প্রচণ্ড গরমে কেউ অসুস্থ হয়ে পড়েছেন অথচ হাতের কাছে ডাক্তারের নম্বর ঠিক করে রাখতে শেখে না ছাত্ররা। মাঝরাতে বাড়ির পাখার সুইচ বিগড়েছে, ইলেকট্রিশিয়ান ডাকার সময় নেই, অথচ গরমে মাথা খারাপ, অন্য বিভাগের তো কোন ছাড়, বিজ্ঞান পড়ুয়া ছাত্রটি এর সমাধান করতে শিখছে না। বাড়ির দৈনন্দিন এমন টুকিটাকি সমস্যায় পরমুখাপেক্ষী না থেকে যাতে নিজেরাই কাজটা সেরে ফেলা যায় তার হাতে-কলমে প্রশিক্ষণের জন্য কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতক স্তরে কমন ভ্যালু অ্যাডেড কোর্স চালু হচ্ছে।
আমার দীর্ঘ শিক্ষক জীবনের সারসত্য এই: কমনসেন্স ইজ ভেরি আনকমন! এই ক’দিন আগেও একশোয় একশো পাওয়া ছাত্র পাঁচশো টাকার নোট নিয়ে বাজারে গেলে খুচরোর হিসেব বুঝত না। এখন অনলাইন বা ফোন পে হয়ে এঁরা বেঁচেছেন বলা যায়। আমাদের সময় স্কুলে নবম-দশমে মূলত ছাত্রীদের জন্য ‘হোম সায়েন্স’ বলে একটা বিষয় থাকত। আমার স্কুলে অপশন ছিল এমন– অঙ্ক, বায়োলজি, হোম সায়েন্স। ভালো ফল করা বা মেধাবীদের শেষোক্ত বিষয়টা নিয়ে ঠাট্টা ও অবজ্ঞার সুর ছিল। যেন ভবিষ্যতের হোম মেকারদের জন্যই এই হোম সায়েন্স! শ্রমের বিনিময় মূল্য না থাকায় যে কাজটাকে এখনও সমাজের চোখে হেলাফেলার ও খাটো করে দেখার প্রবণতা বজায় আছে। মজার বিষয়, যে মেধাবীরা এসব নিয়ে হাসি-ঠাট্টা করতেন, তাঁদের ৯৯ ভাগ মায়েরা ছিলেন এমনই গৃহবধূ। তথাকথিত ওই মেধাবী সন্তানরা ছিল তাঁদের নিরলস শ্রম, নিজেকে উপেক্ষা ও নজরদারির ফসল।
কলা বিভাগের প্রবণতা অনুযায়ী, হোম সায়েন্স ছিল আমার বিষয়। মাধ্যমিক স্তরে বহু কিছু বিস্মৃত হয়েছি, কিন্তু এই হোম সায়েন্সের বেশ কিছু জিনিস সারা জীবন কাজে লেগেছে। বেশিরভাগ মানুষের এক ধরনের কল্পনা ও সৌন্দর্যের বোধ আছে। বাড়ির সাধারণ পুজোয়, উৎসব অনুষ্ঠানে সে যখন নৈবেদ্য সাজায়, ফল কাটে, অপটু হাতে আলপনা দেয়, তখনও যথাসম্ভব শৈল্পিক বোধ বজায় রাখার চেষ্টা করে। নিম্নবিত্ত মানুষটিও ছড়িয়ে-ছিটিয়ে নয়, সামান্য উপকরণে মানুষটিও নিজের ঘর সাজায়।
জয় গোস্বামীর ‘নুন’ কবিতায় যে নিম্নবিত্তকে দেখি, রোজকার বাজারের ঠক নেই– কিন্তু ‘বাড়িতে ফেরার পথে কিনে আনি গোলাপ চারা’ এখানে নিম্নবিত্তের হাতে সামান্য টাকা এলে গোলাপচারা কেনাটি হল মানুষের সৌন্দর্যবোধের প্রতীক। গৃহ বা বাড়িই হল মানুষের নিরাপত্তা ও নিভৃতি সৌন্দর্যবোধের প্রাথমিক স্থান, যার ভিতর দৈনন্দিন জীবনচক্র চলে। এই চক্রটি একটি চালু মেশিনের মতো, যার নিয়মিত যথাযথ দেখভাল করতে হয়, তেল ঢালতে হয়। বাড়ির ফিউজ উড়ে গেলে ঠিক করতে হয়। হাউজ ট্যাক্স থেকে কোথাও কোথাও জলের ট্যাক্স দেওয়ার জন্য অনলাইনে অ্যাপ্লাই করতে হয়। হঠাৎ করে কলের মুখ উড়ে গেলে তাৎক্ষণিক বুদ্ধিতে জল বন্ধ করতে হয়। কোথাও কোথাও জলের ট্যাক্স দেওয়ার জন্য অনলাইনে অ্যাপ্লাই করতে হয়। আধার থেকে ব্যাঙ্কের নানাবিধ কাজে ফর্ম ফিলাপ করতে হয়। ইলেকট্রিক বিলের রিডিং ঠিক আছে কি না, দেখা থেকে বাড়ি রেজিস্ট্রেশন মিউটেশন বিষয়ে জানতে হয়। গ্যাস জ্বালাতে শিখতে হয়। হাতে-পায়ে গরম জল পড়ে গেলে, গরমে ছ্যাঁকা খেলে, পোকার কামড়, কেটে রক্তপাত ইত্যাদির জন্য প্রাথমিক চিকিৎসা, ব্যান্ডেজ বাঁধা এগুলো জানতে হয়। বাড়ি সজ্জার জন্য পর্দা, বিছানার চাদর, বালিশের ঢাকনি থেকে পাপোশ দেখেশুনে বুঝে কিনতে হয়।
ওই হোম সায়েন্সে এগুলির বেশিরভাগ বিষয়ে অবহিত করা হত। ব্যাঙ্ক সংক্রান্ত কাজ, চেক লেখা থেকে প্রাথমিক চিকিৎসা সব শেখানো হত। ক্যান্সেলেড চেকের ছবি আমি প্রথম হোম সায়েন্স বইতেই দেখি। এছাড়া রোজকার রান্নাবান্না, যেটাকে একসময় মনে করা হত মেয়েদের একচেটিয়া কাজ, সেটির প্রাথমিক ধারণা তৈরি করে দিত এই হোম সায়েন্স।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
এই যে আমরা দিনের পর দিন বইয়ের শিক্ষাকে ওই পুঁথি পড়ার মধ্যেই রেখে দিলাম, কোচিং সেন্টারে গেলাম, দুরন্ত রেজাল্ট করলাম, মোটা মাইনের চাকরি আর রোজকার ঘর সংসারের জীবন চালানোর ছোট ছোট কাজগুলোকে অপাঙক্তেয় ও তুচ্ছ করে দিলাম, তাতে সুবিধা হল আরেক শ্রেণির মানুষের। একজন ইঞ্জিনিয়ার বা ডাক্তার ঘরে একটা বাল্ব লাগানোর জন্য মিস্ত্রি ডাকতে শুরু করলেন। স্নাতকোত্তরে প্রথম শ্রেণি পাওয়া একজন ছাত্র ব্যাঙ্কের বা আধার থেকে পোস্ট অফিসের ফর্ম ফিলাপের জন্য এইট পাস, দক্ষ মানুষটির সাহায্য নিতে শুরু করল। দেওয়ালে পেরেক ঠোকা থেকে ফ্যান পরিষ্কার– সবেতেই আমরা পরমুখাপেক্ষী হয়ে গেলাম।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
এ তো গেল আমার সময়। আমার সময়কার বড়দের দেখেছি বাড়ির খুঁটিনাটি কাজের জন্য মিস্তিরি ডাকার প্রয়োজন বোধ করেননি। যেটা পরবর্তীকালে ইউরোপ-আমেরিকায় যাঁরা গিয়েছেন, তাঁরা দেখেছেন একজন উচ্চশিক্ষিত অধ্যাপক, ডাক্তার, আইনজীবী, ব্যবসায়ী থেকে প্রথাগতভাবে কম ডিগ্রিওয়ালা মানুষ বাড়ির প্রাথমিক কাজগুলো নিপুণভাবে জানেন। আমাদেরও এককালে তেমন ছিল। ঘরে ঘরে সেলাই মেশিন থাকত। অধিকাংশ বাড়িতে ছোটদের জামাকাপড় থেকে পর্দা সেলাই নিজেরাই করে নেওয়া হত। ইলেকট্রিকের মেন সুইচ কোথায় আছে, ফিউজের তার কোনটা, বোতাম খুলে গেলে বা জামা ঈষৎ ছিঁড়ে গেলে রিফু বিষয়ে কেমন সমাধান– আমার মাকে দ্বিতীয়বার প্রশ্ন করতে হত না।
পরবর্তীকালে এই যে আমরা দিনের পর দিন বইয়ের শিক্ষাকে ওই পুঁথি পড়ার মধ্যেই রেখে দিলাম, কোচিং সেন্টারে গেলাম, দুরন্ত রেজাল্ট করলাম, মোটা মাইনের চাকরি আর রোজকার ঘর সংসারের জীবন চালানোর ছোট ছোট কাজগুলোকে অপাঙক্তেয় ও তুচ্ছ করে দিলাম, তাতে সুবিধা হল আরেক শ্রেণির মানুষের। একজন ইঞ্জিনিয়ার বা ডাক্তার ঘরে একটা বাল্ব লাগানোর জন্য মিস্ত্রি ডাকতে শুরু করলেন। স্নাতকোত্তরে প্রথম শ্রেণি পাওয়া একজন ছাত্র ব্যাঙ্কের বা আধার থেকে পোস্ট অফিসের ফর্ম ফিলাপের জন্য এইট পাস, দক্ষ মানুষটির সাহায্য নিতে শুরু করল। দেওয়ালে পেরেক ঠোকা থেকে ফ্যান পরিষ্কার– সবেতেই আমরা পরমুখাপেক্ষী হয়ে গেলাম। হৃদযন্ত্র চালু রাখার জন্য ডাক্তাররা প্রাথমিক কিছু কৌশলের কথা বলেন। সাপে কামড়ালে কীভাবে রোগী আনতে হয়, তাও আমরা ইন্টারনেটের দৌলতে হরদম দেখি কিন্তু শিখি না।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
আরও পড়ুন সেবন্তী ঘোষ-এর লেখা: অর্থ ও মেধার মিলমিশ না হলে এ যুগে উচ্চশিক্ষা সম্ভব?
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
এই যে প্রাথমিক জ্ঞান ও ধারণা বিষয়ে এক দীর্ঘ গৌরচন্দ্রিকা, তার কারণ হল, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতক স্তরে কম্পালসারি পড়ুয়াদের জন্য কমন ভ্যালু অ্যাডেড কোর্স (সি-ভ্যাক) চালু করা নিয়ে কথাবার্তা। এই কোর্স নিয়ে যথারীতি বিতর্ক ও তারিফ দুটোই কুড়োচ্ছেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়। প্রচণ্ড গরমে কেউ অসুস্থ হয়ে পড়েছেন অথচ হাতের কাছে ডাক্তারের নম্বর ঠিক করে রাখতে শেখে না ছাত্ররা। মাঝরাতে বাড়ির পাখার সুইচ বিগড়েছে, ইলেকট্রিশিয়ান ডাকার সময় নেই, অথচ গরমে মাথা খারাপ, অন্য বিভাগের তো কোন ছাড়, বিজ্ঞান পড়ুয়া ছাত্রটি এর সমাধান করতে শিখছে না। বাড়ির দৈনন্দিন এমন টুকিটাকি সমস্যায় পরমুখাপেক্ষী না থেকে যাতে নিজেরাই কাজটা সেরে ফেলা যায় তার হাতে-কলমে প্রশিক্ষণের জন্য এই কোর্স চালু হচ্ছে। ‘অকুপেশনাল হেলথ ডিসঅর্ডার’ এবং ‘ইম্পর্টান্স অফ এরগোনমিক্স’, ‘লাইফ স্টাইল ডিজিজ অ্যান্ড দেয়ার প্রিভেনশন’, ‘হ্যান্ডস অন মেশিন লার্নিং’, ‘ভ্যালু ওরিয়েন্টেড লাইফ স্কিল এডুকেশন’, ‘ডোমেস্টিক অ্যাপ্লিকেশন অফ ইলেকট্রনিক্স’-এর মতো বিষয়গুলি অপশনালও নয় অর্থাৎ এটা না পড়লেও হবে এমনটা নয়। স্নাতকে কলা বাণিজ্য বিজ্ঞান শাখার সব পড়ুয়াকেই পরিবেশের পাশাপাশি বাধ্যতামূলকভাবে অন্তত একটা বিষয় নিয়ে ৫০ প্লাস ৫০ নম্বরের কোর্স করতে হবে প্রথম ও দ্বিতীয় সেমিস্টারে। যথাযথভাবে চালু হলে এ তো অত্যন্ত সাধু পরিকল্পনা!
ঠিক জানি না এই শিরোনামগুলির ভিতর কোন কোন বিষয় ছুঁয়ে যাওয়া হয়েছে। দৈনন্দিন জীবনে যন্ত্র চালনার শিক্ষা যেমন জরুরি, তেমনি নান্দনিকতার বোধও প্রয়োজন। মানুষ শুয়োরের মতো কাদায় গড়াগড়ি দিয়ে সন্তুষ্ট থাকতে পারে না বলেই সে মানুষ। সঙ্গে যাকে বলি ‘সিভিক সেন্স’ সেটিও শিক্ষা দেওয়া দরকার। যে আমি সিঙ্গাপুর থাইল্যান্ড হংকংয়ের পরিচ্ছন্নতা দেখে মুগ্ধ সেই আমি দমদম বিমানবন্দরে নেমেই চকোলেটের প্যাকেট, কলার খোসা জানলা দিয়ে বাইরে ছুড়ে দিই। যে আমি দক্ষিণের কয়েকটি রাজ্যের রাস্তার ধারে দেওয়াল সজ্জা দেখে মুগ্ধ হই, সে নিজের শহরে দেওয়াল চিত্রের উপর কদর্য পোস্টার লাগিয়ে ফেলি। রাস্তায় থুতু না ফেলা, কর্পোরেশনের নিয়ম অনুযায়ী বাড়ির ময়লা আলাদা করে ফেলা, রাস্তার কলের জলের মুখ খুলে না রাখা, খোলা থাকলে উপযুক্ত জায়গায় খবর দেওয়া, রুগন নদীটিকে জবরদখল ও নর্দমায় পরিণত না করা, বৃক্ষ রোপণ মাত্র নয়, অন্তত বাড়ির সামনে একটি গাছকে নিজে যত্ন করা– ইত্যাদি নাগরিক সমাজের কর্তব্য বিষয় এই সিলেবাসে থাকা দরকার। সরকারের প্রতিটি কাজকে সন্দেহের চোখে না দেখে, দেখি না কেমন হয় এই নতুন কর্মোপযোগী, জীবনমুখী শিক্ষা। যথাযথ কাজ না হলে বিরোধিতার পথ তো খোলাই রইল।
……………………………………………..
ফলো করুন আমাদের ফেসবুক পেজ: রোববার ডিজিটাল
……………………………………………..