জন্ম কলকাতার খিদিরপুরে, বেড়ে ওঠা ঢাকার তাঁতিবাজারে আর শাহাদাত মিরপুরে। বাপ-মরা মেয়েটা পরিবারের ভাত-কাপড় জোটাতে নিজের সুখসাধ জলে ফেলে দিয়েছিল। একজন প্রেমিক ছিল তার। একজনই প্রেমিক ছিল তার। কবিতা! শত অভাবেও কবিতা ছেড়ে যায়নি তাকে। মনে মনে ঠিক করে রেখেছিল তার প্রথম কবিতার বইয়ের নাম হবে ‘সূর্যজ্যোতির পাখি’। সে বই বের হয়নি আর। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের প্রথম নারী শহিদ কবি মেহেরুন্নেসা নিজেই সূর্যজ্যোতির পাখি হয়ে উড়ান দিয়েছিল।
১২.
মেহেরুন্নেসা। বাংলাদেশ
পাঁচ বছরের মেয়েটা ফ্যালফ্যাল করে দেখছে। দাউ-দাউ আগুনের তাত এসে লাগছে তার নরম কপালে। ওরা তাদের কাপড়ের দোকান পুড়িয়ে দিচ্ছে! ১৯৪৭-এর কলকাতা। দাঙ্গার আঁচ শহর জুড়ে। সেই আঁচে খাক হয়ে যাচ্ছে মেয়েটার বাবার দোকান, তাদের সংসারের আয়পয়ের রাস্তা। এরপর সে কী করবে? এমনিতেই মুসলমানের মেয়ে বলে ইশকুল জোটেনি, খাওয়াও জুটবে না এবার? কী হবে! কী হবে আবার? দুই ছেলে আর দুই মেয়েকে নিয়ে আবদুর রজ্জাক আর নুরুননেসার সচ্ছল সংসারে অভাব গুঁড়ি দিয়ে ঢুকবে এবার। পুতুল ফেলে আব্বুর সঙ্গে কয়লার দোকানে কাজ করতে যাবে ছোট্ট মেহেরুন। পাশের দোকানিরা কটূক্তি করবে। ঘরে বেড়ে চলা অভাব আর বাইরে বেড়ে চলা অসহিষ্ণুতা মিলে পেড়ে ফেলবে পুরো পরিবারটাকে। তারপর একদিন জলের দরে কলকাতার বসতবাড়িটা বেচে দিয়ে পূর্ব পাকিস্তানে পাড়ি দেবে মেহেরুনের পরিবার।
১৯৫০-এ ঢাকায় এসে তাঁতিবাজারের ভাড়াবাড়িতে মাথা গোঁজা ইস্তক ফুরসত মেলেনি মেহেরুন্নেসার। বাবা ব্যবসায় অসফল হয়ে চাকরি করছেন নাবিসকো আর হক বিসকুটের কারখানায়। বড় হতে না হতেই পান্তা ফুরনো থালায় নুন জোগাতে মেহেরুন্নেসা এটা-ওটা-সেটা করে চলেছেন। তারপর একদিন অনুলিখনের কাজ করছেন বাংলা একাডেমিতে আর ইউএসআইএস লাইব্রেরিতে। প্রুফ দেখছেন পত্রিকা অফিসে। তাতেও সংকুলান না হওয়ায় বিদেশি রেডিও কারখানাতেও কাজে ঢুকছেন। অভাবে অভাবে বাসাবদল অব্যাহত, মিরপুরে এসে খানিক থিতু হওয়া। পরিবারের ভাত-কাপড় জোটাতে নিজের সুখসাধের পুরোটাই জলে ফেলে দিয়েছিলেন। নিজের জীবন বলতে তেমন কিছুই বেঁচে ছিল না আর। শুধু… একজন প্রেমিক ছিল তাঁর। একজনই প্রেমিক ছিল তাঁর। কবিতা! শত অভাবেও কবিতা ছেড়ে যায়নি তাঁকে। রাত্তিরের এককুচি নিভৃতিতে কবিতার সঙ্গেই তাঁর একান্ত ব্যক্তিগত সংলাপটুকু ছিল।
………………………………………………………………………………………………………………………………..
২৩ মার্চ সকাল ১০টায় পাকিস্তান প্রজাতন্ত্র দিবসে মিরপুরের ৬ নম্বর সেকশনের ডি-ব্লক, ১২ নম্বর রোডে নিজের বাড়িতে বাংলাদেশের মানচিত্র আঁকা পতাকা উড়িয়ে দিয়েছিলেন মেহেরুন্নেসা। ১৯৭১-এ পূর্ব পাকিস্তানের পরিস্থিতি সম্পর্কে বিন্দুমাত্র ধারণা যাঁদের আছে, তাঁরা বুঝবেন– অসীম সাহস কতটা থাকলে রাজাকারদের ভিড়ে ঠাসা মিরপুরে স্বাধীন বাংলার পতাকা ওড়ানোর ঝুঁকি নিতে পারে কেউ। এবার সরাসরি খুনি-তালিকায় উঠে এল তাঁর নাম।
………………………………………………………………………………………………………………………………..
তোমার ছন্দ বাণীতে জ্বলুক
শত দুঃখের চিতা,
জীবনসারথি তোমারে পেয়েছি
ব্যথিত মনের মিতা।
অবশ্য ব্যথিত মন নিয়েই বেঁচে থাকাটাকে উদযাপন করেননি কোনও দিনই। বিক্ষোভের বীজ তাঁর কবিতায় ছিলই। ছিল কাজী নজরুল ইসলামের স্পষ্ট প্রভাবও।
নয়ালী দিনের নয়ালী নকীব! নয়ালী নওজোয়ান
দিলের কাবায় আবার সুবে-সাদিকে দিল আজান
ঘুম ভেঙে গেছে জাগার কালেমা শুনে,
খোশ তাকদের জোশ আসে পুনঃ কালিজার
ম্লান ঘুনে।
তারপর একদিন প্রিয় বিদ্রোহী কবিকেই লিখেলেন–
শোন নজরুল! তেরোশত এই
নতুন চুয়াত্তরে,
উঠে এসো তুমি
ক্ষুব্ধ বংগ আকাশে ভয়াল
করাল মূর্তি ধরে।
সেসময়ে তাঁর কবিতা নিয়মিত বেরচ্ছে ‘দৈনিক পাকিস্তান’, ‘মাসিক মোহাম্মদী’, ‘ইত্তেফাক’, ‘ললনা’-র মতো সব নামী পত্রপত্রিকায়।
’৬৯-এ বাবা ক্যানসারে মারা গেলেন। পরিবারের পুরো দায় এখন মেহেরুন্নেসার ওপর! আর ওই উনসত্তরেই পূর্ব পাকিস্তানে মুক্তিযুদ্ধের তরঙ্গ মেহেরুন্নেসার কবিতায় আরেকটা বাঁকবদল ঘটিয়ে দিয়েছিল। উনসত্তর, সত্তর, একাত্তরে প্রগতিশীল কবিতার মহলে মেহেরুন্নেসা রীতিমতো পরিচিত মুখ ছিলেন। মুক্তির মিছিলেও। প্রাণে ভরপুর শ্যামলা ছিপছিপে মেয়েটির মুখের হাসি নেভাতে পারেনি অনটন আর পরিশ্রম। কবিতার হাত ছাড়েননি একটা দিনের জন্যও। উনসত্তরে বাংলা একাডেমি চত্বরে দাঁড়িয়ে আইয়ুব-শাহিকে শেল হেনে লেখা ‘প্রভুকে নয়, বন্ধুকে’ কবিতাটির পাঠ আলোড়ন তুলেছিল তাঁর আরও অনেক কবিতার মতো। মৃত্যুর মাত্র কয়েকদিন আগে বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে লেখক সংগ্রাম শিবির যে বিপ্লবী কবিতা পাঠের অনুষ্ঠান করেছিল, তাতে হাসান হাফিজুর রহমান, আহসান হাবীব, শামসুর রাহমান, সৈয়দ শামসুল হক, আলাউদ্দিন আল আজাদ, হুমায়ুন কবির-সহ অন্য কবিদের সঙ্গে স্বরচিত কবিতা পাঠে অংশ নিয়ে মেহেরুন্নেসা ‘জনতা জেগেছে’ নামে তাঁর সদ্যরচিত সেই অমোঘ কবিতাটি পাঠ করেছিলেন।
মিরপুর ছিল মুক্তিযুদ্ধের শত্রুপক্ষের ঘাঁটি। অবাঙালিদের একটা বড় অংশকে সঙ্গে নিয়ে সেখানে অতিসক্রিয় ছিল পাক-পন্থী রাজাকারেরা। মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় আলোকিত মানুষদের পক্ষে দাঁড়ানোর জন্য মিরপুরে কবি কাজী রোজী আর মেহেরুন্নেসার উদ্যোগে গড়ে উঠেছিল ‘অ্যাকশন কমিটি’। ‘মীরপুরের জহ্লাদ’ নামে কুখ্যাত কাদের মোল্লার সাঙ্গপাঙ্গদের বিষনজরে পড়াটা তো স্বাভাবিকই ছিল! তারপর… ২৩ মার্চ সকাল ১০টায় পাকিস্তান প্রজাতন্ত্র দিবসে মিরপুরের ৬ নম্বর সেকশনের ডি-ব্লক, ১২ নম্বর রোডে নিজের বাড়িতে বাংলাদেশের মানচিত্র আঁকা পতাকা উড়িয়ে দিয়েছিলেন মেহেরুন্নেসা। ১৯৭১-এ পূর্ব পাকিস্তানের পরিস্থিতি সম্পর্কে বিন্দুমাত্র ধারণা যাঁদের আছে, তাঁরা বুঝবেন– অসীম সাহস কতটা থাকলে রাজাকারদের ভিড়ে ঠাসা মিরপুরে স্বাধীন বাংলার পতাকা ওড়ানোর ঝুঁকি নিতে পারে কেউ। এবার সরাসরি খুনি-তালিকায় উঠে এল তাঁর নাম। শেষটুকু আমরা বরং শুনি আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে দেওয়া মেহেরুন্নেসার বন্ধু ও সহযোদ্ধা কবি কাজী রোজীর দেওয়া জবানবন্দিতে।
“একাত্তরে নিহত কবি মেহেরুন্নেসা আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিল। আমরা একই এলাকায় থাকতাম। একাত্তরে মিরপুরে অবাঙালি ও বিহারীরা বাঙালিদের ভীষণভাবে অপমানিত ও লাঞ্ছিত করত। এ থেকে রেহাই পাওয়ার জন্য ওই নির্বাচনের সময় আমরা একটা অ্যাকশন কমিটি গঠন করি। আমি ছিলাম ওই কমিটির সভাপতি, কবি মেহেরুন্নেসা-সহ আরও অনেকে ছিল সদস্য। এরই মধ্যে চলে আসে ২৫ মার্চ। সেদিন সকালে আমি মিটিং করছিলাম। বুঝতে পারছিলাম একটা কিছু ঘটতে যাচ্ছে। মিটিং শেষ করে বাসায় ফেরার পর খবর পেলাম, আমার ও কবি মেহেরুন্নেসার বাসায় তল্লাশি হবে। কারণ, এ্যাকশন কমিটিতে আমরা দুজন ছিলাম নারী সদস্য। আমি যখন জানতে পারলাম, আমার বাসায় তল্লাশি হবে, তখন মেহেরুন্নেসার বাসায় খবর পাঠালাম। বললাম, আমি আজই বাসা ছেড়ে চলে যাব। তোমরাও অন্যত্র চলে যাও। এ খবর পাবার পর মেহেরুন্নেসা তার ছোট ভাইকে দিয়ে আমার বাসায় খবর পাঠাল যে, সে, তার মা ও দুই ভাইকে নিয়ে কোথায় যাবে? আমি বুঝালাম, বাড়ি থেকে চলে যাওয়া একান্ত প্রয়োজন। তারপর ২৫ মার্চের কালরাতের ঘটনা সবাই জানেন। দিন চলে গেল। ২৭ মার্চ বিকেলে আমি খবর পেলাম, মেহেরুন্নেসা, তার দুই ভাই (দুজনেই তখন ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের সদস্য ছিলেন) ও মা কে কাদের মোল্লা ও তার সহযোগী অবাঙালিরা হত্যা করেছে। অবাঙালিদের মধ্যে কেউ কেউ মাথায় সাদা ও লাল পট্টি বেঁধে মেহেরুন্নেসার বাসায় সকাল এগারোটায় ঢুকে যায়। …
মেহেরুন্নেসার মা যখন দেখল, ওরা তাদের মারতে এসেছে, তখন তিনি বুকে কুরআন শরীফ চেপে ধরে বাঁচতে চেয়েছিলেন। কিন্তু ওরা কবি মেহেরুন্নেসাসহ চারজনকে জবাই করে। পরে গুলজার ও আরও অবাঙালির কাছ থেকে শুনেছিলাম, কবি মেহেরুন্নেসাকে গলা কেটে ফ্যানের সঙ্গে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছিল। মেহেরুন্নেসা তখন গলা কাটা মুরগীর মতো ছটফট করছিল। এই বীভৎস সংবাদ পেয়ে কষ্ট পেয়েছিলাম। মেহেরুন্নেসার জন্য আজ অবধি আমি কষ্ট পাই। আজ আমি এখানে কাঁদতে আসিনি। এ হত্যাকারীদের ফাঁসির দাবীতে এসেছি। আমি সত্যিকার অর্থে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চাই। আমি বিচার দেখে যেতে পারব কিনা জানিনা। আমার ভিতর কোন রাগ নেই, আছে শুধুই ঘৃণা।”
মনে মনে ঠিক করে রেখেছিলেন তাঁর প্রথম কবিতার বইয়ের নাম হবে ‘সূর্যজ্যোতির পাখি’। সে বই বের হয়নি আর। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের প্রথম নারী শহিদ কবি মেহেরুন্নেসা নিজেই সূর্যজ্যোতির পাখি হয়ে উড়ান দিয়েছিলেন। মৃত্যুর মাত্র ক’টা দিন আগে ‘বেগম’ পত্রিকায় বেরিয়েছিল তাঁর শেষ কবিতা– ‘জনতা জেগেছে’।
জনতা জেগেছে…
মুক্তি শপথে দীপ্ত আমরা দুরন্ত দুর্বার,
সাত কোটি বীর জনতা জেগেছে এই জয় বাংলার।
পাহাড় সাগর নদী প্রান্তর জুড়ে-
আমরা জেগেছি নব চেতনার ন্যায্য নবাঙ্কুরে
বাঁচবার আর বাঁচাবার দাবী দীপ্ত শপথে জ্বলি –
আমরা দিয়েছি সব-ভীরুতাকে পূর্ণ জলাঞ্জলি-
কায়েমি স্বার্থবাদীর চেতনা আমরা দিয়েছি নাড়া
জয় বাঙলার সাত কোটি বীর, মুক্তি সড়কে খাড়া।
গণতন্ত্রের দীপ্ত শপথ কণ্ঠে কণ্ঠে সাধা-
আমরা ভেঙ্গেছি জয় বাঙলার বিজয়ের যত বাধা।
কায়েমি স্বার্থবাদী হে মহল কান পেতে শুধু শোন
সাত কোটি জয় বাংলার বীর ভয় করিনাকো কোন।
বেয়নেট আর বুলেটের ঝড় ঠেলে-
চির বিজয়ের পতাকাকে দেবো, সপ্ত আকাশে মেলে।
আনো দেখি আনো সাত কোটি এই দাবীর মৃত্যু তুমি,
চির বিজয়ের অটল শপথ “জয় এ বাংলা ভূমি।”
…
ঋণস্বীকার কাজী রোজী: শহীদ কবি মেহেরুন্নেসা; হাসান হাফিজুর রহমান স. বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র; পিয়াস মজিদ: সূর্যজ্যোতির পাখি।
…পড়ুন কবি ও বধ্যভূমি…
পর্ব ১১: প্রিয় কমরেড, এসো একসাথে মরি
পর্ব ১০: প্রাণভিক্ষা? বেছে নিই মৃত্যুর অহংকার বরং!
পর্ব ৯: তিমিরের অন্তে যদি তিমিরবিনাশ
পর্ব ৮: অক্সিজেন মৃতদের জন্য নয়!
পর্ব ৭: আকাশে তারারা জ্বলছে, ফ্যলাস্তিনকে ভয় দেখিও না!
পর্ব ৬: কোথায় লুকোবে কালো কোকিলের লাশ?
পর্ব ৫: আমার দুঃখের কথা কি পাথরকে বলব?
পর্ব ৪: আমি সেই মেয়ে, যে আর ফিরবে না
পর্ব ৩: আমাকে পোড়াতে পারো, আমার কবিতাকে নয়!
পর্ব ২: এস্তাদিও চিলে আর চল্লিশটা বুলেটের ক্ষত
পর্ব ১: বিপ্লব, প্রেম ও কবিতাকে আমৃত্যু আগলে রেখেছিলেন দ্রোণাচার্য ঘোষ