বিসবি– আরিজোনা রাজ্যে, আমেরিকা আর মেক্সিকোর বর্ডারের খুব কাছে একটি ছোট শহর। সেখানে একটি বেশ গরিব এলাকায় একটি সম্পূর্ণ পরিত্যক্ত স্কুলের দু’টি ঘরে একটি লাইব্রেরি শুরু করেন অ্যালিসন উইলিয়ামস নামের একজন লাইব্রেরি কো-অর্ডিনেটর। অ্যালিসন এই বছর, আমেরিকায় সর্বোচ্চ সম্মান– যা ন্যাশনাল লাইব্রেরি এবং মিউজিয়ামের জন্য দেওয়া হয়, সেটির অংশীদার হয়েছেন। ছয় বছর বয়স তাঁর এই ‘কপার কুইন লাইব্রেরি’র, তার মধ্যে কী এমন কর্মকাণ্ড হয়েছে যে, সেটি জাতীয় স্তরে এতখানি সাড়া ফেলে দিয়েছে?
২০২৪ সালের জুলাইয়ের একটি দুপুর। আমি এসেছি আমার কাছাকাছি টাউনের একটি লাইব্রেরিতে– কয়েকটি বই নিতে। বাইরের তাপমাত্রা, আর্দ্রতা– দুটোই ভালোভাবে গ্লোবাল ওয়ার্মিংয়ের কথা মনে করিয়ে দিচ্ছে। লাইব্রেরিতে ঢুকে রিসেপশন, সেখানে তিনজন ব্যস্ত কর্মী হাসিমুখে প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছেন, কাজ করছেন। মূল ফ্লোরের একদিকে বিরাট বাচ্চাদের সেকশন। লাইব্রেরির দরজা খুলে আমার সঙ্গেই ঢুকল দুটো পরিবার, তিন-চারটি বাচ্চা, ঢুকেই, বড়রা তাদের হাত ছেড়ে দিলেন নিশ্চিন্ত হয়ে। বাচ্চাদের পায়ের চালে, মুখেচোখে তাদের নিজেদের জায়গায় আসার নিশ্চিন্ত ভাব।
উঁকি মেরে দেখলাম, বিরাট সফ্ট-টয় গোরিলা, ভালুকের গায়ে হেলান দিয়ে, নরম কার্পেটে মাটিতে শুয়ে, ছোট ছোট চেয়ারে বসে বই দেখছে শিশুরা, কোথাও কোনও বড় কেউ বই পড়ে শোনাচ্ছেন। ছোট ছোট টেবিলে লাইন দিয়ে কম্পিউটার রাখা, সেখানে খেলছে বা কিছু দেখছে বাচ্চারা। বই হাতে দাঁড়িয়ে আছে লাইনে, বাড়ি নিয়ে যাবে বলে। এই প্রসঙ্গে একটা মজার কথা বলি, যখন বই নিচ্ছি, আমি হঠাৎ করেই লাইব্রেরি কর্মীকে জিজ্ঞাসা করলাম, একসঙ্গে কটা বই নিতে পারি? বেশ কিছু বছর আগে এই প্রশ্ন করলে, মনে আছে উত্তর আসত ২০ কি ৩০টা বই। ইনি হেসে বললেন, কোনও ঊর্ধ্বসীমা নেই, দু’-হাতের মধ্যে যতগুলো বই ধরে তত নিতে পারেন… কী মন ভালো করা উত্তর।
গ্রীষ্মের ছুটির দুপুরে লাইব্রেরিতে যেমন বাচ্চারা এসেছে, তেমনই বহু টেবিলে বসে প্রাপ্তবয়স্করাও। কেউ বই পড়ছেন, কোথাও বয়স্ক মানুষরা কাগজ পড়ছেন, ল্যাপটপ খুলে বা লাইব্রেরি কম্পিউটারে কাজ করছেন, প্রিন্ট আউট নিচ্ছেন। একটি ছোট গ্রুপ এসেছে বিশেষ ক্ষমতাসম্পন্ন ছেলেমেয়েদের নিয়ে, সেই গ্রুপের একটি মেয়ে মিউজিক স্টেশনে দাঁড়িয়ে কানে হেডফোন নিয়ে গান শুনছে। আপনমনে নাচছে, নিঃশব্দে। আর এক পাশে পরপর ছোট ছোট স্টাডিরুম, সেখানে পড়া, কাজ করা, পড়ানো সবই হয়।
এছাড়া ধরুন, টাউনের এলিমেন্টারি থেকে হাইস্কুল ঘোষণা করে দিল– পরের গ্রেড শুরু হওয়ার আগে গরমের ছুটিতে কি কি বই পড়তে হবে, প্রায় সঙ্গে সঙ্গে টাউন লাইব্রেরিতে জমা হতে থাকে সে-সব বই। যাতে ছুটি পড়লেই ছাত্রছাত্রীদের লাইব্রেরি থেকে বইগুলো পেতে কোনও অসুবিধা না হয়। ট্যাক্স থেকে শুরু করে যেকোনও মিউনিসিপ্যাল কাজকর্মের ফর্ম– শহরটির বিষয়ে যেকোনও অনুসন্ধান সবকিছুর হদিশ মেলে লাইব্রেরিতে।
বাচ্চাদের গল্প বলতে, গান শোনাতে আসেন লেখকরা, মিউজিশিয়ানরা। এমনকী, বড়দের জন্যও। ছোট কনফারেন্স, ওয়ার্কশপ, এসবের জন্য বিনামূল্যে পাওয়া যায় ঘর। কিন্তু এর থেকে প্রশ্ন আসে বিনামূল্যে এত সব চলে কীভাবে? অবশ্যই এই টাকা আসে করদাতাদের কাছ থেকে। সেই কারণে শহরে বসবাসকারী মানুষের অর্থনৈতিক অবস্থার সঙ্গে লাইব্রেরির একটা সমানুপাতিক সম্পর্ক আছে। যে লাইব্রেরির বর্ণনা আমি করছি, সেই শহরে শিক্ষিত, স্বচ্ছল, সচেতন মানুষের বসবাস বেশি।
……………………………………………………………
পাখি দেখতে আর চিনতে চান, এই কারণে ছোট-বড়রা ‘কপার কুইন লাইব্রেরি’ থেকে নিতে পারেন প্রয়োজনীয় সমস্ত উপকরণ দিয়ে সাজানো ব্যাগপ্যাক– যাতে আছে ছোট, বড় সাইজের বাইনোকুলার, সেই অঞ্চলের পাখিদের ছবি-সহ গাইডবুক, তার সঙ্গে আছে লগবুক। একজন মানুষ ব্যাগপ্যাকটি নিয়ে পাখি দেখতে গেলে যদি লগবুকে নোট করেন তিনি কি দেখলেন, তার পরের মানুষটি সেই লগ পড়বেন এবং তারসঙ্গে যোগ করবেন তাঁর অভিজ্ঞতা, এইভাবে তৈরি হবে তাঁদের কমিউনিটির একটা ইতিহাস, চারপাশের প্রকৃতির একটা ইতিহাস তৈরি হবে, আর সেটা সাধারণ মানুষের হাতে গড়া।
……………………………………………………………
কিন্তু যেখানে সংখ্যালঘু মানুষরা সংখ্যায় খুব বেশি? যেখানে তাদের ভাষা আলাদা, তারা অনেক সময়ই নিজেদের অধিকার সম্পর্কে সচেতন নয়, রোজকার জীবনের সংঘাতের বাইরে কোনও সময় পান না তারা, সেখানে একটা ভালো লাইব্রেরির কথা ভাববেন কীভাবে? সেই ভাবনা তো পরে আসে। একজন মানুষ কিন্তু ভেবেছেন। বিসবি– আরিজোনা রাজ্যে, আমেরিকা আর মেক্সিকোর বর্ডারের খুব কাছে একটি ছোট শহর। সেখানে একটি বেশ গরিব এলাকায় একটি সম্পূর্ণ পরিত্যক্ত স্কুলের দু’টি ঘরে একটি লাইব্রেরি শুরু করেন অ্যালিসন উইলিয়ামস নামের একজন লাইব্রেরি কো-অর্ডিনেটর। অ্যালিসন এই বছর, আমেরিকায় সর্বোচ্চ সম্মান– যা ন্যাশনাল লাইব্রেরি এবং মিউজিয়ামের জন্য দেওয়া হয়, সেটির অংশীদার হয়েছেন। ছয় বছর বয়স তাঁর এই ‘কপার কুইন লাইব্রেরি’র, তার মধ্যে কী এমন কর্মকাণ্ড হয়েছে যে, সেটি জাতীয় স্তরে এতখানি সাড়া ফেলে দিয়েছে?
যেমন ধরুন, অনেক লাইব্রেরি থেকে বইয়ের পাশাপাশি বেশ কিছু জিনিস ধার নেওয়া যায়। যেমন, আমাদের এই লাইব্রেরি থেকে হটস্পট, রাউটার এসব ধার নেওয়া যায়, কিন্তু এই ‘কপার কুইন লাইব্রেরি’-তে আপনি আপনার বাড়িতে বাগান করার যন্ত্রপাতি ধার নিতে পারেন, কারণ এখানে অনেকে নিজেদের বাগানে সবজি চাষ করেন। তারা ধার দেন ব্লাড প্রেসার মেশিন, যাতে মানুষ সচেতনভাবে নিজেদের স্বাস্থ্যের খেয়াল রাখেন। অবশ্যই রাউটার, হটস্পটও দেওয়া হয়, যাতে কমিউনিটির মানুষগুলো নিজেদের বাড়িতে ইন্টারনেট ব্যবহার করতে পারেন। অ্যালিসনের মতে, লাইব্রেরিতে এইরকম পরিষেবা চালু করলে আগে জানা দরকার যেখানে লাইব্রেরি, সেই কমিউনিটির মানুষের কী প্রয়োজন। যেমন, বিসবির ওই অঞ্চলে বহু মানুষ ইউকেলিলি যন্ত্রটি বাজাতে পারেন, তাই লাইব্রেরি থেকে ইউকেলিলি ধার দেওয়া হয়। বিসবি শহরের মিউনিসিপ্যালিটি থেকে বানানো হয়েছে অনেক পিকেল বল কোর্ট, যে খেলা পরিবারের সবাই একসঙ্গে খেলতে পারে। ‘কপার কুইন লাইব্রেরি’ থেকে পিকেল বল খেলার ব্যাট ধার পাওয়া যায়।
অ্যালিসন আরও বলেছেন যে, তাঁরা চান, পরিবারের সবাই একসঙ্গে বাড়ির বাইরে যান, খেলুন, প্রকৃতির বুকে ঘুরুন, নিজের এলাকার সৌন্দর্য উপভোগ করুন, বাচ্চারা প্রকৃতি চিনুক। ধরুন পাখি দেখতে আর চিনতে চান, এই কারণে ছোট-বড়রা ‘কপার কুইন লাইব্রেরি’ থেকে নিতে পারেন প্রয়োজনীয় সমস্ত উপকরণ দিয়ে সাজানো ব্যাগপ্যাক– যাতে আছে ছোট, বড় সাইজের বাইনোকুলার, সেই অঞ্চলের পাখিদের ছবি-সহ গাইডবুক, তার সঙ্গে আছে লগবুক। একজন মানুষ ব্যাগপ্যাকটি নিয়ে পাখি দেখতে গেলে যদি লগবুকে নোট করেন তিনি কি দেখলেন, তার পরের মানুষটি সেই লগ পড়বেন এবং তার সঙ্গে যোগ করবেন তাঁর অভিজ্ঞতা, এইভাবে তৈরি হবে তাঁদের কমিউনিটির একটা ইতিহাস, চারপাশের প্রকৃতির একটা ইতিহাস তৈরি হবে, আর সেটা সাধারণ মানুষের হাতে গড়া।
………………………………………………………………
আরও পড়ুন বিশ্বজিৎ রায়-এর লেখা: বাংলা ভাষা-সাহিত্যের জমিতে পা রেখে জানলাগুলো খুলে দেওয়াই রসিকজনের কাজ
………………………………………………………………
এছাড়া এই লাইব্রেরিতে আছে– প্রাথমিক শিশু স্বাক্ষরতা প্রোগ্রাম। কিন্ডারগার্টেনের আগে শিশুদের জন্য অবৈতনিক স্কুল সেখানে নেই, আর ওই অঞ্চলটিতে জনসংখ্যা বেশি, শিশুর সংখ্যা বেশি, সঙ্গে দারিদ্রও। এই স্কুলের বিল্ডিংটি গড়ে তুলতে স্বেচ্ছাশ্রম দিয়ে সাহায্য করেছে এই অঞ্চলের সাধারণ মানুষ অর্থাৎ এই বাচ্চাদের পরিবারের সদস্যরা। তাঁরা দিনের কিছুটা সময় নিশ্চিন্ত যে তাদের বাচ্চারা সঠিক শিক্ষায় শিক্ষিত হচ্ছে। লাইব্রেরিতে তৈরি করা হয়েছে আর্ট গ্যালারি, তাতে রাখা আছে ওই অঞ্চলের শিল্পীদের হাতে আঁকা ছবি, তাঁদের বানানো ভাস্কর্য। আর সেই আর্ট গ্যালারি হচ্ছে লাইব্রেরির লিভিংরুম, প্রাণকেন্দ্র। এই লিভিংরুম, গোটা লাইব্রেরির মধ্যে সবচেয়ে স্বতন্ত্র। এখানে কাউকে চুপ করে থাকতে হয় না, আস্তে কথাও বলতে হয় না। অর্থাৎ লাইব্রেরির যে সার্বজনীন নিয়ম, উচ্চস্বরে কথা বলা যায় না, সেই নিয়ম এখানে নেই।
যেকোনও ব্যস্ত দিনে এই লাইব্রেরির লিভিংরুমে গেলে তা গমগম করে সেখানকার মানুষের গল্পে, আলোচনায়, লাইব্রেরিয়ানদের সঙ্গে প্রশ্নোত্তরে, কথোপকথনে। এখানে সবাই স্বাগত, এটি কমিউনিটির মানুষদের সত্যিকারের নিজস্ব একটা জায়গা– যেখানে তারা পরস্পরকে চেনে, খোঁজখবর নেয়। এই লাইব্রেরি সেখানকার মানুষের সাহায্যেই যেন কমিউনিটি শব্দটার একটা নতুন পরিভাষা তৈরি করেছে। এবং তা করেছে তেমন কিছু অর্থব্যয় ছাড়াই। তাই এক বছরের মধ্যেই এই ‘কপার কুইন লাইব্রেরি’ আজ আমেরিকার সবচেয়ে ভালো লাইব্রেরির মধ্যে অন্যতম, তাতে আর আশ্চর্য কি?
…………………………………………………………………..
ফলো করুন আমাদের ফেসবুক পেজ: রোববার ডিজিটাল
…………………………………………………………………..