আমার নিজের মনে হয়েছে, মানুষটার ভেতরে একটা অপরিমেয় সরলতা ছিল, তার ফলে যে কোনও চরিত্রই তাঁর অভিনয়ে স্বচ্ছ জলে প্রতিবিম্বের মতো ফুটে উঠতে পারত। শম্ভু মিত্রের আচরণের মধ্যে দূরত্ব ছিল, এক ধরনের নৈর্ব্যক্তিকতা, এবং প্রবল আত্মসচেতনতার বোধ। যার ফলে খুব নিকট মানুষ ছাড়া কেউ তাঁর সঙ্গে লেপটে যেতে পারতেন না। তৃপ্তি মিত্র কিন্তু একেবারেই আমাদের সংসারের মা-মাসিদের মতো।
তৃপ্তি মিত্রকে আমি প্রথম দেখি অ্যাকাডেমির দোতলায় শেষ সারিতে বসে, এক টাকার টিকিটে, নাটকের নাম ‘বাকি ইতিহাস’। তখন ক্লাস এইটে পড়ি, রেডিওতে শম্ভু মিত্রের অভিনয় শুনে শুনে তাঁর খুব ভক্ত হয়ে গিয়েছি, তাঁকে সামনা-সামনি দেখব বলে যাওয়া। বাকি ইতিহাসে শম্ভু মিত্র অভিনয় করতেন না, তৃপ্তি মিত্র আর কুমার রায় তিনটে করে চরিত্রে অভিনয় করতেন। একজন বাসন্তী, মাঝবয়সি মহিলা, অন্য দু’জনের নাম কণা, কম বয়সি। এই দুই কণা আবার দু’ধরনের মেয়ে, একজন উচ্ছ্বল, ছটফটে, অন্যজন শান্ত, দুঃখী, যে কোনও কিছুকে মেনে নেওয়া স্বভাবের। প্রথম কণাকে দেখে আমি ভেবেছিলাম উনি নিশ্চয়ই শাঁওলী মিত্র। তার দুটো কারণ। এক তো অস্বাভাবিক দ্রুততায়, সেকেন্ড তিরিশের মধ্যে তৃপ্তি মিত্র বাসন্তী থেকে কণায় রূপ বদলাতেন, সেই সঙ্গে বদলাতেন কথা বলার ধরন, হাঁটাচলার ধরন, এক কথায় পুরো ব্যক্তিত্বটাই অন্য রকম হয়ে যেত। ক্লাস এইটের ছেলের কাছে এ একটা অসম্ভব ব্যাপার! শুধু ক্লাস এইটের কথাই বা বলছি কেন, যাঁরা অভিনয় করেন তাঁরা জানেন, এ খুব সহজ কাজ নয়। অত দ্রুত রূপ বদলের জন্যে দরকার হয় প্রায় যান্ত্রিক নিখুঁত তৎপরতা, আর ব্যক্তিত্ব পালটে দেওয়ার জন্য নিজের কণ্ঠ আর শরীরের ওপর অসামান্য দখল। বিস্ময়করভাবে তা ছিল তৃপ্তি মিত্রের।
আমি তো বয়সের কারণেই তাঁর অনেক অভিনয় দেখা থেকে বঞ্চিত হয়েছি। কিন্তু যেটুকু দেখেছি তার ঘোর আমার আজ পর্যন্ত কাটেনি। কোনও লাভ নেই জানি, যাঁরা সেইসব অভিনয় দেখেননি তাঁদের তো কথা দিয়ে তাঁর অলৌকিকতা বোঝানো যাবে না, তবু ধরুন নিজেকে মনে করিয়ে দেওয়ার জন্যই বলি তাঁর আর-একটি নাটক, একক অভিনয়, ‘অপরাজিতা’র কথা।
একটি মেয়ে একলা বাড়িতে অপেক্ষা করে আছে তার ভালোবাসার পূর্ণতার আকাঙ্ক্ষায়। সে আকাঙ্ক্ষা পূর্ণ হয় না শেষ পর্যন্ত, তাকে নেমে যেতে হয় রাস্তায়, রাস্তার বেশ্যা হয়ে যেতে হয়। একটি সরল, নাগরিক দৃষ্টিতে খানিকটা বোকাটে আটপৌরে মেয়ে, যে খুব মজা করতে ভালোবাসে, নিজেকে নিয়েও মজা করে, অন্যকে নকল করে, আস্তে আস্তে যে কেমন করে জীবনের মুখোমুখি হতে হতে পালটে গেল, সেই জীবন, যা দাঁত-নখ বের করে তার স্বাভাবিক সুন্দর, একটা বেঁচে থাকার স্বপ্নকে দু’পায়ে মাড়িয়ে দেয়। অজস্র হিরের টুকরোর মতো সব মুহূর্ত দিয়ে সাজানো থাকত তৃপ্তি মিত্রের এই অবিস্মরণীয় অভিনয়, মঞ্চের ভাষায় সেইসব কারুকাজ তো লেখায় প্রকাশ করা যাবে না, আমি তার চেষ্টাও করব না। একটা উদাহরণ শুধু দিই। নাটকের মাঝামাঝি পর্বে সে একটি পাঞ্জাবি লোকসংগীত গায়, মজা করে, দ্রুত লয়ে। সেটা আসলে গোপনে গুটিয়ে রেখে দেওয়া থাকে। নাটকের একেবারে শেষে, যখন সব স্বপ্ন ধ্বস্ত হয়ে গিয়েছে তার, তখন সেই পাঞ্জাবি লোকসংগীত আবার ফিরে আসে তাঁর গলায়, এবারে লয় আরও ধীর হয়ে গিয়েছে, আর গলার আশ্চর্য কারুকাজে একটা চেরা স্বর বেরিয়ে আসে, যেন বুকের মধ্যে কেউ করাত দিয়ে কাটছে।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
আরও পড়ুন: ‘বহুরূপী যাপন’ স্মৃতি নামক এক বিশ্বাসঘাতক বন্ধুর থেকে ধার করে আনা গল্প
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
আর একটা অভিনয়ের কথা বলি, এটা ‘বহুরূপী’তে নয়। আরব্ধ নাট্য বিদ্যালয়ে তিনি করেছিলেন ‘সরীসৃপ’ বলে একটি নাটক, বিধায়ক ভট্টাচার্যের লেখা। সেখানে এক বৃদ্ধা অভিনেত্রী, এখন তিনি প্রায় রাস্তার বাসিন্দা, তাঁর কম বয়সের কথা বলছেন। সংলাপ তো হুবহু বলতে পারব না, এই ধরনের কিছু ছিল– আমি তো সাজছি, হঠাৎ কে একটা এসে বলল, গিরিশবাবু আসছেন। আমি দরজার দিকে মুখ ফিরিয়ে দেখলাম, গিরিশবাবু। মঞ্চে এই সংলাপটা বলার সঙ্গে সঙ্গে, বিশ্বাস করুন, আমার সারা শরীরে কাঁটা দিয়ে উঠেছিল। তারপরেও সরীসৃপ দেখেছি, একাধিকবার, প্রত্যেকবার ওই এক কাণ্ড। লোমগুলো সব খাড়া হয়ে ওঠে। কেমন করে হত এটা? ওই যে মুখ ঘুরিয়েই আচমকা দেখা, সহজ ভঙ্গিটা মুহূর্তে বিস্ময়ে পালটে যাওয়া, সেই অনুযায়ী গলা বদলে যাওয়া, শরীরটা হঠাৎ টান টান হয়ে যেত– এসব তো বাইরের রূপ, ভেতরে ভেতরে যেটা হত, যেটা অভিনয়ের গোড়ার দুটো শর্ত, তৃপ্তি মিত্র সেই মুহূর্তে গিরিশবাবুকে দরজায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখতেন, সমস্ত বিশ্বাস নিয়েই দেখতেন।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
জলে ডুবে মারা গিয়েছেন কেয়া চক্রবর্তী। একটা গাড়িতে কালীপ্রসাদ ঘোষ, শাঁওলী মিত্র, তৃপ্তি মিত্রের সঙ্গে যাচ্ছি আমিও। যেতে যেতে উঠে পড়ল মৃত্যুর কথা। তৃপ্তি মিত্র বললেন, না বাবা, ওই রকম হঠাৎ করে মরতে আমি রাজি নই। বেশ বুঝতে পারব, মৃত্যু আসছে, তবে তো। কেউ টের পায়নি, গাড়ির মধ্যে বসে বলা কথাগুলো শুনে বিধাতা অট্টহাসি হেসেছিলেন। ক্যানসার ধীরে ধীরে গ্রাস করে নিল।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
রেডিওতে এই রকম হয়েছিল একবার। দুই ভাই, এক ভাই গরিব, অন্যজন বড়লোক। ঠিক হয়েছে, বিধবা মাকে ভাগাভাগি করে রাখবে তারা। আমি সেই বড়লোক ভাইয়ের পার্ট করছি। মাকে নিয়ে এসেছি বাড়ির সামনে, তৃপ্তি মিত্র বলে উঠলেন, অমু, এই বাড়িটা তোর? পলকের মধ্যে স্টুডিও, সামনে ঝোলানো মাইক্রোফোন, সব মুছে গেল চোখের সামনে থেকে, একটা অট্টালিকা ভেসে উঠল, আর সাদা থান পরা পাকাচুলের এক বৃদ্ধা।
‘সরীসৃপ’ অথবা এই অভিনয়ের টুকরোটা আমি একা একা বহুবার করে দেখার চেষ্টা করেছি, ওই ম্যাজিকটা কিছুতেই ঘটাতে পারিনি।
এমন সব কাণ্ড তৃপ্তি মিত্র কীভাবে ঘটাতেন, আমি ঠিক ব্যাখ্যা করতে পারব না। আমার নিজের মনে হয়েছে, মানুষটার ভেতরে একটা অপরিমেয় সরলতা ছিল, তার ফলে যে কোনও চরিত্রই তাঁর অভিনয়ে স্বচ্ছ জলে প্রতিবিম্বের মতো ফুটে উঠতে পারত। শম্ভু মিত্রের আচরণের মধ্যে দূরত্ব ছিল, এক ধরনের নৈর্ব্যক্তিকতা, এবং প্রবল আত্মসচেতনতার বোধ। যার ফলে খুব নিকট মানুষ ছাড়া কেউ তাঁর সঙ্গে লেপটে যেতে পারতেন না। তৃপ্তি মিত্র কিন্তু একেবারেই আমাদের সংসারের মা-মাসিদের মতো। একটা ঘটনার কথা বলি?
‘বহুরূপী’ অপরাজিতা নাটকের অভিনয় করতে যাবে আগরতলায়। আমার ওপরে মুখ্যত মঞ্চের দায়িত্ব। জীবনে সেই প্রথম প্লেনে চড়া, আগের রাতে ঘুম হয়নি। প্লেনে উঠলাম। জানলার ধারে সিট পেয়েছেন তৃপ্তি মিত্র, আমি তাঁর পাশে। জানলার দিকে তাকিয়ে উশখুশ করছি, বই মুড়ে হাসিমুখে আমার দিকে তাকালেন, ‘জানলার ধারে বসবি?’ সেই প্রথম, জানলার ধারে বসে মেঘের ওপর দিয়ে উড়ে যাওয়া, তৃপ্তি মিত্রের বদান্যতায়। তুচ্ছ কথা, কিন্তু সেই আঠারো বছরের ছেলেটা তা জীবনে কোনও দিন ভুলতে পারবে না। কোনও একটা গোলমালে সেবার আমরা জন দু’-তিনজন প্লেনে ফিরতে পারিনি। বাড়ি ফিরে খবর পেলাম তৃপ্তি মিত্র ফোন করেছিলেন। সৌমিত্র ভালো আছে, খুব এনজয় করেছে, আপনারা কিচ্ছু চিন্তা করবেন না। কী দরকার ছিল? আমার বাড়ির লোককে তো চিনতেনও না তখন। তবুও।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
আরও পড়ুন: শুধু থিয়েটার করা নয়, থিয়েটার নিয়ে কথা বলা ও শোনার পরিসর তৈরি করেছে বহুরূপী পত্রিকা
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
একটা ছাদ-ফাটানো হাসি ছিল তাঁর, খানিকটা পুরুষালি। সত্যি সত্যি চমকে উঠতে হত! ছোটবেলায় এই হাসির কারণে তাঁকে নাকি গুরুজনদের কাছে বকুনি শুনতে হয়েছে। মেয়েমানুষের আবার অত জোরে হাসা কী? এমন হাসি তো তাঁরাই হাসতে পারেন, যাঁদের মনটা একেবারে শুদ্ধ, পরিষ্কার। অথচ, জীবনে তো কষ্ট খুব কম পাননি, মানসিক কষ্টের কথাই যদি আগে বলি। স্বামীর সঙ্গে বিচ্ছেদ, বহুরূপী থেকে চলে যাওয়া, আরও নানা বিশ্রী আঘাত সইতে হয়েছে তাঁকে, আর কে না জানে, সরল মানুষকে এই সব আঘাতে কষ্ট পেতে হয় বড্ড বেশি। আমি যখন থেকে দেখেছি, শরীরও খুব ভালো ছিল না। তার পর তো ক্যানসার ধরে নিল তাঁকে। তাই নিয়ে আড়াই ঘণ্টা ধরে ‘অপরাজিতা’ করছেন। ‘অপরাজিতা’ কলকাতার বাইরে হলে খুব বাছাই করা মানুষই যেত সেই দলে। অন্য কাজের সঙ্গে আমার ওপরে থাকত বেল বাজানো আর পর্দা তোলার ভার। কতদিন এমন হয়েছে, ইন্টারভ্যালে মঞ্চ থেকে বেরিয়ে এসে পা টলে গিয়েছে, ধরে ধরে গ্রিনরুমে বসিয়ে দিয়েছি। দশ মিনিট হয়ে গেছে, এইবার থার্ড বেল দিয়ে পর্দা তুলতে হবে, আমি সাজঘরের দরজায় গিয়ে দাঁড়াতে হাত তুলে হাঁপাতে হাঁপাতে বলছেন, আর একটু, আর এক মিনিট।
জলে ডুবে মারা গিয়েছেন কেয়া চক্রবর্তী। একটা গাড়িতে কালীপ্রসাদ ঘোষ, শাঁওলী মিত্র, তৃপ্তি মিত্রের সঙ্গে যাচ্ছি আমিও। যেতে যেতে উঠে পড়ল মৃত্যুর কথা। তৃপ্তি মিত্র বললেন, না বাবা, ওই রকম হঠাৎ করে মরতে আমি রাজি নই। বেশ বুঝতে পারব, মৃত্যু আসছে, তবে তো। কেউ টের পায়নি, গাড়ির মধ্যে বসে বলা কথাগুলো শুনে বিধাতা অট্টহাসি হেসেছিলেন। ক্যানসার ধীরে ধীরে গ্রাস করে নিল। এর মধ্যে জানা গেল, কালিদাস সম্মান দেওয়া হবে তৃপ্তি মিত্রকে। গিয়ে নিয়ে আসার ক্ষমতা নেই, অতএব ওখানকার কর্তাব্যক্তিরাই এলেন নাসিরুদ্দিন রোডের বাড়িতে। ঠিক সময়ে ঘরের ভেতর থেকে হাসিমুখে বেরিয়ে এলেন তৃপ্তি মিত্র। শাড়ি পরেছেন, সুন্দর করে সেজেছেন, ক্লিষ্টতার কোনও চিহ্ন নেই। হাত বাড়িয়ে পুরস্কার নিলেন, অনুষ্ঠান সুসম্পন্ন হল। পরে শাঁওলী মিত্রের মুখে শুনেছি, তখন শরীর আড়ষ্ট হয়ে গেছে, ওই শাড়ি পরাতেই নাকি লেগেছিল আড়াই ঘণ্টার দুর্বিসহ সময়। কিন্তু না, পুরস্কার নেওয়াটা তো একটা পারফরম্যান্স, শরীর যত বিদ্রোহ করুক, ‘শো মাস্ট গো অন’।
‘অপরাজিতা’ নাটকের শেষ সংলাপটা মনে পড়ে। জীবনের কাছে সম্পূর্ণ পরাভূত অপু দর্শকের দিকে তাকিয়ে বলে, আমি, অপরাজিতা রায়। আমি একটু থেমে, অপরাজিতা। শেষ শব্দটা অজস্র হাততালির পিঠে চেপে চলে যেত অনন্তকালের দিকে।