রবি ঠাকুরের বিধুর ছায়া কি ভেসে ওঠে তাঁর ছবিপটেও, সেজে ওঠে জন্মদিনের চিত্রমালারূপে? বহু জন্মদিনে গাঁথা জীবনে তিনি কি কোনও বিশেষ ভাবনার দিকে চোখ মেলেছেন? না কি জন্মদিনের মুখর তিথি যারা ভুলে থাকে– তাদের দলে নাম লেখাতে চেয়েছিলেন তিনিও? কখনও কি নিজের সমস্ত কীর্তি ভেঙে দিয়ে কেবল ‘এই মাটিতে’ তাঁর ‘বিস্মিত প্রণাম’টুকু রেখে যাওয়ার প্রবল আকুতি জেগেছিল মনের গভীরে? কোথাও আবার অন্য রবি ঠাকুর ফুটে ওঠে।
১৩.
নিজের জন্মদিনে একাধিক কবিতা লিখেছেন রবীন্দ্রনাথ। কত কবিতা, গান রচিত হয়েছে জন্মদিন উপলক্ষেও। কিন্তু জন্মদিনের নিভৃত নিরালায় বসে ছবি এঁকেছেন, সে খবর নেই আমাদের কাছে। থাকার কথাও নয়। কবির জন্মদিনের অনুষ্ঠান যে ক্রমে উৎসবের রূপ নিয়েছিল, তা অজানা নয়। সে আর তাঁর দ্বারা নিয়ন্ত্রিত থাকেনি– বিশেষ করে শেষের দিকে, যখন তিনি মগ্ন চিত্রকর। তবুও প্রায় আড়াই হাজার ছবির মাঝে জন্মদিনের তারিখ-যুক্ত ছবি খুঁজতে চাইলে পাওয়া দুষ্কর! যদিও নানা সময়ে আঁকা নিজের মুখের একগুচ্ছ ছবি আমাদের হাতে আসে। যা প্রধানত শেষবেলাকার ছবির ফসল। তবে কি রবি ঠাকুরের আঁকা সেই আত্মপ্রতিকৃতির সঙ্গে ওঁর জন্মদিনকে মিলিয়ে নেব? নিজেকে নতুন চোখে দেখা, নতুন করে এই চাওয়া– সেই কি তাঁর সত্যিকার জন্মদিন? জীবনপ্রান্তের এক ২৫ বৈশাখে তাঁর কলম লিখেছিল, ‘তোমরা রচিলে যারে/ নানা অলংকারে/ তারে তো চিনিনে আমি,/ চেনেন না মোর অন্তর্যামী/ তোমাদের স্বাক্ষরিত সেই মোর নামের প্রতিমা।/ বিধাতার সৃষ্টিসীমা/ তোমাদের দৃষ্টির বাহিরে…’।
রবি ঠাকুরের সেই বিধুর ছায়া কি ভেসে ওঠে তাঁর ছবিপটেও, সেজে ওঠে জন্মদিনের চিত্রমালারূপে? বহু জন্মদিনে গাঁথা জীবনে তিনি কি কোনও বিশেষ ভাবনার দিকে চোখ মেলেছেন? না কি জন্মদিনের মুখর তিথি যারা ভুলে থাকে– তাদের দলে নাম লেখাতে চেয়েছিলেন তিনিও? কখনও কি নিজের সমস্ত কীর্তি ভেঙে দিয়ে কেবল ‘এই মাটিতে’ তাঁর ‘বিস্মিত প্রণাম’টুকু রেখে যাওয়ার প্রবল আকুতি জেগেছিল মনের গভীরে? কোথাও আবার অন্য রবি ঠাকুর ফুটে ওঠে। যিনি– ‘সব কর্ম, সব তর্ক, সকল সন্দেহ,/ সব খ্যাতি, সকল দুরাশা’ দূর করে কেবল বলতে চান– ‘আমি যাই, রেখে যাই মোর ভালোবাসা’। শুধু একমুঠো ভালোবাসার জন্যে এমন আকুল আকুতি? জানতে ইচ্ছে করে, জন্মদিনের কবিতায়, গানে যে সুরটি বেজে ওঠে সে কি ফুটতে চায় তাঁর ছবির ভাষাতেও? কীভাবে বাঁধতে হবে ছবি ও গানের সেই আশ্চর্য সেতুটিকে? ছবিতে যে অব্যক্ত বিষণ্ণতা, সে কি কোথাও মুখ ঢেকেছে ক্লান্ত মুখোশের ছদ্মবেশে? সেকথা কে বলতে পারে আজ!
সেইসব ছবির মধ্যে দেখি, জীবনের প্রান্তে পৌঁছে যাওয়া আষাঢ়ের প্রথম দিনে চন্দননগরে আঁকা হয়েছে এক অসাধারণ আত্মপ্রতিকৃতি। কোনও উজ্জ্বল রঙের উপস্থিতি নেই সে ছবিতে। হালকা আর ঘন বাদামিতে ভরে উঠেছে সমগ্র মুখমণ্ডল। কেবল নাকের ওপর, চোখের তারায় এসে পড়েছে সামান্য ম্লান আলো! সে আলোর ফুলকি কোনও রং দিয়ে গড়া নয়, ছেড়ে যাওয়া কাগজের একফালি সাদা। পাকা জলরঙের ছবি আঁকিয়েরা যে দুরূহ দক্ষতায় ছেড়ে রাখে কাগজের ত্বক– ঠিক তেমন করে মৃদু আলোকবিভা ছড়িয়ে দিয়েছেন মুখমণ্ডলের কপাল, চোখ, দীর্ঘ নাক বা ওষ্ঠাধরের আনাচ-কানাচে। সেই আশ্চর্য ছবি দেখে শঙ্খ ঘোষের মনে হয়েছে– ‘কালো পাথরের বুক ভেঙে যেন নেমে আসছে আগুনের ঢল’। ‘গাঢ় খয়েরি হলুদে মেশানো সেই মুখের ছবি’ শঙ্খ ঘোষকে মনে করিয়ে দিয়েছে এ ছবি আঁকার দিন দশেক আগে লেখা ‘পত্রপুট’-এর কবিতার কথা, “যেখানে কবি লিখেছিলেন: ‘বিরহের কালো গুহা ক্ষুধিত গহ্বর থেকে/ ঢেলে দিয়েছে ক্ষুভিত সুরের ঝর্না রাত্রিদিন’।” একথাও মনে হয়েছে ‘হয়তো-বা কোনো প্রচ্ছন্ন যোগ ছিল এই কবিতার সঙ্গে ওই ছবির’। কারণ ছবিতে স্পষ্টতই চোখে পড়ে ‘কোনো কালো গুহার ক্ষুধিত গহ্বরের কথা, আগুনের হলকায় ওখানেও যেন নেমে আসছে ক্ষুভিত ঝর্নাই’। তবে কবিতার বিস্তার সেখানে এগিয়ে যায় আরও অন্য অভিমুখে। কবিতায় লেখা হয় ‘আরো অনেক কথা, তার একপাশে ছিল ‘রুদ্র মানবের আত্মপরিচয়’ আর অন্যপাশে ‘ক্ষীণ পাণ্ডুর আমি’। ‘বঞ্চিত জীবন’ আর ‘সার্থক’– কথা দু’টি পাশাপাশি থেকে যেন কোনও বৈপরীত্যের সামঞ্জস্য তৈরি করেছিল ওই কবিতায়’– শঙ্খ ঘোষের মনে হয় এমনটাই।
তিনি প্রশ্ন করেন, ‘নিজের মুখের ওই ছবিরও ভিতরে কি প্রচ্ছন্ন ছিল না সেটা?’ কী আশ্চর্য, অগ্রজ এক কবির ছবি পরবর্তী কালের আরেক কবির সামনে যে বার্তা মেলে ধরে, তা আমাদের মতো দর্শক-পাঠককেও ভাবিয়ে তোলে। রবীন্দ্রনাথের আরও কিছু আত্মপ্রতিকৃতির দিকে খেয়াল করলে দেখব সেগুলোও তাঁর দিনান্তবেলার শেষের ফসল। সেসব ছবি জন্মদিনে না আঁকলেও বৈশাখে আঁকা তার দুয়েকটা। তেমনই অনবদ্য দু’খানি ছবি এঁকেছেন ১০ বৈশাখ আর ১১ বৈশাখে। প্রথমটা ধূসর প্যাস্টেলের টানে আঁকা, সাদা কাগজের গা থেকে ধীরে ধীরে ভেসে উঠেছে কবির অস্ফুট মুখাবয়ব। কী এক জিজ্ঞাসা জড়ানো আছে চোখের তারায়। একেবারে সামনে ফেরা এই মুখমণ্ডল অধিকার করেছে সম্পূর্ণ চিত্রপট। যেখানে রঙের কোনও উগ্রতা নেই, স্বচ্ছ স্ফটিকের মতো সেই বর্ণপ্রতিমার ভিতর দিয়ে যেন অবাধে আলো-বাতাস খেলে যায়।
কিন্তু পরের দিনেই আঁকলেন যে আত্মপ্রতিকৃতি, তা ওপর থেকে নেমে আসা আগুন লাগানো সোনালি রঙের ঝরনা। অন্ধকার পাহাড়ের গা বেয়ে নেমে আসা গলিত লাভার স্রোত বললেও সে বর্ণনা অসম্পূর্ণ থেকে যায়। পুলিনবিহারী সেন এই ছবিকে ‘নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গ’ বলে অভিহিত করেছেন। ভেবে দেখলে, পর পর দু’দিনে আঁকা ছবিতে এই ভয়ংকর বৈপরীত্য কীসের ইঙ্গিত– যা আমাদের মনকে তীব্রভাবে আঘাত করে? শঙ্খ ঘোষ বুঝি একেই বলতে চেয়েছেন ‘বিরোধ আর তীব্রতার কোনো নাটকীয় চাপ’। তাঁর চোখে এইসব মুখমণ্ডলের কোথাও আর্ত যিশুর আদল ফুটে ওঠে। কোথাও ‘মুখের চাপা বাদামি আভা থেকে বা চোখের দৃষ্টি থেকে জেগে ওঠে করুণা-অভিমানের তপ্ত আবেগ’। এ তো সত্যিই। আত্মপ্রতিকৃতির অভিব্যক্তিতে কোথাও উপচে পড়ে চাপা ক্ষোভের সুর, কখনও ঘনীভূত হয় ‘কোনো প্রত্যাহার আর অবিশ্বাস’। এই সূত্রে শঙ্খ ঘোষ টেনে এনেছেন ‘প্রান্তিক’-এর কবিতার সেই ছত্র– ‘দেখিলাম অবসন্ন চেতনার গোধূলিবেলায়/ দেহ মোর ভেসে যায় কালো কালিন্দীর স্রোত বাহি/ নিয়ে অনুভূতিপুঞ্জ’। কী আশ্চর্য! ছবি আর কবিতার কি অদ্ভুত সমাপতন! আবার এ প্রশ্নও তো মনে জাগে, কবির আত্মপ্রতিকৃতির গভীরে প্রবেশ করতে আমাদের কি শক্ত করে ধরতে হবে আরেক কবির ‘হাতখানি’?
তবে এটা স্পষ্ট যে, সত্তর বছর পেরিয়ে আসা রবি ঠাকুর নিজেকে দু’ভাগে বিভক্ত করে নিয়েছিলেন। তার প্রথমটা যদি কবি রবীন্দ্রনাথ তো দ্বিতীয় ভাগে রইলেন ‘পোটো’ রবি ঠাকুর। দেশের মানুষের প্রতি ক্ষোভ আর অভিমান নিয়ে সেই ছবিঠাকুর একদা দিলীপকুমার রায়কে লিখেছেন ‘আমার ছবি ও গান সমুদ্রের দুই তীরে দুই নীড়ে ভিন্ন বাসায় থাকবে’। তাঁর একগুচ্ছ আত্মপ্রতিকৃতি কি সেই ক্ষোভ আর অভিমান বুকে নিয়ে আমাদের দিকে চেয়ে আছে?
…পড়ুন ছবিঠাকুর-এর অন্যান্য পর্ব…
পর্ব ১২: আমেরিকায় কে এগিয়ে ছিলেন? ছবিঠাকুর না কবিঠাকুর?
পর্ব ১১: নন্দলাল ভেবেছিলেন, হাত-পায়ের দুয়েকটা ড্রয়িং এঁকে দিলে গুরুদেবের হয়তো সুবিধে হবে
পর্ব ১০: ১০টি নগ্ন পুরুষ স্থান পেয়েছিল রবীন্দ্র-ক্যানভাসে
পর্ব ৯: নিরাবরণ নারী অবয়ব আঁকায় রবিঠাকুরের সংকোচ ছিল না
পর্ব ৮: ওকাম্পোর উদ্যোগে প্যারিসে আর্টিস্ট হিসেবে নিজেকে যাচাই করেছিলেন রবি ঠাকুর
পর্ব ৭: শেষ পর্যন্ত কি মনের মতো স্টুডিও গড়ে তুলতে পেরেছিলেন রবীন্দ্রনাথ?
পর্ব ৬: রবীন্দ্র চিত্রকলার নেপথ্য কারিগর কি রানী চন্দ?
পর্ব ৫: ছবি আঁকার প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ পরলোকগত প্রিয়জনদের মতামত চেয়েছেন
পর্ব ৪: প্রথম ছবি পত্রিকায় প্রকাশ পাওয়ামাত্র শুরু হয়েছিল বিদ্রুপ
পর্ব ৩: ঠাকুরবাড়ির ‘হেঁয়ালি খাতা’য় রয়েছে রবিঠাকুরের প্রথম দিকের ছবির সম্ভাব্য হদিশ
পর্ব ২: রবীন্দ্রনাথের আঁকা প্রথম ছবিটি আমরা কি পেয়েছি?
পর্ব ১: অতি সাধারণ কাগজ আর লেখার কলমের ধাক্কাধাক্কিতে গড়ে উঠতে লাগল রবিঠাকুরের ছবি