যে গান হয়ে উঠল ‘বিবিধের মাঝে মিলন মহান’-এর আদত মন্ত্র, তা কিন্তু প্রেমের গান। রফি, লতা, মুকেশ, তালাত মাহমুদ, গীতা দত্ত থেকে কিশোরকুমার হয়ে যে গানের পরম্পরায় কোনও ছেদ পড়েনি দীর্ঘকাল যাবৎ। কিন্তু পার্থ চট্টোপাধ্যায় যাকে বলেছিলেন ‘মেলডি’-র শাসন, তা অবিচ্ছেদ্য হয়ে উঠেছিল জনজীবনের সঙ্গে। যেজন্য ষাটের শেষ-সত্তরের শুরুর সেইসব অস্থির বুধবার ‘বিনাকা গীতমালা’ শুনতে গোপন নকশাল পার্টি ক্লাস থেকেও পালাতে চাইত তরুণরা।
১৭.
বিক্রমাদিত্য মোতওয়ানে-র ‘জুবিলি’ স্বাধীনতার আগের বলিউডি সিনেদুনিয়াকে ধরতে চেয়েছিল। টকিজের আগমন ও স্টুডিও ব্যবস্থার সেই অন্দরকথায় কতটা হিমাংশু রায় ও দেবিকা রানির গল্প লুকিয়ে ছিল, তা অন্য প্রসঙ্গ। কিন্তু ‘জুবিলি’ সিরিজের আখ্যানের সিংহভাগ দাঁড়িয়ে ছিল অমিত ত্রিবেদী নির্মিত গানগুলির ওপর। চারের দশকের সুর ও শব্দের সঙ্গে সেসব গান পুরোপুরি মেলে না, বরং পাঁচ-ছয়ের দশকের মেলোডির এক পুনর্নির্মাণ ঘটেছিল ‘জুবিলি’-তে। এই সিরিজের রিফিউজি ক্যাম্পের ভেতর শিক্ষামূলক গান থেকে শুরু করে শেষ গান তক আদতে ট্রিবিউট রাখা ছিল শচীনদেব বর্মন থেকে শঙ্কর-জয়কিষেণ, মদনমোহন থেকে ওপি নায়ারের বিপুল সংগীত-সম্ভারের প্রতি। এর মধ্যে সিরিজে ব্যবহৃত শেষ গানটি ছিল ‘সারে কে সারে আকেলে’। সেই গানের সুরে অবিশ্রান্ত প্যাথোসের পরেই ছিল এক অনিবার্য উত্থান, যেমনটা সলিল চৌধুরীর ‘ও আলোর পথযাত্রী’-র শেষে এসে ঘটে। সেই উত্থান কেবল সুরের নয়, কথারও– ‘মেহফিলে হাসিন হো/ মোহব্বতে জওয়ান হো/ খোয়াবোঁ কি ইয়ে বুলবুলে/ বস ইঁউহি আজাদ হো… খোয়াবোঁ কি ইয়ে বুলবুলে/ বস ইউঁহি আবাদ হো’। স্বাধীন দেশ স্বপ্নের, আকাঙ্ক্ষার। এই সিরিজে কোনও প্রেম পূর্ণ হয় না। একদিকে মিলন ও বৈভবের স্বপ্ন যখন বিলীন হচ্ছে, জমা হচ্ছে ফেলে আসা বাতিল ফিল্ম রিল; তখন দেশ স্বাধীন হচ্ছে নতুন সমষ্টিগত চেতনায়। একদিকে এককের অন্তহীন বিরহ, অন্যদিকে কৌমের কামনা। দেশ কি আদৌ সেই কামনা কোনও দিন চরিতার্থ করবে? না কি দেশও সেই প্রেমিকের মতো, যে প্রেমিকাকে নীরব অপেক্ষায় রাখে, বিচ্ছেদের বার্তাটুকুও দেয় না? সেই প্রশ্নের উত্তর থাকে না, কিন্তু কৌসর মুনিরের লেখা এই গানের ‘আজাদ’ ও ‘আবাদ’ শব্দদ্বয়ে ধরা থাকে এক যৌথ স্বপ্নআলেখ্য, যা থেকে যাবে, শত মিথ্যে, সহস্র প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ, বিশ্বাসঘাতকতা সত্ত্বেও।
দেশ এমন নানা গানেই স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছিল সেই পাঁচ-ছয়ের দশকের বলিউড থেকেই। কিন্তু এখানে একটি অন্য বিষয় নিয়ে ভাবনার প্রয়োজন। ডগলাস ফেয়ারব্যাঙ্কস অভিযোগ করেছিলেন, হলিউডে রং আসার পর রং-ই দর্শকের চোখকে টেনে রাখছে, এবং সাদা-কালো ছবির সারল্য প্রতি পদে নষ্ট হচ্ছে। শব্দের ক্ষেত্রেও কি এমন কিছু ঘটেছিল? বাস্তবানুগ হতে গিয়েই সিনেমায় প্রযুক্তির সহচর হয়ে শব্দ এসেছিল, না কি চলচ্চিত্রে শব্দ আদতে উৎপাদনের অর্থনীতির সঙ্গে সম্পর্কিত হয়ে এসে পৌঁছেছিল? হলিউডের তাত্ত্বিকদের মধ্যে এই সংক্রান্ত তর্ক প্রাচীন। জে. ডগলাস গোমারি সবাক ছবিতে শব্দের অভ্যুত্থানকে দেখতে চেয়েছিলেন অর্থনীতির উপাদান হিসেবে, ব্রিটিশ তাত্ত্বিক এডওয়ার্ড বাসকম্ব সেই সন্দর্ভ খারিজ করে লিখলেন, মানুষের চাহিদা মেটাতে পুঁজিবাদের অবদান হিসেবে দেখা চলে না শব্দকে, বরং তা শিল্পের চাহিদামাফিক এসেছে, কারিগরি প্রযুক্তি যেখানে অনুঘটক মাত্র। কিন্তু শব্দই একমাত্র পরিবর্তনের সূচক ছিল না। শব্দের সঙ্গেই এসেছিল সংগীত। সুজান ল্যাঙ্গার বললেন, ‘মিউজিক’ আমাদের এই আবেগমথিত জীবনের ‘টোনাল অ্যানালগ’, সাংগীতিক রূপক। হলিউডের বাস্তবতার ধারণায় কীভাবে যেন তা হয়ে উঠল এক অন্য বাস্তবতার আহ্বায়ক, রিচার্ড ডায়ার যাকে ‘ইউটোপিয়া’ বললেন।
আমাদের দেশ যেমন আখ্যানের দেশ, কথনের দেশ, তেমন সুরেরও তো দেশ। কীর্তনের দেশ, ভজনের দেশ, বাউলের দেশ, পাঁচালির দেশ, কাওয়ালির দেশ। পরবর্তীতে পার্থ চট্টোপাধ্যায় বললেন, ‘হিন্দুস্তানী ফিল্ম মিউজিক’ কীভাবে হয়ে উঠল বিশ শতকের ভারতীয় সংগীতের অন্যতম পরিচিতি। আওয়াধি থেকে বুন্দেলখণ্ডী, ভোজপুরী থেকে উর্দু এসে জড়ো হল সেই সুরের আঙিনায়। তার নেপথ্যে আমাদের আবহমানকালের কবীর রয়েছেন, মীরা রয়েছেন। রাগসংগীত থেকে গজল, বাই-গান থেকে লোকায়ত মেঠো সুর সেখানে এসে পৌঁছেছে, মিশে গিয়েছে অবলীলায়। মারাঠি নাট্য সংগীত থেকে উস্তাদ ঝান্ডে খান বা উস্তাদ মুশতাক হুসেন খান বরেলিওয়ালা-রা– ভারতীয় চলচ্চিত্রের সংগীত এঁদের নিয়ে এল এক বৃহৎ আধারে; এত বড়, বৈচিত্রময় ও রহস্যাবৃত ভূখণ্ডের সুর এক হয়ে যাওয়া হয়তো সম্ভব নয়, কিন্তু তার সংশ্লেষ তো ঘটল।
চলচ্চিত্রে সংগীত তাই হয়ে উঠল আসমুদ্রহিমাচলের সবচেয়ে বড় যোগাযোগের সূত্র। আর তার মধ্য দিয়েই ঘটতে থাকল মানচিত্রর গোপন বুনন। সুনীল দত্ত-অশোককুমারের ছবি ‘আজ অউর কাল’-এর বিবিধ রোমান্টিক গান পেরিয়েও মহম্মদ রফি-র গলায় থেকে যাচ্ছে ‘তখত না হোগা তাজ না হোগা’-র মতো গান, যেখানে স্বাধীন ভারতের নির্বাচনী রাজনীতির সঙ্গে জড়িয়ে থাকা আশা-হতাশার দলিল ছিল। অজস্র দেশাত্মবোধক গান, ‘দূর হটো এ দুনিয়াওয়ালো’ থেকে ‘মেরা রং দে বাসন্তী চোলা’ যেমন ছিল, তেমনই সুনীল দত্ত অভিনীত ‘দিদি’-তে ‘হামনে সুনা থা এক হ্যায় ভারত’-এর মতো গানও তৈরি হল, যেখানে ক্লাসরুমে বসা খুদে পড়ুয়ারা নির্দ্বিধায় তাদের শিক্ষককে প্রশ্ন করল, এই নিরন্তর বিদ্বেষ, কুৎসিত বর্ণাশ্রম ও ধর্মের নামে খুনখারাপির মধ্যে ভারত নামে দেশটা এক কোথায় রইল? তাহলে কি যা পড়লাম নিজেদের দেশ নিয়ে, সবই ভুল? স্বাধীনতার পরেও কি দেশে নতুন সময় আসবে না? অনাহার যাবে না? গানের মধ্যে দিয়েই শিক্ষক তাদের উত্তর দিল, ব্রিটিশদের পোঁতা রক্তবীজের ফল এসব, তাদেরই ‘বখশিশ’, ক্ষমতাবানরা ‘জ্ঞান’ আর ‘ধন’-কে তাদের কুক্ষিগত রেখেছে। কিন্তু তোমরা তো বড় হবে, তোমরাই বদলে দেবে সব। সেই অন্য দেশের স্বপ্ন তখনও ছিল, এখনও কি নেই?
কিন্তু এত কিছুর পরেও যে গান হয়ে উঠল ‘বিবিধের মাঝে মিলন মহান’-এর আদত মন্ত্র, তা কিন্তু প্রেমের গান। রফি, লতা, মুকেশ, তালাত মাহমুদ, গীতা দত্ত থেকে কিশোরকুমার হয়ে যে গানের পরম্পরায় কোনও ছেদ পড়েনি দীর্ঘকাল যাবৎ। কিন্তু পার্থ চট্টোপাধ্যায় যাকে বলেছিলেন ‘মেলডি’-র শাসন, তা অবিচ্ছেদ্য হয়ে উঠেছিল জনজীবনের সঙ্গে। যে জন্য ষাটের শেষ-সত্তরের শুরুর সেইসব অস্থির বুধবার ‘বিনাকা গীতমালা’ শুনতে গোপন নকশাল পার্টি ক্লাস থেকেও পালাতে চাইত তরুণরা।
‘গাইড’ কেবল ছবি হিসেবে স্মরণীয় হত, যদি না তার মধ্যে থেকে যেত ‘পিয়া তো সে নয়না লাগে রে’-র চাবুকের আঘাতের মতো ছন্দ, ‘গাতা রহে মেরা দিল’-এর সোচ্চার, দিগন্ত-কাঁপানো নিবেদন, ‘আজ ফির জিনে কি তামান্না হ্যায়’-এর যাত্রাপথের আনন্দগান, বা ‘দিন ঢল যায়ে’-র বিষাদ? নবনীতা দেবসেন একবার বলেছিলেন, এই সব গান আমাদের মুখে মুখে ফিরেছে, তাকে আমরা গণসংগীত বলব না কেন? এমন বহু সুর পড়ে থেকে গিয়েছে বিকেলের বিষণ্ণ রোয়াকে, সিনেমাহল-ফেরত কাঁধে কাঁধ মেলানো সমস্বর কোরাসে, ছাদ থেকে ছাদে অব্যক্ত নীরবতায়, কত আনন্দ-বেদনায়, মিলন-বিরহ সংকটে। সুরই আদতে মিত্রা, দর্পণা, মিনার, প্রাচী-র অন্ধকারের সীমা ছাড়িয়ে সিনেমাহল-কে করে তুলেছিল, সততই জনতার। রাস্তায় রাস্তায়, ঘরে ঘরে সেই সিনেমাহল ছিল, সব্বার জন্য।
…পড়ুন জনতা সিনেমাহল-এর অন্যান্য পর্ব…
পর্ব ১৬। পুলিশের কাছেও ‘আইকনিক’ ছিল গব্বরের ডায়লগ
পর্ব ১৫। ‘শোলে’-র চোরডাকাতরা এল কোথা থেকে?
পর্ব ১৪। ‘শোলে’-তে কি ভারত আরও আদিম হয়ে উঠল না?
পর্ব ১৩। ‘জঞ্জির’ দেখে ছেলেটা ঠিক করেছিল, প্রতিশোধ নেবে
পর্ব ১২। ‘মেরে পাস মা হ্যায়?’-এর রহস্যটা কী?
পর্ব ১১। ইন্দ্রজাল কমিকস-এর গ্রামীণ নায়ক বাহাদুর পাল্পে এসে রংচঙে হল
পর্ব ১০। দু’টাকা পঁচিশের টিকিটে জমে হিরোইনের অজানা ফ্যানের স্মৃতি
পর্ব ৯। খান্না সিনেমায় নাকি পৌরাণিক সিনেমা চলছে
পর্ব ৮। পাড়াতুতো ট্র্যাজেডিতে মিলে গেলেন উত্তমকুমার আর রাজেশ খান্না
পর্ব ৭। পাড়ার রবিদা কেঁদেছিল ‘কাটি পতঙ্গ’ আর ‘দিওয়ার’ দেখে, সাক্ষী ছিল পাড়ার মেয়েরা
পর্ব ৬। যে কলকাতায় পুলিশ-পকেটমার মিলেমিশে গেছে, সেখানে দেব আনন্দ আর নতুন করে কী শিরশিরানি দেবেন?
পর্ব ৫। হিন্দি ছবির পাপ ও একটি অ্যাডাল্ট বাড়ির গল্প
পর্ব ৪। দেব আনন্দ, একটি বোমা ও অন্ধকারে হাত ধরতে চাওয়ারা
পর্ব ৩। অন্ধকারে ঢাকা পড়ল কান্না থেকে নিষিদ্ধ স্বপ্ন!
পর্ব ২। ‘জিনা ইঁয়াহা মরনা ইঁয়াহা’ উত্তর কলকাতার কবিতা হল না কেন?
পর্ব ১। সিনেমা হলে সন্ত্রাস ও জনগণমন-র দলিল