মধ্যবিত্ত আজব বস্তু। চিত্ত তার স্বপ্নময়। অথচ যত দিন যায়, স্বপ্নে জং ধরতে থাকে। ভাড়াবাড়ি ছাড়া হয় না, শুধু বদলে বদলে যায়। বর্ষা এলেই বাজার থেকে দামড়া ইলিশ কিনে মহানন্দে বাড়ির পথ ধরে না তারা। গণপরিবহণে তার পা মাড়িয়ে চলে যায় আরেক মধ্যবিত্ত। তবু এই ঘিসাপিটা জীবনে তারা হারে না। দুম করে একদিন সে ডেকে নেয় হলুদ ট্যাক্সি, হঠাৎ করেই কিনে ফেলে জলের রূপোলি শস্য, ইএমআই হিসেব করে একটা দু’কামরার পুরনো ফ্ল্যাটও জুটে যায় কী করে যেন। রাহুল পুরকায়স্থর কথায় ‘স্বপ্নক্রীতদাস’, এই মধ্যবিত্তরা, মাঝে মাঝে ড্র করে। রোজ জেতে না। জেতা-হারার মাঝে এই বিস্তীর্ণ ড্র করার পরিসরে দাঁড়িয়ে আছে বহু মধ্য়বিত্ত। রোজই তারা ড্র করছে। তাদের জন্য রইল ভালোবাসার হ্যান্ডশেক ও হাততালি।
গ্রাফিক্স: দীপঙ্কর ভৌমিক
জয় নয়, জীবনে ড্রয়েরও প্রয়োজন। ড্রয়ের স্বাদ কখনও-সখনও ছাপিয়ে যায় জয়ের উচ্ছ্বাস, হারের দমচাপা আতঙ্ক। দেওয়ালে পিঠ ঠেকে গেলেও, ড্র কখনও কখনও বদলে যায় জয়ে। ক্রিকেটে, জীবনেও।
ম্যাঞ্চেস্টারে ফুরিয়ে আসা বিকেল জানে সেই ড্রয়ের সার্থকতা। জানেন শুভমান গিল, কেএল রাহুল। জানেন রবীন্দ্র জাদেজা, ওয়াশিংটন সুন্দর। জানে ভারতীয় দল। টেস্টের পঞ্চম দিন। জয়ের স্বপ্ন যেখানে ফিকে, বরং হারটাই কড়া উজ্জ্বল ক্রমশ। সেখানে আট উইকেট পুঁজি করে লড়ে যাওয়া আসলে ক্রিকেট নয়, জীবনের সংগ্রাম। এ যুদ্ধে গিল-রাহুল-জাদেজা-সুন্দর যত না ক্রিকেটার, যত না ২২ গজের যোদ্ধা, তার চেয়েও বেশি করে রক্তমাংসের মানুষ। যে মানুষ দৈনন্দিন জীবনে রক্তঘাম পরিশ্রমে বাঁচার রসদ খোঁজে। লোকসানের সাপলুডো অঙ্কে বাঁচিয়ে রাখে অল্প খুশির অভ্যাসকে। ড্র তাই কখনও কখনও জয়কে হার মানিয়ে দেয়। বুঝিয়ে দেয়, ২২ গজের মতো জীবনে ড্র সম্মানজনক, মাথা উঁচু করে বাঁচার মতো প্রাপ্তি।
ম্যাঞ্চেস্টার টেস্টে সেই ড্র-কে ছাপিয়ে ডানা মেলেছে ভারত-ইংল্যান্ড শিবির জুড়ে করমর্দন বিতর্ক। ক্রিকেটের নৈতিকতার আতশকাচে জাদেজা-সুন্দরের সেঞ্চুরির যৌক্তিকতা নিয়ে অজস্র প্রশ্ন, ঠিক-ভুলের হাজারও বিশ্লেষণ। স্টোকস-ডাকেটদের ছুড়ে দেওয়া টোন-টিটকিরি। এসবের নেপথ্যে আড়ালে চলে যেতে বাধ্য ওল্ড ট্র্যাফোর্ডে ড্রয়ের মাহাত্ম্য।
………………………
ওয়াশিংটন-জাদেজারা দিনের শেষে ওই মধ্যবিত্তের প্রতিনিধি। তাঁদের লড়াকু চওড়া ব্যাটে সাম্যের গান শোনা যায়। ড্র সেই সাম্যের সুর। যে সুরে জয়ের উদ্দামতা নেই, নেই হারের শ্মশান-নীরবতা। যা আছে তা হল, এক চুঁইয়ে পড়া মন-খুশি। তাকে পুঁজি করে দু’কদম এগিয়ে যাওয়া। হয়তো সেই প্রাপ্তিতে ঢালাও পিঠচাপড়ানি নেই, না-পাওয়ার যন্ত্রণা কিংবা উপেক্ষা নেই। কিন্তু ভাগ করে নেওয়ার ভালোলাগা আছে। শুভমানদের ড্র আসলে মধ্যবিত্তের হেঁশেলঘরের হাতলভাঙা চায়ের কাপ। জমিয়ে রাখা ভাঙা বিস্কুট। বুকপকেটে জমে থাকা ভাঁজ পড়া নোটের মতো। নিখুঁত না হয়েও নিদারুণ।
………………………
আসলে জয় যেখানে অলীক কল্পনা, সেখানে হারটাই কঠিন বাস্তব। লর্ডসে চতুর্থ ইনিংসে তাসের ঘরের মতো ভেঙে পড়া ভারতীয় ব্যাটিং ওল্ড ট্র্যাফোর্ডের শেষ দিনে আশাতীত কিছু করবে, বিশ্বাস করেনি অতি বড় ক্রিকেটভক্তও। সেই অনিশ্চয়তার পৃথিবীতে ভরসার গল্প লিখেছেন গিল, জাদেজারা। নতুন করে তাদের হারানোর কিছু ছিল না। যেমনটা থাকে না আমাদের আশপাশের খেটে-খাওয়া মধ্যবিত্ত মুখের।
ওয়াশিংটন-জাদেজারা দিনের শেষে ওই মধ্যবিত্তের প্রতিনিধি। তাঁদের লড়াকু চওড়া ব্যাটে সাম্যের গান শোনা যায়। ড্র সেই সাম্যের সুর। যে সুরে জয়ের উদ্দামতা নেই, নেই হারের শ্মশান-নীরবতা। যা আছে তা হল, এক চুঁইয়ে পড়া মন-খুশি। তাকে পুঁজি করে দু’কদম এগিয়ে যাওয়া। হয়তো সেই প্রাপ্তিতে ঢালাও পিঠ-চাপড়ানি নেই, না-পাওয়ার যন্ত্রণা কিংবা উপেক্ষা নেই। কিন্তু ভাগ করে নেওয়ার ভালো-লাগা আছে। শুভমানদের ড্র আসলে মধ্যবিত্তের হেঁশেলঘরের হাতলভাঙা চায়ের কাপ। জমিয়ে রাখা ভাঙা বিস্কুট। বুকপকেটে জমে থাকা ভাঁজ পড়া নোটের মতো। নিখুঁত না হয়েও নিদারুণ।
জাদেজাদের কাছে ব্রুকদের করমর্দন তাই ‘আত্মসমর্পণ’-এর মতো বেমানান, বরং শতরানের জন্য একটু বেশি সময় ব্যাটিং ক্লেশহীন, লোভহীন। যেমনটা মধ্যবিত্ত বাঁচায়, বাসস্টপ থেকে দশ মিনিট হেঁটে ফেরায়, যেখানে ঘর্মাক্ত শরীরের ক্লান্তিকে হারিয়ে জিতে যায় মাস শেষের খুচরো বাঁচিয়ে ফেরার সঞ্চয়। মধ্যবিত্তের দুনিয়া এমনই আজব। চিত্ত তার স্বপ্নময় অথচ যত দিন যায়, স্বপ্নে ঘুণ ধরে। ভাড়াবাড়ি ছাড়া হয় না, শুধু বদলে বদলে যায়। বর্ষা এলেই বাজার থেকে দামড়া ইলিশ কিনে মহানন্দে বাড়ির পথ ধরে না তারা। গণপরিবহণে তার পা মাড়িয়ে চলে যায় আরেক মধ্যবিত্ত। তবু এই ঘিসাপিটা জীবনে তারা হারে না। দুম করে হয়তো একদিন সে ডেকে নেয় হলুদ ট্যাক্সি, হঠাৎ করেই কিনে ফেলে জলের রূপোলি শস্য। আসলে এটাই মধ্যবিত্তের জীবন, মাঝে মাঝে ড্র করে, রোজ জেতে না। জেতা-হারার মাঝে এই বিস্তীর্ণ ড্র করার পরিসরে দাঁড়িয়ে আছে বহু মধ্যবিত্ত।
মধ্যবিত্ত হৃদয় তাই বারবার খুঁজে নেয় জাদেজা কিংবা পন্থ, হনুমা বিহারিদের। কখনও তা ম্যা়ঞ্চেস্টারে, কখনও সিডনিতে। কখনও তাঁদের দেখা মেলে খাস কলকাতায়– ইডেন গার্ডেনসে, ভিভিএস লক্ষ্মণ, রাহুল দ্রাবিড়ের বেশে।
ড্র আসলে মধ্যবিত্তের মাধুকরী। জয়ের উল্লাস সেখানে নেই, হারের গ্লানিও নেই। আছে যা– তা এক আনন্দলহরী, যার স্পর্শে মধ্যবিত্ত জীবন অর্থবহ। হয়তো তাতে স্বপ্নে গড়া ইমারত অধরা থেকে যায়, কিন্তু তার জন্য আক্ষেপের মেঘ জমে না। ইএমআই হিসেব করে একটা দু’কামরার পুরনো ফ্ল্যাটও জুটে যায় কী করে যেন। সেখানেই সে চেনা সুখ খুঁজে নেয়। থাইল্যান্ড কিংবা গোয়ার সি-বিচ হয়তো মধ্যবিত্তের কষ্টকল্পনা, দিঘা-পুরীর বেলাভূমি তখন তার ক্ষতের প্রলেপ। মাসপয়লার বাজারের থলি মাসের শেষবেলায় হয়তো হালকা ঠেকে, কিন্তু মধ্যবিত্ত মন খুশি খুঁজে নেয় অল্পেতে সুখী হওয়ার আনন্দে। দামি গাড়ি কেনার খোয়াব হয়তো মধ্যবিত্তের অধরা, সেই আক্ষেপ মুছে দেয় রকের আড্ডা, রোজনামচার লোকাল। মধ্যবিত্তের একক লড়াইয়ে এভাবেই জুড়ে যায় ক্রিকেট, দানা বাঁধে এগারোর চেতনায়, সমষ্টির মধ্যে খুশির বাঁটোয়ারায়।
ক্রমশ দৃশ্যের জন্ম হলে স্মৃতিচিহ্ন সতেজ হয়। মনে পড়ে যায়, টিফিন টাইম পেরিয়ে ঘড়ির কাঁটায় বিকেল ডাক। ক্ষয়ে আসা দুপুর-রোদ শুষে নেয় বাংলা পিরিয়ড। ব্যাকরণের ক্লাস। ভাবসম্প্রসারণ করতে দিয়েছেন মাস্টারমশাই। ব্ল্যাকবোর্ডে দেখি গোটা গোটা অক্ষরে লেখা– ‘মেঘ দেখে কেউ করিসনে ভয়, আড়ালে তার সূর্য হাসে’।
অক্ষর চুইয়ে পড়া সাদা চকের গুঁড়োকে তখন মনে হয় স্বপ্নের কুচি। স্পর্শ করলে খুঁজে পাই পায়ের তলায় এক ভাঙা উঠোন। যার একদিকে নোনাধরা দেওয়াল। উল্টোদিকে ভাঙা পাঁচিল। সেই পাঁচিলের ভাঙা পাঁজরে শ্যাওলার ছোপ। খেয়াল করলে দেখা মিলবে স্মৃতিচিহ্নের। লম্বালম্বি সমান্তরালে নেমে এসেছে তিনটে দাগ। উইকেট। দুপুরের নিস্তব্ধতা ভেঙে দেওয়াল ছুঁয়ে নেমে আসে বল, ব্যাটের আঘাত সামলে আবার উঠে যায় শূন্যে। ফাটল-ধরা ওই উঠোন তখন একাঙ্ক নাটকের মঞ্চ। নাটকের নাম ক্রিকেট। জীবনের নাম ক্রিকেট।
……………………………..
ফলো করুন আমাদের ওয়েবসাইট: রোববার.ইন
……………………………..