শুধু আম্পায়ারিং করে কারওই ভাতের হাঁড়ি চড়ে না। উপরি রোজগারের রাস্তা দেখতে হয়। দু’মুঠো ভাত জোগাড়ে চাকরি-বাকরি করতে হয়। শুনেছি, ভৈরববাবুরা নাকি আম্পায়ারিংয়ের পাশাপাশি নাকি ফুটবল মাঠে রেফারিংও করাতেন। ভালবাসায়। হৃদয়ের টানে। অর্থের লোভে নয়। তাঁদের উত্তরসূরিরাও ঠিক একই কারণে আজও ছুটে যান মাঠে। প্রাণের টানে। ক্রিকেটের প্রেমে। মার খাওয়ার ভয়কে পাত্তা না দিয়ে।
২৪.
‘দ্য আম্পায়ার…ইজ লাইক দ্য গিজার ইন দ্য বাথরুম; উই ক্যাননট ডু উইদাউট ইট, ইয়েট উই নোটিস ইট ওনলি হোয়েন ইট ইজ আউট অফ অর্ডার।’
অসীম প্রাজ্ঞ ও ভুবন-বন্দিত ক্রিকেট-সাহিত্যিক স্যর নেভিল কার্ডাসের অগণিত অমৃতবচন থেকে এ পঙক্তি নেওয়া, ধারকর্য করে লেখা। বাংলা তরজমা যার জলবৎ তরলং। আম্পায়ার সেই নিঃস্ব ক্রিকেট প্রজাতি, ক্রিকেটারের দৈনন্দিন জীবনে যা একান্ত কাম্য। প্রয়োজনীয়। কিন্তু তা সত্ত্বেও চরম অবহেলিত। স্বল্পেই বর্জনীয়! অনেকটা বাথরুমের গিজারের মতো। প্রাত্যহিক যা দরকার পড়ে। কিন্তু বিকল না হওয়া পর্যন্ত সে কল্কে পায় না!
অবশ্যি, আম্পায়ারই বা বলি কেন? রেফারি। উইকেটকিপার। গোলকিপার। সব, সবাই যে একই পথের পথিক, একই দুঃখের শরিক! দিনে একশো টাকা মজুরির জীবন যাঁদের! প্রশংসা, বাহবা কিংবা ঈষৎ পিঠ চাপড়ানিতে যাদের ন্যূনতম কোনও অধিকার নেই। কিন্তু পান থেকে চুন খসলে তুমি গেলে! তখন বাপান্ত থেকে শাপান্ত, নিমেষে তোমার ছাল-চামড়া ছাড়িয়ে নেওয়া, সব হবে। এবং তোমার পক্ষ নিয়ে ‘আহা, উহু’ করা দূরস্থান। জিভ কেটে সামান্য চুকচুক শব্দও কেউ করবে না!
এই তো, আজই, এ লেখার সময়। ময়দানের এক আম্পায়ারকে তাঁদের জীবন নিয়ে লিখব বলে ফোন করেছিলাম। ফোনে মুখচোখের ভাষা পড়া যায় না। কিন্তু গলা শুনে বেশ বুঝলুম, ভদ্রলোক বড়ই অত্যাশ্চর্য। অস্ফুটে একবার বলেও ফেললেন, ‘আমাদের নিয়ে লিখবে? কিন্তু আমাদের জীবন নিয়ে লেখার আছে কী বলো?’ যেন ভদ্রলোক সম্পূর্ণ এক ‘অপাঙক্তেয়’ শ্রেণির প্রতিভূ, আকস্মিক সম্মান লাভের সম্ভাবনায় বিহ্বল! যা শুনলে অবাক লাগা উচিত। আবার উচিত নয়। আন্তর্জাতিক ক্রিকেট তবু মন্দের ভালো। কিন্তু কলকাতা ময়দানে আম্পায়ারদের মান-সম্মান বলে আর পড়ে আছেটা কী? কয়েক সপ্তাহ আগের ‘সংবাদ প্রতিদিন’ খুললেই দেখতে পাবেন, স্থানীয় ক্রিকেটের এক ম্যাচে কীভাবে এক আম্পায়ারকে প্রাণনাশের হুমকি দেওয়া হয়েছিল! অথচ, পাইলট ছাড়া যেমন উড়োজাহাজ ওড়ে না। ক্যাপ্টেন ছাড়া যেমন জাহাজ নড়ে না। পরিচালক ছাড়া যেমন সিনেমা হয় না। ক্রিকেটও তেমন আম্পায়ার ছাড়া অচল!
আসলে সেই রামও নেই, সেই অযোধ্যাও নেই। কালের নিয়মে আচার-বিচার-শিষ্টাচার, সবই মৃত নদীর মতো শুকিয়ে খটখটে হয়ে গিয়েছে। কলকাতা ময়দানে এক সময় বরেণ্য আম্পায়ার কম ছিলেন না। ক্রিকেটাররা তাঁদের সমীহ করে চলতেন। সম্মান দিতেন। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ডিকি বার্ড কিংবা সাইমন টাফেলরা ঠিক যে বরণডালা পেয়ে এসেছেন। বাংলার বিখ্যাত আম্পায়ার ভৈরব গঙ্গোপাধ্যায়কে নিয়ে কত শত মজার কাহিনি ময়দানের হাওয়া-বাতাসে আজও ঘুরে বেড়ায়। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটেও চুটিয়ে আম্পায়ারিং করেছেন যিনি।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
ওয়েস্ট ইন্ডিজের হয়ে ম্যালকম মার্শাল খেলতে এসেছিলেন। কিটব্যাগে আগুনে পেসকে সঙ্গী করে। যিনি টানা ‘নো’ বল করছেন দেখেও তাঁকে নাকি ভৈরববাবু কিছু বলার ধৃষ্টতা দেখাননি! সাহস পাননি! নন-স্ট্রাইকার প্রান্তে আবারও ছিলেন সম্বরণ। যিনি ফের পাকড়াও করেন আম্পায়ারকে। কিন্তু আবারও লাভ হয়নি। ভৈরববাবু নাকি নির্মল হাসি দিয়ে বলে দেন, ‘যা করতাছে, করতে দে অরে। আমি যদি কিছু কই, ইংরাজিতে গাইলাইব!’
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
শোনা যায়, কাঠ-বাঙাল ছিলেন ভদ্রলোক। ক্রিকেটারদের সঙ্গে রঙ্গ-রসিকতা করতে দু’বার ভাবতেন না। গুয়াহাটিতে একবার ইংল্যান্ড বনাম পূর্বাঞ্চল খেলায় ইংরেজ ওপেনার গ্রাহাম বার্লোকে দিনের তৃতীয় বলে এলবিডব্লিউ করে দিয়েছিলেন বাংলা পেসার বরুণ বর্মণ। সম্বরণ বন্দ্যোপাধ্যায়রা বারবার ‘অ্যাপিল’ করেও ভৈরববাবুর মন গলাতে পারেননি! নিশ্চিত এলবিডব্লিউ নাকি তিনি দেননি। ওভার শেষে সম্বরণ গিয়ে তাঁকে অনুযোগ করে বলেন যে, ‘ভৈরবদা, এটা আউট দিলেন না?’ নিপাট ভালোমানুষের মতো ভৈরব গঙ্গোপাধ্যায় নাকি উত্তর দিয়েছিলেন, ‘দিনের প্রথম ওভার তো। ঘাবড়াইয়া গেসিলাম!’
’৮৯-তেও প্রায় এক কাণ্ড। ওয়েস্ট ইন্ডিজের হয়ে ম্যালকম মার্শাল খেলতে এসেছিলেন। কিটব্যাগে আগুনে পেসকে সঙ্গী করে। যিনি টানা ‘নো’ বল করছেন দেখেও তাঁকে নাকি ভৈরববাবু কিছু বলার ধৃষ্টতা দেখাননি! সাহস পাননি! নন-স্ট্রাইকার প্রান্তে আবারও ছিলেন সম্বরণ। যিনি ফের পাকড়াও করেন আম্পায়ারকে। কিন্তু আবারও লাভ হয়নি। ভৈরববাবু নাকি নির্মল হাসি দিয়ে বলে দেন, ‘যা করতাছে, করতে দে অরে। আমি যদি কিছু কই, ইংরাজিতে গাইলাইব!’
শোনা যায়, ভৈরব গঙ্গোপাধ্যায়ের কাছে নাকি ব্যক্তিগত ‘রিদম’ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বস্তু ছিল! ছন্দ! স্থানীয় ক্রিকেটে অনেক সময়ই উইকেট না পড়া নিয়ে প্লেয়ার ক্যাঁচরম্যাঁচর শুরু করলে তিনি নাকি বলতেন, ‘দাঁড়া, আগে রিদমটা পাইয়া লই!’ যে ‘রিদম’ একবার পেয়ে গেলে, আর নাকি দেখতে হত না! ঝটপট উইকেট পড়তে শুরু করত! ইংল্যান্ড বনাম পূর্বাঞ্চল ম্যাচেই যেমন। যে খেলাটার কথা আগে লিখলাম। সে ম্যাচেই ক্রিস ওল্ডের প্যাডে বল লাগার সঙ্গে সঙ্গে নাকি আঙুল তুলে দিয়েছিলেন ভৈরববাবু! কারণ, ততক্ষণে কাঙ্ক্ষিত ‘রিদম’ পেয়ে গিয়েছিলেন তিনি! সত্য-মিথ্যা জানা নেই। কনফার্মেশনও নেই। পুরোটাই পুরনো আমলের ক্রিকেটারদের মুখে শোনা কাহিনি। ময়দানি গল্পগুচ্ছ। তবে প্রচলিত সত্যিটা হল, দুর্ধর্ষ আম্পায়ার ছিলেন ভৈরব গঙ্গোপাধ্যায়। এক কথায়, বাংলা আম্পায়ারদের ডব্লিউ জি গ্রেস! সাক্ষাৎ কিংবদন্তি।
একা ভৈরব নন। সুনীত ঘোষ। সুব্রত পোড়েল। সুব্রত বন্দ্যোপাধ্যায়। অলোক ভট্টাচার্য। ফ্রান্সিস গোমস। এঁরাও কেউ কম ডাকসাইটে আম্পায়ার ছিলেন না। সুনীত ঘোষ ছিলেন অসম্ভব রাশভারি প্রকৃতির। সব সময় ধোপদুরস্ত-ফিটফাট থাকতেন। ইংরেজিতে কথা বলতেন। মাঠে ক্রিকেটাররা বেচাল ঘটালে শাসনও করতেন কড়া ইংরেজিতে। তাঁর ক্ষেত্রে শোনা যায় (সুনীত বাবুর ছাত্ররাই বলেন), তিনি নাকি আম্পায়ারিংয়ের ‘ল নাম্বার ফর্টি থ্রি’ আবিষ্কার করেছিলেন! আম্পায়ারদের বিয়াল্লিশটা আইন অনুসরণ করে চলতে হয়। কিন্তু সুনীত ঘোষ বলতেন, ‘আমি তেতাল্লিশ নম্বর আইন মেনে খেলাতে ভালবাসি।’ তাঁর দর্শন ছিল, ক্রিকেটের জন্য আম্পায়ারিং। আম্পায়ারিংয়ের জন্য ক্রিকেট নয়। অর্থাৎ, ক্রিকেটের স্বার্থ রক্ষার্থে যদি আইন সামান্য বদলাবদলি করতে হয়, দু’বার নাকি ভাবতেন না সুনীতবাবু। যা তাঁর একান্ত আপন, মোক্ষম ‘ল নাম্বার ফর্টি থ্রি’! অচিন্ত্য নন্দী নামের এক আম্পায়ারের কথা শোনা যায় (সেই সময়ের ক্রিকেটাররা যাঁর নাম দিয়েছিলেন ‘স্ট্যাটাস’), যিনি প্রথম ‘চাকিং’-এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ শুরু করেন! ক্লাব বড় না ছোট, প্লেয়ার ছোট না বড়, ভদ্রলোক কিস্যু দেখতেন না। স্পিনার কনুই ভাঙলে সে পত্রপাঠ খরচের খাতায়! সোজা ‘নো’!
আজ দুঃখই লাগে ভৈরব-সুনীত-সুব্রতদের উত্তরসূরিদের হাল দেখে। প্লেয়ার ও কর্তাদের ‘লেঠেলবাজি’-র সামনে তাঁদের প্রাণভয়ে কাঁপতে দেখে। কী এমন চান, ময়দানের হালফিলের আম্পায়াররা? একটু সম্মান, একটু মর্যাদা, একটু শ্রদ্ধা ছাড়া? অর্থ তো কেউ পান দিন পিছু বারোশো, কেউ পনেরেশো। শুধু আম্পায়ারিং করে কারওই ভাতের হাঁড়ি চড়ে না। উপরি রোজগারের রাস্তা দেখতে হয়। দু’মুঠো ভাত জোগাড়ে চাকরি-বাকরি করতে হয়। শুনেছি, ভৈরববাবুরা নাকি আম্পায়ারিংয়ের পাশাপাশি নাকি ফুটবল মাঠে রেফারিংও করাতেন। ভালোবাসায়। হৃদয়ের টানে। অর্থের লোভে নয়। তাঁদের উত্তরসূরিরাও ঠিক একই কারণে আজও ছুটে যান মাঠে। প্রাণের টানে। ক্রিকেটের প্রেমে। মার খাওয়ার ভয়কে পাত্তা না দিয়ে।
আর তাই, একশো শতাংশ সত্যি লিখেছেন কার্ডাস সাহেব। আম্পায়ররা ‘গিজার’-ই! কনকনে শীতের সকালে সে কাজ না করলে, তার মাহাত্ম্য বোঝা যায়, নচেৎ নয়। আম্পায়াররাও তাই। ক্রিকেটের হাত এঁরা ছেড়ে দেবেন যে দিন, ক্রিকেটাররাও বুঝবেন সে দিন। তার আগে নয়। বুঝলে, ‘দাঁত থাকতে দাঁতের মর্ম বুঝতে হয়’ প্রবাদটারই যে জন্ম হত না!
(চলবে)
…পড়ুন খেলাইডোস্কোপ-এর অন্যান্য পর্ব…
খেলাইডোস্কোপ পর্ব ২৩: বিশ্বাসে মিলায় ক্রিকেট, ‘কু’সংস্কারে বহুদূর!
খেলাইডোস্কোপ পর্ব ২২: ‘ফিক্সার’-রা ছিল, আছে, থাকবে, প্রাগৈতিহাসিক যুগের আরশোলা-র মতো
খেলাইডোস্কোপ পর্ব ২১: বল পিছু স্কোরবোর্ডে যারা সংখ্যা বদলায়, কিন্তু তাদের জীবন বদলায় না
খেলাইডোস্কোপ পর্ব ২০: প্রতি গুরু-পূর্ণিমায় প্রথম ফুল দেব সব্যসাচী সরকারকেই
খেলাইডোস্কোপ পর্ব ১৯: ময়দানের ছবিওয়ালাদের কেউ মনে রাখেনি, রাখে না
খেলাইডোস্কোপ পর্ব ১৮: যারা আমার মাঠের পরিবার
খেলাইডোস্কোপ পর্ব ১৭: অহং-কে আমল না দেওয়া এক ‘গোল’ন্দাজ
খেলাইডোস্কোপ পর্ব ১৬: যে দ্রোণাচার্যকে একলব্য আঙুল উপহার দেয়নি
খেলাইডোস্কোপ পর্ব ১৫: সাধারণের সরণিতে না হাঁটলে অসাধারণ হতে পারতেন না উৎপল
খেলাইডোস্কোপ পর্ব ১৪: মনোজ তিওয়ারি চিরকালের ‘রংবাজ’, জার্সির হাতা তুলে ঔদ্ধত্যের দাদাগিরিতে বিশ্বাসী
খেলাইডোস্কোপ পর্ব ১৩: অনুষ্টুপ ছন্দ বুঝতে আমাদের বড় বেশি সময় লেগে গেল
খেলাইডোস্কোপ পর্ব ১২: একটা লোক কেমন অনন্ত বিশ্বাস আর ভালোবাসায় পরিচর্যা করে চলেছেন বঙ্গ ক্রিকেটের
খেলাইডোস্কোপ পর্ব ১১: সম্বরণই বঙ্গ ক্রিকেটের বার্নার্ড শ, সম্বরণই ‘পরশুরাম’
খেলাইডোস্কোপ পর্ব ১০: যাঁরা তৈরি করেন মাঠ, মাঠে খেলা হয় যাঁদের জন্য
খেলাইডোস্কোপ পর্ব ৯: খণ্ড-অখণ্ড ভারতবর্ষ মিলিয়েও ক্রিকেটকে সম্মান জানাতে ইডেনতুল্য কোনও গ্যালারি নেই
খেলাইডোস্কোপ পর্ব ৮: ২০২৩-এর আগে আর কোনও ক্রিকেট বিশ্বকাপ এমন ‘রাজনৈতিক’ ছিল না
খেলাইডোস্কোপ পর্ব ৭: রোহিত শর্মার শৈশবের বাস্তুভিটে এখনও স্বপ্ন দেখা কমায়নি
খেলাইডোস্কোপ পর্ব ৬: বাংলা অভিধানে ‘আবেগ’ শব্দটাকে বদলে স্বচ্ছন্দে ‘বাংলাদেশ’ করে দেওয়া যায়!
খেলাইডোস্কোপ পর্ব ৫: ওভালের লাঞ্চরুমে জামাইআদর না থাকলে এদেশে এত অতিথি সৎকার কীসের!
খেলাইডোস্কোপ পর্ব ৪: ইডেনের কাছে প্লেয়ার সত্য, ক্রিকেট সত্য, জগৎ মিথ্যা!
খেলাইডোস্কোপ পর্ব ৩: এ বাংলায় ডার্বিই পলাশির মাঠ
খেলাইডোস্কোপ পর্ব ২: গ্যালারিতে কাঁটাতার নেই, আছে বন্ধনের ‘হাতকড়া’
খেলাইডোস্কোপ পর্ব ১: চাকরি নেই, রোনাল্ডো আছে