লোকমুখে বিশ্বকাপ নিয়ে ন্যূনতম আলোচনা নেই, চ্যাম্পিয়নের দাবিদার নিয়ে ফিসফিসানিও কানে আসবে না। পাড়ায় পাড়ায় কাপ-যুদ্ধের গমগমে ভাবটাই যেখানে উধাও, চায়ের ঠেকে কাপ হাতে ঝড় তোলা তো সেখানে অলীক কল্পনা! ফলে বাইশ গজে বল গড়ানোর প্রহর গোনা শুরু হয়ে গেলেও, সিঁদুরে মেঘের মতো আনাগোনা করছে এক বিষম আতঙ্ক! ‘এটাই ক্রিকেট ইতিহাসের শেষ ওয়ান ডে বিশ্বকাপ নয় তো?’
‘হাতের চাবুকটা শুধু সশব্দে আসিয়া জলসাঘরের দরজায় আছড়াইয়া পড়িল।’ ভাঙনের এই আভাসটুকু দিয়ে ওই যে ‘জলসাঘর’-এ দুয়ার এঁটে দিলেন লেখক তারাশংকর, বন্ধ দরজার এপার থেকে অবক্ষয়ের পথ চলার যেন সেই শুরু। পায়ে পায়ে হেঁটে যাওয়া ধ্বংসের দিকে।
ভিন্ন পরিসরে হোক, কিংবা ভিন্ন সময় নিরীক্ষণে। প্রাসঙ্গিক হোক কিংবা অপ্রাসঙ্গিক। তারাশংকরের ওই ‘জলসাঘর’-এর সঙ্গে কতই না মিল ক্রিকেটের ওয়ান ডে বিশ্বকাপের। ক্ষয়িষ্ণু সামন্ততন্ত্রের ভাঙনকে উপলব্ধি করেও আত্মম্ভরিতার মোহ থেকে বের হতে পারেননি ‘জলসাঘর’-এর বিশ্বম্ভর রায়। বিবর্ণ রাজপাটের অন্তিম দীপশিখা, সেই স্খলিত জমিদারের মতোই কি চাবুক হাঁকড়ানো বিবশ পরিণতির দিকে এগিয়ে চলেছে ওয়ান ডে ক্রিকেট? রোহিত শর্মা, বিরাট কোহলি, কেন উইলিয়ামসন, স্টিভ স্মিথরা কি বুঝতে পারছেন না, একদিনের ক্রিকেট তার নাব্যতা হারিয়েছে? মৃতপ্রায়ের সমস্ত লক্ষণই তো স্পষ্ট!
বিশ্বকাপের বোধন সমাসন্ন। কাপ-যুদ্ধে অংশ নিতে ভারতে হাজির অংশগ্রহণকারী বাকি নয় দল। ধারে-ভারে, শক্তিতে প্রবল পরাক্রমশালী ফেভারিট তকমা বুকে নিয়ে নামছে রোহিতের ‘টিম ইন্ডিয়া’। অথচ সেই স্বপ্নদিশারি কুশীলবদের নিয়ে উৎসাহ-উদ্দীপনার লেশমাত্র নেই ক্রিকেট-জনতার হৃদয়ে। লোকমুখে বিশ্বকাপ নিয়ে ন্যূনতম আলোচনা নেই, চ্যাম্পিয়নের দাবিদার নিয়ে ফিসফিসানিও কানে আসবে না। পাড়ায় পাড়ায় কাপ-যুদ্ধের গমগমে ভাবটাই যেখানে উধাও, চায়ের ঠেকে কাপ হাতে ঝড় তোলা তো সেখানে অলীক কল্পনা! ফলে বাইশ গজে বল গড়ানোর প্রহর গোনা শুরু হয়ে গেলেও, সিঁদুরে মেঘের মতো আনাগোনা করছে এক বিষম আতঙ্ক! ‘এটাই ক্রিকেট ইতিহাসের শেষ ওয়ান ডে বিশ্বকাপ নয় তো?’ এমন বেয়ারা প্রশ্ন কানাঘুষো নয়, এখন ঘুরে বেড়াচ্ছে অত্যন্ত জোরালো হয়ে।
আর সেটা অমূলকও নয়। মিথ পুরাণের ধূসর পাণ্ডুলিপিতে কথিত ওই অজগরের মতোই এখন দশা একদিনের ক্রিকেটের। অজগর যেমন নিজের লেজ নিজেই গ্রাস করছিল, ক্রিকেটও তেমনই গিলে খাচ্ছে ওয়ান ডে ফরম্যাটকে। টি-টোয়েন্টির উত্থানের সঙ্গেই যেন প্রোথিত ছিল একদিনের ক্রিকেটের পতনের বীজ। সেই ললাট লিখন এখন স্পষ্ট বিশ্বকাপের স্তিমিত আবহে।
খুব বেশি দিন আগের কথা নয়। ক্যারিবিয়ান সফরে ভারত-ওয়েস্ট ইন্ডিজের ওয়ান ডে ম্যাচ চলাকালীন সোশাল মিডিয়ায় ক্ষোভ উগড়ে নেটিজেনদের একাংশ বলেছিলেন, তারা আর এই ‘ঘুমপাড়ানি ক্রিকেট’ নিতে পারছেন না। একধাপ এগিয়ে আরও সোচ্চার হয়েছিলেন, প্রায় আটঘণ্টা সময়ব্যাপী ওয়ান ডে ক্রিকেট আয়োজনের যৌক্তিকতা নিয়ে। সময়ের দাম যে এই ব্যস্তময় পৃথিবীতে অমোঘ, অমূল্য। অবক্ষয়ের সেই ঘুণ এবার গ্রাস করতে বসেছে ওয়ান ডে ক্রিকেটের প্রাণভোমরা বিশ্বকাপকেও। শচীন তেণ্ডুলকরের মতো কিংবদন্তি রাখঢাক না রেখেই বলেছেন, একঘেয়ে হয়ে যাচ্ছে এই ওয়ান ডে। একই আশঙ্কা কপিল দেবের মতো বিশ্বকাপজয়ী অধিনায়কের। সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়ের মতো সফল ক্যাপ্টেন তো প্রশ্নই তুলে দিয়েছেন ওডিআই ক্রিকেটের ভবিষ্যৎ নিয়ে।
পরিপার্শ্বের এই উপেক্ষা, উৎকণ্ঠা দেখে উপলব্ধি করা কঠিন এই বিশ্বকাপের মঞ্চ একদা ওয়েস্ট ইন্ডিজ নামক অপ্রতিরোধ্য শক্তির জয়রথ থামিয়ে জন্ম দিয়েছিল কপিল দেবদের রূপকথার। কিংবা প্রতিষ্ঠা দিয়েছিল আমির সোহেলের অহং দুরমুশ করে শান্ত ভেঙ্কটেশের প্রতিস্পর্ধী আগুনকে। ভ্রম জাগতে পারে, এই বিশ্বকাপের বুকেই কি একদা ডানা মেলেছিল সেঞ্চুরিয়নে শচীনের সেই অমরত্বের ৯৮! কিংবা ২০০৭-এর স্বপ্নভঙ্গ, ’১১-র ওয়াংখেড়েতে বিশ্বজয়ের স্বপ্নবিলাস। আসলে সবই আজ কালের গর্ভে বিলীয়মান।
অনীহার চোরাবালিতে ওয়ান ডে ক্রিকেটের এই তলিয়ে যাওয়া যতটা কর্কশ সত্য, ততটাই অবাক করা একদা ভারতীয় ক্রীড়া মানচিত্রে ‘দুয়োরানি’ হয়ে থাকা অ্যাথলেটিক্স, ব্যাডমিন্টন, টেবিল টেনিস, হকি কিংবা ফুটবলের চমকপ্রদ উন্নতি। আচমকা নয়, এই উদ্ভাস বহু তপস্যার ফসল। এশিয়াডের মঞ্চে সোনার ছেলে নীরজ চোপড়াকে ঘিরে এই যে প্রত্যাশার পারদ, পারুল চৌধুরি, রোহন বোপান্না, অনুশ আগরওয়াল, সৌরভ ঘোষালদের ঘিরে সোনা জয়ের উল্লাস, তা মোটেই অমূলক নয়। ফুটবলে খালি হাতে ফিরলেও সীমিত শক্তি নিয়ে সুনীল ছেত্রীদের সৌদি আরবের মতো কঠিন প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে চোখে চোখ রেখে লড়াই, গর্ব করার মতো। রূপকথায় নটে গাছ মুড়নোর আগে যেমন ‘দুয়োরানি’র কপালে রাজন্যসুখ জোটে, ভারতীয় ক্রীড়ায় বরাবরের উপেক্ষিতরা আজ সেই সম্মানের জায়গা পাচ্ছেন জনতার হৃদকমলে।
কিন্তু ক্রিকেট? তার কী হবে? কী হবে একদিনের ক্রিকেট, ওয়ান ডে বিশ্বকাপের? সব দেখে-শুনে মনে হচ্ছে, বিশ্বকাপ নয়, ধর্মযুদ্ধে নামতে চলেছেন রোহিত বিরাটরা। ঠিক দশ বছর আগে যেমন নেমেছিলেন মহেন্দ্র সিং ধোনি। বিলেতের বুকে এক মৃতপ্রায় চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিকে জয়ের সঞ্জীবনীতে ফিরিয়ে দিয়েছিলেন জীবনসুধা। ঘরের মাঠে বিশ্বকাপ জিতে সেই অমৃতকুম্ভের সন্ধান কি বিরাটরা পারবেন ওয়ান ডে বিশ্বকাপকে ফিরিয়ে দিতে? পারলে বাঁচবে ওয়ান ডে ক্রিকেট। বাঁচবে বিশ্বকাপ। নয়তো? কালসলিলে তলিয়ে যাবে ক্রিকেটের এক রঙিন ইতিহাস।
রোহিত, পারবেন এই ধর্মযুদ্ধে ধোনি হতে?
A Unit of: Sangbad Pratidin Digital Private Limited. All rights reserved