শিব আসলে ‘ভ্যাগাবন্ড’, ভবঘুরে। কৈলাস তার ভাড়াবাড়ি। আর তারকেশ্বর বা কেদারের ছবি ছাড়া সব ছবিতেই তিনি মানুষের মতো দেখতে। তারকেশ্বর আর কেদারের ছবিতে শুধু শিবলিঙ্গ। যদিও মহাভারতে বলা আছে, প্রতিমায় শিবঅর্চনার থেকে লিঙ্গে অর্চনা করলে নাকি অধিক ফল লাভ হয়। তাই মন্দিরের শিব লিঙ্গরূপী আর মানুষের ভিড়ের শিব ছবিতে আসীন। শিবের ছবিই আসলে গণদেবতার ছবি।
প্রচ্ছদ শিল্পী: অর্ঘ্য চৌধুরী
জয়দীপ মুখার্জী আমার কাছে আঁকতে আসত। আমি খুব একটা আঁকা শেখাতে চেষ্টা করিনি কোনও দিন। বিশেষ করে ছোটদের। বরং ওদের আঁকা-আঁকি দেখতাম। যদিও কিছু অভিভাবকরা সিনারি, উৎসব, তোমার প্রিয় খেলা বা একটি শীতের সকাল– এসব আঁকিয়ে দিতে অনুরোধ করতেন মাঝে মাঝে। আমি উল্টোপাল্টা কিছু একটা বলে এড়িয়ে যেতাম। জয়দীপ কোনও দিনই সময়মতো আঁকতে আসত না। দেরি করে আসত। একদিনই তাড়াতাড়ি এসেছিল। সেদিন আমি সময়মতো আঁকার ঘরে ঢুকে জয়দীপকে আমার টেবিলের নিচে আবিষ্কার করি। ওখানে সে কী করছে, জিজ্ঞাসা করায় বলেছিল– সে করমণ্ডল এক্সপ্রেস চালাচ্ছে! ট্রেনটা তাড়াতাড়ি হাওড়া পৌঁছে গেছে বলে, সে-ও তাড়াতাড়ি আঁকতে চলে এসেছে।
জয়দীপ রোজই নতুন নতুন ছবি খুব তাড়াতাড়ি এঁকে ফেলত। তারপর অন্য বাচ্চাদের গাল টিপে আদর করত। একদিন সে একটি অত্যাশ্চর্য ছবি এঁকেছিল! ‘রেখাচিত্র’ বললেই ঠিক হবে বলে মনে হয়। লম্বালম্বি সাদা খাতার পৃষ্ঠা দুটো। দাগ দিয়ে ওপর-নিচে তিনভাগে ভাগ করা। ওপরের ভাগে অনেকগুলো আইটেলিক্স-এ ইংরেজির ‘Z’। মাঝখানে একটি বাঁকা দাগের উপর গুণচিহ্ন দেওয়া অনেকগুলো আকার। নিচের ভাগে ঢেউ-এর মতো অসংখ্য দাগ। ছবিটা আঁকতে লেগেছিল খুব বেশি হলে মিনিট দশেক। আমি জানতে চেয়েছিলাম ছবিটার সম্বন্ধে।
জয়দীপের ব্যাখ্যা ছিল– ওপরের ভাগের ‘Z’ চিহ্নগুলো হল বিদ্যুৎ। মাঝখানে ঝড়ের মুখে বাঁকা বাঁকা নারকেল গাছ আর নিচে নদীর জলের ঢেউ। সব মিলিয়ে সেটা হল জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র। সেই চমকপ্রদ ছবি আঁকার জন্য জয়দীপের ওপর আমার একটু সমীহই হয়েছিল। তার বেশ কিছুদিন বাদে এক চৈত্রের দুপুরে জয়দীপ আবার অবাক করেছিল খাতা-ভরা অসংখ্য গুণচিহ্ন এবং তার মাঝে একটা করে ইংরেজির ‘Y’ এঁকে। ব্যাখ্যা দিয়েছিল যে, ছবিটা হল শিবনৃত্য। নিচে যদিও লিখে দিয়েছিল, ‘বাবা তারকনাথের চরণে সেবা লাগি’। ‘X’ আর ‘Y’ দিয়ে ওইরকম শিবের ছবি আঁকা যায়, তা জয়দীপের আবিষ্কার।
জয়দীপ আমার প্রিয় শিশুশিল্পী বা শিশু ভোলানাথ। ’৯০-এর শুরুর দিকে, যখন সরকারি আর্ট কলেজ প্রায় শেষ করে এনেছি, পার্ক স্ট্রিট আর বি বি চ্যাটার্জি রোড যখন প্রায় একই রকম পরিচিত, তখন দেখেছিলাম আর একটা চমকে দেওয়া ছবি। জওহরলাল নেহরু রোড আর পার্ক স্ট্রিটের সংযোগে, দক্ষিণ-পশ্চিম ফুটপাথে এক পথশিল্পীর আঁকা শিবের ছবি। রঙিন চকখড়িতে আঁকা নীল রঙের জটাধারী শিব। মাথার গঙ্গাটি রাস্তা বেয়ে একেবারে জেব্রা-ক্রসিং-এ ওপর উঠে পড়ার তালে ছিল। পার্ক স্ট্রিটের পূর্বনাম ছিল ‘বুরিয়াল গ্রাউন্ড স্ট্রিট’, শেষ প্রান্তের কবরখানার জন্যই এই নাম। চকখড়ির শিবের জটার গঙ্গা যেন মহাপ্রস্থানের পথ ধুয়ে দিচ্ছিল সেদিন।
ওই একই লোক বড়দিনের আগে এখানেই যিশু খ্রিস্ট আঁকত আর এককোনায় লিখে দিত ‘হেল্প মি’। কে কাকে ‘হেল্প’ করে, কে জানে! সেই থেকে আমার মাথায় ঢুকেছিল পথশিল্পীর সঙ্গে যোগ দিয়ে কলকাতার দুর্গাপুজোয় কাজ করার কথা। করেওছিলাম। ২০১৪ সালে আমেরিকান পথশিল্পী ট্রেসি লি স্টামের সঙ্গে একটা কাজ করেছিলাম দক্ষিণ কলকাতায়। অনুপ্রেরণায় সেই ফুটপাথের চকখড়ির শিব। ঠাকুর-দেবতাদের মধ্যে শিবের জনপ্রিয়তা সবচেয়ে বেশি। চার্লি চ্যাপলিন একমাত্র ওঁর সঙ্গে কম্পিটিশন দিতে পারে।
শার্লক হোমস থেকে ফেলুদা, বাঙালির কিশোর বয়সের এই দু’জন হিরোর সবচেয়ে যেটা ভালো লাগত তা হল– পর্যবেক্ষণ শক্তি। সমস্যার সমাধানের থেকেও ওই পর্যবেক্ষণের বর্ণনা অনেক বেশি আকর্ষক। আমারও মাঝে মাঝে ওইরকম করে দেখার ইচ্ছা জাগে। তখন দোকান-বাজার, বাস-ট্রেন, সর্বত্র দেখি নানা মানুষের চালচলন আর হাতে-ঘাড়ে করা ট্যাটু লেপ্টে থাকে। এখনও অবধি সবচেয়ে বেশি পেয়েছি ভোলেবাবা মার্কা উল্কি। সঙ্গে জয়দীপের মতো ‘X’, ‘Y’ দিয়ে ত্রিশূল এবং ডমরু। শিবের প্রতীকচিহ্ন দিয়ে বয়ে বেড়ানো মানুষেরা অধিকাংশই অতিসাধারণ। সবাই যে গাঁজা বা সুরাসক্ত, তাও নয়। সবার যে খুব হাঁকডাক তাও নয়, সবাই যে খুব ধোপদুরস্ত, তাও নয়। সবাই যে খুব গ্রাম্য, তাও নয়। সাধারণ, অতিসাধারণ সে-সব মানুষ। অলংকারহীন, আড়ম্বরহীন নেহাতই সাধারণ। যাঁদের সংখ্যায় ভোটবাক্স স্ফীত হয়, রাস্তা সারাইয়ের পিচ গলানো হয়, ঢালাই ছাদের লোহার রড বাঁধা হয়, সে ভিড়ের মাঝে শিবের ছবি, হাতে-ঘাড়ে-গলায় লেপ্টে থাকে। ওই কালো অক্ষরের উল্কিগুলোই তো আসলে শিবজ্ঞানে জীবের প্রসাধনী। ভিড়ের চরণের সেবা লাগে শিবের ছবি।
……………………………………………………………….
বীরভূমের একটা গ্রামের নাম ‘হাটসেরান্দি’। সেখানে ঘরে ঘরে পটে আঁকা দুর্গার ছবি পুজো করা হয় শরতে। ওই গ্রামেরই মানুষ বিশিষ্ট শিল্পোদ্যোগী পূর্ণেন্দু চ্যাটার্জী। ওঁর বাড়িতে এখনও পটের দুর্গার পুজো হয়। এখন পট আঁকেন রামকৃষ্ণ সূত্রধর। তাঁর পূর্বপুরুষরা মাণিক সূত্রধর, আদর গোপাল সূত্রধররাও পট আঁকতেন। তাঁদের আঁকা একটা পট দেখেছিলাম অনেকদিন আগে। দুর্গার চালিতে মেটে লাল রঙের আধশোওয়া শিব। আদর গোপাল সূত্রধর এক অদ্ভুত ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন। সেবার নাকি খরায় খুব অভাবের তাড়না ছিল। ফলে পট আঁকা, পুজো করাটাও ছিল বিলাসিতা। রঙের অভাবে শিবকে দিলেন শুইয়ে।
……………………………………………………………….
এই শ্রাবণ মাসে শিবের ছবিওয়ালা গেঞ্জির খুব বিক্রি। একমাত্র শিবের পোর্ট্রেটই পেরেছে ‘বিয়িং হিউম্যান’ লেখা গেঞ্জিকে কাৎ করে দিতে। তার সঙ্গে বাঘছাল ছাপ ছোট চাদর। ভিড়ের মাঝে এই ড্রেসকোড মানেই বৈদ্যনাথধামের পথিক। বাংলায় আগে ছিল সাদা হাফপ্যান্ট আর স্যান্ডো গেঞ্জি পরে শ্যাওড়াফুলি থেকে বাঁক-কাঁধে তারকেশ্বর যাওয়ার হিড়িক। সাদা প্যান্টে অবধারিত নতুন গামছার লাল ছোপ। ছবি ছাপার জনপ্রিয়তার সঙ্গে সঙ্গেই বাবার ছবি ছাপা হতে থাকল তারকেশ্বরের পথিকদের গেঞ্জিতে। শিবের ছবি ছাপা গণবস্ত্র, সঙ্গে ‘ব্যোম ভোলে’। অবশ্য ‘ব্যোম ভোলে’ মনে মনে উচ্চারণ করলেও কাশীর ঘাটে লালমোহনবাবুকে মনে পড়ে যায়। এক ডায়লগে কাশী। সেথায় শিবের ছবি ঘুরপাক খায় ঘাটের দেওয়ালে, লিনেনের জামায়, বেনারসী জর্দার দোকানের সাইনবোর্ডে। শিব পপুলার কালচারের চিহ্ন। ভিড়ের অভিমুখের প্রতীক। শিব ‘বেয়ারফুট রিয়েলিটি’, শ্রমের পদচিহ্ন।
বীরভূমের একটা গ্রামের নাম ‘হাটসেরান্দি’। সেখানে ঘরে ঘরে পটে আঁকা দুর্গার ছবি পুজো করা হয় শরতে। ওই গ্রামেরই মানুষ বিশিষ্ট শিল্পোদ্যোগী পূর্ণেন্দু চ্যাটার্জী। ওঁর বাড়িতে এখনও পটের দুর্গার পুজো হয়। এখন পট আঁকেন রামকৃষ্ণ সূত্রধর। তাঁর পূর্বপুরুষরা মাণিক সূত্রধর, আদর গোপাল সূত্রধররাও পট আঁকতেন। তাঁদের আঁকা একটা পট দেখেছিলাম অনেক দিন আগে। দুর্গার চালিতে মেটে লাল রঙের আধশোওয়া শিব। আদর গোপাল সূত্রধর এক অদ্ভুত ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন। সেবার নাকি খরায় খুব অভাবের তাড়না ছিল। ফলে পট আঁকা, পুজো করাটাও ছিল বিলাসিতা। রঙের অভাবে শিবকে দিলেন শুইয়ে। তাতে করে অনেকটা জায়গা ভরাট হয়ে গেল। রং লাগলও কম। শিব আর কত সামাল দেবেন। তানপুরা বাজানো বিরহী শিব থেকে হাটসেরান্দির শায়িত শিব একেকটা ছবি পুরাণ, সমাজ সবকিছুকেই জুড়ে নেয়।
‘গোত্রের প্রধান পিতা মুখবংশজাত।
পরমকুলীন স্বামী বন্দ্যবংশখ্যাত।।
পিতামহ দিলা মোরে অন্নপূর্ণা নাম।
অনেকের পতি তেঁই পতি মোর বাম।।
অতি বড় বৃদ্ধ পতি সিদ্ধিতে নিপুণ।
কোন গুণ নাহি তাঁর কপালে আগুন।।’
মাঝে মাঝে সংশয় হয় শিবের পদবি নিয়ে। তখন ভাবি, তার পদবি বন্দ্যোপাধ্যায় নয়তো? পরমকুলীন। পণ্ডিত নই আমি। কিন্তু ওই পরমকুলীন স্বামীর আহার-বিহারের ক্ষেত্র পড়ে মনে হয় বড়ই উদার ছিলেন তিনি। যাকে-তাকে বর দেওয়াই শুধু নয়, মর্তবাসীর কাছে তিনি চাষি থেকে ভিক্ষুক, সব চরিত্রেই পারদর্শিতা দেখিয়েছেন–
‘তুমি হয়ে চাষি কাশীবাসী, কেন কাশীশ্বর?
তোমার কর্মক্ষেত্র এই ব্রহ্মাণ্ড, ক্ষেত্র তব হর।’ (হরিমোহন)
শিব আসলে ‘ভ্যাগাবন্ড’, ভবঘুরে। কৈলাস তার ভাড়াবাড়ি। আর তারকেশ্বর বা কেদারের ছবি ছাড়া সব ছবিতেই তিনি মানুষের মতো দেখতে। তারকেশ্বর আর কেদারের ছবিতে শুধু শিবলিঙ্গ। যদিও মহাভারতে বলা আছে, প্রতিমায় শিবঅর্চনার থেকে লিঙ্গে অর্চনা করলে নাকি অধিক ফল লাভ হয়। তাই মন্দিরের শিব লিঙ্গরূপী আর মানুষের ভিড়ের শিব ছবিতে আসীন। শিবের ছবিই আসলে গণদেবতার ছবি।
……………………………………………
ফলো করুন আমাদের ফেসবুক পেজ: রোববার ডিজিটাল
……………………………………………