যে জাসুসি কাহিনির ডাকাতরা খলনায়ক হয়ে আসত, ইন্দ্রজাল কমিকসে যে বাহাদুরের জন্মই হল ডাকাতদের মোকাবিলায়, সেই ডাকাতদের ‘শোলে’-তে নিয়ে আসা হল বটে একেবারে চেনা ‘ওয়েস্টার্ন’ ঘরানায়, ৭০ মিলিমিটার ফিল্মে প্রায় ‘ম্যাকেনাস গোল্ড’-এর গ্র্যান্ড ক্যানিয়নীয় দৃশ্য মনে করিয়ে আর ডি বর্মনের অভূতপূর্ব ওয়েস্টার্ন আবহে শুরু হল বটে সেই ছবি, কিন্তু তিন ঘণ্টা চলতে চলতেই ‘শোলে’ হয়ে উঠল একান্তই ভারতীয়।
১৪.
জনতা নয়, বরং একটু ব্যক্তিগত সিনেমাহলের গল্প দিয়ে শুরু করা যাক এই কিস্তি। ‘শোলে’-র রিমেক বানিয়েছিলেন রামগোপাল ভার্মা। তখনও ‘সত্য’ দেখিনি, ‘রঙ্গিলা’ দেখিনি, ‘কৌন’ দেখিনি; তাই আলাদা করে আগ্রহীও হইনি রামু ভার্মার ছবি নিয়ে। একে উত্তর কলকাতার মধ্যবিত্ত বাড়ি, তায় বামপন্থী সাংস্কৃতিক পরিবহ তখনও চারপাশে বহাল, হিন্দি সিনেমা দেখার বিষয়ে ভ্রুকুঞ্চন ছিলই। তাই হিন্দি সিনেমা, তখনও পর্যন্ত আমাদের কাছে ছিল, কখনও নিষিদ্ধ রংমহল, কখনও আনোখা এলডোরাডো অথবা কখনও রগরগে সোডোম। তাই ‘রামগোপাল ভার্মা কি আগ’ যখন রিলিজ করল, এবং অবশেষে টিভিতে এল, তখন চোরাগোপ্তা উঁকিঝুঁকি মেরে দেখার চেষ্টা শুরু হল। হিন্দি ছবি দেখতে গিয়ে ধরা পড়লে ভর্ৎসনাই নিয়মানুগ ছিল, কিন্তু এক্ষেত্রে ঘটেছিল ব্যাত্যয়। গুরুজনরা প্রায় একযোগে বলে উঠেছিলেন, ‘ছোঃ! এটা আবার শোলে না কি! দেখলে আসলটাই দেখ।’
ব্যাপারটা এখানে থেমে থাকেনি। সেসময় শ্যামবাজার-হাতিবাগান সরগরম ছিল পাইরেটেড ভিসিডি-ডিভিডি-এমপিথ্রি-র বাজারে। মধ্য কলকাতার ‘মিউজিক ওয়ার্ল্ড’ আর দক্ষিণ কলকাতার ‘সিমফনি’ থেকে চড়া দামে অরিজিনাল কেনাই যেত, কিন্তু পাইরেটেড সিডির রোমাঞ্চ ছিল অপূর্ব। ওয়ার্নার হারজগ পাইরেসিকে চলচ্চিত্রের বিস্তারের অন্যতম সেরা মাধ্যম বলেছিলেন ঠিকই, কিন্তু এই নকল সিডি-বাজারের অন্তরে ঘাই মেরে দেখলে তিনিও বিস্মিতই হতেন। ফেলিনি-কুরোসাওয়া-আন্তোনিওনি থেকে আলমাদোভার-তাকাশি মিকে, নাগিসা ওশিমা-বাস্টার কিটন থেকে হিচকক-সেজুন সুজুকি– এসবই যেমন সেখানে লোকানো থাকত মন্ত্রগুপ্তির মতো, তেমন স্কুলফেরত কিশোর-কিশোরীর মনে তুফান তোলার জন্য ‘জিসম’, ‘রাজ’, ‘এইত্রাজ’, ‘সালাম নমস্তে’-র চোখধাঁধানো ভিসিডি বা ডিভিডি সাজানো ছিল চোখের সামনে। ‘রামগোপাল ভার্মা কি আগ’-এর ‘ভ্রম’ ঘোচাতে এমনই এক দোকান থেকে কিনে দেওয়া হয়েছিল ‘শোলে’-র ভিসিডি।
সাধারণত ভিসিডি আসত দু’ভাগে। ক্যাসেটের এপিঠ-ওপিঠের মতো না, দুটো সিডিতে ভাগ হয়ে থাকত ছবির দুই অংশ। ‘শোলে’ এসেছিল তিন ভাগে। তখনও দীর্ঘতর ডিরেক্টরস কাটটি প্রকাশিত নয়। তাতেই ওই তিন ঘণ্টার গ্রামভারতের মহাকাব্যকে আঁটানো যায়নি ভিসিডির মাপে। দফায় দফায় রিলিজ হওয়া ‘শোলে’ হলে দেখার নানাবিধ বিবরণ পূর্বজদের কাছে শোনা বটে, কিন্তু আমার ‘শোলে’ দেখা কম্পিউটার স্ক্রিনেই, ওই ঢাউস তিন ভিসিডির সূত্রে।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
‘পথের পাঁচালী’ প্রসঙ্গে ‘মাদার ইন্ডিয়া’-র সূত্রে গ্রামভারতের মুখ হয়ে ওঠা নার্গিস বলে বসেছিলেন, এই ছবিতে ভারতীয় দারিদ্রের আন্তর্জাতিক প্রদর্শনী হয়েছে, কিন্তু ‘আধুনিক ভারত’ উঠে আসেনি। কী সেই আধুনিক ভারত? এক সাক্ষাৎকারে এই প্রশ্ন পেয়ে নার্গিস অম্লানবদনে উত্তর দেন, ‘ড্যামস’। ‘বাঁধ’ যদি আধুনিক ভারতের চিহ্নক হয়ে ওঠে, তাহলে ‘মাদার ইন্ডিয়া’ সংক্রান্ত সেই পুরনো প্রতর্কেই ফিরতে হয়।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
ছোট স্ক্রিনে সেই প্রথম ‘শোলে’ দেখা আমার একার ছিল না। সঙ্গে বড়রাও শামিল হয়েছিল, কারণ টেলিভিশনে বিজ্ঞাপনমুখর হয়ে ওই ছবি বাড়তি তিন ঘণ্টার হয়ে উঠতেই পারে, কিন্তু সিডি-তে সিনেমা দেখার স্বাদ অন্ততপক্ষে ঘোলে মেটে। সেদিন বুঝেছিলাম, রমেশ সিপ্পির এই ম্যাগনাম ওপাসের কী সাংঘাতিক শক্তি! খোদ সত্যজিৎ একটা গোটা ফেলুদাকাহিনি-র ক্লাইম্যাক্স লিখে ফেললেন ‘শোলে’-র শুরুর সেই কালজয়ী ঘোড়া-ট্রেনের দৃশ্যর ওপর নির্ভর করে। এবং সেই সময় হলে ‘শোলে’ দেখার আকাঁড়া অনুভূতি যারা পেয়েছিল, বছরের পর বছর তাদের মজিয়ে রাখার মতো মাদক মজুত ছিল ভারতীয় মূল ধারার সিনেমার এই মাইলফলকটিতে।
‘শোলে’ নিয়ে পরে অনেক চলচ্চিত্রবেত্তাকেই এককথায় বলতে শুনেছি, এ ছবি একটু প্রয়োজনের চেয়ে একটু বেশি গুরুত্ব পেয়েছে ভারতীয় চলচ্চিত্র আলোচনায়। যাঁরা এমনটা মনে করছেন, তাঁরা ‘শোলে’-র গুণমান নিয়ে ভাবিত হয়েছেন বেশি। বাংলা ছবিতে মোড়ঘোরানো ‘পথের পাঁচালী’ আছে বলে, হিন্দি ছবির তথাকথিত কাল্টটিকেও ছবি হিসেবে তার সমতুল হতে হবে, এমন ভাবা বাতুলতা। বরং অন্য মার্গে কিছু ভাবনার প্রয়োজন রয়েছে। ‘পথের পাঁচালী’ প্রসঙ্গে ‘মাদার ইন্ডিয়া’-র সূত্রে গ্রামভারতের মুখ হয়ে ওঠা নার্গিস বলে বসেছিলেন, এই ছবিতে ভারতীয় দারিদ্রের আন্তর্জাতিক প্রদর্শনী হয়েছে, কিন্তু ‘আধুনিক ভারত’ উঠে আসেনি। কী সেই আধুনিক ভারত? এক সাক্ষাৎকারে এই প্রশ্ন পেয়ে নার্গিস অম্লানবদনে উত্তর দেন, ‘ড্যামস’। ‘বাঁধ’ যদি আধুনিক ভারতের চিহ্নক হয়ে ওঠে, তাহলে ‘মাদার ইন্ডিয়া’ সংক্রান্ত সেই পুরনো প্রতর্কেই ফিরতে হয়। কর্ষণসভ্যতার আদিমতার পাশাপাশি সেখানে প্রযুক্তির আধুনিকতাও এসেছিল সমান তালে। নেহরুর ভারতকল্পের সেই আশ্চর্য উদাহরণ থেকেই আন্তর্জাতিক স্তরে ‘পথের পাঁচালী’-র দারিদ্রমুখর গ্রামবাংলা, যেখানে মৃত্যু ঘটে ঔদাসীন্যে, তা নিতে পারেননি নার্গিস। কিন্তু ‘মাদার ইন্ডিয়া’-য় সুখীলালের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো রাধার মধ্যে যদি গ্রামভারতের প্রতিরোধ কিছুটা হলেও খুঁজে পাওয়া গিয়ে থাকে, তবে ‘শোলে’-তে তা কতটা প্রকট হয়ে উঠল?
যে জাসুসি কাহিনির ডাকাতরা খলনায়ক হয়ে আসত, ইন্দ্রজাল কমিকসে যে বাহাদুরের জন্মই হল ডাকাতদের মোকাবিলায়, সেই ডাকাতদের ‘শোলে’-তে নিয়ে আসা হল বটে একেবারে চেনা ‘ওয়েস্টার্ন’ ঘরানায়, ৭০ মিলিমিটার ফিল্মে প্রায় ‘ম্যাকেনাস গোল্ড’-এর গ্র্যান্ড ক্যানিয়নীয় দৃশ্য মনে করিয়ে আর ডি বর্মনের অভূতপূর্ব ওয়েস্টার্ন আবহে শুরু হল বটে সেই ছবি, কিন্তু তিন ঘণ্টা চলতে চলতেই ‘শোলে’ হয়ে উঠল একান্তই ভারতীয়। তিনটি বিষয় গোটা ছবিটিকে নিয়ন্ত্রণ করে গেল। এক, জমি বা ভূখণ্ডের হকদার থাকা, দুই, উৎপাদিত কৃষিদ্রব্যর ওপর গ্রামবাসীর অকৃত্রিম অধিকার ও লুটেরাদের সঙ্গে লড়াই, ও তিন, গ্রামজীবনের সারল্য ও তার মধ্যেই লুকিয়ে থাকা তীব্র আত্মমর্যাদাবোধ। ‘মাদার ইন্ডিয়া’ বা ‘নয়া দৌড়’ যে ‘আধুনিক ভারত’-এর স্বপ্ন স্বাধীনতা-উত্তর, ক্ষুধিত ও অস্থির ভারতকে দেখাতে চেয়েছিল, যার জোরেই ভারতের দারিদ্র নিয়ে আন্তর্জাতিক স্তরে প্রশ্নের সম্মুখীন হতে কুণ্ঠিত বোধ করেছিলেন নার্গিস, তার বদলে ‘শোলে’-তে কি ভারত আরও আদিম হয়ে উঠল না? মনে রাখা ভাল, ‘ডিরেক্টরস কাট’-এ ছিল যেসব বাদ পড়া দৃশ্য, তার মধ্যে গব্বরের হননদৃশ্য ছিল, পরে সেন্সরের চাপে যা বাতিল করতে হয় রমেশ সিপ্পিকে, ছিল ভীরুর ঘোড়ায় মুন্ডু বেঁধে ডাকাত দলের ক্যাডারকে ধরে নিয়ে যাওয়ার দৃশ্য, এ কে হাঙ্গল অভিনীত ইমাম সাহেবের ছেলেকে গব্বরের অত্যাচারের দৃশ্য, আবার ঠাকুরের বিশ্বস্ত চাকরের তার জুতোর তলায় পেরেক আটকানোর দৃশ্য। আদর্শবাদী ভারতের লক্ষ্যে যে রাধা ওরফে ‘মাদার ইন্ডিয়া’ পুত্রহন্তা হয়, তার সঙ্গে এমন একযোগে ব্যক্তিগত ও সমষ্টিগত, প্রায় আরণ্যক প্রতিশোধস্পৃহার মিল আছে কি?
এই সব প্রশ্নের সুলুকসন্ধানেই ক্রমে যাওয়া যাবে। তবে তার আগে স্বীকার করে নিতেই হবে ‘শোলে’-র অকৃত্রিম গুরুত্ব ও প্রজন্মান্তরে তার দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব। ‘কয়েনেজ’ বা চালু লব্জর জন্ম দেওয়া থেকে শুরু করে রসবোধে, কথোপকথনে সেসব সংলাপের রেফারেন্স ঢুকে পড়া- কীভাবে না যুগের বাহক হয়ে উঠেছে ‘শোলে’! উত্তর কলকাতার যে কোনও মাচায় এখনও সাউন্ড চেক হয় ‘শোলে’-র টাইটেলের সেই মহাকাব্যিক আবহ বা ‘জয়’-রূপী অমিতাভ বচ্চনের মাউথ অর্গানের বিষাদবিহ্বল রোমান্টিক মূর্চ্ছনা দিয়ে।
একটা ছোট্ট কথকতাতেই শেষ হোক। তুঙ্গ এমারজেন্সি-কালে এক পলাতক নকশাল নেতা তার এক মফসসলি বন্ধুর বাড়িতে আশ্রয় নেয়, এবং কিঞ্চিৎ ঝুঁকি নিয়েই ‘শোলে’ দেখতে যায়। এই ছবির শেষে জয় ওরফে অমিতাভর করুণ পরিণতির আগের দৃশ্যে অমিতাভ যখন দৌড়ে আসেন ব্রিজ দিয়ে, সেই নেতা কিঞ্চিৎ বিরক্তি সহকারেই বলে উঠেছিল, ‘গেরিলা ট্রেনিং না পেলে এই হয়! ব্রাশ ফায়ার চলছে, তার মধ্যে ওইরকম হান্ড্রেড মিটার রেসের মতো কেউ দৌড়য়? হামাগুড়ি দিতে পারল না?’
…পড়ুন জনতা সিনেমাহল-এর অন্যান্য পর্ব…
পর্ব ১৩। ‘জঞ্জির’ দেখে ছেলেটা ঠিক করেছিল, প্রতিশোধ নেবে
পর্ব ১২। ‘মেরে পাস মা হ্যায়?’-এর রহস্যটা কী?
পর্ব ১১। ইন্দ্রজাল কমিকস-এর গ্রামীণ নায়ক বাহাদুর পাল্পে এসে রংচঙে হল
পর্ব ১০। দু’টাকা পঁচিশের টিকিটে জমে হিরোইনের অজানা ফ্যানের স্মৃতি
পর্ব ৯। খান্না সিনেমায় নাকি পৌরাণিক সিনেমা চলছে
পর্ব ৮। পাড়াতুতো ট্র্যাজেডিতে মিলে গেলেন উত্তমকুমার আর রাজেশ খান্না
পর্ব ৭। পাড়ার রবিদা কেঁদেছিল ‘কাটি পতঙ্গ’ আর ‘দিওয়ার’ দেখে, সাক্ষী ছিল পাড়ার মেয়েরা
পর্ব ৬। যে কলকাতায় পুলিশ-পকেটমার মিলেমিশে গেছে, সেখানে দেব আনন্দ আর নতুন করে কী শিরশিরানি দেবেন?
পর্ব ৫। হিন্দি ছবির পাপ ও একটি অ্যাডাল্ট বাড়ির গল্প
পর্ব ৪। দেব আনন্দ, একটি বোমা ও অন্ধকারে হাত ধরতে চাওয়ারা
পর্ব ৩। অন্ধকারে ঢাকা পড়ল কান্না থেকে নিষিদ্ধ স্বপ্ন!
পর্ব ২। ‘জিনা ইঁয়াহা মরনা ইঁয়াহা’ উত্তর কলকাতার কবিতা হল না কেন?
পর্ব ১। সিনেমা হলে সন্ত্রাস ও জনগণমন-র দলিল