মেয়েদের পোশাকআশাক, আচার-আচরণ, কথাবার্তা, ভাবভঙ্গি সব কিছু নিয়েই একরকম নিয়মবিধি জারি করা আছে সমাজে। সে নিয়ম মেনে চললে তবেই ‘লক্ষ্মী’ মেয়ের তকমা মেলে, এ কথাও জানা। কিন্তু যাঁরা নিয়মকে খানিক নিজের শর্তে অদলবদল করে নেন, কথায়-বার্তায় পোশাকে-আশাকে পান থেকে চুন খসতে দেন ইচ্ছে করেই, তাঁদের নিয়েই বাধে গোল। কারণ সমাজের কাছে লক্ষ্মী আর ঊর্বশী, গৃহনারী আর বেশ্যা– এই দুই শ্রেণির মাঝামাঝি আর কোনও জায়গা নেই।
গাড়ির পিছনে স্টিকারে লেখা, বরং সাপকে বিশ্বাস করো, তবুও নারীকে নয়। সেখান থেকেই গল্পের শুরু। কলকাতা পুলিশ তাদের সোশাল মিডিয়া পেজে জানিয়েছে, এহেন বচনামৃত দেখেই গাড়িটিকে পাকড়াও করেন এক পুলিশকর্মী। চালককে বোঝানোর চেষ্টা করেন, এ কথায় তাঁর বাড়ির মহিলাদেরও কি অপমান করা হচ্ছে না? লম্বা কাউন্সেলিং-এর পর চালকও মেনে নেন, ওই স্টিকারটি সমস্যাজনক, মেয়েদের পক্ষে অপমানের। রাজি হয়ে যান স্টিকার সরিয়ে নিতেও।
পুলিশের কৃতিত্বজ্ঞাপক পোস্টে এখানেই গল্প শেষ। কিন্তু কেউ কি জানে, গল্প কোথায় শুরু হয় আর কোথায় শেষ হয়?
গাড়ির পিছনে নানারকমের বাহনলিপি তো ঘটমান বর্তমান। লং বা ক্লোজ শটে সেসব আকছার দেখা যায়। রোববার.ইন-এ প্রকাশিত ‘অটোবায়োগ্রাফি’ শীর্ষক এক নিবন্ধে গৌতমকুমার দে লিখেছিলেন, “অটোচালকের দৃষ্টিকোণ থেকে অটো হল ‘পিচকে রানী, রাস্তাকা মজা/ আধী ঘরওয়ালী জ্যায়সা খাস্তা গজা’!” কথা হচ্ছিল অটো নিয়ে, কিন্তু এই দ্বিতীয় লাইনটির মধ্যে স্ত্রীর বোনের সঙ্গে অবৈধ শরীরী সম্পর্কের ইঙ্গিত নিয়ে যে সুড়সুড়ি রয়ে গেল, তা চোখ এড়িয়ে যাওয়ার উপায় নেই। তবে সেই যৌন ফ্যান্টাসির জন্য কেবল অটোচালককে দায়ী করে লাভ আছে কি? শালি মানেই ‘আধি ঘরওয়ালি’, রঙ্গ-তামাশার ছলে এহেন অধিকার কায়েম করা তো গোটা সমাজেই কমবেশি প্রচলিত। বাহনলিপির মধ্য দিয়ে আড়াল সরিয়ে বেরিয়ে এসেছে সেই ভাবনাই, তা কোনও কল্পলোকের স্বয়ম্ভু সৃজন নয়। আর গল্পটার শুরুও আসলে এখানেই। সেই গল্পটা আরও স্পষ্ট হয় আবার ওই বাহনলিপির কথাতেই ফিরে গেলে। সেখানে হাজির “তরল রসিকতায় পূর্ণ কবিতা: ‘তোর জানলা খোলা/ বউকে ডেকে দে ভোলা’। সুন্দরীর উদ্দেশে লেখা: ‘খিলখিলি হাসি হাসে মেয়ে/ আঁচল খসিয়ে রূপ দেখিয়ে’।” অর্থাৎ বাহনলিপি জুড়ে হাজির মেয়েরা। তবে সে উপস্থিতি যে বিশেষ ইতিবাচক নয়, তা তো বলার অপেক্ষা থাকছে না। এখান থেকে দুটো স্পষ্ট বিষয় পাওয়া যাচ্ছে–
এক, পরস্ত্রী বা রক্তের-সম্পর্ক-হীন অন্য নারীর প্রতি লোলুপতা। সে নারীর দিক থেকে কোনও আগ্রহ বা সম্মতি আছে কি না, সে কথা অবশ্য উহ্য। তবে ডেকে দেওয়ার ভার বর্তাচ্ছে স্বামীর ওপরে, তাতে স্বামীর ‘পৌরুষ’ নিয়ে কটাক্ষ থাকতে পারে, তা সত্ত্বেও স্ত্রীর অন্য পুরুষের ডাকে সাড়া দেওয়ার ক্ষেত্রে তার অনুমতির সামান্য উপস্থিতিটুকুকে অস্বীকার করা যাচ্ছে না।
দুই, যে নারী স্বয়মাগতা, তার প্রতি নীতিপুলিশি কটাক্ষ। এই দ্বিতীয় বক্তব্যের সঙ্গেই লগ্ন হয়ে আছে আরও একটি বিষয়। পুরুষ, বা বলা ভালো পিতৃতন্ত্র যাকে স্বয়মাগতা ভাবছে, যার আচার-আচরণের সঙ্গে ‘পুরুষ-ধরা ছলাকলা’-র যোগ টেনে সন্তুষ্ট হচ্ছে, তার সে আচরণ যে নিছক স্বেচ্ছাতেও হতে পারে, হতে পারে নিজেকে ভালোবেসে কিংবা নিজেকে উদযাপন করতে চেয়েও, এ কথা পিতৃতন্ত্রের বোধের অগম্য।
………………………………………………………………….
পুরো বিষয়টাই আদতে গিয়ে ঠেকছে মেয়েদের নিজের এজেন্সি পাওয়া নিয়ে, যে দাবি পিতৃতন্ত্রের বিলকুল না-পসন্দ। নারীর প্রতি যে মনোভাবকে পিতৃতন্ত্র দিনে দিনে জারিয়ে দিয়েছে সমাজমনে, আসলে সেই অপছন্দই নিজেকে জাহির করছে সামগ্রিকভাবে নারীর প্রতি বিতৃষ্ণায়। এই যে নারীকে বিশ্বাস না করার চেতাবনি, এও কার্যত নারীর চরিত্রের দিকে আঙুল তোলাই। কিংবা সোশাল মিডিয়ায় যেকোনও প্রসঙ্গে নারীর প্রতি ঘৃণার বিস্ফোরণ, সেও একই পথের পথিক।
………………………………………………………………….
এ কথা তো বলার অপেক্ষা রাখে না যে, মেয়েদের পোশাকআশাক, আচার-আচরণ, কথাবার্তা, ভাবভঙ্গি সব কিছু নিয়েই একরকম নিয়মবিধি জারি করা আছে সমাজে। সে নিয়ম মেনে চললে তবেই ‘লক্ষ্মী’ মেয়ের তকমা মেলে, এ কথাও জানা। কিন্তু যাঁরা নিয়মকে খানিক নিজের শর্তে অদলবদল করে নেন, কথায়-বার্তায় পোশাকে-আশাকে পান থেকে চুন খসতে দেন ইচ্ছে করেই, তাঁদের নিয়েই বাধে গোল। কারণ সমাজের কাছে লক্ষ্মী আর ঊর্বশী, গৃহনারী আর বেশ্যা– এই দুই শ্রেণির মাঝামাঝি আর কোনও জায়গা নেই। দ্বিত্বহীন জীবনের শালীনতাকে সে চেনে না, অতএব কোনও শ্রেণিতে কাউকে আঁটাতে না পারলেই তার অস্বস্তি বাড়ে। তাই খানিক বিচ্যুতি দেখলেই সে ওই মেয়েদের ‘গণিকা’ বলেই গণ্য করে নিশ্চিন্ত হয়। আর সেখান থেকেই এই ধরনের বক্তব্য আসে যে, কেউ সম্পূর্ণ শরীর ঢাকছে না মানেই সে আসলে ‘ল্যাম্পপোস্টের তলায় দাঁড়ানো মেয়ে’দের মতো শরীর দেখিয়ে পুরুষদের আকৃষ্ট করতে চাইছে। ‘আঁচল খসে যাওয়া’ মানেই অপর কাউকে রূপ ‘দেখানো’, এই সমীকরণ যখন বাহনলিপি থেকে বুদ্ধিজীবীর বক্তব্য সর্বত্র বিরাজমান হয়ে ওঠে, তখন বোঝা যায় এই ভাবনা কেবল কোনও শ্রেণির গণ্ডিতে বাঁধা পড়েনি, তা একটা গোটা সমাজের অন্তরে অন্তরে বয়ে চলেছে। তাই আঁচল সরানোর কথা কেবল বাহনের দেওয়াল লিখনেই জেগে থাকে না। অটোর গায়ে, বাসের পিছনে, ট্রেনের কামরায়, শৌচাগারের দেওয়াল লিখনে নানাভাবে মেয়েদের আব্রু সরিয়ে দেওয়া হতে থাকে, তার অনুমতির তোয়াক্কা না করে। এই বিশেষ সংস্কৃতিচর্চার স্রষ্টা এবং ভোক্তা আমজনতার সমগ্র পরিসরটাই, আর রলাঁ বার্থ যেমন বলেছিলেন, ‘mass culture is a machine for showing desires.’।
……………………………………………………….
আরও পড়ুন রণিতা চট্টোপাধ্যায়-এর লেখা: নিরুদ্দেশ সম্পর্কে ঘোষণা
……………………………………………………….
যেখানে সেখানে স্ত্রী-অঙ্গ এঁকে রাখা, নারীর সঙ্গে যৌনতার সম্পর্ক টেনে স্ল্যাং ব্যবহার, এ সবকিছুর মধ্যে জনচাহিদাই জেগে উঠছে প্রবল আধিপত্যে। পাশাপাশি জেগে থাকছে আরেকটি দিক, যে মেয়ে পিতৃতন্ত্রের চাপানো আব্রুর বদলে নিজের শর্তে আব্রুর সংজ্ঞা নির্ধারণ করছে, তাদের ‘সবক’ শেখাতে চাওয়া। কিংবা যে মেয়ে পুরুষের লোলুপতার কাছে বশ্যতা স্বীকার না করে, নিজের শরীর ও যৌনতা ঘিরে টানছে স্বেচ্ছা নির্বাচনের গণ্ডি, সেই বেয়াড়াপনাকে ঘাড় ধরে সমঝে দেওয়া। ‘পপুলার কালচার’ প্রসঙ্গেই জন স্টোরি যে বৈশিষ্ট্যের দিকে নজর টেনেছিলেন, তথাকথিত ‘হাই কালচার’-এর অন্তর্ভুক্ত না-হওয়ার ক্ষোভে ‘অপর’ হয়ে থাকা শ্রেণির পাল্টা আঘাত হানার প্রবণতা, সেই বৈশিষ্ট্য এখানে দেখা দিচ্ছে আরেকভাবে। পিতৃতান্ত্রিক সমাজে নারীই তো ‘অপর’ বা ‘other’। সে যদি পুরুষের মতো যা ইচ্ছে তাই করার স্বপ্ন দেখে, তবে এই ক্ষমতাহীন অপর-ই একদিন ক্ষমতার প্রতিস্পর্ধী হয়ে উঠতে পারে– এই আশঙ্কাতেই মেয়েদের ইচ্ছের নটেগাছটি মুড়িয়ে দিতে পিতৃতন্ত্র সদা তৎপর।
অর্থাৎ পুরো বিষয়টাই আদতে গিয়ে ঠেকছে মেয়েদের নিজের এজেন্সি পাওয়া নিয়ে, যে দাবি পিতৃতন্ত্রের বিলকুল না-পসন্দ। নারীর প্রতি যে মনোভাবকে পিতৃতন্ত্র দিনে দিনে জারিয়ে দিয়েছে সমাজমনে, আসলে সেই অপছন্দই নিজেকে জাহির করছে সামগ্রিকভাবে নারীর প্রতি বিতৃষ্ণায়। এই যে নারীকে বিশ্বাস না করার চেতাবনি, এও কার্যত নারীর চরিত্রের দিকে আঙুল তোলাই। কিংবা সোশাল মিডিয়ায় যেকোনও প্রসঙ্গে নারীর প্রতি ঘৃণার বিস্ফোরণ, সেও একই পথের পথিক। কোনও মেয়ে নিজের বিয়েতে কন্যা সম্প্রদান না চাইলে কমেন্ট সেকশন জুড়ে ঘৃণার উদ্গিরণ, কোনও গৃহহিংসার বিবরণ কিংবা নারী অধিকার সংক্রান্ত আইনি বক্তব্যের নিচে জড়ো হওয়া পুরুষ অধিকারের দাবি, কোনও নারীর নাম ক্রাইমের সঙ্গে জুড়ে গেলে ধর্ষকামী উল্লাস– এই সবকিছুর মধ্যে থেকে অগ্ন্যুৎপাতের মতো ছিটকে বেরোয় নারীর প্রতি তীব্র, তিক্ত বিতৃষ্ণা। আদিম মানবের মতো এক গোষ্ঠীর অপর গোষ্ঠীকে সম্পূর্ণ দমিয়ে রাখতে চাওয়ার উদগ্র রিরংসা।
এই যাবতীয় ভাষ্যেই আসলে লেগে আছে কৌমের মানসিকতার দাগ। আর বিজ্ঞাপন যতই বলুক, সব দাগ আসলে ভালো হয় না।
………………………………………………………………
ফলো করুন আমাদের ফেসবুক পেজ: রোববার ডিজিটাল
………………………………………………………………