেতে গেলে সর্বাগ্রে মনকে তৈরি করতে হয়। ও দেশের আলাদা পাসপোর্ট-ভিসা আছে!
ধবধবে সাদা বাড়ি, ‘কবলড রোড’ ধরে সে স্বর্গে প্রবেশ করতে গিয়ে মনে হল, আছে। অবশ্যই এর আলাদা পাসপোর্ট-ভিসা আছে। থাকা উচিত। এত অপার্থিবও একটা ছোট্ট জায়গা হয়? ফ্রান্সের আভিজাত্য আর ইতিহাসের মোহনাকে দেখতে গেলে সঁজেলিঁজে যাওয়াই দস্তুর। আর্ক দ্য ট্রিয়ম্ফের সামনের রাস্তাটা। পশ্চাতের আর্ক দ্য ট্রিয়ম্ফে ফরাসি বিপ্লবের খতিয়ান। নেপোলিয়ন বোনাপার্টের সেনাপতিদের নামধাম খোদাই করা। আর তার না বরাবর রাস্তার দু’পাশে ‘ভার্সাচি’, ‘জারা’,’ গুচি’, ‘জিমি চু’, ‘লুই ভিত্তো’-র নেশাতুর হাতছানি। তা, এই সঁজেলিঁজে ধরেই অলিম্পিকে ভিকট্রি প্যারেড হয়েছিল। দেখে এসেছি, প্রাণবন্ত ফরাসি জীবন সে স্মৃতি-স্রোতকে কেমন দূরে ঠেলা শুরু করে দিয়েছে ইতিমধ্যে। কিন্তু মঁমার্ত দেখে মনে হল, ‘দ্য গ্রেটেস্ট শো আর্থ’-র বিন্দুমাত্র প্রভাবও তার শিল্প-জলাশয়ে পড়েনি!
সিগারেটের দোকানকে ফরাসিরা ‘তাবাক’ বলে। উঁহু, সিগারেটের দোকানের নামে আমাদের কলকাতার মতো ঘুপচি-গুমটির বালাই নেই প্যারিসে। এ তল্লাটে সিগারেটের দোকান থাকে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে। রাস্তার মোড়ে একটা করে। তা, মঁমার্তের ‘তাবাক’-এ ইতস্তত যাঁরা সুখটান দিচ্ছেন, দেখে মনে হল না অলিম্পিক খায় না মাথায় দেয়, শেষ হল না সবে শুরু, জানার সামান্য ইচ্ছেও তাঁদের আছে বলে! ঈষৎ দূরে একটা পাব-কাম-রেস্তোঁরা। বাইরে পাতা চেয়ার-টেবল ফুরসত পেয়ে মৌজসে রোদ পোহাচ্ছে। কয়েক পা হাঁটলে ছবি বাজার! আজ্ঞে হ্যাঁ, মাছ-মাংস-তরি-তরকারির নয়। আদ্যোপাদান্ত ছবি বাজার! এক মনে সেখানে সার-সার সব ছবি আঁকছে! চিনে, ভিয়েতনামিজ, ফরাসি, স্পেনীয়, আফ্রিকান। ভারতীয়-পাকিস্তানিরাও আছেন, তবে তাঁরা মূলত ছবি প্যাকিংয়ের ব্যবসা চালান। সবচেয়ে আগ্রহ দেখলাম, পোট্রেট আঁকানোয়। নাহ্, বাবরের আমলের মতো এখন আর পোট্রেট আঁকানোর জন্য সশরীর ঠায় বসে থাকতে হয় না। প্রিয়তম কিংবা প্রিয়তমার একখানা মোবাইলে তোলা ছবি, ধরিয়ে দিলেই চলে।
ছবি-বাজারকে বাঁয়ে রেখে ডান দিকে ঘোরামাত্র শিরশিরানি বাড়ল আরও। দেখি, চোখের সামনে যাঁর বাড়ি, তাঁর ভুবনজয়ী ছবি ল্যুভরে রাখা রয়েছে! ইয়েস স্যর, মোনালিসার স্রষ্টা লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চির বাড়ি! আর হ্যাঁ, যে রাস্তায় দাঁড়িয়ে হাঁ করে ভিঞ্চির বাড়ি দেখছিলুম, তা সালভাদোর দালির নামে! দালি রোড! কেন জানি না মনে হল, এ স্থানে বেশিক্ষণ না দাঁড়ানোই ভাল। নিশ্চিত ঘাড়ে টোকা পড়বে দ্রুত। নির্ঘাত শুনতেও পাব কেউ একটা জলদগম্ভীর স্বরে বলছেন, ‘রাইনোসেরোসেস’!
ফিরে আসার সময় ভাবছিলাম, গত পাঁচ-ছ’দিনের অভিজ্ঞতা বোধহয় জন্ম-জন্মান্তরেও ফুরনোর নয়। এক দেশের মধ্যে দুটো দেশকে জড়াজড়ি করে বসে থাকতে দেখার সৌভাগ্য ক’জনের হয়? ফ্রান্সে তো তাই! প্রথম ফ্রান্সে, সমস্ত জাগতিক শর্তাবলি প্রযোজ্য। সেখানে অলিম্পিকের আসর বসে। ইউরো হয়। বিশ্বকাপ হয়। ত্যুঁর দ্য ফ্রান্সের মহাযজ্ঞ চলে। কিন্তু দ্বিতীয় ফ্রান্সে এসবের কিছুরই প্রবেশাধিকার জোটে না। সে ফ্রান্সে আজও আনাগোনা লেগে থাকে ভিঞ্চি, রেনোঁয়া, মোনে, মানের। সে ফ্রান্সের ভোরের সূর্যর কিরণ আঁকে তাঁদের অবিনশ্বর রং-তুলি। বিশ্ব-শর্তের পরোয়া করে না সে ফ্রান্স। বরং সেখানে সন্ধে নামলে রাস্তা ধারে হঠাৎ করে নাচ শুরু হয়। পুরুষ-নারীতে। চেনা-অচেনায়। বাড়ি ফেরার তাড়না উপেক্ষা করে যা দাঁড়িয়ে দেখে অফিস ফেরত জনতা। ‘বাগেত’ হাতে নিয়ে। নির্বিবাদে জল-সার দেয় উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া এক ব্যতিক্রমী চেতনায়। যে চেতনার হাওয়া-বাতাস ঘুরপাক খায় বাস্তিল থেকে ভার্সেইয়ে। নতারদামে। কঁকার্দে। যে চেতনা তার একান্ত নিজস্ব, একান্তই ব্যক্তিগত।
একুশ শতকের পৃথিবীতে দ্বৈত সত্তা নিয়ে বাঁচে ক’টা দেশ, জানা নেই। কেউ বাঁচুক, না-বাঁচুক, ফ্রান্স বাঁচে। আর তাই ফ্রান্সই সেরা!