রামানন্দ বালা। বয়স ষাট ছুঁই ছুঁই। কয়েকটা দাঁত খোয়া গিয়েছে, তবে তার চেয়ে বেশি নজরে পড়ে ওঁর হাসি। পরনে নীল-সাদা চেক শার্ট ও লুঙ্গি। সামনে রাখা ছোট বাক্সে কাঠি আইসক্রিম। তবে যে-সে নয়– নারকেল আইসক্রিম। স্বাদে অতুলনীয়, ছবি দেখে চিনে রাখুন, কখনও রাস্তায় পাকড়াও করে আইসক্রিম খেয়ে আমাদের না হয় ধন্যবাদ দেবেন। ওঁকে আপাতত পাওয়া গেল ইডেন গার্ডেনস টিকিট কাউন্টারের বাইরে। যা কথা হল, রইল রোববার.ইন-এর পাঠকদের জন্য। সাক্ষাৎকার নিলেন শুভদীপ রায় ও সম্বিত বসু। প্রচ্ছদের ফোটোগ্রাফ: অমিত মৌলিক
কী বিক্রি করছেন?
আইসক্রিম। নারকেল আইসক্রিম। দশ টাকা।
ভালো হবে? ভালো জলে করা?
দারুণ সুন্দর খেতে। দুধ, মালাই, এলাচ আর নারকেল দিয়ে তৈরি। জল তো নেই। এ কোম্পানির আইসক্রিম না দাদা। নিজের বানানো। নারকেল আইসক্রিম। কোম্পানির আইসক্রিমের থেকে অনেক ভালো টেস্ট। আপনারা খেয়েই দেখুন।
(সেই কাঠের বাক্সের ডালা খুলে গেল। দেখলাম, সাদা বরফের কুচির মতো, বহু আইসক্রিম পড়ে রয়েছে সেখানে। সকালে আমরা যখন বেরিয়েছি, তখন দিব্যি ঘাড়ের ওপর চড়া রোদ এসে পড়েছিল। এখন মৃদু মেঘলা, হাওয়া দিচ্ছে। বাইরের ঘাম শুকোচ্ছে, কিন্তু অন্তরের? ফলে নারকেল আইসক্রিমে একেবারেই না করা চলে না।)
নিজেই বানান বললেন না?
হ্যাঁ, নিজেই। আজ থেকে না, সেই ছোট্টবেলা থেকে, ১৫ বছর বয়স থেকেই। অন্য সময় ধর্মতলার নানা জায়গায় ঘুরে ঘুরে বিক্রি করি। এখানে, এই ইডেন গার্ডেনসের বাইরে যদি পুরো বিক্রি না হয়, তাহলে আবার নিউ মার্কেটে বেচব।
কী মনে হয়? আজ কি বিক্রি হয়ে যাবে?
দেখা যাক। মনে তো হয় হবে।
আজ না হয় ইডেন গার্ডেনস, এমনি সময় বিক্রি কম হলে কী করেন?
ফেরার ট্রেনে বেচে দিই। আর যদি সব বিক্রি হয়ে যায়, তাহলে গল্পগাছা করি, ট্রেনের হাওয়া খাই। মন ভালো থাকে অন্যদিনের চেয়ে।
ট্রেন? কোথা থেকে আসেন আপনি?
বনগাঁ। সকাল ৬টা ৩৫-এর মাঝেরহাট লোকাল ধরি।
আসার সময় বেচেন না?
একটু বেলা গড়ালে মাঝে মাঝে বিক্রি হয়। অনেকটা পথ তো! তবে বেশিরভাগ সময়ই তো ভেন্ডারে। অনেক সময় বৃষ্টি হল, তখন তো অত আইসক্রিম বিক্রি হয় না গরমের দিনের মতো। সেসময়টায় বেচতে হয় ফেরার সময়।
এই যে প্রবল গরম পড়েছিল কয়েক দিন, কেমন বিক্রি হল?
ভালো হয়েছে। এমনি সময়ের তুলনায় অনেকটাই বেশি। আনতামও বেশি করে।
শুধু আইসক্রিমই বেচেন?
না, আইসক্রিম গ্রীষ্মকালে, শীতকালে চা। মেটিয়াবুরুজ হাটে চা বেচি সোয়েটার পরে।
আচ্ছা, খেলা ভালো লাগে?
হ্যাঁ, খেলা ভালো লাগবে না! খেলা ভালো লাগবে না তো কী ভালো লাগবে!
কোনটা বেশি ভালো লাগে, ফুটবল, ক্রিকেট, নাকি অন্য কিছু?
আমার ক্রিকেটই ভালো লাগে।
কেন? ক্রিকেটই ভালো লাগে কেন?
ক্রিকেট হল শক্ত খেলা। সে আপনি যত বড়ই প্লেয়ার হন না কেন! এক বলেই খেলা শেষ হয়ে যেতে পারে। আবার একবলেই সেরা হয়ে যেতে পারেন। ফুটবলে ওই চান্সটা বারবার পাওয়া যায়। ক্রিকেটের মতো না।
ক্রিকেট দেখা হয়?
কখন দেখব আর? বাড়ি ফিরি। পরের দিনের কাজ করি। একটু রেস্ট নিই। বাড়ির কিছু কাজ থাকে করি। তারপর ঘুম।
শেষ কোন ম্যাচ দেখছিলেন, যা মনে আছে?
২০১১ সালে, ভারত বিশ্বকাপ জিতেছিল সেবার, মনে আছে পাড়ার ক্লাবে হইহল্লা করেছিলাম। ছেলেপুলে বন্ধুবান্ধব মিলে খেলা দেখলে যা হয়। তারপর থেকে তেমন দেখিনি। তবে আমার ছেলেমেয়েদের ক্রিকেটের ব্যাপারে খুঁটিনাটি জ্ঞান রয়েছে।
শুধু ম্যাচের দিনগুলোয় এখানে আসা হয়?
হ্যাঁ। এই দিনগুলোতেই। তবে সারাক্ষণ এখানে থাকি না। যদিও এখানে কেউ বসতে বারণ করে না।
আজ কাদের ম্যাচ আছে জানেন?
কলকাতা আর মনে হয় মুম্বই, তাই না?
হ্যাঁ, খোঁজখবর রাখেন তার মানে!
ও-ই টুকটাক।
সেই তো ভোরবেলা বেরোন, দুপুরে খাওয়া-দাওয়া কোথায় হয়?
সকাল ৯টার সময় বাবুঘাটের হোটেলে খেয়ে-দেয়ে আসি। সপ্তাহে চার-পাঁচদিন আসি। তারপর বেচতে বেচতে এই ধর্মতলা, শিয়ালদহ।
আপনার আইসক্রিমে তো নারকেল প্রচুর, আপনার লাভ হয় তো?
হ্যাঁ, হয় গো দাদা। ১০ টাকার আইসক্রিমে ধরে নিন ৪ টাকা লাভ হয়ই। তাও আপনি যে নারকেল খাচ্ছেন, তা বাইরের নারকেল। নইলে আরও ভালো টেস্ট হত। এ রাজ্যে এখন নারকেলের ফলন কমে গিয়েছে।
এ রাজ্যে নারকেলের ফলন কমুক বা বাড়ুক, ওঁর নারকেল আইসক্রিমের বিক্রি যেন না কমে– একথা বলে আমরা সরে এলাম ওঁর কাছ থেকে। ওঁকে ঘিরে ধরল আরও কিছু খরিদ্দার। নারকেলের স্বাদ এই সাক্ষাৎকার যখন লিখে চলেছি, এখনও মুখে লেগে রয়েছে। তা অনুবাদের যোগ্যতা আমাদের নেই। ক্ষমা করবেন।
সহায়তা: রোদ্দুর মিত্র, সুমন্ত চট্টোপাধ্যায়, শঙ্খ বিশ্বাস