শোনো হে ট্রোলজীবী, ‘ব্যক্তি’ আমাদের ভিত্তি। কিন্তু ভবিষ্যৎ– অলওয়েজ ‘দল’। দল জিতেছে যখন, টিম ইন্ডিয়া জিতেছে যখন, ওই সেঞ্চুরি-হাফ সেঞ্চুরির ব্যাপারস্যাপার ভুলে যাও।
হার্দিক পান্ডিয়া মোটেই ভুল কিছু করেননি! রভম্যান পাওয়েলের একটা লোপ্পা বলে গাঁতিয়ে ছয় মেরেছেন। ইন্ডিয়া জিতেছে ও ক্যাপ্টেনের ছক্কায় জিতেছে। তবু লোকজনের ভারী গোঁসা হল। গাল ফুলল। নাক সিঁটকোল। এখন কেউ যদি সাধ ক’রে, আপনার মুখের সামনে বিরিয়ানির আলুটা তুলে ধরে! সটান পাল্টি খেয়ে বলতে পারবেন তো, ‘আমি না, ডালে-ভাতে বাঙালি, বিরিয়ানি তো আর নেসিসিটি নয়!’ পারবেন তো?
ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিরুদ্ধে তিন নম্বর টি-টোয়েন্টি ম্যাচ। টিম ইন্ডিয়ার সামনে টার্গেট: ১৬০। সহজ হার্ডল। পেরিয়ে যেতে প্রয়োজন হল, ১৭খানা ওভার! স্কোরবোর্ড যখন বলছে, ‘ইন্ডিয়া নিড টু রানস টু উইন’– ৬ মারলেন হার্দিক পাণ্ডিয়া! পাঁচ ম্যাচের সিরিজে ভারতের প্রত্যাবর্তন। জয়ধ্বনি শেষে, প্রাক্তন ফাস্ট বোলার ইরফান পাঠান একটি টুইট করলেন। লিখলেন, ‘মুশকিল কাম আপ কারো, আসান কাম ম্যায় কার লেতা হু…’
এ গোছের খোঁচা দেওয়া মন্তব্যের কারণ কী? যেহেতু নন-স্ট্রাইকিং এন্ডে, ৪৯ রানে অপরাজিত তিলক বর্মা! তাই ইরফান পাঠান-সহ একাধিক ক্রিকেটার এবং ট্রোলজীবীদের দাবি: হার্দিক একজন সিনিয়র প্লেয়ার। ছয় মেরে কায়দাবাজি নাই-বা দেখালেন! বরং তাঁর উচিত ছিল, তিলক বর্মাকে স্ট্রাইক দেওয়া। একটা হাফ-সেঞ্চুরি পেত পারত বছর কুড়ির ছেলেটা।
অর্থাৎ– আহা গো বেচারা, ওর দই তো নেপোয় মেরে দিল!
মাত্র ক’দিন তো এসেছে ছেলেটা। এখনই করুণার পাত্র বানিয়ে তোলা কেন? যে প্রতিভার ঝলক তিলক দেখিয়েছেন, তা কি টিকে থাকার জন্য যথেষ্ট নয় মশাই? নৈতিকতার প্রশ্ন আপনি তুলতে পারেন বইকি। কিন্তু দলের স্বার্থ, না ব্যক্তিস্বার্থ কোনটা আগে ধরব? তিলক বর্মা কি পান্ডিয়ার মারা ৬-এ মুষড়ে পড়েছেন? টিম জেতায় মুখ কালো করে ঘুরে বেড়িয়েছেন? তা নিশ্চয়ই নয়। আমাদের আসলে একটা পক্ষ-প্রতিপক্ষ লাগে। নইলে ব্যাপারস্যাপার জমে না। একটা জম্পেশ করে বিপক্ষ তৈরি করে ক্যাঁক করে টুঁটিটা চেপে ধরে, ‘এইটা কেন করলে’ না বলা পর্যন্ত শান্তি নেই!
একটু ফ্ল্যাশব্যাকে যাই। ওয়ার্ল্ড টেস্ট চ্যাম্পিয়ানশিপ ফাইনাল। অস্ট্রেলিয়ার সামনে ন্যাজেগোবরে টিম ইন্ডিয়া। এরপর, ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফর। আশ মিটিয়ে যুদ্ধ করে হেবি রেলায় দেশে ফিরবে দল– এমনটাই ভেবেছিলাম আমরা। অথচ, ওয়ান-ডে সিরিজে কোনওমতে ২-১। টি-টোয়েন্টিতে প্রথম দুই ম্যাচেই ছড়িয়ে লাট! অর্থাৎ, সে বড়ো সুখের সময় নয়। এমন হার-জিরজিরে মুহূর্তে, ক্যাপ্টেন হিসেবে হার্দিক পান্ডিয়ার একমাত্র কর্তব্য– দলের জয় নিশ্চিত করা। তিনি ঠিক সেটাই করেছেন। ‘ব্যক্তি’ আমাদের ভিত্তি হতে পারে। কিন্তু ভবিষ্যৎ, অলওয়েজ ‘দল’। হার্দিক সেটা ভুলে যাননি।
গুইয়ানার প্রভিডেন্স স্টেডিয়াম। ৩৭ বলে ৪৯ রান। তিলক বর্মার অসামান্য ইনিংস। ভারতের জয়ের অন্যতম নায়ক। তবু, স্পটলাইট কেড়ে নিয়েছেন স্বার্থপর হার্দিক– বহু মানুষ বললেন। উগড়ে দিলেন সহজলভ্য বিদ্বেষ। কেউ কেউ আবার বলে বসলেন, হার্দিকের এখনও ক্যাপ্টেন্সির পাঠ শেষ হয়নি। শিখতে হবে মহেন্দ্র সিং ধোনির থেকে! উদাহরণ হিসেবে উঠেছে, ২০১৪ সালের টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ সেমি-ফাইনালের কথা। ভারত বনাম দক্ষিণ আফ্রিকা। ম্যাচ উইনিং শটটি খেলেছিলেন, বিরাট কোহলি। সুযোগ করে দিয়েছিলেন ধোনি। সম্মান জানিয়েছিলেন প্রত্যক্ষেই। এ ঘটনা সর্বৈব সত্য। কিন্তু ধোনি সে-সময় ৩৪ ছুঁই ছুঁই। প্রাজ্ঞতা চোখে-মুখে-কপালে। ঝাঁকড়া চুল নেই। উদ্দাম শট খেলার প্রবণতা কমে গেছে। মোদ্দা কথা, ‘রাঁচি এক্সপ্রেস’ ততদিনে শান্ত।
মনে পড়ছে ভারত-পাকিস্তান টেস্ট। ২০০৪। শচীন তেন্ডুলকর ১৯৪ রানে অপরাজিত। আর মাত্র ছ’টা রান! অথচ রাহুল দ্রাবিড়, ভারতীয় দলের ক্যাপ্টেন– ইনিংস ডিক্লেয়ারের সিদ্ধান্ত নিলেন। দ্রাবিড়কে নিয়ে যত ইচ্ছে বাপ-ঠাকুরদা হোক, ক্যাপ্টেন কিন্তু তিনি। দলের ভালমন্দ বাদ দিয়ে অত ব্যক্তিফ্যক্তি নিয়ে মাথা ঘামাবেন কেন? স্মৃতি হাতড়ে পেলাম বেন স্টোকসের সদ্য খেলা একটা অতিমানবিক ইনিংস। লর্ডসে। এই বছরই। আউট হলেন ১৫৫ রানে। অথচ, হইহল্লা ঢের বেশি হয়েছিল ২০১৯-এর হেডিংলে টেস্টের ১৩৫ নট আউট নিয়ে। কেন? যেহেতু ইংল্যান্ড সেই ম্যাচ জিতেছিল। দল জিতেছিল। ব্যক্তিগত রানের ঝুড়ে সেখানে ফক্কা!
২০১১ সাল। মায়াবী ওয়াংখেড়েতে ধোনি ছয় মারলেন! ড্রেসিংরুমে কোচ গ্যারি কার্স্টেন লাফিয়ে উঠলেন বিশ্বজয়ের আনন্দে! তখন ভারতীয় ক্রিকেটের শিরায় শিরায় ছড়িয়ে গিয়েছিল আরও এক স্বাদ। নেশার মতো। সেই স্বাদ উত্তরাধিকার সূত্রে পেয়েছেন হার্দিক পান্ডিয়া– এমনটা জোর দিয়ে বলতে পারি না। কিন্তু, ধোনি-পরবর্তী সময়ে ছয় মেরে যে কোনও জেতার স্মৃতিতে ফিরে আসে ওই ২০১১-এর ঝলক, একথা সত্যি। এই ব্যাপারটা, তেমন ‘আসান’ নয়। মনে হয়, একটু মুশকিলই।