গব্বর সিং কিন্তু হয়ে গেল ফেনোমেনন। লহমায়। কেন? গব্বরের মতো গ্রাম্য ডাকু কি আদতে চারপাশে অমিল? না কি গব্বর রীতিমতো জাসুসি সাহিত্যের পাল্পীয় পাতা থেকে উঠে আসা, ওয়েস্টার্ন-এর গন্ধমাখা কিঞ্চিৎ অবাস্তবীয় ডাকু বলেই তার ‘পঁচাস পঁচাস কোস দূর গাঁও মে’-র হুংকার আতঙ্কের সঞ্চার না করে ভারতীয় জনমানসে শিহরন জাগাল?
১৬.
‘আংরেজো কে জমানা কে জেলার হ্যায়’…, হিটলারের মতো গোঁফ, ‘দ্য গ্রেট ডিক্টেটর’-এর ঢংয়ে গ্লোব নিয়ে নাড়াচাড়া– সব মিলিয়ে ‘শোলে’-র ‘কমিক রিলিফ’ আসরানি-র মধ্যে কতটা হিটলার ছিল, আর কতটা চ্যাপলিন– তা বিচার্য। কিন্তু ‘পুলিশ তুমি যতই মারো’-র জমানায় ওই হাস্যরসের খোরাক জেলারকে রসিয়ে রসিয়েই উপভোগ করেছিল একাংশের বঙ্গবাসী, তাই নিয়ে কোনও সংশয় থাকার কথা নয়। কপ ইউনিভার্স তখনও তৈরি হয়নি। তাই এমন জনমোহিনী ছবিতে পুলিশের উপস্থিতি ছিল রীতিমতো নগণ্য। ‘শোলে’-র শুরুতে ও শেষে প্রায় অকিঞ্চিৎকর সূত্রধর ছাড়া পুলিশের কোনও ভূমিকা নেই। ঠাকুরসাহাব পুলিশ ছিল বটে, ‘হাত নেহি হাতোড়া হ্যায়’ মার্কা সংলাপ দিয়েই সে গব্বরকে পাকড়াও করেছিল, কিন্তু আইনের সেই হাত কেটে নিয়ে গব্বরের তামাশা প্রমাণ করেছিল, প্রতিশোধ বা ন্যায়বিচারের প্রশ্নে, প্রশাসন শেষত ঠুটো জগন্নাথ। যা করার করবে মানুষ, সে সংশোধিত চোর-ডাকাত হতে পারে, আবার হতে পারে অধুনায় উর্দিহীন, আইনের সেই হাতোড়াসম হাতবিহীন এক পুলিশ অফিসারও।
‘দিওয়ার’, ‘জঞ্জির’, ‘শোলে’-র তুঙ্গ জনপ্রিয়তার মূলে এই অ্যান্টি হিরো আবেদন ও প্রতিষ্ঠানবিরোধী নায়কের ইমেজ ছিলই। কিন্তু ‘জঞ্জির’ বা ‘দিওয়ার’-এর খলনায়ককে কে মনে রেখেছে? গব্বর সিং কিন্তু হয়ে গেল ফেনোমেনন। লহমায়। কেন? গব্বরের মতো গ্রাম্য ডাকু কি আদতে চারপাশে অমিল? না কি গব্বর রীতিমতো জাসুসি সাহিত্যের পাল্পীয় পাতা থেকে উঠে আসা, ওয়েস্টার্ন-এর গন্ধমাখা কিঞ্চিৎ অবাস্তবীয় ডাকু বলেই তার ‘পঁচাস পঁচাস কোস দূর গাঁও মে’-র হুংকার আতঙ্কের সঞ্চার না করে ভারতীয় জনমানসে শিহরন জাগাল? নানা কাহিনিতে, আখ্যানে গব্বর হয়ে উঠল রঙচঙে কমিকসের ছবির মতো। প্যান-ভারতীয় দস্যু মোহন হয়ে উঠল গব্বর। সঙ্গে সঙ্গে আমজাদ খান হয়ে উঠলেন একমেবদ্বিতীয়ম!
উত্তর কলকাতার এক যুবক, যে কিনা অমন অস্থির সময়েও পুলিশের চাকরির জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে, সে রোয়াকে আড্ডা মারতে এসেই বলত, ‘ও সামভা, কিতনে ইনাম রাখা হ্যায় সরকার হাম পর?’ বাকিরা উত্তর দিত, সমস্বরে, ‘পঁচাশ হাজার!’ পুলিশ হয়ে যাওয়ার পর সে আর পাড়ায় ওই সংলাপ দিত কি না জানা নেই। কিন্তু ততদিনে হাতিবাগানের বাজারে নাকি কান পাতলেই শোনা যাচ্ছে, ‘হোলসেল আমজাদ খান! হোলসেল আমজাদ খান!’ আমজাদীয় শার্ট বিক্রি করার স্লোগান হয়ে উঠল এটি। সেই শার্ট আদতে গব্বরের ওই খাকি শার্টের কাছাকাছি। নিশ্চয়ই কেউ না কেউ কিনেওছেন সেইসব শার্ট। তাহলে কি গব্বর ‘আইকন’ হয়ে উঠছে সেই সময়? না কি, স্টাইল স্টেটমেন্ট, সংলাপ এসবই বিনোদন ও জনজীবনের সংলগ্ন ইতিহাসের অংশ হয়ে উঠে সময়ের স্মারক হয়ে থেকে যাচ্ছে? মিখাইল বাখতিনের ‘কার্নিভাল’ তত্ত্বের আধারে ভাবলে বাড়াবাড়ি হতে পারে, তাও যদি ভাবা যায়, সবরকমের সামাজিক শ্রেণি, ভাষিক বর্গ ‘শোলে’-কে উদযাপন করেছিল একমাত্রিক কোনও চেতনায়, তাহলে ভুল হবে কি বিশেষ? বিদগ্ধ জনরা বলতে পারবেন। তবে ওই ‘হোলসেল আমজাদ খান’-এর কার্নিভাল তত্ত্বায়িত হোক ছাই না হোক, তা তো তৎকালীন জনসংস্কৃতির পরিসর বুঝতে সাহায্য করাবেই আজকের দিনে দাঁড়িয়ে।
‘শোলা অউর শবনম’, ‘বন্দিনী’, ‘আপ কি পরছাঁইয়া’, ‘অনুপমা’, ‘আয়ে দিন বাহার কে’-র ধর্মেন্দ্র নিমেষে ‘হি ম্যান’ হলেন তো ‘শোলে’-র সূত্রেই। ‘মেরা গাঁও মেরা দেশ’ বা ‘জুগনু’ থেকেই তো তিনি আর দিলীপকুমার, সুনীল দত্ত, দেব আনন্দ-দের উত্তরসূরি নন, তিনি সত্তরের নতুন নায়ক। যে ভদ্রশ্রেণির প্রতিনিধি তিনি হয়ে ছিলেন চলচ্চিত্র-জীবনের প্রথম দিকে, এখন আর তিনি তা নন, বরং পাড়ার লোফার থেকে মস্তান, সকলেই তার ‘চাক্কি পিসিং অ্যান্ড পিসিং’ থেকে ‘চুন চুনকে মারেঙ্গা’-য় মজল। ‘অ্যাংরি ইয়ং ম্যান’-এর ইমেজ ভেঙে মরণপণ হওয়া বন্ধু ও অব্যক্ত, ট্র্যাজিক প্রেমিক হয়ে ওঠা অমিতাভ ও ভাবগম্ভীর ঠাকুর সঞ্জীবকুমারের পাশে বাসন্তী-রূপী হেমা মালিনীকে কোমরে হাত দিয়ে বন্দুক চালানো শেখানোর অপচেষ্টা করা, মাতালের অভিনয় করে, আত্মহত্যার ছল করে বাসন্তীর মাসিকে প্রণয়ে রাজি করানো এবং শেষে গব্বরকে শ্বাসরোধ করার কাষ্ঠকঠিন প্রয়াসে তিনি হয়ে উঠলেন হিন্দি সিনেমার নব্য লুম্পেন প্রলেতারিয়েত।
আর হেমা মালিনী? বি টি রোডগামী বাসে, সাতের দশকের শুরুর দিকে একবার এক মহিলা সহযাত্রী পুরুষকে ‘সঠিকভাবে দাঁড়াতে’ বলায় সেই পুরুষ নাকি ঠোঁট বাঁকিয়ে বলেছিলেন, ‘উঁহ, হেমা মালিনী!’ নায়িকা হিসেবে এমনই ধরাছোঁয়ার বাইরে ততদিনে চলে গিয়েছেন ‘সীতা অউর গীতা’, ‘শরিফ বদমাশ’ বা ‘প্রেম নগর’-এর নায়িকা। ‘বাসন্তী, কুত্তো কে সামনে মত নাচ না’ বলার পর কাচের টুকরোয় পা ফেলে ‘রক্তমাখা চরণতলে’ তাঁর একলা চলো রে-র নাচ ট্র্যাজিক বা রোমান্টিক হল না বিশেষ, লতা মঙ্গেশকরের তীব্র কণ্ঠে ‘যবতক হ্যায় জান, যানে জাঁহা’-ও ‘হিট’ করল না তেমন। কিন্তু ওই নাচের প্রেক্ষিত হয়ে উঠল খোরাকের অনিবার্য উপকরণ। বরং, ‘মেহবুবা মেহবুবা’-তে হেলেনের মোহময়ী আরব্য রজনীর গল্প থেকে উঠে আসা নাচের দৃশ্য ও তৎপরবর্তী বিস্ফোরণ ও অ্যাকশনে অত্যধিক উত্তেজিত হত দর্শক। এমনটা কেন? ভীরু-বাসন্তীর প্রেম যেন পূর্বনির্ধারিত। তার মধ্যে চটুলতা ছিল, হাস্যরস ছিল, যৌনতার আভাস ছিল। ‘হোলি কে দিন’ গানে যখন গ্রামের পুরুষরা পিচকিরি তাক করেন গ্রামের মহিলাদের দিকে, প্রেম-সম্পর্কের ক্ষমতায়নের সমীকরণে চেনা গ্রামভারতীয় কাঠামোই সেখানে স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল। জয়-রাধার প্রেমে মাউথ অর্গানের সুর যে বিরহ বুনেছিল, এবং জয়া বচ্চনের অভিনয়ে রংহীন, শ্বেতশুভ্র ছোঁয়াচ যে অনন্ত হাহাকার রেখেছিল, তা-ই বোধহয় ছিল এই অ্যাকশনভর ছবির একমাত্র রোমান্টিক আভাস! ইয়ুং-কথিত সমষ্টিগত অচেতনে যে পৌরাণিকতা খোঁজার চেষ্টা থাকে, ভারতীয় কালেকটিভ আনকনশাস সেই মার্গেই ওই বৈষ্ণবীয় ছলচাতুরি ও রগরগে রগড়ের বদলে অমন ‘শূন্য মন্দির মোর’-এর বিষাদকেই বেছে নিল কি?
ম্যাকমোহনের সামভা থেকে কালিয়া- সকলেই ‘শোলে’-র কয়েনেজের অংশ হয়েছে। অফিসের মিটিং থেকে পরীক্ষার রেজাল্টের আগের দিন, ‘তেরা কেয়া হোগা কালিয়া’-র প্রয়োগ হয়েছে নানাভাবে। তবে ২০০১ সালের ৯/১১-র পর এক পাড়াতুতো কাকু বাজার করতে এসে যা বলেছিলেন, তা মনে থাকবে আজীবন। নির্লিপ্ত গাম্ভীর্যের সঙ্গে তিনি বলেছিলেন, ‘‘গব্বর ‘ও সামভা’ (পড়ুন, ওসামা) বলে যে মালটাকে ডাকছিল, সে এত বড় হয়ে গেল?’’
…পড়ুন জনতা সিনেমাহল-এর অন্যান্য পর্ব…
পর্ব ১৫। ‘শোলে’-র চোরডাকাতরা এল কোথা থেকে?
পর্ব ১৪। ‘শোলে’-তে কি ভারত আরও আদিম হয়ে উঠল না?
পর্ব ১৩। ‘জঞ্জির’ দেখে ছেলেটা ঠিক করেছিল, প্রতিশোধ নেবে
পর্ব ১২। ‘মেরে পাস মা হ্যায়?’-এর রহস্যটা কী?
পর্ব ১১। ইন্দ্রজাল কমিকস-এর গ্রামীণ নায়ক বাহাদুর পাল্পে এসে রংচঙে হল
পর্ব ১০। দু’টাকা পঁচিশের টিকিটে জমে হিরোইনের অজানা ফ্যানের স্মৃতি
পর্ব ৯। খান্না সিনেমায় নাকি পৌরাণিক সিনেমা চলছে
পর্ব ৮। পাড়াতুতো ট্র্যাজেডিতে মিলে গেলেন উত্তমকুমার আর রাজেশ খান্না
পর্ব ৭। পাড়ার রবিদা কেঁদেছিল ‘কাটি পতঙ্গ’ আর ‘দিওয়ার’ দেখে, সাক্ষী ছিল পাড়ার মেয়েরা
পর্ব ৬। যে কলকাতায় পুলিশ-পকেটমার মিলেমিশে গেছে, সেখানে দেব আনন্দ আর নতুন করে কী শিরশিরানি দেবেন?
পর্ব ৫। হিন্দি ছবির পাপ ও একটি অ্যাডাল্ট বাড়ির গল্প
পর্ব ৪। দেব আনন্দ, একটি বোমা ও অন্ধকারে হাত ধরতে চাওয়ারা
পর্ব ৩। অন্ধকারে ঢাকা পড়ল কান্না থেকে নিষিদ্ধ স্বপ্ন!
পর্ব ২। ‘জিনা ইঁয়াহা মরনা ইঁয়াহা’ উত্তর কলকাতার কবিতা হল না কেন?
পর্ব ১। সিনেমা হলে সন্ত্রাস ও জনগণমন-র দলিল