‘দিওয়ার’-এর আদর্শবাদী মা, যে আদতে কোথাও যেন এক পিতৃতান্ত্রিক কাঠামোকেই বহন করছে তার নিহত স্বামীর আদর্শ নিয়ে বেঁচে, এবং ভারতীয় বৈধব্যের চিরন্তন চিহ্ন সাদা থান যেন হয়ে উঠছে তার নিষ্কলুষ নৈতিকতার পরাকাষ্ঠা, তা নিরুপা রায়কে দিয়েছিল অন্তত কিছুদিনের জন্য বলিউডি মাতৃত্বের পরোয়ানা।
১২.
‘মেরে পাস মা হ্যায়’– এই সহজ, একরৈখিক বাক্যটির মধ্যে প্রায় একটি জাতিকল্প লুকিয়ে ছিল। যে ভারতীয়ত্বের নির্মাণ ঘটতে শুরু করেছিল স্পষ্টাস্পষ্টি ‘মাদার ইন্ডিয়া’ থেকেই। ইয়ুং কথিত সমষ্টিগত অচেতনের মধ্যে পুরাণের আবাসস্থলকে চিনতে চেয়ে ঋত্বিক ঘটক যে ‘মাদার আর্কেটাইপ’-কে তুলে ধরছিলেন তাঁর ছবিতে, তা যেমন আবহমান এবং লোকায়ত ভারতের, নার্গিস-সুনীল দত্ত অভিনীত ‘মাদার ইন্ডিয়া’ তা ঘটিয়েছিল স্বাধীন ও আধুনিক ভারতের নির্মাণের প্রেক্ষিতে। নেহরুর দেশভাবনায় যে নতুন ভারত গড়ে উঠছে তখন, সেখানে মাতৃমূর্তি কেমন হবে, তার একটা আভাস ছিল সেই ছবিতে।
বেনেডিক্ট অ্যান্ডারসন বলেছিলেন ‘ইমাজিনড কমিউনিটি’-র কথা, যেখানে খণ্ড খণ্ড জাতিভাবনা জুড়ে এক সামগ্রিক জাতিকল্পনার জন্ম হয়। ভারতের ক্ষেত্রে এই জাতিকল্পনায় কি ভিন্নতার স্বর চাপা পড়ে গেল? প্রশ্ন তুলেছিলেন পার্থ চট্টোপাধ্যায়। কিন্তু সত্যিই যদি একমুখী ভারত-কল্প নির্মাণের প্রশ্ন উঠে থাকে, তাহলে ‘মাদার ইন্ডিয়া’ কি সেই কল্পিত গ্রামভারতেরই মা হয়ে উঠছিলেন? ‘বারোমাস’ পত্রিকার এক সংখ্যায় একটি নিবন্ধে এই প্রসঙ্গ তুলে মৈনাক বিশ্বাস দেখিয়েছিলেন, ‘মাদার ইন্ডিয়া’ বা রাধা-রূপী নার্গিস নারীত্ব, মাতৃত্বের দ্বন্দ্বের মধ্যে পড়েই হয়ে উঠেছিলেন ভারতীয় মায়ের প্রকল্প। যে ভারতের কর্ষণ-সভ্যতার নানা চিহ্নক বহন করে, যে প্রযুক্তি ও প্রাচুর্যের মাঝে দাঁড়ায় আদর্শের অঙ্গীকার নিয়ে, যে শ্রমিক এবং যে তার ব্যক্তিসত্তাকে অতিক্রম করে জাতীয় মাতৃত্বের প্রকল্পের সঙ্গে একবিন্দু আপস করে না। ‘তোমারই মাটিরই কন্যা’ হয়ে হয়তো সীতার সঙ্গে এক সমতলে এসে দাঁড়ায় রাধা, কিন্তু একই সঙ্গে সে আধুনিক ভারতের মা-ও বটে।
এহেন মাতৃকল্পর চেহারা বদলে যাচ্ছিল দীর্ঘদিন ধরেই। ‘দিওয়ার’-এর এই সংলাপ যেন একই সঙ্গে এই মাতৃকল্পর পূর্ণতা, এবং বাঁকবদলের সূচক। নিরূপা রায়ের অভিনয়-জীবন শুরু হয়েছিল সেই স্বাধীনতার পরে পরেই। ‘দিওয়ার’-এর আদর্শবাদী মা, যে আদতে কোথাও যেন এক পিতৃতান্ত্রিক কাঠামোকেই বহন করছে তার নিহত স্বামীর আদর্শ নিয়ে বেঁচে, এবং ভারতীয় বৈধব্যের চিরন্তন চিহ্ন সাদা থান যেন হয়ে উঠছে তার নিষ্কলুষ নৈতিকতার পরাকাষ্ঠা, তা নিরুপা রায়কে দিয়েছিল অন্তত কিছুদিনের জন্য বলিউডি মাতৃত্বের পরোয়ানা। এরপর ‘মা’ ছবিতে ধর্মেন্দ্র অভিনীত বিজয় চরিত্রের মায়ের ভূমিকায় তাঁকে আবারও দেখা গেল। পরপর দুই ছবিতে তাঁর ছেলের চরিত্রনাম বিজয়, এই প্রসঙ্গে, শোনা যায়, কফিহাউসের এক আড্ডায় কোনও লেখক নাকি গম্ভীরভাবেই প্রস্তাবনা রেখেছিলেন, নিরূপা রায়কে কি তবে ‘বিজয়ের মা’ বলে ডাকা যায়?
অমুকের মা, তমুকের মায়ের পরিচয়ে বহু নারী-পরিচিতিই ঢাকা পড়তে দেখেছে মধ্যবিত্ত বাঙালি। খুব চেনা এই লব্জ ঘিরে এই কফিহৌসি আপাত চটুল রসিকতার মধ্যেও তাই নারী-পরিচয়ের অবলুপ্তির একটা সমস্যাকূট থেকেই যায়। এর কিছুদিন পর ‘অমর আকবর অ্যান্টনি’-তে ভারতী-র চরিত্রে নিরূপা রায়কে দেখা যাবে, যেখানে ভারতী টিবি আক্রান্ত হয়ে, কেবল স্বামীর গলগ্রহ হবে না বলে চলে যাচ্ছে তিন সন্তানকে ছেড়ে, আত্মহননেচ্ছু হয়ে। তার আত্মঘাত আর হয়ে উঠছে না, বরং তাকে অন্ধত্বের শাস্তি আরোপ করছে কোনও দৈব শক্তি। তার স্বামী তার অবর্তমানে ছেলেদের রক্ষা করছে মহাত্মা গান্ধীর মূর্তির নিচে তাদের রেখে গিয়ে। জাতির জনকের পাদদেশ থেকে তারা ছিটকে পড়ছে স্ফুলিঙ্গের মতো, তিন ধর্মপরিচিতি নিয়ে, সেকুলার ভারতের তিন টুকরো হয়ে। কেউ পুলিশ হলে কেউ হচ্ছে প্রায় রবিন হুড, তো কেউ কাওয়ালি গায়ক। সদ্য আবিষ্কৃত অমিতাভ বচ্চনের পাশে এসে দাঁড়ালেন ‘ববি’-র পর বাউন্ডুলে প্রেমিক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত ঋষি কাপুর এবং পুলিশ হিসেবে বারবার পর্দায় আসা বিনোদ খান্না। ঘটনাচক্রে এই ছবিতেও বিনোদ খান্না পুলিশ, অমিতাভ বচ্চন আইনের আওতার বাইরে থাকা সামাজিক নায়ক, এবং ঋষি কাপুর প্রধানত প্রেমিক।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
রোজি থমাস তাঁর ‘স্যাংটিটি অ্যান্ড স্ক্যান্ডালস: দ্য মিথলজাইজেশন অফ মাদার ইন্ডিয়া’ নিবন্ধের শুরু করেছিলেন এক আশ্চর্য ঘটনা বলে। ‘মাদার ইন্ডিয়া’-র রাধাকে জোতদার সুখীলাল এসে কুপ্রস্তাব দেয়। ১৯৫৮ সালে ইউরোপে এই ছবির স্ক্রিনিংয়ে ছবির এই ঘটনার সূত্র ধরে পরিচালক মেহবুব খানকে প্রায় ত্রস্ত করে দিয়ে এক ইংরেজ বেমক্কা প্রশ্ন করে বসেন, ‘রাধা ওই জোতদারের সঙ্গে শুলেই তো ওর সব অভাব মিটে যেত, ও তা করল না কেন?’ ভারতীয় মাতৃত্বের ভেতরে থাকা সতীত্বর ধারণা তবে কি পাশ্চাত্যের কাছে ঠুনকো? এই প্রশ্ন নিয়ে ভাবনার অবকাশ থেকে যায়।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
তিন ধর্মপরিচিতি নিয়ে থাকা এই তিন হিন্দু সন্তান নায়ক শেষত কিন্তু তাদের মায়ের সঙ্গেই মিলিত হয়। যদিও এই গল্পের পিতৃকল্প অন্যতর। ‘দিওয়ার’-এর আদর্শবান আইনরক্ষক বাবা নয়, অপরাধের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে থাকা কিষাণলাল (প্রাণ) আদতে অমর, আকবর ও অ্যান্টনি নামের তিন ভারতকে সঁপে দিয়েছিলেন মহাত্মার আশ্রয়ে। শাহিদ আমিন ‘সাবঅলটার্ন স্টাডিজ’-এ পরে গান্ধীর সঙ্গে প্রান্তিক ভারতের সম্পর্কের এক অন্য নির্মাণ দেখাবেন, যার পূর্বসূত্রটুকু ছিল হয়তো ‘ঢোঁড়াই চরিত মানস’-এ।
রোজি থমাস তাঁর ‘স্যাংটিটি অ্যান্ড স্ক্যান্ডালস: দ্য মিথলজাইজেশন অফ মাদার ইন্ডিয়া’ নিবন্ধের শুরু করেছিলেন এক আশ্চর্য ঘটনা বলে। ‘মাদার ইন্ডিয়া’-র রাধাকে জোতদার সুখীলাল এসে কুপ্রস্তাব দেয়। ১৯৫৮ সালে ইউরোপে এই ছবির স্ক্রিনিংয়ে ছবির এই ঘটনার সূত্র ধরে পরিচালক মেহবুব খানকে প্রায় ত্রস্ত করে দিয়ে এক ইংরেজ বেমক্কা প্রশ্ন করে বসেন, ‘রাধা ওই জোতদারের সঙ্গে শুলেই তো ওর সব অভাব মিটে যেত, ও তা করল না কেন?’ ভারতীয় মাতৃত্বের ভেতরে থাকা সতীত্বর ধারণা তবে কি পাশ্চাত্যের কাছে ঠুনকো? এই প্রশ্ন নিয়ে ভাবনার অবকাশ থেকে যায়। সর্বোপরি, মাতৃত্ব, সতীত্ব বাদ দিয়ে আপস না করা, রুখে দাঁড়ানো ভারতীয় নারীকে সেই সাহেব উপনিবেশের ভোগী দৃষ্টিতেই দেখলেন। রাধার সন্তান বিরজুকে কৃষ্ণ হিসেবে কল্পনা করে কোনও কোনও সমালোচক যে ইডিপাস কমপ্লেক্সের সূত্র টেনেছেন, তা মৈনাক বিশ্বাস উল্লেখ করেছিলেন। পরবর্তীতে অমিতাভ বচ্চনের নায়ককল্পেও কৃষ্ণের উপমা মিশেছে আশিস নন্দীদের আলোচনার সূত্রে, কিন্তু সেখানে রাধার বদলে যেন হাজির হচ্ছেন যশোদা।
উত্তর কলকাতার কোনও হল থেকে ‘দিওয়ার’ দেখে বেরিয়ে হাতিবাগানের ভিড়ে হারিয়ে গিয়ে এক নাবালক নাকি কেঁদে উঠেছিল, ‘মেরে পাস মা নেহি হ্যায়’ বলে, এমন একটি গল্প প্রায় মিথে পরিণত। মা আদতেই ‘দিওয়ার’-এর সৎ পুলিশ পিতার মূল্যবোধের বাহক হয়ে থেকেছে। তার ছেলে বিরজুর মতোই হয়তো সেই মূল্যবোধের নিগড় ভেঙেছে, আর রাধার মতো, মা নিজেই পুত্রহন্তা না হয়ে উঠে ভ্রাতৃহত্যার মধ্যে দিয়ে ট্র্যাজেডি সম্পূর্ণতা পেয়েছে সেখানে। প্রসঙ্গত, এই সাতের দশকেই আরেক পুলিশ পিতার আইনকে বুড়ো আঙুল দেখানো পুত্রসন্তান হয়ে উঠবে বাণিজ্যনগরীর ত্রাস, এবং পরবর্তী কয়েক দশক বলিউডকে আড়ালে সেইই নাকি শাসন করবে, তবে তা অন্য কিসসা।
(চলবে)
…পড়ুন জনতা সিনেমাহল-এর অন্যান্য পর্ব…
পর্ব ১১। ইন্দ্রজাল কমিকস-এর গ্রামীণ নায়ক বাহাদুর পাল্পে এসে রংচঙে হল
পর্ব ১০। দু’টাকা পঁচিশের টিকিটে জমে হিরোইনের অজানা ফ্যানের স্মৃতি
পর্ব ৯। খান্না সিনেমায় নাকি পৌরাণিক সিনেমা চলছে
পর্ব ৮। পাড়াতুতো ট্র্যাজেডিতে মিলে গেলেন উত্তমকুমার আর রাজেশ খান্না
পর্ব ৭। পাড়ার রবিদা কেঁদেছিল ‘কাটি পতঙ্গ’ আর ‘দিওয়ার’ দেখে, সাক্ষী ছিল পাড়ার মেয়েরা
পর্ব ৬। যে কলকাতায় পুলিশ-পকেটমার মিলেমিশে গেছে, সেখানে দেব আনন্দ আর নতুন করে কী শিরশিরানি দেবেন?
পর্ব ৫। হিন্দি ছবির পাপ ও একটি অ্যাডাল্ট বাড়ির গল্প
পর্ব ৪। দেব আনন্দ, একটি বোমা ও অন্ধকারে হাত ধরতে চাওয়ারা
পর্ব ৩। অন্ধকারে ঢাকা পড়ল কান্না থেকে নিষিদ্ধ স্বপ্ন!
পর্ব ২। ‘জিনা ইঁয়াহা মরনা ইঁয়াহা’ উত্তর কলকাতার কবিতা হল না কেন?
পর্ব ১। সিনেমা হলে সন্ত্রাস ও জনগণমন-র দলিল
আমি যখন মস্কোয় ছিলাম, সেই সময় ইলাদি মস্কোয় এসেছিলেন, কিন্তু তখন তাঁর সঙ্গে আমার দেখা হয়নি, উনি এসেছিলেন আরও কয়েকজন কমরেডের সঙ্গে মস্কোর পার্টি-স্কুলে মাস ছয়েকের জন্য মার্কসবাদ-লেলিনবাদের একটি শিক্ষাশিবিরে যোগ দিতে। উনি যে এখানে এসেছেন, তা দেশেও অনেকেই জানে না। সংবাদটা গোপনীয়।