এ উপন্যাসের চুম্বকগুণ চোখে ধুলো দেবে এর শব্দবিন্যাসে এবং গল্প বলার কায়দায়। উপন্যাস নামিয়ে রাখার জো নেই, আবার পড়তে পড়তে যে দমবন্ধ করা কষ্ট হতে থাকবে তাকে প্রকাশ করার ভাষা পাওয়াও দুষ্কর। এখানেই এই উপন্যাসের সার্থকতা। এ শুধু শব্দসৌধই রচনা করে না, পড়তে পড়তে একসময় পাঠক আবিষ্কার করে যেন সেই সৌধের মেঝেতে যে শবাধারটি শোয়ানো সেটিতে সে কখন নিজেই বন্দি হয়ে গেছে টের পায়নি।
২০১৮ সালের ইন্টারন্যাশনাল বুকার প্রাইজের মঞ্চ। বিচারক মণ্ডলীর মধ্যে আছেন ব্রিটিশ পাঠকদের কাছে সুপরিচিত ডাকসাইটে সাহিত্য সমালোচক মাইকেল হফম্যান। ‘দ্য গার্ডিয়েন’–এর পাতায় তাঁর রিভিউ বেরনোর আগে বাঘা বাঘা সাহিত্যিকরও বুক ঢিপ ঢিপ করে। রিচার্ড ফ্ল্যানাগান থেকে মার্টিন অ্যামিস, এমনকী, নোবেলজয়ী গুন্টার গ্রাস পর্যন্ত তাঁর শাণিত কলমে রেয়াত পাননি। যখন তাঁর সামনে কোনও লেখা আসে, অক্ষরই সেখানে হয় শেষ কথা। নাম দেখে বইয়ের বিচার করেন না। ‘দ্য গার্ডিয়েন’ পত্রিকারই আরেক সমালোচক ফিলিপ অল্টারম্যান ২০১৬-এ হফম্যান সম্পর্কে লেখা এক প্রতিবেদনে লিখেছিলেন, ‘তাঁকে বিশ্বের সবচেয়ে প্রভাবশালী জার্মান থেকে ইংরেজি অনুবাদক হয়তো বলা চলে, যিনি অবলীলায় একাই কোনও লেখকের জীবন দাঁড় করিয়ে দিতে পারেন, যেমন করেছিলেন হান্স ফালাদা-র ক্ষেত্রে’।
লোকটার কলমের আঁচড় এত দাপুটে হলে কী হবে, মানুষটা বাস্তব জীবনে অত্যন্ত লাজুক, অন্তর্মুখ এবং মিতবাক।
সে বছরই পুরস্কারপ্রত্যাশী বইয়ের তালিকায় বুকারের লং লিস্টে ছিল সমকালীন জার্মান সাহিত্যের প্রথিতযশা সাহিত্যিক জেনি এরপেনবেকের উপন্যাস, যার ইংরেজি নাম ‘গো, ওয়েন্ট, গন’। শরণার্থী সমস্যা নিয়ে লেখা এ বইতে লেখিকার অন্যান্য বইয়ের মতোই কিছু বিষয় ছিল একই। এরপেনবেক সেই প্রজন্মের লেখককুলের সদস্য, যাঁরা বার্লিন প্রাচীরের পতন দেখেছেন যৌবনকালে। ১৯৮৯-’৯০ সালে জার্মানির রাজনৈতিক জীবনে যে পরিবর্তনগুলো ঘটে, তার একটা প্রেক্ষিত ছিল। এর আগে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তীকালে মিত্রশক্তির দেশগুলো জার্মানি দেশটার যে ভাগ বাঁটোয়ারা করেছিল নিজেদের মধ্যে, তাতে পূর্ব-পশ্চিম– এ দুটো ভাগের ফারাক বজায় ছিল ঠান্ডাযুদ্ধের শেষ অব্দি। জার্মানির পশ্চিমদিকে পাশ্চাত্যের হাওয়ায় উদারনৈতিক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় চলছিল পুঁজিবাদের রমরমা, আর উল্টোদিকে পূর্ব জার্মানিতে এ সময়েই বহাল ছিল সোভিয়েত অধীনস্থ সমাজতন্ত্রে শ্বাসরোধী সব নিয়মকানুন। যে সময়কালের কথা বলা হচ্ছে, তখন সোভিয়েত রাষ্ট্রপ্রধান মিখাইল গর্বাচেভ এই বন্দোবস্তে একটু ঢিলে দেন, পূর্ব জার্মানিতে তখন জায়গায় জায়গায় পাশ্চাত্যের উদারনৈতিক ব্যবস্থা লাগু করার জন্য আন্দোলন চলছে।
এমন সময় খানিক আচমকাই ১৯৮৯ সালের ৯ নভেম্বর বার্লিন প্রাচীর ভেঙে পড়ে, শুরু হয় দুই জার্মানির একত্রীকরণের প্রক্রিয়া। এই পরিবর্তনের সময়কালকে জার্মান ভাষায় অভিহিত করা হয় ‘দি ভেন্দ্অ’ (die vende) বলে, যার আক্ষরিক ইংরেজি হয় ‘দ্য টার্ন’। জেনি এরপেনবেকের প্রথম উপন্যাসিকা (ইংরেজি অনুবাদে ‘দ্য ওল্ড চাইল্ড’ ) থেকেই তিনি নিজের জাত চিনিয়েছিলেন। সাম্প্রতিককালে তো জার্মান পাঠকদের মধ্যে প্রায় প্রতিবছরই ধুয়ো ওঠে, ক’বে নোবেল পুরস্কারের জন্য তাঁর নাম ঘোষণা হয়।
সদ্য এ বছরের ইন্টারন্যাশনাল বুকার পুরস্কারের চূড়ান্ত ফল ঘোষণা হল। চূড়ান্তপর্বের বাছাই করা ছ’টা বইয়ের মধ্যে বিজয়ী ঘোষিত হল মূল জার্মান ভাষায় লেখা অনূদিত উপন্যাস ‘কাইরোজ’। ২০১৮ সালের ইন্টারন্যাশনাল বুকারের সেই বিচারক আর সেই প্রতিযোগী(র) এবার দুই মলাটে (যুগল)বন্দি। এ লেখার শুরুতে লেখিকার নাম না বলে অনুবাদকের নাম বললাম কেন, তা উপন্যাস পড়লেই বোঝা যাবে। তরতর করে এ বই এগিয়ে চলে, যেমন ভেসে চলে স্মৃতি আর ইতিহাসের খড়কুটো। এত সাবলীল ভাষার ছাঁদ, পড়তে পড়তে এক মুহূর্তের জন্য মনে হয় না, অনুবাদ পড়ছি– সেখানেই লেখিকার এবং সর্বোপরি অনুবাদকের সার্থকতা; উপন্যাস সুখপাঠ্য হয়ে ওঠে স্বাদু গদ্যের গুণে। হফম্যান আগে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ‘ইংরেজি ভাষা আসলে একটা ফাঁদ, প্রায় যেন একটা গুপ্তচরেরই ভাষা।’ ভাষার প্রকোষ্ঠে, অলিন্দে কতরকমের কারুকাজ। প্রচলিত ধারণা অনুযায়ী, যে অনুবাদক যত নিজেকে লেখকের শব্দের আড়ালে লুকিয়ে রাখে তার কাজ তত সার্থক। লেখকের কণ্ঠস্বরকে স্বার্থহীনভাবে শেরপার মতো এক ভাষা থেকে অন্য ভাষায় পথ চিনিয়ে নিয়ে যাওয়াই কি অনুবাদকের কাজ নয়? হফম্যান দ্বিধা-সহকারে স্বীকার করেছেন, তিনি যথেষ্টই তাঁর নিজের কণ্ঠস্বর অনুবাদকর্মটির উপর ন্যস্ত করেন। উদাহরণস্বরূপ জোসেফ রথের উপন্যাস অনুবাদ করার সময় জার্মান শব্দ ‘Baracke’-কে ইংরেজিতে ‘barracks’ করে দিলেই হয়তো ল্যাঠা চুকে যেত, কিন্তু তিনি ইচ্ছে করেই তার অনুবাদে ব্যবহার করেন ‘tenement’ শব্দটি। আরেকটি পরিচিত উদাহরণ– “কাফকার মেটামরফোসিস অনুবাদের দ্বিতীয় পরিচ্ছেদে গ্রেগর সামসা জিজ্ঞেস করে ‘Was ist mit mir geschehen?’ গড়পড়তা আক্ষরিক অনুবাদে হয়তো দাঁড়াত– ‘What happened to me?’, হফম্যান অনুবাদ করেন, “What’s the matter with me?” এই অনুবাদটা তাঁর পছন্দের, কারণ সারা রাত হুল্লোড়ের পর সকালে মাথায় ধোঁয়াশা নিয়ে এ বাক্যবন্ধ মনে আসাই বেশি সঙ্গত। সবার অলক্ষ্যেই কিন্তু মূল থেকে সরে দাঁড়ানো হল। তাতে এক চিলতে আত্মসম্মান, এক ছটাক সাহসিকতা, আর এক চিমটে মৌলিকতা মিশে গেল লেখায়। তাতে পুরো ব্যাপারটা অনেক স্বচ্ছন্দ ও সাবলীল মনে হবে। জার্মান ভাষার অনুকরণে ল্যাংড়ানোর চেয়ে ইংরেজি ভাষায় দৌড়ানো অনেক শ্রেয়”।
লেখকদের খবরদারি নিয়ে অভিযোগ করতে গিয়ে বলেছেন, কুন্দেরার মতো লেখকরা অনুবাদকদের কাজের জন্য খুবই কম স্থান বরাদ্দ করেন, সেটা তাঁর বিরক্তির উদ্রেক করে। তাই তিনি জীবনে মৃত সাহিত্যিকদের কাজই অনুবাদ করেছেন বেশি। তাঁরা বরং অনেক বেশি সহনশীল। প্রায় ৭০টা বইয়ের অনুবাদক হফম্যান এ বই অনুবাদ করতে কতটা স্বাধীনতার দাবি করেছেন, তা এ সব কথার প্রেক্ষিতেই স্পষ্ট হয়। ফলে এ প্রাপ্তি যতটা লেখকের, ততটা অনুবাদকেরও।
আগেই উল্লেখ করেছি যে জেনি এরপেনবেক ‘দি ভেন্দ্অ’ পরবর্তী সময়ের লেখিকা। যেদিন বার্লিন পাঁচিল ভাঙলো, তখন তিনি ২২ বছরের যুবতী, ইউনিভার্সিটিতে পড়াশুনো করেন। নভেম্বরের ৯ তারিখের সন্ধেটা বর্ডার থেকে একটু দূরেই বন্ধুবান্ধবদের সাথে কাটিয়েছিলেন তিলমাত্র আন্দাজ না করে যে, এক রাতের ঘটনায় কীভাবে জীবন আমূল বদলে যেতে চলেছে। ২০১৩ সালে এক প্রবন্ধে লিখছেন, সেদিন রাতে তিনি বন্ধুদের কাছ থেকে ফিরে এসে স্রেফ ঘুমিয়ে পড়েন। ‘আর আমি যখন ঘুমাচ্ছিলাম তখন শুধু পাত্রে নাড়া দিয়েই ক্ষান্ত হয়নি, বরং তা ভেঙে ফাটিয়ে টুকরো টুকরো করে ফেলা হয়েছে। পরের দিন সকালে উঠে জানতে পারলাম, আমাদের পাত্রের আর কোনো প্রয়োজনই নেই’। এরকম বিভিন্ন ভঙ্গিতে তিনি সে রাতের স্মৃতিচারণা করেছেন। ‘সেই মুহূর্ত পর্যন্ত যা কিছুকে বর্তমান বলে জেনে এসেছিলাম, এরপর থেকে সেসব কিছুই অতীত হয়ে গেল’। তিনি লিখছেন, তারপর থেকে তাঁর শৈশবের ঠাঁই হল জাদুঘরে…
এরপেনবেকের জন্ম পূর্ব জার্মানির এক বুদ্ধিজীবী পরিবারে। মা ডরিস কিলিয়াস আরবি ভাষার অনুবাদক– নোবেলজয়ী নাগিব মাফুজের সাথে কাজ করেছেন, বাবা জন এরপেনবেক পদার্থবিদ, দার্শনিক ও সুলেখক। ঠাকুর্দা ও ঠাকুমা ছিলেন কমিউনিস্ট– নামকরা মানুষ। ঠাকুর্দা ফ্রিটজ এরপেনবেক ছিলেন প্রকাশক, লেখক, পরবর্তীতে সমাজ সংস্কারক। ঠাকুমা হেদ্দা জিনার ছিলেন অভিনেত্রী ও লেখিকা। ঠাকুর্দার নামে এখনও জেনি এরপেনবেকের জন্মস্থান পাঙ্কোতে একটা রাস্তার নাম আছে। জেনির বাবা মা-র বিবাহবিচ্ছেদ হয় যখন তাঁর বয়স মাত্র পাঁচ। কিন্তু সে বিচ্ছেদের তিক্ততা জেনির জীবনে পড়তে দেয়নি তাঁর বাবা-মা। মা-র অভিনয়ের জন্য ঘুরে বেড়াতে বেড়াতে অপেরায় আসা। স্টেজের পিছনে টুকটাক কাজ করতে করতে শেখা। বার্লিন দেয়ালের পতন তাঁর জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেয়। ধীরে ধীরে শুরু হয় তাঁর লেখক জীবনে প্রবেশ। একাকিত্ব, আত্মজৈবনিক উপাদান, বর্তমানের সাথে ইতিহাসের সম্পৃক্ততা, স্মৃতির তাড়া করে ফেরা, কালখণ্ডের সমানুবর্তিতা– এসব প্রায় প্রথম উপন্যাস থেকেই তাঁর লেখায় জায়মান।
প্রথম উপন্যাসিকা ‘দ্য ওল্ড চাইল্ড’-এ দেখি বালতি হাতে দাঁড়িয়ে থাকা একটা মেয়েকে যখন কর্তৃপক্ষ জিজ্ঞেস করে তার বৃত্তান্ত, সে শুধু এটুকুই জানাতে পারে যে তার বয়স ১৪ বছর। তাকে একটা বাচ্চাদের হোমে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। সেখানে বাকিদের সাথে সে ঠিক খাপ খায় না ঠিকই কিন্তু তাকে দেখা যায়, সে-ই সবচেয়ে সন্তুষ্ট, সবচেয়ে বেশি নিয়মানুবর্তী, যেন এই নিয়মের শৃঙ্খলেই সে মুক্তি পেয়েছে। কোথা থেকে সে পালাতে চেয়ে এখানে আশ্রয় নিয়েছে তা কেউ জানে না, কোন আতঙ্কের ভয়ে ত্রস্ত হয়ে এ জীবনে নিরাপত্তা খুঁজেছে তাও কেউ জানে না, ছোটদের মধ্যে লুকিয়ে বয়স্ক শরীরের কদর্যতা ঢাকতে পারে না সে। কোঁচকানো চামড়া, বুড়ো ত্বকের বিবরণে অনবধানে ঠারেঠোরে জার্মান রাষ্ট্রের বৈপরীত্য ও পাশ্চাত্যের নব্য পুঁজিবাদকে সম্বল করে শিং ভেঙে বাছুরের দলে জোটার ধান্দাকে যেন তীব্র বিদ্রূপ করে এই লেখা। এই লেখারই সহযোগী পাঠ হতে পারে ‘নট আ নভেল: মেমোয়ার্স ইন পিসেস’-এর একটা লেখা, যার নাম ‘হাউ আই রাইট’। তখন এরপেনবেকের ২৭ বছর বয়স, সদ্য ইউনিভার্সিটি থেকে ডিপ্লোমা করে বেরিয়ে সপ্তাহে তিনদিন একটা বেকারিতে কাজ করেন। আগস্ট মাসের শেষদিকে স্কুলগুলো খোলে। বেশ কিছু ফোনকল করার পর শেষমেশ একজন স্কুলের প্রিন্সিপালকে খুঁজে পান, যিনি এক অনবদ্য বন্দোবস্ত করতে রাজি হন। এরপেনবেক ক্লাস ইলেভেনে ভর্তি হবেন জাল বয়স, জাল নাম এবং জাল ঠিকানায়, তাঁর বইয়ের উপাদান সংগ্রহ করার জন্য। তারপর আর কী? সেপ্টেম্বরের পয়লা তারিখে ‘নতুন মেয়ে’ সেজে তিনি ক্লাসে গিয়ে হাজির। হঠাৎ করেই এক লহমায় বয়স দশ বছর কমে যায় যেন।
এ বছরের বুকার পুরস্কার বিজয়ী বই ‘কাইরোজ’-এ পূর্ব জার্মানির ইতিহাস এরপেনবেকের আগের বইগুলোর তুলনায় অনেক বেশি সোজাসুজি, স্পষ্ট। এক অসমবয়সি প্রেমের গল্প শুরু হয় স্মৃতির বাক্স হাতড়ে। মূল চরিত্রদ্বয় হ্যান্স ও ক্যাথরিনার সম্পর্কের সূত্র ধরে গল্প এগোয়। ১৯৮৬-তে যখন দু’জনের প্রথম আলাপ হয়, তখন হ্যান্সের বয়স ৫৩, ক্যাথরিনা মাত্র ১৯। তারপর রম-কমের গড়পড়তা গল্পে যেমন হয় আর কি– বাসে দৃষ্টি বিনিময়– হঠাৎ একই স্টপেজে নেমে আবিষ্কার যে গন্তব্য এক– হাঙ্গেরিয়ান কালচারাল সেন্টার– কফি?– গিয়ে আবিষ্কার, নাহ্, দোকান বন্ধ– গানের রুচি মেলায় হু হু করে ঘনিষ্ঠতা বৃদ্ধি; সেখান থেকে প্রেম-যৌনতা-সংসার-বাইরের সম্পর্ক-বিশ্বাসভঙ্গ-মৃত্যু।
ক্যাথরিনা যখন হ্যান্স এর মৃত্যুসংবাদ পায়, তখন সে আমেরিকায়। ছ’মাস পর ক্যাথরিনা জার্মানিতে ফিরলে হ্যান্স এর ব্যবহার্য জিনিস ফেরত পায় দুটো বাক্সে। তাদের প্রেমপর্বের চিঠি, কাগজপত্র, ডায়রি ইত্যাদি। উপন্যাসেও তাই আখ্যানপর্ব বিভক্ত বাক্স এক, বাক্স দুই হিসেবে। এই চিঠি, কাগজপত্র, ডায়রি বাধ্য করায় স্মৃতি রোমন্থনে। জীবন রঙের তাস বিছানো আর পাঁচটা প্রেমের উপন্যাসের মতোই প্লট, শুরুতেও এমন আহামরি কিছু নেই। কিন্তু সেটুকু বললে কম বলা হয়। এ উপন্যাসের চুম্বকগুণ চোখে ধুলো দেবে এর শব্দবিন্যাসে এবং গল্প বলার কায়দায়। উপন্যাস নামিয়ে রাখার জো নেই, আবার পড়তে পড়তে যে দমবন্ধ করা কষ্ট হতে থাকবে তাকে প্রকাশ করার ভাষা পাওয়াও দুষ্কর। এখানেই এই উপন্যাসের সার্থকতা। এ শুধু শব্দসৌধই রচনা করে না, পড়তে পড়তে একসময় পাঠক আবিষ্কার করে যেন সেই সৌধের মেঝেতে যে শবাধারটি শোয়ানো সেটিতে সে কখন নিজেই বন্দি হয়ে গেছে টের পায়নি। সেসময় গুপ্তচর (যাদের জার্মান নামের সংক্ষেপ অপভ্রংশ ‘স্ট্যাসি’) পরিবৃত পূর্ব জার্মানির সদাসতর্ক প্রহরাময় জীবনে সেখানকার বাসিন্দাদের যা অনুভূতি তাও উপন্যাসের পরতে পরতে লেপ্টে থাকে। যেমন ক্যাথারিনার বন্ধু সিবিলকে স্ট্যাসি ধরে নিয়ে গিয়ে সারারাত থানায় আটকে রাখে। মেয়েটিকে বাড়িতে ফোন করতে দেওয়া হয় না। জামাকাপড় খোলানো হয় দেখার জন্য যে তার ‘পিছনে কোনও বন্দুক গোঁজা আছে কি না’। লক্ষ্যণীয় বিষয়, উপন্যাসে এসব অত্যাচারের বিবৃতি লেখা নিরাসক্ত ভাষায়, কখনও বা ঈষৎ বিরক্তি, রাগ। ব্যস, ওটুকুই। আসলে সন্ত্রাস এবং ষড়যন্ত্রের বাতাবরণ যখন প্রাত্যহিকতার অঙ্গ হয়ে যায়, তখন অর্থহীন পুলিশি উপদ্রবে মানুষ নিস্পৃহ হয়ে থাকে। ক্যাথরিনা যখন থিয়েটারের ইন্টার্নশিপ পেয়ে ফ্রাঙ্কফুর্ট যায় কিছুদিনের জন্য, তখন তাদের সম্পর্ক নতুন মোড় নেয়। ফ্রাঙ্কফুর্ট-এ ক্যাথরিনার বন্ধুত্ব হয় তার সহকর্মী ভাদিমের সঙ্গে।
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
এরপেনবেকের জন্ম পূর্ব জার্মানির এক বুদ্ধিজীবী পরিবারে। মা ডরিস কিলিয়াস আরবি ভাষার অনুবাদক– নোবেলজয়ী নাগিব মাফুজের সাথে কাজ করেছেন, বাবা জন এরপেনবেক পদার্থবিদ, দার্শনিক ও সুলেখক। ঠাকুর্দা ও ঠাকুমা ছিলেন কমিউনিস্ট– নামকরা মানুষ। ঠাকুর্দা ফ্রিটজ এরপেনবেক ছিলেন প্রকাশক, লেখক, পরবর্তীতে সমাজ সংস্কারক। ঠাকুমা হেদ্দা জিনার ছিলেন অভিনেত্রী ও লেখিকা।
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
হ্যান্স যখন ক্যাথরিনার শরীর-সম্পর্কের কথা জানতে পারে, তখন যেন আকাশ ভেঙে পড়ে। এখানে লক্ষণীয়, এমন নয় যে হ্যান্স বরাবর ক্যাথরিনার কাছে বিশ্বস্ত থেকেছে। এমনকী, সময়বিশেষে নিজের যৌন অভিজ্ঞতা নিয়ে ঢাক পিটিয়েছেও বেশ কয়েকবার, কিন্তু ক্যাথরিনার ক্ষেত্রে সে রেগে ফেটে পড়ে। ঘণ্টার পর ঘণ্টা ধরে সে গালিগালাজ, খিস্তিখেউড় রেকর্ড করে পাঠাতে থাকে ক্যাথরিনাকে। এখানে বিষাক্ত পুরুষতান্ত্রিক কাঠামো ব্যতিরেকেও এরপেনবেক আলো ফেলে দেখান হ্যান্সের মনস্তত্ত্বের চোরকুঠুরিগুলো। হ্যান্স ক্যাথরিনার চেয়ে বয়সে এত বড় হওয়ার কারণে শৈশবের প্রথম বছরগুলোতে আতঙ্কে আর অনিশ্চয়তায় প্রহর কাটিয়েছে, নিজের চোখে দেখেছে হিটলারি শাসনকাল। এক নিষ্ঠুর নাৎসি বাবার হাতে মার খেতে খেতে তার বড় হয়ে ওঠা। ক্যাথরিনার প্রতি হ্যান্সের নিষ্ঠুরতা পড়তে পড়তে আমাদের মনে পড়ে যাবে আর্ট স্পিজেলম্যানের বিখ্যাত গ্রাফিক নভেল ‘মাউস’-এ কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্প ফেরত স্পিজেলম্যানের বাবার তিক্ততার কথা– সবসময় খিটখিটে, একগুঁয়ে, জেদে, একল্ষেঁড়ে যে লোকটা বেঁচে ছিল, সে ‘আসল মানুষ নয়’। হ্যান্সও যখন কলম ধরে, তার লেখায় মস্কো শহরটাই হয়ে ওঠে স্বপ্নের শহর– আস্থার প্রতিভূ। ক্যাথরিনা যখন দেওয়াল পেরিয়ে জার্মানির ওদিকে যাওয়ার ছাড়পত্র পায়, তখন কালোন ক্যাথিড্রাল দেখার জন্য উৎসাহে ডগমগ করে। হ্যান্স তাতে কোনও আমল না দিয়ে বলে, ক্রেমলিনের গম্বুজ কোনও অংশে কম যায় না। দুই প্রজন্মের এই দ্বৈত আসলে পূর্ব জার্মানি আর পশ্চিম জার্মানির বোঝাপড়া। পাশ্চাত্যমুখী নতুন প্রজন্ম বনাম কমিউনিস্ট শাসনে বড় হওয়া ‘পূর্ব’ প্রজন্ম।
এবার আসা যাক, বুকার পুরস্কার অনুষ্ঠান প্রসঙ্গে। অনুষ্ঠানের বহর এবং আড়ম্বর দেখে উপন্যাসের দুই প্রজন্মের মতোই, দুই প্রজন্মের পাঠককুলের কথা মনে পড়ে বেশি। বুকার পুরস্কার শুরু করেছিল ১৯৬৯ সালে ‘বুক ট্রাস্ট’ নামের এক সংগঠন। তখন ভাবা হয়েছিল, কমনওয়েলথ দেশগুলোয় যদি কেউ ইংরেজি ফিকশন লেখে, এবং তা যদি ব্রিটেন যুক্তরাষ্ট্রে প্রকাশিত হয়, তবে তা বুকার পুরস্কারের জন্য গণ্য করা হবে। এতে সাম্রাজ্যবাদী ইংরেজের সাংস্কৃতিক আধিপত্য বজায় রাখার গোপন উদ্দেশ্য কী ছিল না ছিল তা নিয়ে গবেষণা ও লেখালেখি হয়েছে বিস্তর, আমি সেসবে যাচ্ছি না। ২০০২ সাল থেকে পুরস্কারের দায়িত্ব সামলাত ‘ম্যান ট্রাস্ট’, তাই নাম দেওয়া হয়েছিল ‘ম্যান বুকার প্রাইজ’। আমরা যে পুরস্কার নিয়ে কথা বলছি, সেই বুকার ইন্টারন্যাশনালের পথ চলা শুরু ২০০৫ সালে। তখন স্বাভাবিকভাবেই তার নাম ছিল ‘ম্যান বুকার ইন্টারন্যাশনাল’। ২০১৯ সালে ম্যান গ্রুপের সঙ্গে সংগঠনের মতানৈক্য ঘটলে, নতুন সংগঠন ‘ক্র্যাংকস্টার্ট চ্যারিটি ট্রাস্ট’ দায়িত্বভার গ্রহণ করে, যারা বর্তমানে অর্থভারবহনের দায়িত্বে আছে।
এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন, যা অনেকেই গুলিয়ে ফেলেন, বুকার ইন্টারন্যাশনাল আর বুকার প্রাইজ আলাদা। বুকার ইন্টারন্যাশনাল দেওয়া হয় অন্য কোনো ভাষায় প্রকাশিত যে বইগুলো ইংরেজিতে প্রকাশিত হয় উল্লেখিত বিশেষ ভূখণ্ডে, সেগুলোকে। প্রথমে প্রতি দু’বছর অন্তর দেওয়া হত বুকার ইন্টারন্যাশনাল পুরস্কার। ২০১৬ সাল থেকে প্রতি বছরই দেওয়া হয় এ পুরস্কার। পুরস্কারের অর্থমূল্যও বিপুল। ৫০ হাজার পাউন্ড (ভারতীয় মুদ্রায় প্রায় ৫৩ লাখ টাকার কাছে) লেখক ও অনুবাদক অর্ধেক অর্ধেক করে পান। শর্ট লিস্টে ওঠা লেখক ও অনুবাদকরা প্রত্যেকে পান আড়াই হাজার পাউন্ড করে। এ বছর বুকার দীর্ঘ তালিকায় যে বইগুলো স্থান পেয়েছিল তাতে লাতিন আমেরিকার উপস্থিতি ছিল চোখে পড়ার মতো। কিছু কিছু পত্রপত্রিকায় এমনকী, লেখা হয়েছিল ছয়ের দশকের লাতিন আমেরিকার ‘বুম’ পর্বের পর আবার এই দ্বিতীয় তরঙ্গ আছড়ে পড়ল বোধহয়। মূলপর্বের মনোনয়নের জন্য স্প্যানিশ, পর্তুগিজ, জার্মান, কোরিয়ান, ডাচ ও সুইডিশ ভাষার বই নির্বাচিত হয়েছিল। দেশের নিরিখে লাতিন আমেরিকা থেকে ছিল আর্জেন্টিনা ও ব্রাজিলের বই। নজর কেড়েছে দক্ষিণ কোরিয়ার অবস্থান, ২০০৫-এ পুরস্কারের সূচনা থেকে এই নিয়ে সপ্তমবার দক্ষিণ কোরিয়ার উপন্যাস এই পুরস্কারের জন্য মনোনীত হল।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
আরও পড়ুন পৃথু হালদার-এর লেখা: টাইগার পতৌদির ক্রিকেটই ছিল একচোখের দৃষ্টি হারানো বিষণ্ণ রুশদির অনুপ্রেরণা
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
আগের বছরের মতোই এ বছরের অনুষ্ঠানে কিছু নতুনত্ব বহাল থাকলে, যা বদলাতে থাকা পাঠরুচি ও অক্ষর-সংস্কৃতির নিরিখে বিশেষ ইঙ্গিতবাহী। আশ্চর্যের বিষয়, এ নিয়ে সেরকম কোনও লেখা চোখে পড়ল না। এ তালিকার শীর্ষে অবশ্যই থাকবে বুকটিউবার ও বুকস্টগ্রামারদের সংযোজন। পাঠসংস্কৃতির যে দ্রুত বদল হচ্ছে, এ কথা দেখা গেল বুকার প্রাইজের অনুষ্ঠানেই।
ইউটিউবে যাঁদের বই সংক্রান্ত চ্যানেল আছে, তাঁদের বুকটিউবার বলে, ইন্সটাগ্রামে যাঁদের বই সংক্রান্ত পেজ আছে তাঁদের বুকস্টাগ্রামার বলে। আগের বছরই বুকার প্রাইজের অনুষ্ঠান লাইভ স্ট্রিমিং-এর সঞ্চালক ছিলেন জ্যাক এডওয়ার্ডস। এ বছর ইন্টারন্যাশনাল বুকারের অনুষ্ঠানেও দেখা গেল তাঁকে। ১.৩৬ মিলিয়ন ইউটিউব চ্যানেলের সাবস্ক্রাইবারের সংখ্যাটাই প্রমাণ করে তরুণ প্রজন্মের কাছে তাঁর জনপ্রিয়তা। বুকস্টাগ্রামার কমিউনিটি থেকে আমন্ত্রিত ছিলেন সারা গোনিওমা ও বার্নি লোম্বার্ডি। Whatsarareadnext Bernie Lombardi– এঁদের ইনস্টাগ্রামের ঠিকানা। ডিজিটাল মাধ্যমের পাঠচক্র ভালো না খারাপ, সে নিয়ে বিস্তর বিতর্কের অবকাশ থাকবে। গ্রন্থসংস্কৃতিতে অর্থের ত্রাহ্যস্পর্শ কতটা মুনাফাকামী আর কতটা আদর্শকামী সে নিয়েও আলোচনা হতে পারে বিস্তর। আপাতত সে নিয়ে জলঘোলা না করেও একথা বলা যায়– কিন্ডেলে পড়া, গুডরিডস, ইউটিউব আর ইন্সটাগ্রামে বইয়ের রেকমেন্ডেশন নিতে অভ্যস্ত হওয়া পাঠকপ্রজন্ম বনাম আগের প্রজন্মের পাঠককুল– মেরুকরণের এই দুই প্রান্তে বসে দুই প্রজন্মের অক্ষরপ্রেম যেন ‘কাইরোজ’ উপন্যাসের দুই প্রজন্মের অসমবয়সি মানুষের প্রণয়ের অস্তরাগ।