বাস্তব জগৎ থেকে বহু যোজন দূরে অবস্থিত রবি ঠাকুরের ছবি সাধারণের গ্রহণযোগ্যতা পায়নি। আর্টিস্ট রবীন্দ্রনাথ কোনও দিনই যা দেখছেন, তাকে হুবহু আঁকার চেষ্টা করেননি। তবুও শিক্ষক নন্দলালের কখনও মনে হয়েছে হাত-পায়ের দুয়েকটা ড্রয়িং এঁকে দিলে গুরুদেবের হয়তো সুবিধে হবে। এমনটা ভেবে খাতায় কয়েকটা হাত-পায়ের ডিটেল স্কেচ করে রবীন্দ্রনাথকে দিয়েছিলেন নন্দলাল। সেই স্কেচের দুয়েকটা নমুনা এখানে রইল। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ জানেন, তিনি করছেন, আর কী করতে চান। তিনি মৃদু হেসে সে খাতা ফিরিয়ে দিয়েছেন কলাভবন অধ্যক্ষের হাতে।
১১.
কিছুকাল আগেও রবি ঠাকুরের আঁকা ছবি নিয়ে যথেষ্ট হাসিঠাট্টা চলেছে। অনেককে বলতে শুনেছি, ‘উনি তো মশাই হাত আঁকতে হাতপাখা এঁকে বসেন’। অর্থাৎ অধিকাংশের কাছে বাস্তবের অনুকরণেই ছবির রীতি বা পদ্ধতি ধরা আছে। সোজা কথায় তাদের কাছে ‘ফোটোগ্রাফিক রিয়্যালিটি’ হল চিত্রকলার আরেকটা পিঠ। যদিও উপকরণের দিক থেকে একটায় রং-তুলি, তো অন্যটায় ক্যামেরা। খেয়াল করলে দেখি, রিয়েলিস্টিক আর্টের মোহ দীর্ঘকাল আমরা কাটিয়ে উঠতে পারিনি। ফারাক বুঝতে শিখিনি চোখের দেখা আর মনের দেখার মধ্যে। নিঃসন্দেহে বিলেতের শিক্ষা এর পিছনে অনেকখানি কাজ করেছে।
সময়ের নিরিখে বলতে হয়, ব্রিটিশরাজত্ব শুরুর কিছুকাল পর থেকে লন্ডনের রয়্যাল কলেজ অফ আর্টের ছত্রছায়ায় আমাদের শিল্পভাবনা ধূমায়িত। প্রাচ্যদেশের সেমি-ডেকরেটিভ আর্ট-ফর্মকে উপলব্ধি করতে বিলেতি সাহেবদের লেগেছে বেশ খানিকটা সময়। তাদের সঙ্গে আমরাও ফোটোগ্রাফিক রিয়্যালিটিকে চিত্রকলার যথার্থ নমুনা হিসেবে মেনে নিয়েছি। বাস্তবের অনুসরণ একদিকে যেমন জরুরি, তেমনই সেই শিক্ষা অধিগত হলে সেখান থেকে সরে আসাও বিশেষভাবে দরকার। অন্যথায় তা সত্যিকার শিল্পসৃষ্টির পথে অন্তরায় হয়ে উঠতে পারে। অধ্যাবসায় আর শিল্পসৃষ্টিকে এক সারিতে বসানো চলে না। শিল্পশিক্ষার পথে সে একটা পর্ববিশেষ। কিন্তু সাধারণের মধ্যে এই ভাবনা চাড়িয়ে উঠতে এখনও বাকি আছে। তবে কি শিল্পকলা ‘যদ্দিষ্টং তল্লিখিতং’ অবস্থার মধ্য দিয়েই বয়ে চলবে? সময়ের সঙ্গে সে কি বাঁক নেবে না? সেইটেই তো স্বাভাবিক। ইতিহাসের নিরিখে শিল্পের আধুনিক জোয়ার বিলেতের মাটি ছুঁয়েছে অনেক দেরিতে। সেদিক থেকে ফরাসি দেশ বা জার্মানিতে শিল্পের নতুন সংজ্ঞা গড়ে উঠেছে বিলেতের আগে। বিলেতের পর্দা সরিয়ে বেরিয়ে আসতে সময় লেগেছে আমাদের। সাহিত্যকে একটু স্বতন্ত্র কোঠায় রেখে বোঝার চেষ্টা করি, সংগীত বা নৃত্যের কোনওটিই তো চোখে দেখা বাস্তবের জেরক্স কপি নয়। এইসব শিল্পমাধ্যমের নিজস্ব এক চরিত্র, একটা আলংকারিক চেহারা আছে। যেমন ধরা যাক, সংগীত যেখানে সপ্তস্বরের ওপর দাঁড়িয়ে, সেখানে ছবির প্রধান ভর হচ্ছে রং, রেখা ও আকার। এরাই চিত্রকলার প্রধান উপাদান, ছবির সা-রে-গা-মা-পা-ধা-নি-সা। একজন চিত্রকর যখন কোনও মুখের ছবি আঁকছেন, তখন কি তিনি সেই মুখমণ্ডলের সারফেসের ছবি আঁকছেন? তা তো নয়। সে কাজ ক্যামেরা এক মুহূর্তে সেরে ফেলতে পারে। শিল্পী এখানে মুখের আদল থেকে মানুষটির মনের আয়নায় প্রতিফলিত অন্দর মহলের ছবি আঁকেন। মুখের ওপরিতলের হবহু প্রতিবিম্ব রচনার বদলে রেখা আকার, রং ও অভিব্যক্তির সাহায্যে ফুটিয়ে তোলেন তার ব্যক্তিত্ব। সেখানেই শিল্পসৃষ্টির সার্থকতা। এবারে তাকাই রবি ঠাকুরের দিকে।
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………..
পড়ুন বিশ্বজিৎ রায়ের লেখা: রবীন্দ্রনাথ কি আড্ডা মারতেন?
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………..
তরুণ বয়সের রবি ঠাকুর রিয়্যালিস্টিক আর্টের প্রতি খানিক পক্ষপাতী হলেও দ্রুত সেখান থেকে সরে এসেছিলেন। ছবির ক্ষেত্রে প্রকৃতির হুবহু অনুকরণের বিপরীতে জোরালো মত প্রকাশ করেছেন একাধিকবার। এজন্যে অতুল বসুর মতো বাস্তববাদী শিল্পীরা তাঁকে কটুকথা বলতে ছাড়েনি। পাশাপাশি অবনীন্দ্রনাথও ছিলেন অতুল বসুর ক্রিটিসিজমের অন্যতম টার্গেট। উভয়ের প্রতিই তিনি কঠিন স্বরে সমালোচনা করেছেন– ‘‘আশৈশব প্রকৃতির রূপমুগ্ধ কবিগুরু রবীন্দ্রনাথও অনুরূপ কারুকর্মে বিশ্বাসী শিল্পীদের ‘প্রকৃতির ধামাধরা’, ‘অবিকৃত বমনকারী’ বলতে দ্বিধা করলেন না। …যদিও এই দুই মনীষীর শ্রেষ্ঠ পরিচয় কাব্যে ও চিত্রে তবু ছবির আদর্শ সম্বন্ধে এঁদের মতামত যে আমাদের সংস্কৃতি ক্ষেত্রে প্রায় শেষ কথার সামিল, তা সহজেই অনুমেয়। আক্ষেপের বিষয় এই যে, মতবাদ প্রচারে বহুবার বিপরীত কথা বলে রবীন্দ্রনাথ ভক্তবৃন্দকে বিভ্রান্ত করেছেন’’ ইত্যাদি ইত্যাদি। স্পষ্টই বোঝা যায়, রিয়্যালিস্টিক আর্টের বিপরীত পথে চলা শিল্পের প্রতি অতুল বসুদের সায় ছিল না। বরাবর তিনি অবন ঠাকুর-সহ তাঁর শিষ্যদের সমালোচনায় মুখর হয়েছেন। এদিকে রবীন্দ্রনাথের ৭০ বছরপূর্তি উপলক্ষে ১৯৩১ সালের ডিসেম্বরে কলকাতার টাউনহলে আয়োজিত হল রবীন্দ্রজয়ন্তী উৎসব। সেই উপলক্ষে প্রদর্শিত হল রবি ঠাকুরের আঁকা একগুচ্ছ ছবি। এই প্রথম আমাদের দেশে জনতার দরবারে উন্মোচিত হলেন ছবিঠাকুর– যা দেখামাত্র ‘শনিবারের চিঠি’ তাঁকে বিদ্রুপের বন্যায় ভাসিয়ে দিয়েছে। কাগজে লেখা হয়েছে– ‘রবীন্দ্রনাথ ছবি আঁকিয়েছেন, শুধু আঁকা নয়, আঁকিয়া জগতের গুণীসমাজে খ্যাতিলাভ করিয়াছেন। রবীন্দ্রপ্রতিভার ইহা বিকাশ না বিবর্তন? বিস্ময়ের আর সীমা রহিল না। যতগুলি কলা ছিল, ক্রমে ক্রমে প্রায় সবগুলি রবীন্দ্রপ্রতিভাশশীর তিথিতে তিথিতে পুরিয়া উঠিয়া এতদিনে কি ষোলকলা সম্পূর্ণ হইয়া পৌর্ণমাসী দেখা দিল? না, কৃষ্ণপক্ষের রবীন্দ্রশশী একে একে সকল কলাগুলি ত্যাগ করিয়া শেষ কলায় আসিয়া ঠেকিয়াছে? –‘কলামাত্র শেষাং হিমাংশো’। আমরা প্রার্থনা করি, ইহাই যেন শেষকলা না হয়। মূর্তি ও বাস্তব দুইটি কলা এখনও বাকি আছে, আশা হয় এ দুটিও বাদ যাইবে না, অন্তত বাস্তব কলাটি।’’
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………..
একজন চিত্রকর যখন কোনও মুখের ছবি আঁকছেন, তখন কি তিনি সেই মুখমণ্ডলের সারফেসের ছবি আঁকছেন? তা তো নয়। সে কাজ ক্যামেরা এক মুহূর্তে সেরে ফেলতে পারে। শিল্পী এখানে মুখের আদল থেকে মানুষটির মনের আয়নায় প্রতিফলিত অন্দর মহলের ছবি আঁকেন। মুখের ওপরিতলের হবহু প্রতিবিম্ব রচনার বদলে রেখা আকার, রং ও অভিব্যক্তির সাহায্যে ফুটিয়ে তোলেন তার ব্যক্তিত্ব। সেখানেই শিল্পসৃষ্টির সার্থকতা।
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………..
এ হেন বিদ্রুপের গোড়ায় সেই ‘হাত আঁকতে হাতপাখা আঁকা’র কথাই প্রকারান্তরে প্রতিফলিত। প্রদর্শনীতে রবীন্দ্রছবির বর্ণনা করতে গিয়ে যেরকম ভাষা ব্যবহৃত হয়েছে, তা আজকের সমালোচকেরাও ভাবতে পারেন কি না সন্দেহ! – ‘ছবিগুলি ছবি হউক আর না হউক– একটা কিছু বটেই, আমরাও তাহা অস্বীকার করি না। অনেকগুলিতে শ্যাওলা ছ্যাতলা মেছেতা জাতীয় একটা রূপ আছে, আবার কতকগুলিতে যে বিকট হিলিবিলির মত রেখাবিন্যাস আছে– তাহার সহিত লালা কিন্ন সরীসৃপের সাদৃশ্য আছে। রবীন্দ্রনাথ তাঁহার ছবিগুলির অংকন রহস্যের যে আভাস দিয়াছেন, তাহাতে মনে হয়, এগুলি তাঁহার অবচেতন হইতে উদ্ভূত। যদি তাহাই হয় তবে এগুলিকে চিত্রশিল্পের অন্তর্গত না করিয়া মনোবিকলন শাস্ত্রের অধীন করাই ত সঙ্গত’।
এখানেই সমালোচকের কলম থামেনি, নির্মমভাবে লেখা হয়েছে– ‘সজ্ঞান সৌন্দর্যসাধকের নিরজ্ঞানে যে কুৎসিত-কুরূপের প্রীতি অবরুদ্ধ হইয়া থাকে, এগুলি কি তাহাই কবিপ্রতিভার তন্দ্রাচ্ছন্ন অবস্থায় মুক্তি পাইবার চেষ্টা করিতেছে’? আগেই বলেছি, বাস্তব জগৎ থেকে বহু যোজন দূরে অবস্থিত রবি ঠাকুরের ছবি সাধারণের গ্রহণযোগ্যতা পায়নি। আর্টিস্ট রবীন্দ্রনাথ কোনও দিনই যা দেখছেন, তাকে হুবহু আঁকার চেষ্টা করেননি। তবুও শিক্ষক নন্দলালের কখনও মনে হয়েছে হাত-পায়ের দুয়েকটা ড্রয়িং এঁকে দিলে গুরুদেবের হয়তো সুবিধে হবে। এমনটা ভেবে খাতায় কয়েকটা হাত-পায়ের ডিটেল স্কেচ করে রবীন্দ্রনাথকে দিয়েছিলেন নন্দলাল। সেই স্কেচের দুয়েকটা নমুনা এখানে রইল। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ জানেন, তিনি কী করছেন, আর কী করতে চান। তিনি মৃদু হেসে সে খাতা ফিরিয়ে দিয়েছেন কলাভবন অধ্যক্ষের হাতে। বাস্তব আর কল্পনার কোন সন্ধিক্ষণে মূর্ত হয়ে ওঠে শিল্পের আধুনিকতা– তা ছবিঠাকুরের অজানা ছিল না।
(চলবে)
…পড়ুন ছবিঠাকুর-এর অন্যান্য পর্ব…
পর্ব ১০: ১০টি নগ্ন পুরুষ স্থান পেয়েছিল রবীন্দ্র-ক্যানভাসে
পর্ব ৯: নিরাবরণ নারী অবয়ব আঁকায় রবিঠাকুরের সংকোচ ছিল না
পর্ব ৮: ওকাম্পোর উদ্যোগে প্যারিসে আর্টিস্ট হিসেবে নিজেকে যাচাই করেছিলেন রবি ঠাকুর
পর্ব ৭: শেষ পর্যন্ত কি মনের মতো স্টুডিও গড়ে তুলতে পেরেছিলেন রবীন্দ্রনাথ?
পর্ব ৬: রবীন্দ্র চিত্রকলার নেপথ্য কারিগর কি রানী চন্দ?
পর্ব ৫: ছবি আঁকার প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ পরলোকগত প্রিয়জনদের মতামত চেয়েছেন
পর্ব ৪: প্রথম ছবি পত্রিকায় প্রকাশ পাওয়ামাত্র শুরু হয়েছিল বিদ্রুপ
পর্ব ৩: ঠাকুরবাড়ির ‘হেঁয়ালি খাতা’য় রয়েছে রবিঠাকুরের প্রথম দিকের ছবির সম্ভাব্য হদিশ
পর্ব ২: রবীন্দ্রনাথের আঁকা প্রথম ছবিটি আমরা কি পেয়েছি?
পর্ব ১: অতি সাধারণ কাগজ আর লেখার কলমের ধাক্কাধাক্কিতে গড়ে উঠতে লাগল রবিঠাকুরের ছবি
১৯৩৭ সালে পিল কমিশন প্যালেস্তাইনে ধর্মের ভিত্তিতে ভূখণ্ড ভাগের প্রস্তাব দেয়। এটাও ভারতের প্রেক্ষাপটে দাঁড়িয়ে গান্ধীজির পক্ষে মেনে নেওয়া অসম্ভব ছিল। কারণ এদেশেও তখন ধর্মের ভিত্তিতে দেশভাগ অর্থাৎ ‘টু নেশন’ তত্ত্ব ধীরে ধীরে দানা বাঁধছে।